ধূসর রংধনু পর্ব ৪৮

ধূসর রংধনু পর্ব ৪৮
মাহিরা ইসলাম

নিচে নেমে তাসফি ড্রয়িংরুমের সোফায় গম্ভীর মুখে বসে রইলো।
বাসন্তী এলো তখন পরিপাটি হয়ে।
মাহীনদের বাড়িতে যাবে সে।
তাসফিকে বসে থাকতে দেখে সুধালো,
-” ওও উঠেছিস।তা ঘুম কেমন হলো? ”
তাসফি উত্তর দিলো না বরং উল্টো প্রশ্ন করলো,

-” তোমার ভাই বাড়িতে নেই?”
-” কার কথা বলছিস? নিস্তব্ধ? সে বাড়িতে আছে কিনা সেটা তো আমার থেকে তোর ভালো জানার কথা রে।”
-” হেয়ালী করো না আপা বলো।”
-” নাহ নেই। আর শোন আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। মা বাড়িতে নেই।রুম্পা ড্রায়নিংয়ে তোর জন্য খাবার রেখেছে খেয়েছিস কেমন। আমি যাচ্ছি।”
বাসন্তী বেরিয়ে গেল।
তাসফি উদাস ভঙ্গিতে বসে রইলো।
তার মাঝে ব্রেকফাস্টের তাগিদ দেখা গেল না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কাল এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও আশা আজ কলজে এসেছে।আসতে তো হতোই।গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে যে। সর্নিধিও আসবে।
তবে মনে হয় না আরাধ্য বা তাসফি কেউই আসবে।
করিডর পেরোনোর সময় সুজন স্যার কে দেখে আশা উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো।
তা না করে উপায় আছে। তাকে দেখলেই তে স্যার খোঁচাতে থাকবে।
এইতো কাল হঠাৎ মেসেজ পাঠালো তাকে সুজন স্যার।
-” এত রাতে অনলাইনে কেন? কার সঙ্গে প্রেম করছিলে? ওওহ তোমার তো আবার বয়ফেন্ডের অভাব নেই বোধহয়। যে কেউ এসে প্রপ্রোজ করে আর এক্সেপ্ট করে তাদের সঙ্গে প্রেম জুড়ে দাও। ভালোই খেলোয়াড় তুমি।”
তার লেখায় ছিলোনা কোনো রসকষ। ছিলনা কোনো আন্তরিকতার ছোঁয়া ।সেই লেখায় ছিল শুধু আশাকে কটাক্ষ করে বলা কিছু বাক্য।

আশার তখন মন মানসিকতা ভালো নেই। ফুঁসে উঠতে গিয়েও সে চুপ করে গিয়েছিল।
উল্টো সহ্য করে নিয়ে কালকের ঘটনা জিজ্ঞেস করলো।সে জানে সুজন ছিল।
সুজন প্রথমে বলতে না চাইলেও আবার আনমনেই সবটা বলে ফেলল।
আশা ধন্যবাদ জানালো।
কিন্তু সুজন আবারো তাকে কটাক্ষ করে লিখলো।
-” ইট’স ওকে। ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। তুমি বরং তোমার বয়ফেন্ডদের ধন্যবাদ দিও কেমন।”
আশা এবার তেঁতে গেল।

-” আপনি কিন্তু এবার বেশি বলছেন। আমার কোনো বয়ফেন্ড নেই। শুধু শুধু ফালতু কথা বলবেন না।”
-” ফালতু কথা তোমার বলার স্বভাব আমার নয়। আর শিক্ষকের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানোনা। ”
-” শুনুন আপনাকে আমি আগেও বলেছি শিক্ষক আপনি কলেজে আমার বাড়িতে নয়।”
-” ওও আচ্ছা মনে মনে তো তোমার শয়তানিতে ভরা। এই জন্যই তো একজন পুরুষ মানুষের ঘরে অনুমতি ব্যতীত ঢুকে তার ইজ্জত লুটতে যাচ্ছিলে।
ভাগ্যিস পুরুষটা নিজেকে সামলে নিয়েছিল।নাহলে সে দুর্বল হলে তো তার মান ইজ্জত সব ধূলোয় মিশে যেত।”
আশা দাঁতে দাঁত চাপলো। বুঝলো এই খোঁটা তার আজীবন শুনতে হবে।
আশা রাঁগে কটমট করতে করতে লিখলো।

-” আপনি একটা ফালতু লোক। ”
সুজন রাগী ইমোজি দিলো
-” আপনার ইজ্জত লুট হলে আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হতো না। ফালতু লোক।”
সুজন চোখ বড় বড় করা ইমোজি পাঠালো।
সঙ্গে সঙ্গে ফোন আসলো।
আশা অফলাইন হয়ে গেল। হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
বড্ড সাহস দেখিয়ে ফেলেছে আজ সে।
এরপর সুজন স্যার তাঁকে আস্ত রাখবে কি না কে জানে।
আর কতদিন তাকপ এই খোঁটা শুনতে হবে কে জানে৷ কোন কুক্ষণে যে সে ওবাড়িতে গিয়েছিল।ছেহ।
রাত অনেক হওয়ায় আশা তাসফিকে তখন চেয়েও ফোন দিতে পারেনি।

-” দাঁড়াও।”
পেছন হতে পুরুষালী কন্ঠ শুনে আশা থমকে দাঁড়ালো। চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো।
ইশশ দেখে ফেলেছে তাকে, আজ আর রক্ষে নেই বোধহয়।
আশার ঘুরে দাঁড়াতে হলো না। সুজন দ্রুত কদম ফেলে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
করিডর পুরো ফাঁকা।
আশা দৌঁড় দেওয়ার সুযোগটাও পেল না।
সুজন চোয়াল শক্ত করে সুধালো,
-” কাল কি যেন বলেছিলে আমায় আবার বলো তো?”
আশা আমতাআমতা করতে লাগলো।
-” প্রশয় দিয়েছি বলে সাহস বেশি বেড়ে গিয়েছে তাইনা?”
আশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
সুজন আবারো দমক দিয়ে বলল,
-” কল করেছিলাম ধরো নি কেন? উত্তর দাও। রাবিশ।”
আশা ভয়ে কেঁপে উঠলো।
সত্যিই তার সাহসটা একটু বেশিই বেড়ে গিয়েছে।তার তো এতটা বাড় বাড়া একদমই উচিত হয়নি। সে নিজেকে সুধরে নিবে।

“আশা? ”
আচমকা সর্নিধির ডাক শুনে আশা যেন প্রাণ ফিরে পেল।
আশার পানে একবার চেয়ে সুজন হনহন করে সে স্থান ত্যাগ করলো।
সর্নিধি এগিয়ে এসে বলল,
-” কিরে কি করছিলি। ”
আশা বিথা হাঁসার চেষ্টা করে বলল,
-” ওই কালকের ঘটনা স্যারের থেকে শুনছিলাম।”
সর্নিধি আর ঘাটালো না।এমনিতেই কাল আরাধ্য’র ব্যাপারটা তারা কেউই এখনো হজম করে উঠতে পারেনি।ছেলেটা হঠাৎ এমন ভয়ংকর কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে তারা কল্পনায় ও ভাবতে পারেনি।

তাসফি সোফার সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিল।
হঠাৎ ইনায়া এসে বসলো তার সামনের সোফায়।
তাসফি মাথা তুলে চাইলো।
ইনায়া কটাক্ষ করে বলল,
-“এত কাহিনি করে আবারো ফিরে এলে বা’বা। দম আছে তোমার বলতেই হচ্ছে। ”
তাসফি মুচকি হেঁসে বলল,
-” কি করবো বলুন ভাবী। আপনার দেওয়র যে পরিমাণে চাপ দিচ্ছিলো। না এসে উপায় আছে বলুন?
না এলে সে আমায় গুম করে দিতেও দ্বিধা করতো না বুঝলেন। নিজের ভালো কে না চায় বলুন।এই যে দেখুন না কাল আপনি কেমন শ্বাশুড়ি মার ধমক খেয়ে সুড়সুড় করে বাপের বাড়ি ছেড়ে এলেন।নিজের ভালো চেয়েই তো। কে চায় বলুনতো অযথাই ঝামেলায় জড়াতে। আমি তো আর আপনি নই তাই না।”
ইনায়া চোয়াল শক্ত করে নিলো।

এসেছিলো মেয়েটাকে একটু টাইট দিতে। কিন্তু এই মেয়ের মুখ দিয়ে তো কথা ফুলঝুরি নয় বোমা ফাটে।সে তো ভুলেই গিয়েছিল।অসহ্য। ইনায়া উঠে চলে গেল।
তার যাওয়ার পানে চেয়ে তাসফি মুচকি হাঁসলো।
কটাক্ষ করে পিছু ডেকে বলল,
-” আরে ভাবী যাচ্ছেন কেন একটু বসুন না। একটু গল্প গুজব করি।”
ইনায়া একবার তাসফির পানে চোখ গরম করে চেয়ে উপরে উঠে গেল।
-” অসভ্য মেয়ে।”
তাসফি তাতে শব্দ করেই হেঁসে দিলো।
কি অদ্ভুত তার কালকের বিষয়টা নিয়ে মন খারাপ করা উচিত।কিন্তু তার মাঝে কোনোটাই অনুভব হচ্ছে না।বরং সে নিস্তব্ধ আর তার কলেজ ছাড়ার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত।
মন খারাপ হবেই বা কেমন করে তার ডাক্তার সাহেব তো তার সুযোগটাই রাখেনি।

মাহীনদের বাসার সামনে আসতেই বাসন্তী রিক্সা থামাতে বলল।
ভাড়া মিটিয়ে সে নেমে পড়লো।
বাসন্তীর মনের মাঝে হঠাৎ কেমন যেন অদৃশ্য ভয় বাঁসা বেঁধেছে। চিন্তায় কপালে চামড়ায় দীর্ঘ ভাঁজ পরেছে।
তার ভয়ের কারণটাও অহেতুক নয়।
বাসন্তীর পরিবারের ব্যাপারে মাহীনের মা বোন কেউ কিছু জানেনা। আবেদা বেগম কিছু জিজ্ঞেস করলেও বাসন্তী যথা সম্ভব এরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
নাটকটা আর কতদিন চালাতে হবে বাসন্তীর?
মাহীনকে আজই বলে দিতে হবে যা বলার।
সে শুধু শুধু অহেতুক ঝামেলা করতে চায় না।
দোতালায় উঠে কলিংবেল বাঁজাতেই পারুল এসে দরজা খুলে দিলো।
বাসন্তীকে দেখেই তার চোখ চকচক করে উঠলো।
পারুল চেঁচিয়ে বলল,

-” মা দেখ ভাবী এসে পরেছে ইয়াহু।ভাইয়া তোমার হবু বউ এসে পরেছে।দেখ।”
মাহীন সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বাইরে বের হয়ে এলো।
বাসন্তীকে দেখে মাথা চুলকালো।সে ভেবেছিলে এতটা দেরি হলো বাসন্তী বোধহয় আজ আর আসবে না।তার পরনে লুঙ্গি, টি-শার্ট। সঙ্গে সঙ্গে আবারো সে রুমে ভিতরে ঢুকে গেল।
বাসন্তীর ভীষণ লজ্জা লাগছে।
সে প্রথমে আবেদা বেগমের কাছে যেতে চাইলো।
আবেদা বেগম তখন কিচেনে ছিলেন।
ভদ্রমহিলা এখন অনেকটাই সুস্থ।
তিনি চাইছিলেন এই সুযোগে বাসন্তীর বাবা- মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিয়েটা পাঁকা করে ফেলতে।
আবার কখন অসুস্থ হয়ে পরেন বলা তো যায় না।
বাসন্তী তার কাছে গিয়ে কুশল বিনিময় করলেন।
আবেদা বেগম হাতের কাজ শেষ করে তাকে নিয়ে সোফায় বসালো।
পারুল সরবত এনে রাখলো টেবিলে।
তিনি বললেন,

-” দেখ মা বয়স তো অনেক হলো।আর কতকাল একা থাকবো বলো।তুমি চলে এলেই আমি শান্তি পাই।একটু হাল ছেড়ে বাঁচি। মেয়েটাকে ও আমার আবার পরের ঘরে পাঠানোর সময় চলে এলো বলে।আমি বুড়ো মানুষ মানুষ একা আর কতদিক সামলাবো। আমি চাইছিলাম তোমার বাবা মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলতে আরকি।”
নিজের বিয়ের কথা শুনতেই পারুল রেগে বলল,
-” মা আগে ভাইয়ার বিয়ে হোক তার পর আমারটা নিয়ে ভাববে। আমাকে তাড়াতে এত পায়তারা কেন তোমার।”
ভদ্রমহিলা মেয়ের দিকে চোখ গরম করে চাইলেন।
আবেদা বেগমের কথায় বাসন্তী’র ইতস্তত লাগছে খুব।সে এখন কি বলবে।
আবেদা বেগম বোধহয় তার মনোভাব বুঝতে পারলো।
হাতের ইশারা করে বলল,

-” তুমি বরং ছেলেটার সঙ্গে আগে একটু কথা বলে নাও কেমন।যাও ওও ঘরেই আছে।”
বাসন্তী লজ্জা সংকোচ নিয়ে মাহীনের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
একটা ছেলের রুমে যাওয়া তার জন্য ভারী দৃষ্টিকটু।যতই হোক।
সময়টা তখন বিকেলের দিকে।
সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়তে শুরু করেছে।
বাসন্তী বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু মার্কেটে গিয়েছিল।
তাতেই এতটা বেলা গড়িয়ে গিয়েছে।
মাহীন তখন ওয়াশরুমে বুঝতে পেরে বাসন্তী বেলকনির দিকে পা বাড়ালো।
উদাসীন ভঙ্গিতে আনমনেই সে বাইরে তাকিয়ে রইলো।
-” ওও আপনি এখানে?”
মাহীনের কন্ঠ পেয়ে সে পিছু ঘুরে চাইলো।
মাহীনের পরনে এবারে টি-শার্ট, টাওজার।
মাহীন এগিয়ে এলো।
বাসন্তী জিজ্ঞেস করলো,

-” তুমি কি যেন বলবে বলে ডেকেছিলে?দেখ সন্ধ্যা হয়ে আসছে।তোমার কথা বলা শেষে দ্রুত বাড়ি ফিরতে চাই।”
-” আর তোমার মা কি বলছিলো।দেখ আমার মনে হয় এবারে তোমার আন্টিকে সত্যিটা জানিয়েই দেওয়া উচিত। শুধু শুধু তে তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে লাভ নেই বলো।
সত্যিটা তো সে একসময় জানবেই তখন সে কষ্ট পাবে তোমার আচরণে।”
মাহীন তার নিকট আরো খানিকটা এগিয়ে এলো।সূর্য ইতোমধ্যে অস্ত গিয়েছে।
চারপাশে অন্ধকার ও গ্রাস করে নেবে খানিকক্ষণের মাঝেই।

-” কোন সত্যির কথা বলছেন আপনি বাসন্তী। ”
মাহীনের এতটা কাছে আসায় সে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে সুধালো,
-” এই যে তুমি আমাকে পছন্দ করো এগুলো সব নাটক।”
মাহীন বাসন্তী চোখে চোখ রাখলো।
তার চোখের গভীরতা বিশাল।
বাসন্তী তাতে ঠাই হারালো।
মাহীন ফিসফিস করে বলল,
-” পছন্দ নয় বাসন্তী ভালোবাসা। আপনাকে আমি ভালোবাসি।”
বাসন্তীর বুক কেঁপে উঠলো। যার আভাস সে পেয়েছিলো মাহীন তাই স্বীকার করছে। অজানা আশঙ্কায় সে বড্ড ভয় পাচ্ছে।

-” দেখ মাহীন একদম হেয়ালি করো না। তোমার এসব কথা ভালো লাগছে না।আন্টিকে সত্যিটা জানিয়ে দাও এবারে। ”
মাহীন বাসন্তীর হাত চেপে ধরলো। কাতর স্বরে বলল,
-” দেখুন বাসন্তী আমি কোনো হেয়ালি করছি না।
আমি সত্যিই আপনাকে ভালেবাসি। আপনার বিয়ের আগে থেকে।
আমি মাকে যা বলেছি সব সত্য। আমি বিয়ে করতে চাই আপনাকে। আপনি কি রাজী হবেন না।”
বাসন্তী হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
-” দেখ মাহীন আবেগে ভেসো না। আমি একটা ডিভোর্সী মেয়ে তাকে তুমি বিয়ে করবে এই সমাজ কখনোই তা মেনে নেবে না। তুমিও পরে আফসোস করবে।তার চেয়েও বড় বিষয় আমি তোমার থেকে বয়সে বড় মাহীন। এটা কখনোই সম্ভব নয়।”
মাহীন অস্থির হয়ে উঠলো।

-” আমি এতসব জানি না বাসন্তী আমার আপনাকেই চাই। প্লিজ আমায় ফেরাবেন না।”
-” তা হয় না। তুমি আমার থেকে আরো সুন্দরী, স্মার্ট, শিক্ষিত মেয়ে ডিজার্ব করো মাহীন। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো।”
-” আমি চাইনা। আমি আপনাকেই চাই বাসন্তী কেন বুঝতে পারছেন না।”
মাহীন অনেক অনুনয়-বিনয় করলো।
এক পর্যায়ে সে বাসন্তীর মুখটা নিজ দু’হাতের আঁজলায় তুলে বোঝাতে চেষ্টা করলো।
-” প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করুন।এসব সমাজ আমার কাছে ম্যাটার করে না।আমার কাছে আপনিই মুল। ”
বাসন্তী মাহীনের হাত ছাড়িয়ে রুমের ভেতর চলে এলো।
কিছুটা উচ্চ কন্ঠে বলল,

-” আমি ডিভোর্সী।বয়সে তোমার চেয়ে বড়। তুমি মানলেও তোমার ফ্যামিলি মানবে তার গ্যারান্টি কি মাহীন।
তার চেয়ে বরং আমাদের আর না এগোনোটাই ভালো।”
বাসন্তী চোখ বন্ধ করতেই তার চোখ ফেটে বেরিয়ে এলো নোনাজলের ধারা।
আবেদা বেগম দরজার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো।
সে এসে ছিলো বাসন্তী কে ডাকতে।
আবেদা বেগম কে সামনে দেখে বাসন্তী আরো ঘাবড়ে গেল।
মাহীন ও মাকে এখন একদমি আসা করেনি।
আবেদা বেগম থমথমে কন্ঠে বলল,

-” এসব আমি কি শুনছি মাহীন।”
বাসন্তী এগিয়ে গিয়ে বলল,
-” আসলে আন্টি আমরা দুজনের কেউ কাউকে ভালোবাসি না। সবটাই নাটক ছিলো।
আমায় ক্ষমা করে দেবেন আন্টি।”
বাসন্তী আর এক মুহুর্ত ওও দাঁড়ালো না।ছুটে বেরিয়ে এলো।
মাহীন তার পিছু যেতে গেলে আবেদা বেগম ওকে থামিয়ে বলল,
-” দাঁড়াও। ওকে যেতে দাও।”
মাহীন অস্থির কন্ঠে বলল,
-” মা তুমি বুঝতে পারছো না।”
আবেদা বেগম হুংকার ছেড়ে বললেন,
-” আমার যা বোঝার আমি তা বুঝে নিয়েছি। আর একটা কথাও বলবে না তুমি। আর কিছু আমায় বোঝাতেও আসবেনা।”

আবেদা বেগম নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
ছেলে তার সঙ্গে এই প্রতারণা করতে পারলো।কষ্টে তার বুক ব্যাথা করছে।
ছেলে কে এই শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন তিনি।
এতটুকু বিশ্বাস নেই ছেলের তার উপর।
এই দুঃখে তিনি মূর্ছা যাচ্ছেন।
মাহীন মেঝেতে মাথা নিচু করে বসে রইলো।
সব ঠিক করতে গিয়ে আবার সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
বড্ড বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেললো না তো সে।
আর একটু সময় নেওয়ার প্রয়োজন ছিলো কি।
একদিকে মা অপর দিকে ভাই। পারুল কাকে শান্ত্বনা দিবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল।সবটা তার ছোট মস্তিষ্কের উপর দিয়ে গেল।
রিক্সায় চেপে সারাটা রাস্তা বাসন্তী নিঃশব্দে কান্না করতে করতে পার করলো।শত চেষ্টা করেও তার চোখের পানি আটকানো গেল না।

কেন এত কষ্ট হচ্ছে তার। পুনরায় একই কাজ কেন করতে যাচ্ছিলো সে।সে কষ্টে হৃদয় বড্ড পীড়া দিচ্ছে।
ওসমান ভিলায় পৌঁছে বাসন্তী কোনো রকমে চোখের পানি মুছে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে উপরে উঠে এলো।
কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন সে হতে চায় না আপাতত।
ইতোমধ্যে মাহীন অনেকবার ফোন করেছে তাকে।বাসন্তী একটাও রিসিভ করলো না।
ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিলো।
কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।
নিস্তব্ধ সারা দিনে আর একবারো বাড়িতে ফেরে নি।
তাসফি ফোন দিলেও রিসিভ করেনি।
মেসেজ পাঠিয়েছে” সন্ধ্যার পর বাসায় এসে সব খুলে বলবে।”
তাসফি মেসেজ পাঠিয়েছিলো তার বদলি হওয়ার ব্যাপারে তারও উত্তর দেয়নি লোকটা।
তাসফি টোম ফুলিয়ে বসে ছিল বেলকনি তে।
নিস্তব্ধ ব্যাটা আসুক আজ বাসায় একটা কথাও বলবে না সে। কিসের এত ব্যস্ততা।
তখনি সে বাসন্তীকে এলোমেলো ভাবে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেখলো।
তাসফি উঠে এলো দ্রুত।
তাসফি বুঝতে পারলো না আপার হঠাৎ কি হলো।

-” দরজা খুলো আপা।কথা আছে।শুনছো?”
থমথমে কন্ঠে ভেতর থেকে উত্তর আসলো,
-” রুমে যা তাসফি।কাল কথা বলবো।আমার মাথা ব্যাথা করছে একটু ঘুমানো দরকার।”
-” আমি ম্যাসাজ করে দেব।খোল প্লিজ।”
-” কি বলেছি শুনিস নি। রুমে যা। এখন উঠতে পারবো না।”
তাসফি মন খারাপ করে আবারো রুমে ফেরত এলো।
বেলকনির রেলিং ভর করে দাঁড়ালো।
এই প্রথম আপা এতটা রুড বিহ্যাভ করলো।
কি হলো হঠাৎ তার। সকালে তো ভালোভাবেই বের হলো।
তাসফি ভাবনায় এতটাই বিভোর যে কেউ তার পিছে এসে দাঁড়িয়েছে সেটাও বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো।
রমণী হঠাৎ নিজেকে কারো শক্ত পোক্ত বক্ষে আবিষ্কার করলো।
কেউ তাকে পেছন থেকে ঝাপটে জরিয়ে ধরেছে।
তাসফি ঠিক জানে এই হাতের বাঁধন তার ডাক্তার সাহেবের ছাড়া আর কারো নয়।
ভেবেছিলো লোকটার সঙ্গে কথা বলবে না। অথচ এখন কথা না বলেও উপায় নেই।
তাসফি হুশিয়ারী দিলো,

“কি করছেন ছাড়ুন একদম ছুবেন না আমায়।”
নিস্তব্ধ ফিসফিস করে বলল,
-” আজ সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম বউ।একটু রিল্যাক্স হতে দাও প্লিজ। তোমার মাইগ্রেশন সঙ্গে আমার অন্য হসপিটালে জয়েন্ট হওয়ার কাজে বুঝেছো। শুধু শুধু রাগ করছেন আপনি মিসেস নিস্তব্ধ ।”
খানিকক্ষণ যেতেই তাসফি চট করে সামনে ঘুরে বলল,
-“কেন করছেন এসব? আমি সবাইকে ছেড়ে নতুন কলেজে নতুন পরিবেশে কি করে মানিয়ে নেব বলুন?
সম্ভব নয়।প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন।”
নিস্তব্ধ রেগে গেল।

-” মানুষ চাইলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয় তাসফি।
তোমার স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার সেটাই শুধু চেষ্টা করবে।কোথায় স্বপ্ন পূরণ করছো সেটা ফ্যাক্ট নয়।যেখানে একবার আমার ব্যক্তিগত জীবনের দিকে কেউ আঙুল তুলেছে সেখানে মানিয়ে নেওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো কিছু মানিয়ে নেওয়া আমার ধাঁচে নেই।
যা করবো সোজাসুজি, খোলাখুলি। লুকোচুরি ব্যাপার স্যাপার আমার সাথে যায় না। সো আমার থেকে তা আশা করা টাও তোমার জন্য বোকামি।”
তাসফি করুণ চোখে চেয়ে রইলো।
নিস্তব্ধ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তাসফিকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।
তার কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল,

-” বোঝার চেষ্টা করো বউ।যা করছি আমাদের ভবিষ্যতের ভালোর জন্যই। আমাদের দুজনের জন্যই বেটার। খানিকের দুঃখ ভবিষ্যতে যদি সুখ দেয় তবে তাতে ক্ষতি কি বলো?”
তাসফি টোম ফুলিয়ে রাখলো।
এক পর্যায়ে কাঁদতে শুরু করলো।
নিস্তব্ধ শ্বাস ফেলে বলল,
-” এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন? আচ্ছা আচ্ছা তোমার যেন নতুন কলেজে গিয়ে একটুও খারাপ না লাগে তার ব্যবস্থা আমি করে দেব।। খুশি তো।”
তাসফি নাক টেনে সুধালো,

ধূসর রংধনু পর্ব ৪৭

-” সত্যি তো। কথার খেলাপ হলে ভালো হবে না।প্রমিস?”
-” আচ্ছা প্রমিস।”
তাসফি মুচকি হাঁসলো।
নিস্তব্ধ সযত্নে অর্ধাঙ্গিনীর ললাটে চুম্বন করলো।
তাসফি চোখ বন্ধ করে নিলো।

ধূসর রংধনু পর্ব ৪৯