ধূসর রংধনু পর্ব ৩৯
মাহিরা ইসলাম
“মেয়ে আমি তোমায় ভালোবাসি ওই দূর পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা সমান,সমূদ্রের গভীরতা সমান,দিনের তীব্র আলোর সমান,রাতের অন্ধকারের নিস্তব্ধতা সমান,চাঁদের আলোর উজ্জ্বলতা সমান, আগ্নেয়গিরির লাভার সমান,ভূমিকম্পের কম্পনের সমান,টর্নেডোর ঢেউয়ের সমান,ঘূর্নিঝড়ের উত্তলতা সমান, ওই বিশাল আকাশের সমান,মাটির পরিমাণের সমান,এই গোটা পৃথিবী, গোটা বিশ্বভ্রম্ভান্ডের সমান আমি তোমায় ভালোবাসি মেয়ে।”
ইতি
আপনার ব্যক্তিগত সে
সকালের মিষ্টি রৌদ্দুরে ঘুম ভাঙ্গার পর তাসফি নিজের সবচেয়ে বিশেষ, দামি অনুভূতির সাক্ষী হলো।
এই তো সে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে এলো এলোমেলো বিছানা গোছাতে শুরু করতেই একখানা চিরকুট পেল। তাসফি কিছুটা অবাক হলো।এখানে চিরকুট এলো কেমন করে।
দুরুদুরু বুকে সে চিঠিখানা খুলে দেখলো।
এএ অনুভুতি যে মারাত্মক।
এএ চিরকুটের হাতের লেখা যে তার বড্ড চেনা।
ব্লক করা নম্বরখানা সে কাঁপা কাঁপা হাতে খুললো।
সঙ্গে সঙ্গে সে নিস্তব্ধ কে ফোন দিলো।
নিস্তব্ধ রেডি হচ্ছিলো। প্রথমবার প্রেয়সীর কল পেয়ে নিস্তব্ধ মুচকি হাঁসলো।
কিন্তু সে কলটা রিসিভ করলো না রহস্যময় ভঙ্গিতে হাঁসলো ।
তাসফি বারবার চেষ্টা করলো কিন্তু পেল না।নিস্তব্ধ কল ধরলো না।এবারে তো ফোনটা বন্ধ আসছে।
রেডি হয়ে নিস্তব্ধ নিচে নেমে এলো।ড্রাইনিংয়ে বসল।
খাওয়ার মাঝে নিলয় সাহেব প্রশ্ন করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” পরশু রাতে বাসায় ছিলে না। কোথায় ছিলে?”
নিস্তব্ধ নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দিলো,
-” ফার্মহাউসে।”
-” সেখানে কেন হঠাৎ। ”
-” ইচ্ছা হয়েছিল তাই। তোমার আর কোনো প্রশ্ন আছে?”
-” অবশ্যই আছে।কাল এতরাতে তুমি কই থেকে ফিরেছিলে? নেশা ভান করতে শুরু করো নি তো।”
-” নিস্তব্ধ ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকালো।”
নিলয় সাহেব মুখ কাচুমাচু করে বলল,
-” না ওই বলছিলাম আরকি। খেতেও পারো।ওগুলো ভালো নয় বাবা, খেতে নেই।”
আয়েশা ঠোঁট টিপে হেঁসে বলল,
-” বাবা এসব বাদ দিন। কোনো কাজ ছিল বোধহয় তাই বেরিয়ে ছিল। তা দেওয়রজি তাসফির সঙ্গে তোমার কথা নয় নাকি?”
নিস্তব্ধ মাথা নেড়ে না বোঝালো।
খাওয়া শেষ করে নিস্তব্ধ নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।নিস্তব্ধ চলে যেতেই সবাই একে অপরের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো ,
-” তার ছেলে মিথ্যা বলা পছন্দ করে না অথচ একটু আগে নিজে কি সুন্দর,চমৎকার মিথ্যা কথা গুলো বলে গেল। ”
নিলয় সাহেন ঠাট্টা করে বলল,
-” বুঝলে গিন্নি এই হচ্ছে তোমার বউ পাগল ছেলে।
তলে তলে টেম্পু চালায় অথচ ওপর দিয়ে বলে তৈল শেষ।যত দ্রুত সম্ভব ছেলে বউকে বাড়ি নিয়ে এসো।ছেলে তোমার পাগল হলো বলে।”
অনিমা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-” তার বউ লাগলে সে নিজে নিয়ে আসুক।দেখ তোমার ছেলে আর কি কি কান্ড ঘটায়।সবাই চুপ থাকবা।
মোক্ষম সময় তাকে জবাব দেওয়া হবে।”
বাসন্তী বলে উঠলো,
-” মা তুমি যাই বলো না কেন।ভাই কিন্তু বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ”
-” হ্যাঁ এখন শুধু তোমার ভাই তা সবার কাছে স্বীকার করলেই হয়।”
সবাই এক জোট হেঁসে নিলো।
ব্রেকফাস্টে তাসফিকে মন মরা হয়ে খেতে দেখে মেজো চাঁচি জিজ্ঞেস করলো,
-” কি হয়েছে। জামাই বাবাজীর সঙ্গে সব ঠিকঠাক তো? তুই তো কাল এসে বললি সব ঠিকঠাক। ”
তাসফি মাথা নাড়লো বলল,
-” কিছু না চাঁচি।আসো তোমায় একটু জরিয়ে ধরি।”
-” দেখ মেয়ের কান্ড। কি হয়েছে তাও বলবে না। উল্টো কথা ঘোরাতে বাপের মতো ওস্তাদ। ”
-” আহা আসো না”
তাসফি চেয়ারে বাসা অবস্থা মেজ চাঁচির কোমড় জরিয়ে ধরলো।
চাঁচি তাসফির মাথায় হাত বুলালো।
তাসফি মনে মনে বলল,
-” তোমায় আমি ভীষণ ভালোবাসি চাঁচি।মা মারা যাবার পরে তো তুমিই আমার মা হয়ে উঠেছো।এখন এই দুনিয়ায় আপন বলতে তো শুধু তুমিই।আর হঠাৎ এসে ধরা দিলো ডাক্তার সাহেব আর তার পরিবার।”
রেডি হয়ে তাসফি কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
কলেজে এসে তাসফি সবার প্রথমে দৌঁড়ে নিস্তব্ধ’র চেম্বারে এলো।কিন্তু সে তাকে সেখানে পেল না।
তার অনুমান ঠিক কিনা শিওর হওয়া দরকার।কিন্তু লোকটা যেন হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে গেল।আজব।
যা বলার সরাসরি না বলে লোকটা প্রতিবার হেয়ালী করে।
অপর বিল্ডিংয়ের থার্ড ফ্লোর থেকে নিস্তব্ধ তাসফির ভাবমূর্তি অবলোকন করে মুচকি হাঁসলো।
সে তো চায় তাই।তার বিবি তার জন্য উতলা হোক।অস্থির হোক।না হলে প্রেমটা জমবে কেমন করে।
ক্লাসে আসতেই তাসফিকে আশা, সর্নিধি আরাধ্য জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরলো কথার জালে।
আশা কটমট করে তাকিয়ে থেকে আশে পাশে অবলোকন করে গর্জে উঠে বলল,
-” এতবড় একটা কথা তুই আমাদের থেকে গোপন করে গেলি?কি করে পারলি বলতো। স্যারের মতো গম্ভীর মানুষ কিনা সবসময় তোর খোঁজ করে।তুই অসুস্থ হতে হাইপার হয়।তোকে যারা শাস্তি দিলো তাদের ওওও শাস্তি দিলো।আমাদের তো আগেই বোঝা উচিত ছিল।ইশশ।ইচ্ছে করছে তোকে এখন বুড়ি গঙ্গা নদীতে গিয়ে চুবাই।ইশশ! কি অপমানটাই না হলাম আমরা।আগে আমাদের বললে তোর কি এমন ক্ষতি হতো বল? আর বিয়ের খবর সবাই জানে না কেন? স্যার তোর এত কেয়ার করে অথচ সবাইকে বিয়ের কথা জানাতে সমস্যা কোথায়।”
তাসফি করুণ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
বিয়ের কথা কেন বলছে না সেটা তো সেও জানেনা।
লোকটার ভাবগতি বোঝা বড্ড মুশকিল। কখন কি করে কে জানে।
ওদের উদ্দেশ্যে ধীর স্বরে বলল,
-” সব বলবো তোদের একটু ধৈর্য ধর এখন তো ক্লাস
টাইম স্যার চলে আসবে।”
ওরা শান্ত হলো কিছুটা।
সর্নিধি চোখ ছোট ছোট করে বলল,
-” সত্যি সব বলবি তো।”
-” প্রমিস”
আরাধ্য বলল,
-” এই এবার বিশ্বাস হলো।তুই কোনটা সত্যি বলিস মিথ্যা বলিস আমরা তো ভেবেই কুল পাচ্ছি না।”
তাসফি অসহায় চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
প্রথম বেল শেষে সুজন নিস্তব্ধ’র কেবিনে এলো।
এসেই চেয়ারে গাঁ এলিয়ে দিলো।
সুজনকে দেখে নিস্তব্ধ ভ্রু কুঁচকালো।প্রশ্ন করলো,
-” কি ব্যাপার এত হতাশ কেন।”
সুজন কপাল ঘসে বলল,
-” ভালো লাগছে না।মা বিয়ের জন্য প্যারা দিচ্ছে উফফ। ”
নিস্তব্ধ সিরিয়াস হয়ে বসে বলল,
-” দেখ সুজন বিয়ে করা তোর এখন দরকার।আঙ্কেল আন্টির ওতো একটা শখ আহ্লাদ আছে তাইনা।তৃপ্তি কে কেন নিজের কথা বলছিস না?”
সুজন নিস্তব্ধ’র দিকে তাকালো।
দুর্বল হেঁসে বলল,
-” তৃপ্তির মতো মেয়েকে ভালোবাসা যায় নিস্তব্ধ। কিন্তু
জীবন সঙ্গী করা যায় না।”
নিস্তব্ধ অবাক হয়ে বলল,
-” মানে? তুই তো ওকে ভালোবাসিস।তবে?”
সুজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-” দেখ নিস্তব্ধ তুই বুদ্ধিমান ছেলে।তৃপ্তি যেই ক্যাটাগরি মেয়ে তাকে সংসারের মায়ায় বেঁধে রাখা সম্ভব নয়।আমি ওকে ভালোবাসি। ভালোবাসবো।তবে ওকে কাছে পেতে চাই না। যখন ওর বিষয়ে জানতাম না তখন থেকেই ওকে ভালোবাসি।আমার ভালেবাসা তো মিথ্যা নয়। কি করে ভুলবো সেই ভালোবাসা।ছুঁতে চাইতাম ওকে।কিন্তু যেদিন থেকে ওর বিষয়ে জানলাম।সেদিন থেকে ওকে ছোঁয়ার ইচ্ছে টা মরে গেছে। ওও ওর মতো বেঁচে থাক।নিজের মতো চলুক।আমি কখনো আড়ালে দেখবো।কখনো হয়তো সময়ের বিবর্তনে ভুলেও যাবো।
ওকে জীবন সঙ্গিনী হিসাবে আমি চাই না। চাইলে আরো অনেক আগেই মায়ের কাছে নিয়ে যেতাম ওকে।
আমি চাই আমার জীবন সঙ্গী আমার মতো করে থাকবে।আমাকে সে শ্রদ্ধা করবে, ভীষণ করে ভালোবাসবে, অভিমান করবে,রাগ দেখাবে। আমার বাবা- মা কে শ্রদ্ধা করবে।যার মস্তিষ্কে হাজারটা পুরুষের ছবি থাকবে না।
তৃপ্তির পক্ষে তার কোনোটাই করা সম্ভব নয়।ওও অহংকারী। অসুস্থ পরিবেশে বড় হয়েছে।সে কি করে আমার সুস্থ ফ্যামিলির সাথে মানিয়ে নেবে।
তৃপ্তি কে যেহেতু ভালোবাসি তাই ওকে ভুলতে পারি না শত চেষ্টা করেও।তবে আমি চাই এমন একজন আমার জীবনে আসুক যে আমার এই দুঃখ গুলোকে নিঃশেষ করে দিতে পারবে।বাকিটা জীবন আমায় ভালোবেসে আগলে রাখবে।”
নিস্তব্ধ মাথা নাড়লো,
-” বুঝলাম।তবে বিয়ে করছিস না কেন?”
সুজন মুহূর্তে কন্ঠ পরিবর্তন করে হতাশ কন্ঠে বলল,
-” মেয়েই তো পছন্দ হচ্ছে না ভাই।দুর, জীবনটাি বেদনার ভাই।”
নিস্তব্ধ সুজনের পিঠে ধরাম করে থাপ্পড় মেরে বলল,
-” সালা তুই আর সুধরাবী না।”
-” আমি সুধরালে কেমন করে হবে।তোর বাসর ঘর কে সাজাবে। ”
নিস্তব্ধ চোখ গরম করে চেয়ে বলল,
-” দ্বাড়া তুই।”
সুজন কে আর পায় কে।
সে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল।বলে গেল,
-” দেখ ভাই চিন্তা করিস না।তোর মেয়ের সাথে আমার ছেলের সেটিংটাও আমিই করে দিবুনে।বাইই দোস্ত।”
সুজনের ছেলেমানুষী কান্ডে নিস্তব্ধ রাগ করতে গিয়েও হেঁসে দিলো।
সময় তখন দ্বিপ্রহর।
রোদেরা গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি মারছে।
তাদের তপ্ততাও খানিকটা কমে এসেছে।
নিস্তব্ধ’র চেম্বার আগমন ঘটলো তাসফির।
নক না করেই সে ঠাস করে ঢুকে পড়লো।
আজ রোগী নেই।
নিস্তব্ধ ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
-” নক করে আসা উচিত ছিলো।”
তাসফি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
-” প্রয়োজন মনে করিনি।”
-” তাই?”
-” হ্যাঁ।”
নিস্তব্ধ চেয়ার ছেড়ে উঠে তাসফির কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো।
তাসফি তার সামনে সকালের পাওয়া চিরকুটটি মেলে ধরলো।বলল,
-” এটা চিনেন?”
নিস্তব্ধ ভাবার ভঙ্গিমা করে বলল,
-” কেন বলুন তো?”
-” এটা যে আপনার হাতের লেখা বুঝতে পারছেন”?
নিস্তব্ধ মাথা নাড়লে।
তাসফি রেগে গেল ” হেঁয়ালি করছেন কেন।”
-” আপনি জেনেও কেন প্রশ্ন করছেন?”
সকালে ফোন কেন ধরেন নি?
-” পানিশমেন্ট। ”
তাসফি অবাক হয়ে বলল,
-” আবার কিসের পানিশমেন্ট? ”
-” নিজে ভেবে দেখুন।”
-” মানেটা কি।আমি আপনাকে ব্লক করেছিলাম বলে আপনি এখন এমন করবেন। ”
-” উহু ভুল।এমন করবোনা। একবার করলাম।আপনি দীর্ঘদিন করেছেন।আমি একমুহূর্ত করে আপনাকে আমার অনুভূতিটুকু বোঝালাম। দ্যাটস ইট।”
তাসফি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো নিস্তব্ধ’র পানে।
নিস্তব্ধ আবারো ফিসফিস করে বলল,
“মিসেস ইয়াসার আপনি আমায় চিনেন নি।বলেছিলাম আমার প্রত্যেকটা পাওনা আমি সুদে আসলে ফিরিয়ে নেব। কাটাকাটি হলে আর ভালোবাসা জমলো কোথায় বলুন।”
বাকি কথাটুকু বলার সুযোগ পেল না নিস্তব্ধ।দিতে চাইলো না বোধহয় তাসফি।
মুহুর্তের মাঝে শার্টের কলার টেনে ধরলো। নিস্তব্ধ সামান্য ঝুঁকতেই তাসফি নিস্তব্ধ’র অধর আঁকড়ে নিজের কোমল ওষ্ঠের সহিত।
নিস্তব্ধ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুইহাত স্যালেনডারের মতো করে উঁচু করে।
তাসফি তাকে ছেড়ে দিয়ে ইষৎ চর বসালো নিস্তব্ধ’র দু গালে।বলল,
-” আপনি একনম্বরের একটা বদলোক ভেবেছিলাম আপনি সুধরে গেছেন কিন্তু না।কুকুরের লেজ কি আর সোজা হয়। অসহ্য! ”
নিস্তব্ধ করুন চোখে তাকিয়ে বলল,
-‘ আমি কি করলাম বউ?”
-” আপনি কি করলেন মানে? আপনি তো সব নষ্টের মূল।বারবার আমায় চিন্তায় রাখেন।সবকিছু গন্ডগোল করে দেন উফফ।আপনাকে কাঁচা চিনিয়ে খেয়ে ফেলবো আমি।”
তাসফি দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল।
নিস্তব্ধ এখনো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
ধূসর রংধনু পর্ব ৩৮
সে ঠাস করে চেয়ারে বসে পরলো।
বউ তার বেজায় ক্ষেপে গেছে।
আসলেই নিস্তব্ধ সব দোষ তোর।
কিন্তু বউকে না রাগালেও তো তোর ভালো ও লাগে না। কি করবি বল।
হাহহ। আসলেই এত সুখের মাঝে জীবনটাই বেদনার!