ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১৯
মাহিরা ইসলাম মাহী
নিশুতি রাত।
বাড়ির সামনে বাইক থামিয়ে হুড়মুড় করে নামে সাদাফ।
পঁচা ডিমের আঁশটে গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে তার।
তীব্র ভাবে প্রার্থনা করছে সে এই মুহুর্তে বাসার ড্রয়িংরুমে যেন কেউ না থাকে।টিপটিপ পায়ে সে বাসায় ঢুকে।
দরজা খোলা থাকবে না এই ভয়ে ছিল সে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার সদর দরজাটা খোলা।
সে একটু খানি ধাক্কা দিতেই হাট করে খুলে গেল।
ড্রয়িংরুম একদম অন্ধকারে মোড়া। দরজা খোলা রেখেই কি সকলে ঘুমিয়ে পরলো নাকি।
সর্বনাশ চোর টোর ঢুকলো নাকি আবার।
কিন্তু এই মুহুর্তে চোরের সন্ধান করার মতন অবস্থায় নেই সে।
তাকে ওয়াশরুম যেতে হবে।
ডেটল, স্যভলন, সুগন্ধী সাবান, শ্যাম্পু সব গায়ে মেখে তাকে বাথট্যাবে ঝাঁপাতে হবে এনি হাউ।
টিপটিপ পায়ে নিজের রুমের সামনে পৌঁছাতেই ঠাস করে ড্রয়িংরুমের লাইট জ্বলে উঠলো।
লাইটের আলোয় আলোকিত হলো পুরো ঘর।
কেউ তার টি-শার্টের কলার চেপে টেনে ধরলো,
“ দাঁড়া।”
সাদাফ শুষ্ক ঢোক গিললো।
অসহায় চোখে পিছু ফিরলো।
আশা’র তীক্ষ্ণ কন্ঠের জিজ্ঞাসাবাদে সাদাফের অথৈয় জলে ডুবে যাওয়ার অবস্থা।
“ কোথায় গিয়েছিলি?”
সাদাফ মুখ কাচুমাচু করে মায়ের পানে চায়
সাদাফের গায়ের গন্ধ তীব্র হয়ে আশা’র নাকে লাগতেই সে তার টি-শার্ট ছেড়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কয়েকহাত পিছিয়ে নাকে হাত দেয়।
ছেলের হাত, পায়ে, গায়ে ডিমের আস্তরণ দেখে হতভম্ব আশা।
সে দাঁতে দাঁত চেপে সুধায়,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ ডিম দিয়ে গোসল করে এসেছিস নাকি গাঁধার বাচ্চা গাঁধা। নাকি কেউ করালো?”
সাদাফ কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে।
“ এসব কি রে হতভাগা? বাড়ি শুদ্ধ মানুষকে পাগল বানানোর পায়তারায় নেমেছিস তোরা বাপ-ছেলে?”
“ মা আসলে… আসলে আমি, আমার কোনো দোষ নেই মা।সব নিরু করেছে।”
“ আসলে মানে কি? সব নিরু করেছে হ্যাঁ? সব নিরু করেছে? করবেই তো। সে কি বসে বসে আঙুল চুষবে? তুই ওকে বিয়ে করবি না। আবার তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাঙ্গামা করবি আর ওও তোকে ছেড়ে দেবে। কি ভেবেছিস তুই?”
আশা সাদাফের মাথায় মারে।
“ কি হলো বল? নিরু মা আমায় ফোন না করলে তো আমি জামতেই পারতাম না তোর কার্যকলাপ।
ছিঃ,ছিঃ। এভাবে নির্লজ্জের মতো উল্টো গেঞ্জি গায়, পায়ের জুটো দু পায়ে দুরকম নিয়ে ঘুরে বেড়াস।লজ্জা করেনা তোর? মান সম্মান সব ধুয়ে দিলো।”
“ হতভাগা এক বারে হয়েছে বাপের মতন।”
সাদাফ চোখ বড় বড় করে চায়।
নিরিবিলি’র বাচ্চা টা তবে নিরব না থেকে সবটা উগড়ে দিয়েছে মায়ের কাছে।
“ কি হলো বল কেন গিয়েছিলি? বল কেন গিয়েছিলি?”
“ এমনিই গিয়েছিলাম মা। ওখানে প্রচুর মশা জানো তো। ইদানীং টের পাচ্ছিলাম শরীরের রক্ত একটু বেশি হয়ে গেছে। কোনো ইনজেকশন ব্যতীত কি করে শরীরের রক্ত কমানো যায় সেই পদ্ধতি আবিষ্কার করে শরীরের রক্ত কমাতে গিয়েছিলাম।”
আশা হতভম্ব বদনে ছেলের পানে চেয়ে,
“ তুই কবে থেকে বিজ্ঞানী ট্যাগ গায়ে লাগিয়ে গবেষক হলিরে গাঁধার বাচ্চা? “
“ এই তো আজকে থেকে।”
“ তোকে আজ জন্মের মতন বিজ্ঞানী হওয়ার স্বাদ ঘুচাবো হতভাগা দাঁড়া।আমার খুন্তি কোথায় ।”
আশা এদিক ওদিক চায়।কিছু খোঁজার তাগিদে।
সাদাফ আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ায়।এক দৌঁড়ে রুমের দরজা দেয়। আজ সে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মার খেতে খেতে সত্যিই তার জীবন শেষ হবে, পরিষ্কার সে ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছিলো।
আদ্রিতের ধমকে ধমকে অতিষ্ঠ করায় মাহরিসা
চোখ ভিঁজে আসে।
সেই মোতাবেক নাক টানতে হয় পুনরায়।
মাহরিসা থেমে থেমে সুধায়,
“ আপনি একটা সাইকো আদু ভাইয়া।”
মাহরিসার নাক টেনে কথা খানা বলতে দেরী দৌঁড় দিয়ে বাসায় ভেতরে ঢুকতে দেরী নেই।
আদ্রিত সেই পানে চেয়ে রহস্যময় হাসে।
মাহরিসা রুমে আসতেই মেসেজ আসে,
“ অনুমতি ব্যতীত দৌঁড়ে পালিয়েছিস ভালো কথা।
আমি সাইকো সেটা তুই জানিস, দ্যাট’স গ্রেইট।
সেই মোতাবেক শাস্তি গ্রহন করতে এই মুহুর্তে তুই বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে থাকবি আঁধা ঘন্টা। গট ইট।নয়তো তোর কপালে শনি আছে।”
মাহরিসা চোখ বড় বড় করে চায়।
দৌঁড়ে বেলকনিতে গিয়ে সে আদ্রিতের গাড়ির হদিশ পায় না।তারমানে কি লোকটা চলে গেল?
তবে কি ঘোড়ার ডিম ফেলতে সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। আশ্চর্য।
প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয় মাহরিসার।
পরদিন ভার্সিটিতে নাওমীর সাদাফের সঙ্গে দেখা হতেই সে সালাম দেয়।
“ আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন ভাইয়া?”
নাউডুবা চশমিশের হঠাৎ এমন আমূল পরিবর্তনে নীবিড় চোখ বড়বড় করে চায়।
সাদাফ হেসে বলে,
“ আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো নাওমী? “
“ আলহামদুলিল্লাহ। আমায় চিনতে পেরেছেন ভাইয়া।”
সাদাফ মুচকি হেসে বলে,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি।সেদিন নীবিড়ের সঙ্গে তোমার ক্যান্টিনে ঝামেলা হলো না দেখেছি আমি।চিনতে পেরেছি।”
সেদিনের ঘটনা মনে হতেই নাওমী নীবিড়ের পানে চোখ ছোট ছোট করে চায়।
নীবিড় এতটা সময় তার পানেই চেয়ে ছিলো।
নাওমী তাকাতেই সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নেয়।
জন মানবহীন রাস্তার পাশ দিয়ে মাহরিসা হাঁটছে।
মাঝে মাঝে দু একটা রিক্সা তার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে কিন্তু তার তাতে চরে বসতে একদমই ইচ্ছা করছে না।
আচ্ছা এই পাঁচ,ছয় কিলো রাস্তাটুকু সে হেঁটে পাড় করলে কেমন হয়?
তাহলে পায়ের কষ্ট আর শরীরের ব্যাথা টুকু কি তার মনের কষ্টকে লাঘব করতে সফল হবে?
এতদিনে মাহরিসার হৃদয়ে ক্ষীণ অনুভুতি জাগ্রত হতো আদ্রিতের প্রতি।
সঙ্গে খানিকটা সন্দেহ হতো তার আদু ভাইয়া তাকে পছন্দ করে কি না?
কেউ যদি কাউকে পছন্দ নাই করবে তবে একজনের প্রতি অপরজনের এত রাগ জেদ সে খাটায় কোন অধিকারে?
মাহরিসা একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট, হয়তো সে একটু বেশিই ইমোশনাল, অল্পতেই ভেঙে পরে তার মানে তো এই নয় সে বোকা।
সমাজ তাকে বোকা ভাবলে তাতে তার কি দোষ।
কিন্তু আজকে আদ্রিতের কিছু কথা শ্রবণ করে সে স্তব্ধ।
এই তো খানিকক্ষণ আগের ঘটনা।
একটা প্রশ্ন জানার তাগিদে সে গিয়েছিল আদ্রিতের চেম্বারে।
কিন্তু কিছু অযাচিত কথার বানে তার আর ভেতরে ঢোকা হয় নি। ফিরে আসতে হয়েছে বাহির থেকেই
সম্ভবত আদ্রিত আর স্মৃতি দুজনের কথোপকথন হচ্ছিল। খুব গভীর আলাপ। মাহরিসা থমকে যায়।
স্মৃতি আদ্রিতের উদ্দেশ্যে সুধালো,
‘ছোট মেয়েটার সঙ্গে এত নাটক কেন করছো আদ্রিত? কেন গেম খেলছো?”
“ সেই প্রশ্নের জবাব তোমায় দিতে হবে আমায় স্মৃতি? “
“ অবশ্যই। দিতেই পারো।আফটার অল ওদেশে তোমাকে কোম্পানি দেওয়ার জন্য তোমার সঙ্গে আমিই ছিলাম।
কিন্তু তুমি দেশে এসে বোকা মেয়েটাকে পেয়ে আমায় ভুলেছ। ওকে নিয়ে খেলছো।
কেন এমন টা করছো আদ্রিত? মাহরিসাকে সব বলে দাও।”
“ আমি কি করবে না করবো সেটা তোমায় বলবো না। আমি গেম খেলছি না খেলবো সেটাও তোমায় বলবো না। দ্যাট’স নান অফ ইওর বিজনেস।”
দুজনের কথপোকথনের মাঝে নিজের নামখানা শ্রুতিগোচর হতেই মাহরিসা থমকে গিয়েছিল।
তার মানে স্মৃতি ম্যামের উদ্দেশ্য করে বলা মেয়েটা সে? আদ্রিত তার সঙ্গে কিসের গেম খেলছে?
কিসের নাটক করছে তার সঙ্গে?
কি সব হচ্ছে তার সঙ্গে।
পাগল পাগল লাগছে মাহরিসার নিজেকে।
নিজের প্রতি নিজের রাগ, জেদ, তীব্র হয়।
আজ কয়েকটা ক্লাস শেষে নাওমী,কাশফি আর অদিতি বাহিরে বের হয়।
কলিডর দিয়ে হাঁটার পথে নীবিড়ের দেখ পায় তারা।
নীবিড় তাদের সামনে হাঁট ছিলো।
নাওমী সেটা লক্ষ করতেই কাশফি আর অদিতির হাত টেনে ধরে।
কারো ফোন আসায় নীবিড় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে।
নাওমীর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপে।
সে সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যাগ থেকে দুতো খাতার পেজ ছিঁড়ে ততক্ষণাৎ হাতে নিয়ে মুঠপাকিয়ে শক্ত বল বানায়।
নাওমীর কার্যে অদিতি আর কাশফি আঁতকে উঠে বলে,
“ এই কি করছিস? পাগল হলি নাকি।”
“ হুশ দেখতে থাক শুধু। শুধু আমি গো বললেই দৌঁড়ে ওপাশের কলিডরে আড়াল হবি।
মহিষের বাচ্চার আজ গুষ্টির ষষ্ঠী করবো।”
নাওমী তার হাতে থাকা দুটোর মাঝে একটা বল নীবিড়ের পিঠে ঢিল ছুঁড়েই দেয় দৌঁড়।
অগত্যা উপায় না পেয়ে ওরা দুজন ও দৌঁড়ে লুকায়।
নীবিড় নিজের পিঠে কিছু অনুভব করতেই পিছু ঘুরে চায়।
কাগজের বল দেখে তার চোখমুখ আপনাআপনি কুঁচকে যায়।আশ্চর্য কেউ কি তার সঙ্গে রসিকতা করছে নাকি।
“ কোন হালার পো রে। ফাজলামো পেয়েছে নাকি।”
আরো একটু সামনে আগালেও নীবিড় কাউকে খুঁজে পায় না।
অগত্যা নীবিড় সামনে আগায়।
নাওমী উঁকি মেরে নীবিড়ের রিয়েক্টশন দেখে আবারো শয়তানি হাসে।
দ্বিতীয় বলটি ছুঁড়তে নেবে তার আগেই পেছন থেকে পুরুষালী গম্ভীর স্বর ভেসে আসে।
“ কি হচ্ছে এখানে?”
জাওয়াদের কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই চোখ বড় বড় করে নাওমী সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাতের বলটা সে চটঅদিতির হাতে ধরিয়ে দেয়।
অতঃপর দাঁত কেলিয়ে মেকি হেসে অদিতি আর কাশফিকে নিয়ে সামনে ঘুরে। যেন তাদের থেকে ইনোসেন্ট কেউ নেই।
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১৮
অদিতি পরপর ঘটনায় তাজ্জব বনে হতভম্ব দৃষ্টিতে একবার জাওয়াদের পানে চায় তো একবার নাওমীর পানে।
বেয়াদব টা সব রেখে তাকে ফাঁসালো।ইয়া খোদা।