ধূসর রংধনু শেষ পর্ব
মাহিরা ইসলাম
মাঝে কেটে গিয়েছে আরো একটি মাস।
আজ শুক্রবার। কদিন দোনামনা করার পর নিস্তব্ধ ঠিক করলো সুখবর টা আজ দিয়েই দেবে সকলকে।
চিন্তায় সে বারবার কপালের ঘাম মুছছে।
সবাই কেমন রিয়েক্ট করবে তাই নিয়েই টেনশন।দুদিন আগেও ফুফু বলল,
” এই যে ভাইয়ের পুত শুনো।কাজ বাজ একটু দেখেশুনে করো কেমন, মেয়েটাকে একটু সাবধানে রেখ। বয়স আরো কিছুটা বাড়ুক তারপর ওসব বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ভাবা যাবে বুঝলে।তাছাড়া এখন বউ তোমার ডাক্তারী পড়ছে।শুধু শুধু একটা হাঙ্গামা বাঁধিয়ো না বুঝেছো।”
নিস্তব্ধ’র তখন শুধু শুষ্ক ঢোক গিলা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।কারণ অলরেডি তখন তাসফি প্রেগন্যান্ট।
তবুও তার মনে হয় না খবর টা শোনার পর কেউ রাগ করে থাকবে। প্রথমে খানিকটা হুমবি তুমবি করলেও পরে ঠিকই সবাই আহ্লাদে আটখানা হবে সে ঠিক জানে।
কিন্তু নিস্তব্ধ এই কথাটা মুখে বলবে কেমন করে।এই পর্যন্ত সে জীবনে এতটাও লজ্জা পায় নি যতটা না সে এখন পাচ্ছে।
নিস্তব্ধ’র পায়চারী দেখে তাসফি বিছানায় বসে বসে পা দোলাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাঁসছে।
ইসস! তার ডাক্তার সাহেবের এমন হতভম্ব, চিন্তিত মুখখানা দেখার জন্যই তো তার এসব কারসাজি এত দ্রুত করা।
নিস্তব্ধ কন্ঠে উৎকন্ঠা নিয়ে তাসফিকে সুধালল
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” মা তুমি দাদী হতে যাচ্ছো।এভাবে বললে কেমন হয় বলো তো।এটাই বেস্ট হবে তাই না বলো?”
তাসফি বোঝার ভান করে মাথা দুলালো।
” দুর। কি যে বলো। কেমন যেন বিচ্ছিরি লাগছে শুনতে। এটা বলা যাবে না। তার চেয়ে বরং এটা বলা যেতে পারে, বাবা তোমার ঘর আলো করে পরবর্তী প্রজন্ম আসতে চলেছে।”
নাহ এটাও কেমম যেন ওড লাগছে।
“আচ্ছা তবে ‘ আপা তুই ফুপি হতে যাচ্ছিস।’ এটঅ বলাই যেতে পারে তাই না বলো?”
তাসফি সত্যিই এবারে ভীষণ মজা পাচ্ছে।
এত কিছু ভাবনার পরেও নিস্তব্ধ ঠিক করলো নাহ আর না। এবারে আর মুখে নয়।
মাহীনের মতো সে চিঠিই লিখবে।তার মাধ্যমেই জানান দিবে।
চিঠিটা চুপ করে টেবিলে রেখে সে আড়াল হবে।ব্যস তাহলেই কাজ শেষ।
চিঠি লিখতে লিখতে নিস্তব্ধ বিরক্তির স্বরে বলল,
” আমি বুঝলাম না কথাটা তুমি তো বলতে পারো সবাইকে। আমাকেই কেন ঠেলে দিচ্ছো এখানে আশ্চর্য। ”
তাসফি নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিলো,
” আমি কেন বলতে যাবো বলুন তো।যানেন না মেয়ে মানুষের লজ্জা বেশি। তারা কি এসব কথা সারা বাড়িময় গেয়ে বেড়াতে পারে। আজব মানুষ তো আপনি।
ছেলেদের কাজ হচ্ছে মেয়েদের লজ্জার ভার খানিকটা কমিয়ে দেওয়া, এইটুকু কাজ পারবেন না আপনি।
কদিন পর তাহলে আমার সন্টু সোনা কে সামলাবেন কেমন করে।”
সন্টু নামটা শুনতেই নিস্তব্ধ’র বিরক্তির মাত্রা আরো বেড়ে গেল।
” এই শুনো মেয়ে, আমার ছেলে মেয়েকে এসব ফাঁলতু
নামে একদম ডাকবে না ডিজগাস্টিং। ”
নিস্তব্ধ চিঠি খানা ভাঁজ করে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।
তাসফিও হাঁসতে হাঁসতে নিস্তব্ধ’র পেছন পেছন এলো।
আরে শুনুন তো।
নিস্তব্ধ পিছু ফিরে রেগে বলল,
” তুমি কেন নিচে আসছো বুঝলাম না। পা পিছলে পড়লে কি হবে বুঝতে পারছো?”
” কি যে বলেন না বাবু তো এখনো নিজের আকৃতিই ধারণ করে নি।কিছু হবে চলুন তো।”
তাসফি আরো একটু এগিয়ে বলল,
” তাছাড়া আপনি তো আছেনই আমার খেয়াল রাখতে।কি এইটুকু খেয়াল রাখতে পারবেন না নিজের বউ বাচ্চার?”
নিস্তব্ধ মুচকি হাঁসলো ,
” পাগলী। এসো।”
ড্রয়িংরুমে সবাই উপস্থিত। শুক্রবার থাকায় সবাই জম্পেশ আড্ডা বসিয়েছে।বাসন্তী আর মাহীন ওও উপস্থিত সঙ্গে পারুল ওও আছে।
আবেদা বেগম এখন অনেকটাই সুস্থ।
তাসফি এবারে নিজেও লজ্জা পাচ্ছে,
দাদা, মাহীন সহ বাড়ির পুরুষ মানুষ সহ মুরুব্বি সকলেই এখানে উপস্থিত।
নিস্তব্ধ ফিসফিস করে বলল,
” তুমি রেখ আসো বউ চিঠিটা।”
” আমি? পাগল হয়েছেন যান তো।”
বাসন্তীর ওদের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে বলল,
” কি ব্যাপার বলতো ভাই। তোরা ওখানে কি
গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছিস।
নিস্তব্ধ আমতাআমতা করলো।
বাসন্তী উঠে গিয়ে তাসফিকে নিজের পাশে এনে বসালো।
আসলে বাসন্তী প্রেগন্যান্ট তার খবর দিতেই একদিন আগে এবাড়িতে এসেছে।
মাহীন নিস্তব্ধ’র দিকে এগিয়ে গেল।
ফিসফিস করে বলল,
” কি করছিলি ঘরে বসে বলতো? ”
মাহীনের চোখ গেল নিস্তব্ধ’র হাতের মাঝে মুটপাকানো কাগজটার দিকে।
“এই তোর হাতে কি দেখি দেখি।”
” আরে..
নিস্তব্ধ মুঠো খুলে মাহীন জোড় করে কাগজ টা নিয়ে নিলো।
সামনে মেলে ধরতেই মাহীন বিস্মিত চোখে একবার নিস্তব্ধ’র পানে চাইলো।
মাহীনের বিয়্যাক্টশন দেখে সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে।
তাসফি মুখ কাচুমাচু করে বসে আছে।
বাসন্তী আর না পেরে খপ করে নিজেই কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো।
পড়া শেষে বাসন্তী ওও কারো জবাব দিচ্ছেনা দেখে
একে একে সকলের হাত পাছ করে শেষমেশ নিলয় সাহেবের হাতে গিয়ে পৌঁছালো।
নিলয় সাহেব তা খানিকটা জোড়েই পড়তে লাগলেন,
” আগামী কয়েকমাস পরেই এই ওসমান ভিলার পরবর্তী বংশধর আসিতে চলেছে।আপনাদের সবাইকে খরবটা জানানো হলো।
সবাই দাদা, দাদু, ফুফা, ফুপি, তাওইমা,মাওইমা, হতে চলেছেন।ধন্যবাদ।”
সকলের চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো।
“আলহামদুলিল্লাহ। ”
বলে উঠলো সকলে।
ফুফু চিৎকার করে ডাকলেন,
” ওরে রুম্পা কোথায় আছিস, ফ্রিজ থেকে বের করে মিষ্টি নিয়ে আয়।আগে মিষ্টিমুখ করে তারপর হারামজাদা টাকে ওষ্ঠা দেব।”
নিস্তব্ধ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কি করতে চাইলো আর কি হলো।
তাসফি মাথা নিচু করে আছে লজ্জায়।
নিলয় সাহেব গিন্নি দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
” দেখ অনিমা,ছেলে নাকি তোমার এতটাও অধৈর্যশীল নয়। হুম কোথায় গেল তোমার সেই ধৈর্যশীল ছেলে।হুমহু।বাপ কা ব্যাটা বুঝলে।”
অনিমা বেগম চোখ গরম করে চাইলেন,
” সবসময় বেশি বুঝো তুমি। আল্লাহ চেয়েছেন তাই হয়েছে।”
” হ্যাঁ এখন তো সেটা বলবেই।”
মাহীন নিস্তব্ধকে কুনুই দিয়ে গুতো দিলো।
তীর্যক কন্ঠে বলল,
” তো কে যেন সেদিন বলেছিল তার বউ পিচ্চি। এসব বহুত দেরী।কে যেন কয়েকমাস আগে বলেছিল বউকে মানবে না।”
নিস্তব্ধ রাগী চোখে তাকালো।
মাহীন তার তোয়াক্কা না করে বলল,
” উহু তা তো হবে না বন্ধু তোমার এই চোখ গরমে আমি আর ভয় পাচ্ছি না বুঝলে। ছেলে হলে আমার মেয়ের সঙ্গে তোর ছেলের বিয়ে দেব এই আমি বলে রাখলাম।শ্বশুর মশাইকে কি করে টাইট দেবে আগেই শিখিয়ে পড়িয়ে দেব মেয়েকে বুঝলি।
হাহাহা।”
নিস্তব্ধ রক্তচক্ষু বদনে চাইলো
মাহীন তার চাউনিকে পাত্তাই দিলো না।
বাসন্তী তাসফিকে জরিয়ে ধরলো শক্ত করে।
” ওও মাই গড, তাসফি কি শুনছি।দুই ননদ ভাবী কি তবে একসঙ্গে… হুম হুম।”
তাসফির গাল লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে।
” থামো আপা। আর বলো না প্লিজ। ”
নিলয় সাহেব মিষ্টি মুখে দিতে গেলেই অনিমা বেগম চোখ পাকিয়ে চেয়ে সুধালেন,
” তোমার না ডায়াবেটিস আছে,উহু কোনো মিষ্টি চলবে না বুঝেছো।”
নিলয় সাহেব করুণ চোখে গিন্নির পানে চাইলো।
মাহীন এগিয়ে এলো,
” আহা থাক না মা একটা খেলে কিচ্ছু হবে না খান,খান, বাবা দুই খুশি এক মিষ্টিতেই আনন্দ মেটান।”
নিলয় সাহেব হেঁসে বললেন,
” এইতো যোগ্য জামাইয়ের মত কথা। দেখেছ অনিমা কেমন শ্বশুরের খেয়াল রাখে।”
বলেই টপ করে মিষ্টিটা মুখে পুরলেন।
অনিমা বেগম চোখ বড়বড় করে চাইলেন।
ফিরোজা বেগম কে তাসফির দিকে এগিয়ে যেতে দেখেই ড্রয়িংরুমে উপস্থিত পুরুষেরা
গলা খাঁখারি দিয়ে একে একে কেটে পড়লো।
সঙ্গে নিস্তব্ধ ওও ভাগলো।সেঁধে সেঁধে কেই বা লজ্জায় পরতে চায়।
ফিরোজা বেগম তাসফি আর বাসন্তীর দিকে এগিয়ে গিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
” যাক তবে এতদিনে দুইজনে একখান কাজের কাজ ঘটাইয়া ফেলছো। এই বারে বোধহয় খোদা চাইলে মরণের আগে নাতী নাতকুরের পোলা-মাইয়া গের দেইখা যাইতে পারবো।”
তাসফিকে বললেন,
” এহনো এইসব কি জামা কাপড় পরে বসে আছিস বলতো।এইসব থ্রি পিচ টিস আর পড়িস না তো।
গোল ফোড়াক পড়বি সব সময় । বাচ্চার বাড়নে সুবিধা হইবো বুঝলি।দুজনকেই বলছি।”
তাসফি আর বাসন্তী মাথা নাড়লো।
বাসন্তী বলল,
” নানি তুমি না অসুস্থ রুম থেকে বের হয়েছ কেন বলো তো। চলো রুমে চলো।”
খুশির খবর শোনার পর আশা ভীষণ খুশি হয়েছে।বান্ধবীকে জরিয়ে ছিল কতক্ষণ। নিস্তব্ধ’র বাকি বন্ধুগন তাকে তিতকারি মারতে ছাড়েনি।
সুযোগ একদম লুফে নিয়েছে।
দেখতে দেখতে কয়েকমাস কেটে গেল।
তবে সুফিয়া বেগম তাসফির পেট দেখে বলল,মাসের সঙ্গে পেটটা একটু বেশিই উঁচু উঁচু লাগছে তাই না রে অনিমা।
তাসফি এখন একটু বেশিই অসুস্থ। ঠিকমতো খেতে পারেনা। যা খায় বমি হয়ে যায়। হাটতেও একটু সমস্যা। বেশিক্ষণ হাঁটলেই পেটে চিনচিন ব্যাথা হয়।
মাঝে মাঝে মনে হয় বাচ্চাটা সুড়সুড়ি দিচ্ছে তাকে।
মায়ের কথা শুনে অনিমা বেগম নিস্তব্ধ’র দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো।
নিস্তব্ধ অবাক স্বরে সুধালো,
” কি আশ্চর্য তুমি আমার দিকে কেন তাকাচ্ছো এভাবে মা।”
” তাকানোর কাজ করেছ তাই তাকাচ্ছি। তাসফি যাও তো মা রেডি হয়ে এসো।আমরা হসপিটাল যাবো। ”
মায়ের চাউনিতে নিস্তব্ধ খানিকটা ভয় ওও পাচ্ছে। যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে।
তাসফি যেতে চাইলো না।
আসলে তাসফি চাচ্ছিলো না আল্ট্রা করে এখনি ছেলে বাবু না মেয়ে বাবু তা জেনে যেতে।
সে চাইছিলো একবারে বাবু দুনিয়ার আলো দেখার পরেই সব জানবে।
কিন্তু অনিমা বেগম তাসফির কথা মানলেন না।জোড় করে নিয়ে চললেন হসপিটালে।
এবং রিপোর্ট দেখে বুঝলেন তার সন্দেহই ঠিক ছিল।
রিপোর্ট হাতে শ্বাশুড়ি বউমা দুজনেই থমথমে মুখে বাড়ি ফিরলো।
নিস্তব্ধ চিন্তিত ভঙ্গিতে ড্রয়িংরুমে বসে ছিল।
মা তাকে সাথে নেয় নি।
দুজন কে গম্ভীর মুখে আসতে দেখলে তার চিন্তা আরো বেড়ে গেল।
– “রিপোর্টে কি এসেছে মা।”
” নিজেই দেখে নাও।”
বলেই তিনি রিপোর্টটা দেখে চলে গেলেন।
নিস্তব্ধ একবার বউয়ের টম ফোলানো মুখের দিকে চেয়ে রিপোর্ট চেক করলো।
রিপোর্ট দেখে তার মাথায় হাত।
একটা নয় দু-দুটো বাচ্চা তার বউয়ের পেটে বেড়ে উঠছে।
ওও মাই গড।
“জা…”
” একদম কথা বলবেন না আপনি। ”
” এতে আমার দোষ টা কথায়। ওষুধ খায় নি কে বলো।”
নিস্তব্ধ তাসফিকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলল,
“ আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে তাসফি, তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না। একটা নয় দুটো এক সঙ্গে ভাবতে পারছো তুমি।একসঙ্গে দুই কাজ শেষ।”
তাসফিও মুচকি হাঁসলো।
অভিমানী কন্ঠে বলল,
“ আপনি আর কি বুঝবেন সব কষ্ট তো আমার।”
“ আর কষ্ট লাঘব করতে আমি আছি তো।”
তাসফি তৃপ্তির হাঁসি হাঁসলো।
অনিমা বেগম কঠোর জারি ঘোষণা করলেন।
তাসফির নিচে নামা বন্ধ।
সঙ্গে কলেজ যাওয়া ও।ইন্টার্নি শেষ করতে আরো একটা বছর বেশি লাগুক কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু শরীরের ঝুঁকি তিনি কিছুতেই নিতে দেবেন না।
মায়ের সঙ্গে বেবির ওও সমস্যা হবে। ডাক্তার পইপই করে বলে দিয়েছে বেড রেস্টে থাকতে।
ওও আরেকটা কথা। এর মাঝে আরো একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে। একমাস আগেই আশা জানালো সে মা হতে যাচ্ছে।
সৃজন শুনে বুঝলো না,
” সবাই কি এক সঙ্গে যুদ্ধে নামলো নাকি আশ্চর্য।
যুদ্ধের মাঠ সেই শুধু একটু বেশিই আগে পাড় করে চলে এসেছে।”
পান্নার পরে ওসমান ভিলার দ্বিতীয় বংশধরের আগমন ঘটলো।
মাহীন আর বাসন্তীর প্রথম সন্তান ” নীবিড় আহসান”
জন্মের পড়ে বাচ্চারা যতটা কান্না করে ছেলেটা মোটেও তেমন করে কাঁদে নি।
সামান্য একবার কেঁদে ছিলো কি কাঁদে নি টাইপ।
এর মাস খানে পরের ঘটনা।
সেদিন ছিল ঝড় বৃষ্টির রাত।
প্রকৃতিতে উত্থাল পাত্থাল বাতাস বৈছিলো।
তাসফির হঠাৎ করেই ব্যাথা শুরু হলো।প্রচন্ড ব্যাথা।
নিস্তব্ধ ছিল হসপিটালে।
খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে এলো।
তার কপাল বেয়ে ঘাম টপটপ করে পড়ছে।
দীর্ঘ ঘন্টা শেষে দুজন নার্স দুটো ফুটফুটে শিশু বাচ্চা কোলে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলো।
বাচ্চা নরমালেই হয়েছে।
নার্স দুজন এগিয় আসতে আসতে হেঁসে বলল,
” কনগ্রাচুলেশন স্যার আপনি এক ছেলে এক মেয়ের বাবা হয়েছেন। ”
” আ..র আর আমার ওয়াইফ। ”
” সেও সুস্থ আছে।”
সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
কতটাই না ভয় পেয়ে ছিলো।
মাহীন ছুটে এসে বাচ্চা ছেলেটাকে কোলে নিলো।
বাচ্চারা সাধারণত জন্মের পর ভীষণ কান্না করে কিন্তু এই ছেলের মাঝে তেমন কিছুই দেখা গেল না।একদম শান্ত। কেমন ডাগর ডাগড় চোখ মেলে চেয়ে আছে।কান্নার লেশমাত্র নেই।
তার ছেলেতো তবুও কেঁদেছিলো কিন্তু এতো জন্ম থেকেই আজকের পরিবেশের মতন থমথমে।মনে হচ্ছে কেমন আড় দৃষ্টিতে গম্ভীর চোখে চেয়ে আছে বাবার দিকে।
মাহীন আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
” নার্স বাচ্চা তো কান্না করছেনা না।”
নার্স হেঁসে বলল,
” আসলেই বাচ্চাটা কিছুটা ব্যতীক্রম ধর্মী।”
নিস্তব্ধ মেয়েকে কোলে তুলে নিলো।
তুলতুলে শরীরকে কোলে নিয়েই সে কেঁদে ফেললো।
” মা আমি ধরতে পারছিনা , এত নরম যদি গলে যায়।মনে হচ্ছে পরে যাবে দেখ।”
ছেলে পাগলামি কথা দেখে অনিমা বেগম হাঁসেন।
ছেলেটা শান্ত থাকলেও মেয়েটা একদম তার বিপরীত।
গলা ফাটিয়ে কান্না করে যাচ্ছে।
বুঝতে পারছেনা বাচ্চা একটা মেয়ের গলার আওয়াজ এত উচ্চ হয় কি করে।
তার কান্না থামার নামই নিচ্ছে না।
নিস্তব্ধ মুচকি হেঁসে মেয়ের কপালে আলতো চুমু খেয়ে মেয়ের নাম রাখলো,
নীহারিকা বিনতে নিস্তব্ধ সঙ্গে যুক্ত করলো তা।
“নীহারিকা বিনতে নিস্তব্ধতা।”
নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধতা হাঁসলো। যেন নামটা তার ভারী পছন্দ হয়েছে। তার উচ্চ গলার মতো কোনো নাম রাখলে বোধহয় তার গলার স্বরের সঙ্গে কান্নার বেগ আরো বেড়ে যেত।
সুজন পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল,
” সে কিরে বন্ধু। মেয়ে তো তোর গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার জুরলো।আর তুই কিনা নাম রাখলি নিস্তব্ধতা।”
নিস্তব্ধ শয়তানী হেঁসে বলল,
” জ্বী আর দেখে নিস। তোর ছেলের সঙ্গেই মেয়েকে আমি ঝুলাবো।”
” হুহ দেখা যাবে।”
তাসফি সুস্থ হলে ভেঙচি কেটে নিজের ছেলের নাম রাখলো,
“আদ্রিত শেখ নিভৃত ”
আসলেই মায়েদের ছেলের প্রতি একটু বেশিই টান থাকে জন্ম থেকে।আর বাবাদের মেয়ের প্রতি।
নিস্তব্ধতা নিজের নামের মতো নিস্তব্ধ থাকলো না অবশ্য। বাবার মতো সারাক্ষণ তাকে জ্বালিয়ে মারে।
তাসফি একটু কাছ ছাড়া হলেই কান্না করে ভাসিয়ে দেয়।
আদ্রিত নিস্তব্ধতার থেকে এক মিনিটের বড়।তবুও কি শান্ত।
তাসফি রেগে মেয়ের দিকে চেয়ে বলে,
” দেখ দেখ তোর ভাই কেমন শান্ত হয়ে আছে।
আমায় ক্ষ্যামা দে মা বাপের মত আমায় আর জ্বালাতন করিস না মা করিস না।”
নিস্তব্ধ তখন হাঁসে বাবার হাঁসিতে নিস্তব্ধতা ওও তখন খিলখিল করে হেঁসে উঠে।
যেন সে বাবার পক্ষে।
তাসফি বাপ বেটির দিকে রক্তচক্ষু বদনে চেয়ে থাকে।
এর দু’মাস পরেই আশার ডেলিভারি হয়।
সুজন আর আশার প্রথম সন্তান “সাদাফ ইফতিসাম”
আশা কে রিলিজ করার পরে ওসমান ভিলার সবাই গিয়েছিল, সাদাফকে দেখতে।
সাদাফের দিকে একপলক তাকাতেই নিস্তব্ধতার সে কি কান্না কিছুতেই থামানো গেল না।
সাদাফ ও শুরু করলো কান্না।
দুজন একে অপরের কোন জন্মের শত্রু কে জানে।
শেষে তাসফিরা বাড়ি থেকে না বেরুনো পর্যন্ত ওইটুকু মেয়ের কান্না থামলোই না।
সুজন নিস্তব্ধ’র কানে কান ফিসফিস করে বলল,
“বন্ধু তোমার মেয়েকে বোধহয় আর আমার ঘরে পাঠানো হলো না।”
নিস্তব্ধ রহস্যময় ভাবে হাঁসলো।
তাসফি ইচ্ছে করছিলো মেয়েকে তুলে একটা আছাড় মারে।
এইটুকু মেয়ে অথচ তার কি তেজ।
নিস্তব্ধ চোখ পাকিয়ে বলল,
” খবরদার আমার মেয়েকে যদি তুমি কিছু বলেছো।”
নীহারিকা কে তাসফি ঠাস করে বাপের কোলে দিয়ে বলল,
” নিন তবে সামলান নিজের মেয়েকে।”
তাসফি অবাক হয়ে দেখে ওমা মেয়ে তার বাপের কোলে গিয়ে শান্ত। হুহ হয়েছে বাপের নেওটা।
নিস্তব্ধ মেয়েকে কোলে নিয়ে মুচকি হাঁসে।
এর চারবছরের মাথায় জন্ম নেয়,
“মাহরিসা আহসান”
মাহীন এবং বাসন্তীর দ্বিতীয় সন্তান।
মেয়েটা ভারী শান্ত।
তাসফি সারাক্ষণ মেয়েটাকে কোলে রাখে।
আর তার নিস্তব্ধতা সে এখনো কেঁদেই যায়।
ওসমান ভিলায় আসলে আদ্রিত গম্ভীর মুখে ছোট্ট মাহরিসার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে।
আর তাসফি ছেলের গালে চুমু খায়।
তা দেখে নিস্তব্ধতা গাল ফুলিয়ে রাখে।
মেয়ের অভিমাম দেখে তাসফি মুচকি হাঁসে।
বোনের টোম ফোলানো মুখে আদ্রিত চুমু খায়।
নিস্তব্ধতা তখন খিলখিল করে হেঁসে দেয়। প্রতিবারই তো সে এমন করে। ভাইয়ের থেকে আদর খেতে সে ভান ধরে।ভাইকে যে সে বড্ড ভালোবাসে।
সুজনদের বাড়িতে গেলে এখনো সাদাফ আর নিস্তব্ধতা এতটা বড় হওয়ার পরেও দুটোতে মিলে টুকুর টুকুর করে ঝগড়া করে।
মেয়েটা তার সাদাফকে বলে সাদাবিলাই।আর সাদাফ নীহারিকা কে সারাক্ষণ নিরিবিলি বলে ক্ষেপাতে থাকে।
দুজনের দেখা হলে খাওয়া নাওয়া বাদ দিয়ে ঝগড়া করাই তাদের প্রধান পেশা হয়ে দাঁড়ায়।
তাসফি আর আশা দুজনেই নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে সমান তালে।
দেখতে দেখতে আশা আর তাসফি এমবিবিএস পাশ করে বের হলো।
তাসফি নিস্তব্ধকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরিয়ে বলল,
” ডাক্তার সাহেব, আমি আমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি তাই না বলুন?”
নিস্তব্ধ সায় দিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে অর্ধাঙ্গিনীর কপালে চুমু খায়।
ছ’বছরের আদ্রিত আর নিস্তব্ধতা দুজনের কেউই আজ কাঁদছে না।মায়ের গায়ে জড়ানো ডাক্তারী সাদা এপ্রোন আর গলায় থাকা স্টেথোস্কোপের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো।
কি ভেবে আদ্রিত আর নিস্তব্ধতা দুজনেই দৌঁড়ে গিয়ে মাকে জরিয়ে ধরে।
স্বামী সন্তানকে বুকে আগলে ধরে তাসফি নিরব অশ্রু ফেলে।চোখ কে বাড়ুন করা যে বড্ড দায়।
এই তো আজ তার জীবন পরিপূর্ণ। আর কি দরকার জীবনে। যা যা দরকার সবই তো আছে। সেই বোধহয় জীবনে সবচেয়ে সুখী।
অতীতের ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে আজ সে মুক্ত বাতাসে।
তাসফি ফিস করে সুধায়।
” বাবা কোথায় তুমি দেখ তোমার আদরের তাসফি আজ কতটা সুখি তোমার বাঁছা পাত্রের সঙ্গে। মা দেখ তোমার সেই ছোট তাসফি কত্ত বড় হয়ে গিয়েছে। তার দু’দুটো ছানা পোনা ওও রয়েছে।
সে তোমার দেখা স্বপ্নকেও পূরণ করেছে। মা…, বাবা, দেখে যাও।
অশ্রুর ঢল নামতে শুরু করে তার চোখ বেয়ে।
নিস্তব্ধ’র চোখেও পানি, পূর্ণতার পানি।
বাবা মায়ের কান্না দেখে আদ্রিত আজ অনেকগুলো দিন পর কাঁদলো।
কিন্তু অবাক করা বিষয় সব সময় কাঁদতে থাকা নিস্তব্ধতা আজ কাঁদলো না। বরং মায়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে একে একে মা, বাবা, ভাই সকলের চোখের জল মুছিয়ে নিজের আধো আধো স্বরে বলল,
” তোমরা সবাই কাঁদছো কেন। দেখ এই যে আমি আছি না। কেঁদনা কেউ কেমন। তাহলে তো তোমাদের নীহারিকা কষ্ট পায়। কাঁদে না কেমন। “
নিস্তব্ধ তাসফি অবাক হয়ে চেয়ে রয় মেয়ের পানে।
যেন তার এইটুকুনি মেয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে শক্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে,
” কাঁদছো কেন তোমরা। কীসের কষ্ট তোমাদের। তোমাদের নীহারিকা আছে তো। সে সব প্রবলেম সলভ করে দেবে দেখেনিও।”
দু বছর পর।
ওসমান ভিলা আজ মানুষের গুঞ্জনে মুখরিত।
বাইরের কোনো মানুষ নয়। ঘরের মানুষ।
নিস্তব্ধ’র পরিবার, মাহীন,সুজন, সৃজন, আয়ানা আরশী,এমনকি তৃপ্তিও আজ উপস্থিত সেখানে।
আজকের তৃপ্তির সঙ্গে দশ বছর আগের তৃপ্তিকে মেলানো বড্ড মুশকিল।
তৃপ্তির পরনে কাতান শাড়ি। কোথাও ফাঁকফোকর নেই যেখান দিয়ে তার শরীরের একটি ভাঁজ অন্য পুরুষের চোখে দৃশ্যমান হবে।
তার এক বছরের মেয়ে কোলে।পাশে তার হাসবেন্ড নিখিল।
বড্ড শান্ত ছেলে।
আসলেই তৃপ্তি জীবনের যে একটুকরো সুখের খোঁজে বিদেশে পারি জমিয়েছিল। তা সে পেয়েছে।
আসলে মন থেকে চাইলে এবং সেই অনুযায়ী কর্ম করলে আল্লাহ তায়ালা আসলেই আমাদের তা দেন।
ড্রয়িংরুমের সকলের মুখে আজ হাঁসি।
আড্ডায় মশগুল সকলে।
সৃজন সকলের দিকে তাকিয়ে বলল,
স্মাইল প্লিজ।
অতঃপর এতগুলো মানুষ সকলে বন্দি হলো এক ফ্রেমে।
ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে,
নিস্তব্ধ তাসফির হাতটা শক্ত করে ধরে আছে।
মাহীন বাসন্তীর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে।
আর আশা আর সুজন একে অপরের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
তৃপ্তির কোলে নিজের মেয়ে।
আদ্রিত মাহরিসাকে কি নিয়ে যেন আঙুল উঁচিয়ে ধমকাচ্ছে আর মাহরিসা কাঁদো কাঁদো মুখ করে মাথা নিচু করে রেখেছে।
সাদাফ আর নিস্তব্ধতা দুজনের চুল ধরে টানছে।
আশার কোলে থাকা তার এক মাসের মেয়ে কাশফির দিকে নীবিড় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে যেন সে মেয়েটার আগমনে মনে মনে বড্ড বিরক্ত।
অনিমা বেগম নিলয় সাহেবের দিকে হাস্যউজ্জ্বল মুখে ঘেঁসে বসা। আর বাকি সবাই স্বাভাবিক ভাবেই হেঁসে তাকিয়ে আছে।
হয়তো বহু বছর পর এই ফ্রেমটি নিজের জায়গা করে নিবে ওসমান ভিলার ড্রয়িংরুমের ঠিক মাঝ খানে বিশাল আকারে।
প্রত্যেকের জীবনের আজ ধূসর মেঘ কেটে তার জায়গায় সকলের মুখে ছড়িয়ে পড়েছে আজ ওই আকাশের ওই সাত রঙা উজ্জ্বল রংধনুর প্রজ্জ্বলিত রশ্মি। সকলের মুখশ্রী আজ রঙিন। সেখানে নেই কোনো আর ধূসরের ছাড়া।
সময়টা ঠিক গগনে সূর্যিমামা অস্ত যাবার আগ মুহূর্তে।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ওমা সে কি হঠাৎ মেঘে ঢাকা আকাশ ধারণ করলো লালাভ বর্ণ।
অদূরে রংধনু দেখা যাচ্ছে কি?
হ্যাঁ হ্যাঁ তাই তো।ওই তো দেখা দিয়েছে সাত রঙে রাঙা উজ্জ্বল রংধনু।
ধূসর রংধনু পর্ব ৫৭ (২)
ধূসর গগন আজ মেতেছে রঙে,
সে যে সেঁজেছে লাজে।
ভালোবাসার অসীম প্রেমে সে যে
পড়েছে ফাঁদে।
কহিবো সেই অমরও বাণী
আমি ভালোবাসি যে তোমায় হে সুন্দরী রমণী
আকাশের ওই ধূসর মেঘের ন্যায়?
না না ঠিক ওই উজ্জ্বল রাঙা রংধনুর ন্যায়।