ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৩৭
মাহিরা ইসলাম মাহী
ঘড়িতে সকাল ছয়টা তখন।কাকডাকা ভোর যাকে বলে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার একটি কাক-পক্ষী ও ডাকছে না আশেপাশে। অদ্ভুত না?
নিস্তব্ধতার মনে হচ্ছে বড্ড মাতলামো করে ফেলেছে সে আজ।
অজানা উত্তেজনায় বার বার গলা শুকিয়ে আসছে তার।
ওসমান ভিলার পরিবেশ এই মুহুর্তে বেশ উত্তপ্ত।
নিস্তব্ধতা আর সাদাফ ওসমান ভিলার সকলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে।
সুজন আর আশা এসেও হাজির হয়েছে।
একপাশে সোফায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসা স্বয়ং আদ্রিত নিজে ওও।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে পরখ করছে আসামীর ন্যায় দুই কপোত-কপোতী কে।
লুকোচুরি খেলায় ধরা পরে গেছে দুজনে।
“ আমরা দুজনে বিয়ে করতে চাই বাবা।”
নিস্তব্ধতা দৃঢ়তার সঙ্গে চায় নিস্তব্ধ’র পানে।নিস্তব্ধ ড্রয়িংরুমে নিস্তব্ধতার হঠাৎ বাক্যলাপে সকলে যেন একটু নড়ে চরে বসলো।
নিস্তব্ধ মেয়ের পানে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ।এরপর লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল,
“কিন্তু এখন তো সেটা সম্ভব নয় মামনী।দুদিন পর সাদাফের জন্য মেয়ে দেখতে যাবো আমরা। পছন্দ হলে ওটাই ফাইনাল। বড্ড দেরী করে ফেলেছ যে তুমি মামনী।”
“ কেন সম্ভব নয় বাবা? মেয়ে দেখতে যাবে বিয়ে তো হয় নি না?”
“কিন্তু নীরু তোমার বিয়ে যে আমরা জাওয়াদের সঙ্গে ফাইনাল করে ফেলেছি।তুমি তো জানো সবটা।”
এবারে তাসফি কথা বলল।
নিস্তব্ধতা যেন আকাশ থেকে পরলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আমি জানি মা?”
“ অবশ্যই তোমার জানার কথা, যেখানে ভার্সিটির সকলে জানে।”
“ এভাবে ব্লেইম দিতে পারো না তোমরা আমায়।আমার উপর জোড় করে কিছু চাপাতে পারো না তোমরা।ভার্সিটির সবাই জানে প্রফেসর জাওয়াদের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা, অথচ আমিই জানিনা ব্যাপারটা হাস্যকর নয় কি বাবা, মা?”
“ উহু একদমি নয়।কারণ সেবার তোমার মা আর আঙ্কেল যখন তোমাদের দুজনের বিবাহ ঠিক করেছিল তোমরা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দিয়েছিলে।এখন তো কোনো কাহিনী শুনবো না।”
নিস্তব্ধতা ভাইয়ের দিকে চাইলো করুণ চোখে।
তার চোখে আকুতি,
“ নিজে বিয়ে করলে ঠিকই এখন নিজ বোনের বেলায় কিপ্টামি করছো এটা তো ঠিক নয় ভাই।”
আশা সাদাফের হাত চেপে ধরে বসে।
ফিসফিস করে ছেলের কানের কাছে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ এই হচ্ছে তোর আর্জেন্ট তলব তাইনা।বন্ধু ডাকছে? বন্ধু না বান্ধবী হুম।সোজা বিয়ে? এই মা কে না নিয়ে? কুপিয়ে খুন করবো তোকে আমি হারামজাদা।”
সাদাফ অসহায় মুখ করে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে সকলের পানে।
সাদাফ মুখ খুলছেনা দেখে নিস্তব্ধতা আগুন চোখে তার দিকে চেয়ে।
সারারাত একটু খানি ঘুমানোর ফলে দুজনের চোখ লাল হয়ে আছে।
তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকার দরুণ ঘাড় ব্যাথা করছে।কোন পাপের শাস্তি তারা ভোগ করছে কে জানে।
এই তো ঘন্টা কয়েক আগের ঘটনা।
নিস্তব্ধতা সাদাফকে টানছিল বিয়ে করতে নিতে।
গিয়েছিল ও দুজন কাজী অফিসে।কিন্তু হায় ভাগ্য তাদের সহায় হয় নি।
না তো খোলা কাজী অফিস আর না তো আছে কাজী।
বিয়েটা হবে কেমন করে?
তার তো ভাইয়ের মতন এত পাওয়ার নেই যে ঘুমন্ত কাজীকে জাগ্রত করে বরকে থাপড়ে থাপড়ে বিয়ে করবে।
নিস্তব্ধতা সাদাফকে ফিরতে দেয়নি বাড়িতে। পুনরায় এনে বসিয়ে রেখেছে ওসমান ভিলার সামনে।
বাইকের দু পাশে দুজনে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে।
ক্ষণে ক্ষণে মশার কামড় খাচ্ছে সে।
ঠাস ঠাস করে থাপ্পড়ের শব্দ হচ্ছে এক একটি মশা মারার সঙ্গে সঙ্গে।
“ তুই একটা কুফা সাদাফ।”
“ আমি?”
“ অবশ্যই। যেদিন থেকে জীবনে এসেছিস জীবনের কুফা নড়ছে না এক চুল ও।”
“ ওকে চলে যাচ্ছি। থাক তুই নীরবতার বাচ্চা ।”
“ খবরদার এক পা বাড়িয়ে দেখ সজনেডাঁটার বাচ্চা তোর ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেব আমি।”
“ তুই কে আমার ঠ্যাং ভাঙার? হাত ছাঁড় আমার।”
“ ছাড়বো না কি করবি তুই?”
“ তোর জাওরার কাছে যা না তুই। যা গিয়ে বস বিয়ে। আমার কাছে কি? আমি কে তোর।আর হ্যাঁ বিয়ের আগে আমার টাকা দে।দে টাকা দে। আমার টাকা পরিশোধ করে তুই বিয়ে বসবি খবরদার। ”
নিস্তব্ধতা দাঁত কেলিয়ে হাসলো,
“ দেব তো।যেই টাকা টা তুই কাবিনে লিখবি ওটাই তোর।”
“ তোকে বিয়ে করবে কে ওই জাওরা টায়।”
“বাজে কথা বলবি না।”
“ ওও এখন বুঝি বাজে কথা তাই না? জাওরাটা যখন তোকে নীরু ডাকে তখন খুব ভালো লাগে তাইনা? মনে লাড্ডু ফুটে খুব হুউম?”
নিস্তব্ধতা হাসলো।
“ তা তো অবশ্যই। “
সাদাফ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে তাকে।
রাত বাড়ে, একই সঙ্গে বাড়ে চারপাশের নিঃসঙ্গতা। দুজন কপোত-কপোতী দু দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে।অজানা অভিমানের পাল্লা ভারী হয় তাদের মাঝের।অথচ অজানতেই ঘোরের মাঝে দুজনের কাঁধ একত্রিত হয় একে অপরের ছায়ায়।
“ হতভাগা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘুমানো হচ্ছে তাই না? কেন বাড়ির অভাব পরেছে তোদের। তা বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে রাস্তায় নেমে গেলি বুঝি।”
সাদাফের ঘুম ঘুম ভাঙে বাবা মায়ের তীর্যক স্বরে।
এরপর দুজন গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায় সোজা ওসমান ভিলার ভেতরে।
নিলয় সাহেব বললেন,
“ দিদিভাই তুমি কি সাদাফ দাদাভাইয়ের নামে মামলাটা এবার করেই ফেলবে নাকি? কি বলো?
দেখ যা ভালো বুঝো।”
সুজন আর নিস্তব্ধ চোখ ছোট ছোট করে চায় নিলয় সাহেবের পানে।
সুজন আহাজারি করে বলল,
“ আঙ্কেল আমার হতভাগা ছেলেটাকে আর ভোগাবেন না।আপনারা আপনার নাতনীর বিয়ে দিন ঠিকঠাক, আমরা আমাদের ছেলে বিয়ে দেব পরশু।”
নিস্তব্ধতা একপলক সাদাফের পানে চেয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল নিজ রুমে।
সুজন, আশা ছেলেকে রেখেই বেরিয়ে গেল।
রুমে ফিরলো নিলয় সাহেব নিস্তব্ধ, তাসফিও।
সাদাফ একা অসহায় মুখ করে বসে রইলো সোফায়।
আদ্রিত এগিয়ে এলো তার দিকে,
“ ব্রো..”
“ ভালোবাসিস আমার বোনকে? কেন বিয়ে করবি তাকে?”
“…. “
“ আমি কিন্তু লক্ষ করেছি সাদাফ তুই বিয়ে করবি না একবারও শিকার করিস নি। তার মানে কি দাঁড়ালো? এত অনুভূতি তবে সেদিনের নিষেধাজ্ঞা তবে কেন সাদাফ? জবাব দে।”
সাদাফ হাসলো জবাব দিলো না।
“ পরশু যে আশা মা তোকে মেয়ে দেখাতে নিবে এটা শিওর থাক।”
সাদাফের ইচ্ছে হলো পাশে থাকা ফুলটানি দিয়ে নিজের মাথায় সে নিজেই একটা বাড়ি মারে।
নীরু টা দিন দিন এত বেয়াদব হচ্ছে না। তার হাড় মাংস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা করে খাচ্ছে।
ধরণীর বুকে রাত নেমেছে পুনরায়। অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে সমস্ত আলোটুকুকে।
তবে কে বেশি শক্তিশালী? আলো?নাকি অন্ধকার?
কিন্তু এই অন্ধকারটুকুকেও যে সূর্যিমামা খুব ভোরে গ্রাস করে নেবে।
তবে কি দাঁড়ালো।
হিমেল হাওয়ায় নাওমীর ভাবনার ছেদ ঘটে।
সে দাঁড়িয়ে ছাঁদে।
বিদ্যুৎ নেই।
রুমে ভীষণ গরম।তাই তো একটু বেরিয়েছে শীতল হাওয়ার খোঁজে।
হঠাৎ পুরুষালী থাবায় নাওমী হকচকায়।গোলগোল চোখে তার সামনে দাঁড়ানো বেয়াদব ছেলেটার পানে চেয়ে।
নীবিড় তার দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেলিংয়ের সঙ্গে চেপে ধরে।
“ সমস্যা কি তোমায় মিস নাউডুবা চশমিশ। আমায় ইগনোর কেন করছো?”
“ ফর কাইন্ড ইউর ইনফরমেশন আমি কাউকে ইগনোর করছি না।”
“ তাই?”
“ ইয়েস।আর হ্যাঁ আপনি বলছিলেন না আমার প্রেমিক আছে? তাই তো প্রেমিক কে সময় দিচ্ছি ইদানীং। ধূলো ময়লার সঙ্গে ফালতু পিরিত করতে চাইছিনা বুঝলেন তো মহিষের বাচ্চা। “
“ হোয়াট? আমায় তোমায় ধূলোময়লা মনে হয় তোমার?”
“ ওমা আমি আপনার সঙ্গে পিরিত টা করলাম কখন শুনি?”
“ মিস নাউডুবা চশমিশ ফাজলামো করছো আমার সঙ্গে তুমি।”
“ এমা ছিঃ ছিঃ মোটেও না।”
“ তাই নাকি? তবে আমিও একটু করি। কি বলো চশ…মিশ,কিছুমিছু ক..কি বলো?”
নাওমী বুঝে উঠার আগে নীবিড় চট করে নাওমীর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিলো।
সরে গেল দূরে মুহুর্তে?
নাওমী হতভম্ব হওয়ার সুযোগ পেল না।
দু চোখের সামনে কিচ্ছুটি দেখতে পাচ্ছে না সে।সব কিছু আবছা।
শুধুমাত্র বাতাসের শো শো শব্দ। নাওমী শুষ্ক ঢোক গিললো।
চারপাশে নীবিড়ের কোনো সারা শব্দ পাচ্ছে না সে।
নীবিড় কি সত্যিই চলে গেল তাকে এভাবে ফেলে? পারলো তাকে এভাবে একা ফেলে যেতে?তার সত্যিই এবারে কান্না পাচ্ছে।
“ নী..বিড়? আপনি কি আছেন?
নীবিড় শুনতে পাচ্ছেন আপনি?
আমি এখানে দেখছেন পাচ্ছেন আমাকে?
নীবিড়?
কোথয়া আপনি নীবিড় আমার কাছে আসুন প্লিজ।ভয় পাচ্ছি আমি নীবিড়।”
নাওমী ডাকলো কয়েকবার অপরপক্ষ থেকে কোনো সাড়া শব্দ এলো না।
নাওমী বুঝতে পারছেনা সে ছাঁদের কোনদিকে দাঁড়িয়ে।
কোথায় তার ঘরটা।কি করে পুনরায় রুমে গিয়ে নতুন চশমা নেবে সে।তার ওপর পশ্চিম পাশে রেলিং নেই।
অসহায় নেত্রে বসে পড়লো সে নিচে।
চোখ বেয়ে গরিয়ে পরতে লাগলো তার অশ্রকণা।
নিজেকে প্রচন্ড অসহায় অনুভূত হলো তার।
সময় কাটলো কয়েকপল।টের পেল একটি পুরুষালী অস্তিত্ব তার পাশে এসে বসেছে। একই সঙ্গে ভেসে এলো তার পরিচিত অসভ্য বেয়াদব ছেলেটার হেঁয়ালির সঙ্গে তাচ্ছিল্যপূর্ণ, মিছে গৌরব মেশানো ফিসফিসানো কন্ঠস্বর।
“ আমি কি দেখতে পেলাম জানো মিস নাইডুবা চশমিশ? দেখতে পেলাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবচেয়ে অসহায় মেয়েটা আমায় আকুল স্বর তুলে ডাকছে।তার কাছে ডাকছে।ভীষণ আদুরে অসহায় স্বরে ডাকছে।
নিজ থেকে কাছে ডাকলে তো আমায় নাউডুবা চশমিশ। চ্যালেঞ্জে হেরেছ তুমি।গে হারা হেরেছ।”
নাওমী ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো।
“ তার মানে আপনি এখানে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলেন নীবিড় ?”
কোনো জবাব এলো না।
পুরুষালী অস্তিত্ব তার চোখে চশমা খানা পুনরায় পরিয়ে দিলো।
নাওমী পিটপিট করে চোখ মেলে চেয়ে নীবিড় কে খুঁজতে চেষ্টা করলো পেল না।কেউ নেই। কেউ না পুরো ছাঁদ খালি।
“ আপনি এত নিষ্ঠুর কেন নীবিড়?কেন?”
“ বিশ্বাস করুণ একদিন আপনার ওই ঝকঝকে দাঁত গুলো উঠবোই।অবশ্যই উঠাবো।”
মাহরিসা আজ বেলকনি তে দাঁড়িয়ে আদ্রিতের অপেক্ষায়।
অসভ্য ডাক্তার তাকে হুমকি দিয়েছে আজ বেলকনির দরজা যদি ঠাস ঠাস করে লাগায় নির্ঘাত মাহরিসাকে খুন করবে লোকটা আজ।
ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ তার।
বেচারা আদ্রিত যখন বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য গাছে উঠতে যাবে।
সেই মুহুর্তে থেমে যেতে হলো তার।
কারণ একটাই নীবিড়ের উপস্থিতি।
আদ্রিত ফিসফিস করে বলল,
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৩৬
“ আদ্রিত শেখ ইহজীবনে তোমার শ্বশুর বাড়িতে বাসর করা হবে না।
সালার শ্বশুরের জাত সবকটা শত্রু তোমার।
ছেহ।ঘেন্না ধরে গেল জীবনে।”