ধূসর রংধনু পর্ব ৪০
মাহিরা ইসলাম
সময়টা প্রায় দুপুর তিন টার পরমুহুর্ত।
সূর্য্যিমামা তপ্ত বদনে চেয়ে আছে সকল মানবজাতির উপরে।তবুও কলেজের পেছনের দিকটায় তার ঠিক উত্তপ্ততা ঠাহর হচ্ছে না গাছের ছায়ায়।তার উপর পেছনে নদীর শীতল হাওয়া পরিবেশ কে আরো শীতল করে তুলেছে।
সূর্যের উত্তপ্ততা কে ছাপিয়ে গিয়েছে।
তাসফি, আশা,সর্নিধি, আরাধ্য বসে আছে সেই গাছের ছায়ায়।ওরা তিনজন তাসফির মুখপানে চেয়ে আছে।তাদের চোখ চকচক করছে কিছু জানবার আশায়।
নিস্তব্ধ স্যারের বিষয়ে শুনতে তারা আগ্রহী।ভীষণ আগ্রহী।এমন একজন কর্কশ স্যারের সঙ্গে সে থাকছে কেমন, করে।কি করে কি হলো।এসবই তাদের ভাবনা।
তাসফিও মুখ কাচুমাচু করে কথা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
আশা তাড়া দিয়ে বলল,
-” কি ব্যাপার বলছিস না কেন।সারা দিন পার করে দিবি নাকি দুটো কথা বলতে।”
তাসফি মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,
-” আহাঃ বলছিতো।”
আরাধ্য বলল,
-” হ্যাঁ সেটা শুনতেই আপনারা বসে আছি।এবার বল মা।দোহাই তোর।”
তাসফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার আর নিস্তব্ধ হুট করে বিয়ে হওয়ার বিষয়টা খুলে বলল।
তবে মেডিকেলে পড়ার আঙ্গিকে তাসফি বিয়েতে রাজি হয়েছে, আর বর্তমান ডিভোর্সে বিষয়টা চেপে
গেল।
কারণ ঘরের কথা কখনো পর কে বলতে নেই। সে যতই তোমার আপন হোক না।কোনো একদিন তাতে তোমার বিপদ আসবে নিশ্চিত। তোমার যখন তার সঙ্গে মন কষাকষি হবে।দূর্বল যায়গায় আঘাত করে তারা তোমাকে ছোট করতে মোটেও ভুলবেনা।
সর্নিধি জিজ্ঞেস করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” এই এখন তোদের মাঝে সব ঠিকঠাক হুম?”
আরাধ্য ওদের কথা গিলছে চুপচাপ করে শান্ত ভঙ্গিতে নির্বোধ বাচ্চার ন্যায়।
এই পর্যায়ে তাসফি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশা আর সর্নিধি চোখ গরম করে আরাধ্য’র দিকে তাকালো।ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-” কিরে তুই এখনো এখানে কি করছিস।যা সর। ফট এখান থেকে। আমরা এখন পার্সোনাল কথা বলবো। যা বাসায় যা। মেয়েদের মাঝে ছেলেদের কাজ কি। যা।”
আরাধ্য হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো ওদের দিকে।
আশ্চর্য কন্ঠে সুধালো।
-” কি আজব আমি কি করলাম।”
-” কিছু করিস নি যা এখন সর।”
আরাধ্য কে ওরা এক প্রকার ঠেলেই পাঠালো।
আরাধ্য যাওয়ার সময় বিরবির করে বলল,
-” এই জন্যই বলে মেয়ে মানুষ মানেই ঝামেলা।
এদের মতি গতি বোঝা দায়।হুট করে কখন কি করে বলে বলা মুশকিল।”
আরাধ্য যেতেই আশা আর সর্নিধি আরো একটু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,
-” এই তোদের মাঝে সব ঠিকঠাক তো।”
তাসফিও নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
-” কি ঠিকঠাক হবে?”
-” কি ঠিকঠাক হবে মানে।স্যার এখন তোকে মেনে নিয়েছে?”
তাসফি মাথা নাড়লো।
আশা আবারো আরো ফিসফিস করে বলল,
-” স্যার তোকে……
তাসফি চোখ বড় বড় করে দুটোর মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
-” অসভ্য মেয়ে মানুষ।”
-” বলনা ভাই।স্যার যেমন।কেমনে কি।আমরা তো ভেবেই কুল পাচ্ছি না দোস্ত। ”
তাসফি চোখ রাঙালো।
-” তোরা বেশি কথা বলিস।”
আশা দুষ্টু হেঁসে বলল,
-“এই স্যার কখনো তাকে কি*স করেছে।”
তাসফি চোখ গরম করে তাকালো,
দুজন নিজেদের ব্যাগ কাধে নিতে নিতে আমতাআমতা করে বলল,
-” থাক, থাক সমস্যা নেই বলতে হবে না। ঠিক আছে। ঠিকআছে।আমরা বরং আজ আসি হ্যাঁ।টাটা দোস্ত। ”
আশা যাওয়ার আগে তাসফির কানে কানে ফিসফিস করে বলে গেল,
-” স্যারকে বেশি বেশি আদ*র করিস বাই।”
-” তবে রে।”
দুজনে দিলো দৌঁড়।
দুজনের কর্মকান্ডে তাসফিও হেঁসে দিলো
ঘড়ির কাটা চারটার ঘরে গিয়ে পা রেখে বোধহয়।সূর্যের তেজও খানিকটা কমে এসেছে।
ওরা যাওয়ার পর তাসফি দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলো নদীতে থলথল করা দীর্ঘ জ্বলরাশির দিকে।
বাতাসের তোপে তারা কেমন ঢেউয়ে কাঁপছে।
সেই ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কতশত ময়লা আবর্জনা,কচুরিপানা, গাছের পাতা।
এই অবেলায় বাবার কথা তার ভীষণ করে মনে পড়ছে।
নিঃসংঙ্গতার ভীরে আমাদের কখনো কখনো হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন কে মনে পড়ে।
অথবা যাদের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের আলাপচারিতা বন্ধ। কিন্তু একদিন তারা আমাদের ভীষণ আপন ছিল।
সময়ের বিবর্তনে সব বদলে গিয়েছে।
“কোথায় তুমি বাবা।
আমার জন্য দোয়া করো।
মাকে বলো আমার জন্য ভীষণ করে দোয়া করতে।
আমার ডাক্তার সাহেবের জন্য জন্য দোয়া করতে।
আমরা যেন ইহকাল, পরকাল দু জনমেই এক সঙ্গে থাকি।”
আশা একা একা হাঁটছে বাসার উদ্দেশ্যে।হঠাৎ করে তার অদ্ভুত ইচ্ছে জাগ্রত হলো মনে।উহা নিছকই ছেলেমানুষী। তবুও মন চাইছে কাজটা করে ফেলতে।
সঙ্গে সঙ্গে সে সুজন কে মেসেঞ্জারে নক দিলো।
-” স্যার আপনার বাসার এড্রেস টা একটু বলবেন প্লিজ।”
সুজন লাইনেই ছিল।ভ্রু কুঁচকে লিখলো,
-” হোয়াই? আমার বাসার এড্রেস দিয়ে তোমার কি প্রয়োজন?”
-” আমার প্রয়োজন নয় স্যার আসলে তাসফি জানতে চাইছিলো।ওর নাকি কিসের প্রযোজন।ওও আজ ফোন আনে নি। তাই আপনাকে বলতে পারছে না।প্লিজ বলুন না।”
আশা ডাহা মিথ্যা কথাটাই বলে বসলো।
সুজন ভাবলো সত্যিই হয়তো তাসফি চেয়েছে।
আসরের আজান পড়বে খানিকক্ষণ বাদেই।
সুজন দের দোতালা বাড়ির সামনে এসে আশা রিক্সা থেকে নামলো।
এই পর্যন্ত এসে সে এবারে দোটানায় পড়েছে ভেতরে যাবে কি যাবে না।
নাহ এখন ভেবে আর লাভ নেই এসেই যখন পরেছে সে আন্টিকে একবার দেখাই যাক।
আশার মনে এই ইচ্ছে পোষন হত না। সম্পূর্ণ দোষ সুজন স্যারের। ক্লাসে প্রায় সময় সে মায়ের গল্প করে।
তার মা রান্না -বান্নায় নাম্বার ওয়ান।কথা বলায় নাম্বার ওয়ান। সুজন নাকি তার থেকে এত সুন্দর সুন্দর গুন গুলো রপ্ত করেছে।
আশা আজ আর লোভ সামলাতে পারলো না।
তার চাঁচি বাসায় নেই, গিয়েছে বাপের বাড়ি।এই সুযোগে আশা একটু ঘোরাঘুরি করে রাখুক।
গেটে সটান দাঁড়িয়ে থাকা দারওয়ান প্রথমে তাকে ঢুকতে দিতে দারুণ ত্যাড়ামি করলো।পরবর্তী তে সুজন স্যারের কথা বলে ভয় দেখানো তে একটু রেহাই পাওয়া গেল।
আশা সামান্য কেঁশে গলা পরিষ্কার করে ভাব নিয়ে বলল,
-” আপনি কি জানেন সুজন স্যার আমায় পাঠিয়েছে।সে যদি জানে আপনি আমাকে ভেতরে ঢুলতে দেননি আপনার চাকরি নট হয়ে যেতে পারে।জানেন?”
দারওয়ান সুজনের কথা শুনে মুখ কাচুমাচু করে ফেলল।চাকরি নটের কথা শুনে আরো ভয় পেল।
অমনি আশা কে সুরসুর করে ভেতরে ঢুকতে দিয়ে দিলো।
আশা জিজ্ঞেস করলো, আপনার মালিক উপরে তাকে না নিচে থাকে?
দারওয়ান হাতের ইশারায় নিচে দেখালো।
আশা উৎফুল্ল চিত্তে এগিয়ে গেল।কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেল চাপলো।
সুজনের বাবা তিতাস মিত্র ড্রয়িংরুমে বসে চা খাচ্ছিলো আর খবরের কাগজ পড়ছিলো।
ভদ্রলোক সারাদিনে একটু বসার ফুসরত পান নি পাবে কি করে ঘরে জোয়ান ছেলে থাকতে যদি নিজেকেই ব্যবসা সামলাতে হয় তবে হবে কেমন করে।
কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে গলা উচিয়ে ডাকলো,
-” সুজনের মা, দেখ তো কে এলো।সুজন এলো নাকি দেখ।”
-” আসছি।”
রাহেলা বেগম দ্রুত এসে দরজা খুলে দিলো।
তবে সেখানে সুজনের মুখের পরিবর্তে হাসিখুশি বদনে সাদা এপ্রোন পরিহিত অপরিচিত মেয়েকে দেখে কিছুটা অবাকই হলেন।
আশা হাসি মুখে বলল,
– আসসালামু আলাইকুম। আন্টি, আপনি কি ডাক্তার সুজন স্যারের মা।”
ভদ্রমহিলা সালাম নিয়ে কিছুটা অবাক স্বরেরই মাথা নাড়লো।
আশা সঙ্গে সঙ্গে তাকে জরিয়ে ধরলো।
-” আন্টি ভালো আছেন? ”
রাহেলা বেগম কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেল আশার
কর্মকান্ডে।
রাহেলা বেগম আশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” তুমি কে মা তোমায় তো চিনতে পারলাম না।”
আশা বলল,
-” আন্টি আমি সুজন স্যারের একজন কুখ্যাত ছাত্রী।”
ভদ্রমহিলা চোখ পিটপিট করে চাইলো।
আশা বলল,
-” বুঝলেন না তো? আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বলছি।কুখ্যাত কেন বলছি কারণ আমি সব সময় স্যারের ভুল ধরিয়ে দেই। তাই কুখ্যাত।স্যারের কথা তো শুনে চলি না।শুনে চললে তার ভদ্র ছাত্রী হতাম।বুঝেছেন? ”
রাহেলা বেগম কিছু না বুঝলেও মাথা নাড়লো। তার মাথা ঘুরছে।
সে মেকি হেঁসে বলল,
-” ওও আচ্ছা আচ্ছা। এসো মা ভেতরে এসো।”
আশা উৎফুল্ল চিত্তে ভেতরে ঢুকলো আশেপাশে তাকাতে তাকাতে।বাহ বাড়িটা তো খুব সুন্দর করে সাজানো।
তিতাস মিত্র স্ত্রী দিকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে চাইলো।
আশা নিজে থেকে বলল,
-” আঙ্কেল ভালো আছেন।আমি সুজন স্যারের একজন ছাত্রী। আসলে স্যার আমার থেকে একটি নোট নিয়েছিল।সেটা আমার এখন খুব দরকার তাই নিতে আসলাম। সঙ্গে মিষ্টি আন্টিকেও দেখতে এলাম।
স্যারের মুখে আন্টির প্রশংসা অনেক শুনি। আন্টিকে দেখার লোভটা আর সামলাতে পারলাম না।
আশা মনে মনে বলে আসলেই আন্টির চেহারা এখনও ভীষণ কিউট।দেখেই বোঝা যাচ্ছে ছেলে তার মায়ের জিনগুলোই বেশি পেয়েছে।হাহ!
রাহেলা বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” সুজন আমার প্রশংসা করে।”
আশা মাথা নাড়লো। ”
রাহেলা বেগম খুশি হয়ে আশা কে বসতে দিলো। বিভিন্ন নাস্তা পানি এনে ভরে ফেলল,
-” আশার মজার মজার কথা শুনে সুজনের বাবা, মা দুজনেই হাসতে লাগলেন। দুজনেই অনেক দিন পর এভাবে মন খুলে হাসলো।”
ভদ্রলোক হাসলেন।আশার ছেলেমানুষী সে বুঝতে পারছে।
স্ত্রী কে বললেন,
-” সুজনের মা যাও ওকে সুজনের রুমে নিয়ে যাও।নোট আনলে ওর রুমেই রাখবে। ”
রাহেলা বেগম বললেন,” ওও হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।আসলে সুজন দোতালায় থাকে তো।এখনও আসে নি ওও।এসো মা।”
রাহেলা বেগম আশা কে নিয়ে সুজনের রুমের সামনে এসে আবার ফিরে গেল।সুজনের বাবা হঠাৎ ডাকলো।
আশা কে বলল,
ধূসর রংধনু পর্ব ৩৯
-” তুমি যাও রুম খোলাই আছে।ওর সব কাগজ পত্র টেবিলেই তাকে দেখ।”
সুজন খানিকক্ষণ আগেই এসেছিল হসপিটাল থেকে।
ভেবেছিলো ফ্রেস হয়ে একদম নিচে যাবে।
মাত্রই গোসল শেষ করে হয়ে তোয়ালে জরিয়ে মৃদু স্বরে গান গাইতে গাইতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো সে।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সুজন ভ্রু কুঁচকে সেদিকে চাইলো।
আশাকে দেখে সুজন হতভম্ব হয়ে চাইলো।
আশা এই মুহুর্তে ভেতরে সুজনকে এই অবস্থায় একদমি আশা করেনি।চোখ বড় বড় করে চাইলো সে।
সুজন সঙ্গে সঙ্গে একপ্রকার চিৎকার করে তেড়ে এলো আশার দিকে।