ধূসর রংধনু পর্ব ৫৭

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৭
মাহিরা ইসলাম

আশা সুজন কে জরিয়ে ধরলো না বরং শক্ত কন্ঠে বলল,
” এতদিনের তো আপনি আমার কাছাকাছি আসেন নি স্যার।তবে আজ কেন এই উদ্যোগ? ”
সুজন আশার মুখ পানে মায়াময় দৃষ্টিতে চাইলো। আশার মুখখানি হাতের আঁজলায় তুলে সুধালো,
” কে বললো জরিয়ে ধরি নি।
প্রতি রাতে যে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাও সেই খবর কি রাখো বোকা মেয়ে? ”
আশা চমকিত দৃষ্টিতে হতভম্ব বদনে চেয়ে রইলো।
কি বলল লোকটা।

“তৃপ্তিকে আমি ক্ষমা করেছি বহু আগে।এখন আর ওর জন্য আমার মনে কোনো জায়গা নেই আশা।
আর না তো চাই তাকে নিজের সঙ্গে জড়াতে।
তৃপ্তির নাম খানা এখন আমার হৃদয়ে শুধু ধূলো হয়ে জমা রয়েছে।সেই ধূলো ও তুমি চাইলে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারো এক নিমিষে।সেই অনুমতি তোমায় দিয়ে রেখেছি যেদিন কবুল বলে তোমার নিকট নিজেকে গচ্ছিত রাখলাম সেদিনই
এই পুরো আমিটাই তো তোমার তোমার
তবে কেন তোমার মনে এত দ্বিধা দন্দ আশা?
আর তোমায় জরিয়ে ধরার কারণ তৃপ্তি নয়।তুমি নিজে।ওর চিঠি পড়ে আমি উপলব্ধি করলাম সত্যিই তোমার প্রতি আমার অসম্ভব টানকে। যা তৃপ্তির প্রতি কোনোদিন অনুভব হয় নি।”
তার দেওয়া লকেট কেন পড়ালেন তবে স্যার?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” লকেট পড়িয়েছি মানে এই নয় যে তৃপ্তির কথা আমি মেনে চলি।পরিয়েছি কারন এতে আমাদের আমার আর তোমার নামের সিম্বল রয়েছে।
তাকে বহু আগে ক্ষমা করেছি। তাই পরাতে তো কোনো দোষের নেই। তাছাড়া সবাইকে একটা শেষ সুযোগ দেওয়া উচিত। তোমার ভালো না লাগলে খুলে ফেলতে পারো।”
আশার জবাবের অপেক্ষা করলো না সুজন।একটানে লকেট টা খুলে ছুড়ে ফেলেদিলো বাহিরে।
বাতাসের ঝাপটায় তা কোথায় গিয়ে পড়লো কে জানে।
-” কি করলেন।ফেললেন কেন ”
আশা আতঙ্কিত স্বরে সুধালো।
” জীবনে আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তির আগমন না হোক।”
আশা কয়েকপলক সুজনের পানে চেয়ে রইলো।
সুজনের শক্ত সামর্থ হাতটা শক্ত করে ধরলো।টেনে নিতে নিতে হাঁটা ধরলো।

” আসুন।”
” কোথায় যাচ্ছো?”
” হুঁশশশ।”
সৃজন, আরশী, আয়ানার জন্য যে বক্স পাঠিয়েছে তাতে একই লেখা একই সম্মোধনের সহিত।
প্রিয় আরশী,
তোদের সঙ্গে কথা হয়না অনেক দিন যাবত।তবে তোরা আমার খোঁজ খবর না নিলেও আমি ঠিকই সবসময় তোদের খোঁজ রাখি, আক্রোশে হোক বা চিন্তিত ভঙ্গি থেকে। তোদের কে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসতাম রে।এখন পুনরায় বাসতে শুরু করেছি।
তোদের সঙ্গে কত অন্যায় করেছি পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস।
সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি। আগামীকাল সাতটায় ফ্লাইট।
সৃষ্টি কর্তা না করুক আজ যদি প্লেনটা ক্রাশ হয় তবে আমার থেকে সব চেয়ে খুশি বোধহয় কেউ হবে না।
যদিও জানি নিজের মৃত্যু কামনা নিজের করতে নেই। তবুও ওই যে অপরাধের সূক্ষ্ম ব্যাথা তা হতে মুক্তি পেতে চাই রে।দেখি পারি কিনা জীবনটাকে নতুন করে গড়তে।

ভালো থাকিস তোরা আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোদের সকলের ঘাড়ে বসে রক্ত চুসে খাওয়া অতৃপ্ত আত্মা
সৃজন সময়ের হিসাব করলো।
বক্সটা কাল পাঠিয়েছিল।
আজ তবে…..
চমকে উঠলো সে।
এখনো ঘন্টা খানেক সময় বাকি আছে।
তৃপ্তি নম্বরে ফোন করলো সে।তবে ততক্ষণে তা বন্ধ বলছে।
বোধহয় সূর্যিমামা ইতোমধ্যে ডুব দিয়েছে পশ্চিম দিগন্তে।
তৃপ্তি উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে এয়ারপোর্টে চলাচল মানুষ জনের পানে।
আর মাত্র আঁধা ঘন্টা পরেই সে উড়াল দেবে ওই দূর আকাশে। থাকবে না আর এই বাংলাদেশে
হারিয়ে যাবে নতুন পথের খোঁজে। তার চোখ বেয়ে গরিয়ে পড়া অশ্রুকণাগুলো খুবই অযত্নে মুছে নিলো।
কি দরকার তার চোখের পানিকে এড যত্ন করে মোছার।পড়ুক না একটু জল।ক্ষতি কি তাতে।
বাংলাদেশে এখন তার নিজের বলতে কিছুই নেই।

শুধু বন্ধু গুলো ছাড়া। তারাও কখনো তাকে কোনেদিন ক্ষমা করবে কিনা জানেনা।
খুব ইচ্ছে করছিলো শেষবার সকলকে একটু দেখার। আবার মনে হলো না থাক। সব ইচ্ছে যে পূরণ হয় না।
হে খোদা তুমি শক্তি দিও বাকি জীবনটা লড়াই করে বাঁচার।আর কোনো পাপাচারে লিপ্ত হতে চাইনা।
তুমি তো অতি দয়ালু।কেউ আমায় শেষ সুযোগ না দিক।তুমি অন্তত দিও।
নাহলে তোমার দরবারে আমি কি নিয়ে দাঁড়াবো।আমার এ হৃদয় ভর্তি ঝোলা যে শূন্য।
নিস্তব্ধ নিজের গাড়ি খানা এনে থামালো এয়ারপোর্টের সামনে।
অতঃপর একপলক তাসফির পানে চাইলো।
তাসফি মাথা নাড়লো।
সাত টা বাঁজার আগেই যে এসে পৌঁছাতে পেরেছে এসেই তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
দুজনেই নেমে এলো গাড়ি থেকে।
দুজনে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকতেই সেখানে সুজন আর আশা একটা গাড়ি থেকে নামলো।
পরপর, সৃজন, মাহীন, আয়ানা, আরশী সকলে।
কি অদ্ভুত সবার মনের টান।

আসলে জীবনে রেসারেসি, হিংসা-বিদ্বেষ,লোভ, ভালোবাসা এসবের থেকে বন্ধত্বটা একটা আলাদা অনুভূতি। যা মুখে বলে বোঝানো বা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটা রক্তের কোনো সম্পর্ক নয়। আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলে একে অপরের সঙ্গে।
শত চাইলেও আমরা তা ভুলতে পারি না।
শত বছর পর দেখা হলেও মনে হবে।ওই যে ওই মেয়েটা বা ছেলেটাই তো আমার বন্ধু ছিল।বন্ধু। বন্ধু।
সেই বন্ধুটি যদি আমাদের কাছে এসে কখনো বলে আমায় ক্ষমা করে দিস রে।ভুল হয়েছে।
তখন অটোমেটিক চোখে অশ্রু ঝরে।অভিমানের পাল্লায় ভাঁটা পরে।এটাই বন্ধুত্ব।
কখনো কখনো কোনো বন্ধু খারাপ কাজে লিপ্ত হলো না ভালো কাজে, সে যাইহোক, জেনে বা অজান্তে প্রিয় বন্ধুটার সব কাজেই তাকে সঙ্গ দেই।
তেমনি ভাবে প্রিয় বন্ধুর প্রতারণা ওও বড্ড ভয়ংকর।
তৃপ্তি আনমনা হয়ে নিচের দিকে মুখ করে বসে ছিল।

” তৃপ্তি। ”
হঠাৎ পরিচিত কন্ঠস্বরে নিজের নামখানা কারো মুখ শুনে চমকে সামনে তাকালো।
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখশ্রী পানে বিস্মিত দৃষ্টি তাক করে উঠে দাঁড়ালো।
তার সামনে এক এক করে এসে দাঁড়ালো পুরো বন্ধুমহল।
পুনরায় পানিতে টইটম্বুর হলো তার চক্ষু।
সবাই যে এভাবে আসবে তা তার কল্পনার ওও বাহিরে ছিলো।
তাসফি, আশা, আয়ানা, আরশী এসে তৃপ্তি কে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।
তাসফি ফিসফিস করে তার কানে কানে বলল,

” আপু তুমি আমার জীবনে দেখা প্রথম ব্যক্তি।যে কিনা নিজের ভুল সুধরে নিয়ে নিজেকে বদলাতে চাচ্ছে। অতীতে যাই করে থাকো না কেন বর্তমানের তুমি ভীষণ ভালো আপু।তাছাড়া অতীতকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলে কেউ জীবনে সফল হতে পারে না।
জীবনের ভুলগুলোকে যে শুধরে নিয়ে পরবর্তী ধাপে আগাতে পারে সেই তো চিনে আসল জীবন।
তুমি খুব ভালো থেকো। দোয়া করি তোমার জীবনেও এমন একজন আসুক যে তোমায় মাথায় করে রাখবে।
তৃপ্তি অবাক দৃষ্টিতে তাসফির দিকে চেয়ে রইলো।
যে মেয়েটা তার কৃতকর্মের কারণে তাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতো। আজ সেই…
জীবন আসলেই ভীষণ সুন্দর। যদি তুমি সৎ পথে জীবন পরিচালনা করো।
আরশী বলল,

” তৃপ্তি তোকে আমরা সকলে আসলেই অনেক ভালোবাসতাম জানিস। কিন্তু মানুষের কিছু খারাপ অভ্যাস, স্বভাব আমাদেরকে সেই মানুষটির থেকে মুখ ফিরিয়ে আনতে বাদ্য করে।
আমরা বুঝি তুই পরিস্থিতির স্বীকার। তবুও নোংরা কাজ তো নোংরাই রয়ে যায় বল।
কিন্তু তুই আজ যে সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশ ছাড়ছিস তোকে আমরা স্যালুট জানাই।কজনই বা পারে এমনটা করতে।আজকাল তো লোভ,আর হিংসায় দুনিয়া তোলপাড়। কখনো যদি তোর কথা কারো কাছে বলার থাকে আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো। আমাদেরও একটা বন্ধু ছিল,এবং আছে, সারাজীবন থাকবে যে নিজের ভুলকে সুধরে নিয়ে নতুন করে জীবন গড়ার তাগিদে পা বাড়িয়েছে।
তার জন্য সবসময় দোয়া করি।সে ভালো থাকুক।
তার জীবনে এমন একজন মানুষকে পাঠাক সৃষ্টিকর্তা যেন তার অন্ধকার জীবনে ভাঁটা পড়ে।
তার জীবনের ধূসর মেঘ কেটে সেখানে উজ্জ্বল ওই সাত রঙার রংধনুতে রাঙুক।
তোকে বলবো না বাংলাদেশে থেকে যেতে।বরং বলবো ওপ দেশে ভালো থাকিস। কারণ আমরা চাই সত্যিই তুই নতুন করে জীবনটা শুরু কর।
তুই নিজেই একজন ডক্টর। তোর তো কিছুর প্রযেজন নেই। নিজের জীবিত নিজেই পরিবহন করতে পারবি। বেস্ট অফ লাক দোস্ত।
আশা বলল,

” অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে আপু।আপনি নিজেও জানেন না আজ আপনি আমায় কি দিয়েছেন। আপনার দেওয়া লকেট টা পরতে পারছি না।তবে ভাববেন না। আপনাকে আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি। ভালো থাকবেন আপু।
নিস্তব্ধ এগিয়ে এসে তার চিরাচরিত গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” জীবনকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
তুই দিচ্ছিস। এবং জীবন ওও অনেক সময় আমাদের এই সুযোগ টা পায় না। তুই পাচ্ছিস এবং দিচ্ছিস। আশা করি ভবিষ্যতে ভালো থাকবি।”
একে একে সবাই বেস্ট অফ লাক জানালো।
ফ্লাইটের অ্যানাউন্সমেন্ট করতেই তৃপ্তি সামনে পথে হাঁটা ধরলো।
আশা সুজনের হাতে চিমটি কাটলো।
সুজন শুধু একটি বাক্যই আওড়ালো,

” ভালো থাকিস, বেস্ট অফ লাক।”
সুজনের কন্ঠে তৃপ্তি পিছু ফিরে চাইলো।
এতক্ষণে তৃপ্তির উজ্জ্বল মুখশ্রীতে হাঁসি ফুটলো।
তৃপ্তি ওই অবস্থায়ই পিছু হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে গেল। তৃপ্তি চিৎকার করে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
” তোরা ও সবাই ভালো থাকিস দোস্ত। ”

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৬

তৃপ্তি চোখের কোণ মুছে সামনে ফিরে দৌঁড়ালো।
খানিকক্ষণ বাদেই বিমানটি আকাশে উড়াল দিলো।
থাইগ্লাসের মাঝ দিয়ে প্লেনের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই তাকিয়কেই থাকলো।
দেখা যাক জীবন তাদের পরবর্তীতে কোন পদক্ষেপে নিয়ে যায়।

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৭ (২)