ধূসর রংধনু পর্ব ৫২

ধূসর রংধনু পর্ব ৫২
মাহিরা ইসলাম

আশা উদাসীন ভঙ্গিতে বসে আছে সুজনের রুমে।
সুজন রুমে নেই কোথাও গিয়েছে হয়তো।
এই তো খানিকক্ষণ আগেই এলো তারা।
প্রথমবার সে নিজে থেকে এসেছিল।আর আজ দ্বিতীয় বার তাকে আনা হলো।
কে জানতো ভবিষ্যতে তার জন্য এই দিনটি অপেক্ষা করে ছিল।
প্রথমদিন যে নিজের রুম থেকে তাকে বের করে দিয়েছিল। আজ আবার সেই সযত্নে তাকে রুমে রেখে গেল।সময় কখন কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় কে জানে।
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা।
সুজন আশা কে নিয়ে তাদের সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।
কয়েকবার কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো।

রাহেলা বেগম দরজা খুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সুজন আর তার পাশে দাঁড়ানো বউ সাজে আশা দিকে।
-” কি হলো মা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে? তোমার জন্য বউমা নিয়ে এসেছি। বউ চাই,বউ চাই বলে বলে তো পাগল করে দিচ্ছিলে।নাও বউ এনে দিলাম।
এবারে বরণ করে ঘরে তুলো।”
রাহেলা বেগম অতি আনন্দে চিৎকার করে স্বামীকে ডাকলেন,
-” ও গো শুনছো।দেখে যাও তোমার ছেলের কান্ড।ছেলে আমার গেল বিয়ে খেতে শেষে সেই বিয়ে করে এলো। সঙ্গে নাক মুখ ওও ফাঁটিয়ে এসেছে।ওগো কে কোথায় আছিস একটু ধান দুব্বা নিয়ে আয়। রুমু কই রে। ”
আশাকে যে তিনি আনন্দে কতবার চুমু খেলেন কপালে,চোখে,মুখে তার হিসাব নেই।
আশার চোখ ছলছল করে উঠলো। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর কবে এতটা আদর পেয়েছে সে কারো মনেই নেই।
আশা ফুফিয়ে কেঁদেই দিলো।
রাহেলা বেগম অস্থির হয়ে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” ওমা কি হলো কাঁদছো কেন। কোথাও ব্যাথা পেলে নাকি
এই আশা।”
আশা তাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।
রাহেলা বেগম তার মাথায় হাত বুলালো।
আশা ভেজা কন্ঠে বলল,
-” তোমাকে মা বলে ডাকি?”
-” ওমা শুনো বোকা মেয়ের কথা। মা কে মা বলে ডাকবে না তো কি বলে ডাকবে।”
আশা আবেগে আপ্লূত হলো।
“মা।”

রাহেলা গগপমন আশার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন পরম যত্নে।
সুজন বলে উঠলো,
-” তোমরা থাকো আমি আসছি একটু।”
রাহেলা বেগম আশাকে বুকে রেখেই বলল,
-” সে কি কথা দেখছিস না মেয়েটা কাঁদছে একটু সান্ত্বনা দিবি না। যা মেয়েটাকে তোর রুমে নিয়ে যা।ফ্রেস হতে দে।”
সুজন গমগমে কন্ঠে বলল,
-” তুমি নিয়ে যাও।”
” সেকি কথা। তোর বউকে তোর রুমে তুই নিয়ে যাবি।আমি কেন নিয়ে যাবো আশ্চর্য। ”
সুজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” ঠিকআছে আসো।”
” এভাবে বললে হয় নাকি।মেয়েটাকে কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছে দেখ। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারবে নাকি।কোলে করে নিয়ে যা।”

সুজন হতবাক হয়ে মায়ের দিকে চাইলো।
” মা তোমার মাথা ঠিক আছে তো।”
রাহেলা বেগম ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,
-” তো না থাকার কি আছে।এই রুমু চল চল আমরা ওদিকটায় যাই। রান্না বান্না ঝামেলা আছে।আয় আয়।”
রাহেলা বেগম যেতে যেতে পিছু ঘুরে বলল,
-” কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছিস কেন।যা।”
সুজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিলো।
আশা পরে যাওয়ার ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে সুজনের পাঞ্জাবি একটুকরো চেপে ধরলো।
পিছন থেকে রাহেলা বেগম হাসলেন। যাক ছেলে তার জব্দ হয়েছে বেশ।
সুজন বিরবির করে বলল,

-” আমার কোলে ওঠার তোমার ভারী শখ তাইনা।”
আশা নাক টেনে বিরক্তির স্বরে বলল,
-” আমি কি আপনাকে বলেছি নাকি কোলে তুলতে হুহ।”
-” এই একদম ভেঙচি দেবে না ঠোঁট ভেঙে দেবো।”
” নরম জিনিস ভাঙা যায় না কাটতে হয়।”
-” হ্যাঁ সেই। সময় হলে সেটাই করবো।”
” দেব না।পারবেন না ।”
” চ্যালেঞ্জ করছো তুমি এই সুজন কে? হুম।”
আশা জবাব দিলো না।
রুমে এসে সুজন তাকে নামিয়ে দিয়ে বলল,
” আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। আসতে লেট হতে পারে মা খাবার দিলে খেয়ে ঘুমিয়ে যেও।”
সুজন বেরিয়ে যেতেই আশার মনে হলো।
অজানতেই সুজন তাকে কৈফিয়ত দিলো।
কেন জানিনা আশার মনটা ভালো হয়ে গেল।
অজানতেই ঠোঁটের কোনে মুচকি হাঁসি ঝুললো।

নিস্তব্ধ দোকানে পৌঁছে দেখলো।
মাহীন আর সৃজন দুজন গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
আর সুজন সমানে পায়চারি করছে।গায়ে তার লাল টুকটুকে পাঞ্জাবি।
নিস্তব্ধ অবাক কন্ঠে বলল,
” আশ্চর্য। হয়েছেটা কি বলবি তো। এভাবে পায়চারি কেন করছিস।আর লাল পাঞ্জাবি কেন হঠাৎ। বিয়ে সাদি সেড়ে এলি নাকি?”
সুজন ওদের সামনে এসে বসে বলল,
” দোস্ত প্লিজ তোরা রাগ করিস না।একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছি। ”
তিনজন উৎসুক দৃষ্টিতে চাইলো।
সুজন মিনমিন করে চাইলো।

পকেটে ভাঁজ করে রাখা কাবিননামাটা ওদের সামনে মেলে ধরলো।
তিনজন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো।একবার সুজনের দিকে তো একবার কাবিনের দিকে।
নিস্তব্ধ হতভম্ব গলায় সুধালো,
” ভাই তুই ঠিক আছিস তো।মানে আমাদের না জানিয়ে সোজা বিয়ে।কনে আশা। কোন আশা? তোর ভাবীর ফেন্ড নাকি?”
সুজন মুখ কাচুমাচু করে মাথা নাড়লো।
মাহীন বলল,
” বুঝলাম বিয়ে করেছিস কিন্তু আমাদের একটাবার জানাতে পারতিস।সালা তোর সঙ্গে কথা নেই।এমন একটা কাজ করলি…”
সুজন দ্রুততার সহিত তখনকার পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলল ওদের।
নিস্তব্ধ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-” মানলাম। কিন্তু তুই কি আশা কে পছন্দ করিস। দেখ আমার মতো একই ভুল করিস না। মেয়েটা ভালো। কষ্ট পাবে।”

সুজন মিনমিন করলো।
নিস্তব্ধ ধমক দিলো।
” বিড়ালের মতো মিউমিউ করবি না। স্পষ্ট করে বল।”
সুজন মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” কিছুটা।৷ ওর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে।”
সৃজন বলে উঠলো,
-” ওও আচ্ছা আচ্ছা। কথা বলতে ভালো লাগে? চেহারা ভালো লাগে না তোমার?”
নিস্তব্ধ কোতুক করে বলল,
” তলে তলে টেম্পু চালাচ্ছো অথচ আমাদের বলোনি। বাহ বেশ বেশ।”
” দেখ ভাই এমন কিছু নয়।”
মাহীন বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা বুঝে গিয়েছি।”
নিস্তব্ধ জিজ্ঞেস করলো,

” তো আশাকে কোথায় রেখেছিস। আঙ্কেল আন্টিকক জানিয়েছিস? কোনো ঝামেলা করেনি তো। ”
” হ্যাঁ ওকে বাড়িতেই রেখে এসেছি। বাবা-মা ওকে চিনতো।কোনো ঝামেলা করেনি।”
সৃজন বলল,
-” করবে কেমন করে বিয়ের জন্য তারা তো তোমায় আজ থেকে বলছে না।”
সুজন মাথা নাড়লো।
নিস্তব্ধ বলল,
” যাক অবশেষে তুই বিয়েটা যে করেছিস এতেই আমরা খুশি। কাল আমরা সবাই যাবো। আমাদের নতুন বর-কনে কে দেখতে।”
সবাই তাল মেলালো নিস্তব্ধ’র কথায়।
সৃজন বলল,
-” হ্যাঁ দাড়া আমি আয়ানা আর আরশী কে বলে দিচ্ছি। ”
নিস্তব্ধ বন্ধুকে জরিয়ে ধরে কনগ্রাচুলেশন জানালো।
ফিসফিস করে বলল,

” তা বাসর টা কি আজই সেরে ফেলার প্লান করেছো নাকি বন্ধু?”
সুজন বিস্মিত দৃষ্টিতে নিস্তব্ধ’র পানে চাইলো।
তার বিশ্বাস হচ্ছে না।নিস্তব্ধ এমন বেফাঁস কথা বলতে পারে।
” ভাই তুই ঠিক আছিস তো। ভাবী আদ্যত্ত্বেও আস্ত আছে তো?”
নিস্তব্ধ অভিনয় করে বলল,
” ছিঃ, ছিঃ কিসব আসতাগফিরুল্লাহ মার্কা কথা বলছিস। সবাইকে নিজের মত ভাবো নাকি।”
সুজন নিস্তব্ধ ঘাড় চেপে ধরে বলল,
” সালা আমি আজই বিয়ে করেছি। এখন পর্যন্ত একটা চুমু ওও খেতে পারলাম না বউকে আর তুই আমায় অপবাদ দিয়ে দিলি।”
নিস্তব্ধ হাঁসতে হাঁসতে বলল,

-” ছাড়। আরে দম আটকে যাবে তো। কি করছিস।”
সৃজন আর মাহীন বলল,
” ভাই আর দুদিন সবুর কর। তোদের বাসর সাজিয়ে দিয়ে আসবোনে। দুদিন পর তো নিস্তব্ধ’র রিসিপশন বেটার বাসর ওও তো আমাদের সাজাতে হবে।”
সুজন টিটকারি করে বলল,
” তোদের কি মনে হয় ব্যাটা এখনো বাসর না করে বসে আছে।”
সৃজন আর মাহীন নিস্তব্ধ’র দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই নিস্তব্ধ দাঁত কেলিয়ে হাঁসলো।
“দেখেছিস বন্ধু আমাদের আর বিবাহিত সিঙ্গেল নেই।”
ওদের খুনশুটিতে দোকানদার চাঁচা মুচকি মুচকি হাঁসে।
সুজন বলল,

” একটা হেল্প লাগবে ভাই।”
কি হেল্প বল।
” মানে আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। হুট করে বিয়েটা করে ফেললাম কিন্তু…।
নিস্তব্ধ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” দেখ সুজন বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়। আমি যে ভুলটা করেছি সেটা কখনো করিস না পরে পস্তাবি।
যাই করিস মেয়েটাকে কোনো ভাবে আর কষ্ট দিস না। যা শুনলাম মেয়েটা ছোট থেকেই অভাগী। আর তুই নতুন করে তার হৃদয়ে দাগ কাটিস না।
আর যাই করিস ভেবে চিন্তে করিস।
সুজন মাথা নাড়লো।
নিস্তব্ধ বাসায় গিয়ে তাসফিকে খবরটা দিলো না। আশাকে নিয়ে মেয়েটাও ভারী চিন্তায় ছিলো।সে ভাবলো কাল একবারে সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে।
সুজন নিজ রুমে ঢুকে দেখলো তার নব বিবাহিতা বধূ শাড়ী না পাল্টেই এভাবেই শুয়ে পরেছে।
শাড়ী তার খানিকটা এলো মেলো।

সুজন গুটি গুটি পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।
কাল রাতেও সুজন মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলো।
অথচ দেখ একদিনের মাথায় মেয়েটা তার ঘরে এসে উপস্থিত।
নিয়তি কখন কাকে কিভাবে সব মিলিয়ে দেবে তা তো একমাত্র উপরওয়ালাই জানে।
সুজন কি কখনো ভেবেছিলো আশা কে সে এই মুহুর্তে বিয়ে করবে। সে তো কল্পনাও করেনি।
সুজন আশার নিষ্পাপ মুখাবয়বে দিকে তাকালো।
হাত বারিয়ে সুজন লাইট অফ করে দিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালালো।
কমলা আলোয় নববধূর মুখটা বড্ড মায়াবী লাগছে।
সুজন নিজের অজান্তেই এগিয়ে গেল ওই মুখশ্রীর পানে।
প্রথম পবিত্র চুম্বন একে দিলো অর্ধাঙ্গিনীর ললাটে।
কেমন ঘোর কাজ করছে তার।

সুজন দ্রুত উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
সুজন ওয়াশরুমে ঢুকে যেতেই আশা চোখ মেলে তাকালো।
সে ঘুমায়নি। সারাদিন এত ঝড়-ঝাপটা যাওয়ার পর কারই বা ঘুম আসে।
তখন দরজা খোলার শব্দ পেয়ে আশা ঘুমের ভান ধরে ছিল। কাজটা সে খুব ভালো করতে পারে।
কিন্তু সুজন এমন একটা কাজ করে বসবে তার কল্পনায়ওও ছিল না।স্বামীর নিকট হতে প্রথম আদরটা সে এভাবে পাবে কোনোদিন ভাবেই নি।

ধূসর রংধনু পর্ব ৫১ (২)

ইশশ যদি সে সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়তো।তবে তো এই ধারুণ অনুভূতিটা সে মিস করে যেত।
আশা মনের মাঝে কেমন রঙিন প্রজাপ্রতির দল পাখা মেলে উড়ছে। তারা নতুন ভাবনায় স্বপ্ন বুনছে।
তবে কি সুজন স্যার বিয়েটা মন থেকে করেছে?

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৩