ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৫০
মাহিরা ইসলাম মাহী
“জানিস তো নীরু আমাদের জীবনটা বড্ড তিতকুটে। ঠিক মানুষের স্বভাবের ন্যায়।অথচ আমরা ভুলে বসি এই স্বভাবটা আমরা নিজেরাই নিজের হাতে গড়ে তুলি।
সকলে বলে মানুষ চাইলে সব করতে পারে। আসলেই কি তাই?
কিন্তু এই আমাকেই দেখ না আমি তো চেয়ে ও পারলাম না কিছু করতে।
না পারলাম তোকে ভালোবাসতে আর না পারলাম তোর মুখ থেকে ভালোবাসি শিকার করাতে।
সম্মোধন বিহীন চিরকুটের জন্য দুঃখিত।তবে জেনে রাখা ভালো ইহা কোনো চিরকুট নহে।
ইহা একখানা গরুর রচনা।অথচ দেখ না গরুর রচনায় গরুর কোনো অস্তিত্বই তুই খুঁজে পাবি না।
এই পৃথিবীতে ভালোবাসা বাসি হচ্ছে সবচেয়ে নিষ্ঠুর তম কাজ।
এই দেখনা বাবার বন্ধবী আরশী আন্টি এই ভালোবাসা-বাসির চক্করে সিঙ্গেল লাইফ পার করছে।
কত মানুষ দেবদাস হয়ে রাস্তায় ঘুরছে।
কতজন প্রেমিকার বিয়ের শোকে বিষ খেয়ে মরছে।কতজন গলায় ফাঁস নিচ্ছে।
অথচ আমাদের মনষ্যজাতির সেই নিষ্ঠুরতম ভালোবাসাই চাই।
ছোট বেলায় তুই একটা বল হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াতি। তোর সর্বোশক্তি দিয়ে তাতে বিশাল কিক মেরে বাউন্ডারির ওপাশে পাঠাতি।
এরপী বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলতি,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“দেখ সজনেডাঁটা তোর থেকে বেশিদূর গিয়েছে না বল? একদিন দেখবি খবরের কাগজে এই নীহারিকা বিনতে নিস্তব্ধতা’র ছবি বের হবে।শিরোনামে লেখা থাকবে ‘ বিখ্যাত ফুলবলার, আমাদের দেশের গর্ব নিস্তব্ধতা এবারে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কে হারিয়ে এলো। এখন দেখার পালা তার প্রতিভা আর কোন কোন দেশকেও ছাড়াতে পারে?’ তখন তুই দেখবি আর লুচির মত ফুলবি।”
তারপরই তো বাঁধলো বিপত্তি তিয়াশা শত্রুুতা করে তোর পায়ের বিশাল ইনজুরি বাঁধিয়ে দিলো।
ডাক্তার ঘোষণা দিলো বেশি দৌঁড়ঝাপ করা তোর জন্য সম্পূর্ণ নিষেধ।
অথচ তোর ইচ্ছে ছিল একদিন বড় ফুটবলার হবি।আমায় চমকে দিবি।
সেই এক্সিডেন্টের কথা ভাবলে আমি আজও কেঁপে উঠি।
সেমিস্টার ফাইনাল পরিক্ষা চলছিলো আমাদের।আমি পাগল পাগল হয়ে ছুটে গেলাম হসপিটালে। গায়ের টি-শার্ট উল্টো, পায়ের সু দুপায়ে দু রকমের, মাথায় উষ্কো খুসকো চুল।সুস্থ হতে তোর সময় লাগলো দীর্ঘদিন।
অথচ নিজের বুকে বাঁধা স্বপ্নের ডানা ছেটে ফেলে তুই সুস্থ হয়ে আমায় যেই প্রশ্নটা সর্বপ্রথম করলি তা হলো সেমিস্টার কেন মিস দিলাম আমি।
অথচ তুই একবারো খেয়াল করে দেখলিনা আমার করুণ অবস্থা।
তোর এই অবস্থা কার জন্য হয়েছিল বল কার জন্য? আমার জন্যই তো।
আমায় আবেগে ভালোবাসার প্রতিদান তো তিয়াশা তোর উপর-ই এপ্লাই করলো।তবে দোষী কে হলো? সেই তুই কি করে চিন্তা করিস তোকে ফেলে আমি একেরপর এক সেমিস্টার ফাইনাল এক্সামে বসে যাবো?
এত বোকা তুই নীরু।
সেবার আমার জেদে যখন তুই আমার কলেজে ভর্তি হতে বাঁধ্য হলি।
অনয় নামের ছেলেটা তোকে প্রোপোজ করার অপরাধে মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দিলি সেদিন এত ভয় পেয়েছিলাম, কোনোদিন তোকে প্রোপোজ করার সাহস পাইনি।
ইশশ ওভাবে যদি আমারও মাথা ফাটিয়ে দিস।
তোর ইনজুটির আগে ভার্সিটিতে সেদিন নীবিড় যখন ওর ব্যাচমেটকে পছন্দ করে বসলো।তুই ওকে নিয়ে খুব হাসলি, ওকে যখন বললি,
‘ শোন মহিষের বাচ্চা, নিজের ব্যাচমেটের সঙ্গে প্রেম করা আর গু খাওয়া সমান ব্যাপার স্যাপার।এই দেখনা ওই মেয়ে বাচ্চা কাচ্চা পয়দা করে বুড়ি হয়ে যাবে আর তুই ওর বাবার দেওয়া শর্ত মোতাবেক চাকুরীই খুঁজে পাবিনা। তারপর কি হবে? সারাজীবন ভালোবাসার বুক ভাঙ্গা কান্নায় তোকে সিঙ্গেল লাইফ লিড করতে হবে।দিস ইজ ফ্যাক্ট ব্রাদার।জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্রে এমন কাচা খেলোয়াড় হলে হয়? হতে হবে তুখোড় মাপের খেলোয়াড়।’
সেদিনের পর আমি নিজে হাতে কি করে তোকে গু খাওয়াই বলতো।আমার দ্বারা এতবড় একটা ব্লান্ডার করা অসম্ভব ব্যপার ছিলো।
যেই তোর হাতে একটা সুচ ফুটলে আমার ঘাম ছুটে যায় সেই তোকে এত বড় একটা আঘাত দেই কেমন করে বল।
এত বড় কলিজা কি আদৌও আমার আছে?
উহু এই দেখ না বুক চিরেই দেখ, একদম নেই।
এই দেখনা নীরু তোর দেওয়া উপদেশ তোতাবেক তুখোড় খেলোয়াড় আর হতে পারলাম কই।সেই তো তোর প্রেমের জালে পিছলে পড়লাম।শেষ ভুলটা করেই বসলাম।
তুই জানিস এই গরুর রচনা সম্বলিত চিরকুটের অর্ধেক খানি আমি কবে লিখে রেখেছিলাম? ঠিক আরো একবছর আগে।
যেখানে তোকে সামান্য একখানা চিরকুট দিতে আমি এক বছর লাগিয়ে দিয়াম ভয়ে,সেখানে ভালোবাসির মত এত ভয়ংকর একখানা কথা আমি কি করে বলে ফেলি বলতো ঠাস করে?
এই এত এত অপূর্ণ ইচ্ছের মাঝে আমার শেষ ইচ্ছে টা কি জানিস নীরু?
তোর ওই একবার সিগারেট টেস্ট করে দেখা ঠোঁটে চুমু খাওয়া।
এবারে তোর সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হবে দেখেনিস তুই আমার ইচ্ছেটা আমি পূরণ করেই ছাড়বো।
ভার্সিটি তে উঠে সেদিন যখন প্রথমবার সিগারেট তোর ঠোঁটের ছোঁয়া পেল বিশ্বাস কর মনে হয়েছিল এখুনি ওটা ছুঁড়ে ফেলে দেই বুড়িগঙ্গায়।
এত স্পর্ধা ওদের হয় কেমন করে আমি ছোঁয়ার আগে তোর ওই কালচে গোলাপি ঠোঁট ওরা ছুঁয়ে দেওয়ার।
রাগে দুঃখে সেদিন রাতে এক বান্ডেল সিগারেট শেষ করেছিলাম।
পরদিন সকালে ভার্সিটি যেতেই তুই যখন বললি
‘ ঠোঁটের কি করেছিস রে সজনেঁডাটা, তোর ঠোঁট খানায় অমন কালসিটে পড়ে গেছে কেন?’
বিশ্বাস কর এত লজ্জা পেয়েছিলাম।আর বুঝি আমায় ভালো দেখা যাচ্ছে না তোর চোখে।সিগারেট খেয়ে ঠোঁট কালসিটে করার অপরাধে সেদিন পণ করেছিলাম আর কোনোদিন সিগারেট ঠোঁটে ছোঁয়াবো না।
যদি ছোঁয়াতেই হয় তোর ওই ঠোঁট জোড়া গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেবে আমায়।
আমি তখন ওদের দেখিয়ে গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো দেখ তোমাদের চাইতেও নীরুর কাছে আমার ঠোঁটের দাম বেশি। তোমাদের ওও একবার ছুঁয়েছে আমায় ছুঁবে অসংখ্যা অগতিত বার।যতবার ওকে আমি আদর করবো।বড় আদর, ছোট আদর সব সব আদর।আদরের চাদরে ওকে মুড়িয়ে দেব।”
সম্মোধন বিহীন চিরকুট খানা বড্ড তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নিস্তব্ধতা ঠিক যেইখান থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিল ঠিক সেই খানটায় ফেলে রাখলো।
ফিসফিস করে বলল,
“ সাদাফরেএএএ তোর এই ইয়া বড় একটা ইচ্ছে পূরণ হতে আমি দেবই না।কিছুতেই দেব না।
তুই আমায় আর দেখতে পেলে তো।আমায় খুঁজেই পাবি না।
ছোঁয়া তো দূর আর রইলো ঠোঁটে চুমু খাওয়া হুহ।”
নিস্তব্ধতা নিজের পণ রেখেছে।সে ভার্সিটিতে যাচ্ছে না আজ কদিন যাবত।সাদাফ যেদিক দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে সে উল্টোদিকে পালায়।সাদাফ ড্রয়িংরুমে বসলে নিস্তব্ধতা কিচেনে ঢুকে।তার রুমে গেলে বেলকনিতে গিয়ে সাদাফের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়।
ছাঁদে গেলে সে এপাশ দিয়ে বের হয়ে ছাঁদের দরজাটাই লাগিয়ে দেয়।
সাদাফ পারেনা ছাঁদের এককোনায় জড় করে রাখা ইট দিয়ে নিজের মাথা ফাটায়।
জাওয়াদ আর অদিতির প্রেম চলছে তুখোড় গতিতে।
ভার্সিটিতে তাদের সম্পর্কের কথা কেউ জানে না।
বরং নিস্তব্ধতা কে নিয়ে তোলা বিয়ের গুঞ্জন হঠাৎ থেমে গেল কেন সেই চিন্তায় সকলে মশগুল। এদিকে তাদের মারকুটে নিস্তব্ধতা কে তো ভার্সিটিতেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না ইদানীং এর কারণ কি?
অদিতি প্রতিদিনই ভার্সিটিতে আসে।অথচ জাওয়াদের ক্লাসে সে লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারে না।
মেসেজ করে কাছে ডাকলে যায় না।
এই লজ্জা মিশ্রিত মুখখানি সে লোকটার সামনে নিয়ে দাঁড়াবে কেমন করে।
অদিতি নিজ রুমে পায়চারি করছে সমানতালে।
যে লজ্জায় এতদিন লোকটার থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছে।আজ সেই লজ্জারই মুখোমুখি হতে হবে তার দারুণ ভাবে।
রহিমা খালা একটু আগে এসে তাকে রসিয়ে রসিয়ে খবর দিয়ে গেল ‘ আজ আপনের সোনায় সোহাগা সোয়ামী আসবে গো আপামনি।কাপড় টাপড় পিন্দা রেডী হইয়া এক্কেরে পরি সাইজা বইসা থাহেন। আজকে আপনার এইটাই কাম।’
অথচ অদিতি পরি সাজতে পারছেনা।
সে তো চিন্তায়-ই কাহিল।
তার ফোনে মেসেজের টোন বাজে,
“ আসছি মাই লিটল বার্ড।বড় আদরটা আজ কিন্তু চাই মাই লাভ।”
অদিতি এখন কোথায় লুকাবে? কোথায়? বাথরুমে? না ছাঁদে?
শিট,শিট।
তার কি এখন উচিত জাওয়াদ কে ফোন করে অনুরোধ করা।
” জাওয়াদ আপনি আসবেন না প্লিজ।আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে, সঙ্গে ভয়। আপনি আমার কথাটা বুঝতে পারছেন তো।”
আদ্রিত নিজ চেম্বারে বসে আছে।
তার সামনে দীর্ঘ আঁধ ঘন্টা যাবত বসে আছে বিদ্যুৎ।
তার কপালে ঘামের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা।
আদ্রিত বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো।
“ সমস্যা কি কিছু বলবি তুই? বললে বল নয়তো আউট হ।বউকে দেখি না অনেক দিন।বউকে দেখতে যাবো।”
বিদ্যুৎ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“ বিশাল বড় একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছি দোস্ত। “
আদ্রিত ভ্রু কুঁচকে চাইলো।
“ ভাবীর বান্ধবী রোশনীকে দেখে পিছলে পড়েছি দোস্ত।এখন সেখান থেকে একমাত্র তুই-ই আমায় উদ্ধার করতে পারিস।”
“ পিছলে পড়েছিস যখন একা পড়লি কেন ওটাকে দিয়ে পড়তি।”
“ প্লিজ দোস্ত তুই একটাবার রোশনীকে বলে ট্রাই করে দেখবি? প্লিজ? “
তোর কি মনে হচ্ছে আমি এখন আমার ছাত্রীর সঙ্গে তোর বিয়ের ঘটকালী করবো?
“ অফকোর্স করবি, তোর বিয়ের সাক্ষী আমি আর তুই আমার জন্য এইটুকু করতে পারবি না দোস্ত?”
আদ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ বিয়ে করে আর লাভটা হলো কোথায়।তোর ভাবী তো আমায় পাত্তাই দেয় না।”
বিদ্যুৎ চোখ পিটপিট করে চাইলো।
“ ভাবীকে বলিসনি তুই ভালোবাসিস?”
“ উহু।”
“ কেনন?”
“ ইচ্ছে হয়নি।”
“ তোর মত একজন সচেতন ডাক্তারের কাছ থেকে এমন উত্তর মোটেই কাম্য নয় আদু।”
আদ্রিত গরম চোখে চাইলো।
বিদ্যুৎ দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
“ বলছিস? বউয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে সবাইকে সবটা এবার বলে দেওয়া উচিত?”
“ অবশ্যই। “
রাত তখন দশটা প্রায়, মাহরিসার রুমের ভেতর পায়চারী করছে সমানতালে।
তার মনে হচ্ছে সে যে কোনো সময় মারা যেতে পারে।তার বুকের ধুকপুক ধ্বনি ক্রমাগত বাড়ছে প্রায়।নিশ্বাস কেমন বন্ধ হয়ে আসছে।
মনে হচ্ছে এই রাত্রীতে বাইরে প্রখর খড়া।
মাঠঘাটের সঙ্গে সব চিড়ে চৌচির।
একটু আগে নিশান এসে তাকে ভয়ংকর একটি খবর জানিয়েছে।
তার হাত-পা কাঁপছে।
সে ভয় পাচ্ছে এই খবর যদি কোনো ভাবে তার আদু ভাইয়ের নিকট পৌঁছে যায় তবে লোকটা যে প্রলয় ঘটাবে সে নিশ্চিত। কি করে এখন সে সবটা সামলাবে।ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে আসছে।
কাশফির ফোন বাঁজছে।
নীলাদ্র’র ফিরিয়ে দেওয়া সেই ফোনটা।
আজ ব্যাগ খুলে সে চমকে গিয়েছে।নিজ ব্যাগে সে সেম সেম তার ডোরেমনের কভার খানার ন্যায় একটা ব্যাক কভার ওও পেয়েছে।
সে নিশ্চিত এটা তার নয়। এটা নতুন।কারণ তারটা একটু পুরোনো হয়েছে।
সঙ্গে একটানা চিরকুট একলাইনের,
প্রিয় কাশফুল,
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৪৯
“ সারপ্রাইজ। “
ব্যস এতটুকুই।
কাশফি ফোন রিসিভ করে।ওপাশ থেকে গমগমে পুরুষালী কন্ঠ সুর তুলে….