ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৬
মাহিরা ইসলাম মাহী
নাওমী’র ছুঁড়ে দেওয়া গ্লাসে থাকা সমস্ত পানি টুকু এই মুহুর্তে নীবিড়ের পুরো মুখমণ্ডলের সঙ্গে পুরো শরীরে টালমাটাল হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে ।
নীবিড় রাগে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।
ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহুর্তে অসভ্য মেয়েটার গালে ঠাস ঠাস করে কতগুলো চর বসিয়ে দিতে।
রাগে তার সমস্ত মুখমন্ডল লালচে বর্ণ ধারণ করেছে।
এই তো খানিকক্ষণ আগের ঘটনা….
অদিতি, নাওমী আর কাশফি আজ ভার্সিটি এসেই বসে গেছে ক্যান্টিনে খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে।
নাওমী চাউমিন অর্ডার দিয়েছিল।
খাবারের অর্ডার নেওয়ার সময় ছেলেটা কিছুটা বলতে চেয়ে মুখ কাচুমাচু করছিলো।
নাওমী তা লক্ষ্য না করে দ্রুত তারা দিয়ে এসেছিল খাবার গুলো দিয়ে দিতে।
খেতে খেতে তারা লক্ষ্য করলো কতগুলো সিনিয়র ছেলেপেলে এসে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে।
অবাক হয়ে তারা মুখ তুলে চাইলো।
নীবিড় এসে নাওমীর সামনের চেয়ার টেনে বসলো।
পায়ের উপর পা তুলে টেবিলে ভর দিয়ে আয়েশ করে বসলো।খামিকটা টিটকারী ভঙ্গীতে সুধালো,
“ তোমরা জানো না আজ ক্যান্টিন শুধুমাত্র আমাদের জন্য বরাদ্দ? তবুও কেন এসেছ?
স্পিক আপ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নীবিড়ের ধমকে তিনজনে ভয়ে ভয়ে চাইলো।
নাওমী বুঝতে পারলো না ক্যান্টিন তো সবার জন্য উন্মুক্ত তবে শুধু তাদের জন্য কেন বরাদ্দ হবে।
সে ততক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে বলে উঠলো,
“ কেন ক্যান্টিন কি আপনাদের আন্ডারে চলে? যে আপনারা যা খুশি বলবেন আর তাই হবে?কোথায় লেখা আছে আজ ক্যান্টিন শুধু আপনাদের জন্য বরাদ্দ। “
নীবিড় গা দুলিয়ে হাসলো।
যেন ভীষণ মজার কোনো শ্রুতিমধুর বাক্য তাকে শোনানো হয়েছে।
“ওওও রিয়েলি? তো তোমার জন্য কি এখন নোটিশ বোর্ড টানাতে হবে ব্লাক চশমিশ?সো সরি। পারছি না।
নীবিড় হাক ছেড়ে ডাকলো,
এই ছোটু এই দিকে আয় তো।”
ক্যান্টিনে কাজে সাহায্যকারী বারো বছরের ছোটু দৌঁড়ে এলো তার নীবিড় ভাইয়ের হাকডাকে।
“ জ্বী ভাই?”
নীবিড় নাওমীর পানে চেয়ে ইশারা করে বলল,
“ এই ম্যাডাম কে বলিস নি মঙ্গলবার ক্যান্টিনটা শুধুমাত্র সিনিয়রদের জন্য বরাদ্দ? “
ছোটু মুখ কাচুমাচু করলো।
“ তারমানে বলিস নি?”
নাওমী প্রতিবাদ করে বলল,
“ এইটুকু একটা বাচ্চা কি বলবে। ওকে তো আপনারা যা বলতে বলবেন তাই বলবে।”
“ ওহ রিয়েলি? তা মিস ব্লাক চশমিশ আপনাকে কি আমার এখন প্রুফ দিতে হবে?”
“ একদম এসব আজেবাজে নামে ডাকবেন না আমায়।”
“ ওকে ফাইন!নাম বলো?”
“ বলবো না।”
নীবিড় ঝারি মেরে বলল,
“ নাম বলো।”
ধমকে শুনে পাশ থেকে কাশফি ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো,
“ না..নাওমি ওর নাম নাওমী নী..বিত ভাইয়া।”
নীবিড় কাশফির পানে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ তোকে জিজ্ঞেস করেছি? আমার নামের বিকৃতি করতে বলেছি তোকে?”
কাশফি চুপসে গেল।
নীবিড় এবারে নাওমীর দিকে চেয়ে গা দুলিয়ে হেসে তার পাশে থাকা ছেলেপেলের দিকে চেয়ে সুধালো,
“ কি বলেরে শুনেছিস তোরা ‘নাউডুবা চশমিশ’।
নাউডুবা চশমিশ আমাদের আবার নিজের নাউ’য়ে নিয়ে গিয়ে মাঝ পথে ডুবিয়ে না দেয়।”
সবাই হাসতে লাগলো নীবিড়ের কথায়।
নাওমী দাঁতে দাঁত পিষে রইলো।
“ দেখুন। হাঙ্গামা করবেন না।এখান থেকে যান।আমাদের খেতে দিন।”
নীবিড় ভাবলেশহীন ভাবে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।
“ দেখুন ভাইয়া ভদ্র ভাবে বলছি এখান থেকে সরুণ।”
“সরবো না কি করবে? অভদ্র হবে? হও দেখি একটু। প্লিজ বিরক্ত করো না তো। অভদ্র হতে হলে দ্রুত হও।তোমার চারপাশে একটু তাকিয়ে দেখ।আর কোনো জুনিয়র স্টুডেন্ট কে দেখতে পাচ্ছো? তোমায় বললাম তে আজ ক্যান্টিন টা আমাদের। তোমরা যেহেতু অতিথি। একটু বিনোদন নাহয় দিলে।
কি বলিস তোরা?”
“ জ্বী ভাই । হা হাহা।”
নাওমী আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই তারা তিনজন ব্যতীত কোনো স্টুডেন্ট প্রতিদিনকার ন্যায় আজ ক্যান্টিনে উপস্থিত নেই।
নীবিড় চট করে দাঁড়িয়ে খপ করে নাওমীর চোখের চশমাটা খুলে ফেলল।
তার পাশে দাঁড়িয়ে মজা নিতে থাকা নিদ্রাকে সুধালো,
“ এই নিদ্রা দেখতো।মিস নাউডুবা চশমিশ কি সত্যিই কানা নাকি, তবে তো নামটা আরো খানিকটা বড় হবে।মিস কা..না নাউডুবা চশমিশ।
উপস্থিত সকলের হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠলেো।পুরো ক্যান্টিন এরিয়া।”
তীব্র রাগে ফুঁসতে লাগলো নাওমী।
“ আমার চশমা দিন।”
“ ন আকার না।নো মানে না।”
নীবিড়ের বলতে দেরি কিন্তু মহুর্তেই নাওমীর সামনে থাকা বাটির সবটুকু চাউমিন তার মাথায় ঢালতে দেরি নেই। সবটুকু চাউমিন সে নাওমীর মাথায় উবুর করে ঢেলে দিলো।
নাওমীর সমস্ত মুখমন্ডল ধারণ করলো জোকারের আকৃতির ন্যায়।
পুনরায় হাসতে আরম্ভ করলো সকলে।
নাওমী রাগে চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিলো। হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে সামনে থাকা গ্লাসের সমস্ত পানিটুকু নীবিড়ের মাথায় ঢেলে দিলো।
উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো।
নীবিড় দাঁতে দাঁত চেপে চাইলো।
“ইউ…
নীবিড় হাত তুলে চর বসাতে নিতেই
নাওমী শক্ত করে তার হাত খানা ধরে ফেলল।
পেছন থেকে নীলাদ্র চিৎকার করে উঠলো।
“ নীবিড়।”
নীলাদ্র’র ডাকে নীবিড় ভ্রু উঁচিয়ে চাইলো।
“ আমার কাজের মাঝে ব্যাঘাত ঘটাবিনা নীলাদ্র ফল ভালো হবে না।”
নীলাদ্র সে কথার পাত্তা না দিয়ে নাওমীর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার মাথা থেকে লম্বা লম্বা চাউমিন গুলো ফেলতে ফেলতে সুধাতে চাইলো,
“ তোমার কোথাও লাগে নি… “
পুরো কথা টুকু শেষ করার আগেই নাওমী নীলাদ্র’র হাত খানা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
“ ডোন্ট টাস মি।”
বলেই সে হনহন করে হেঁটে চলে গেল।
নীবিড় ঠোঁট কামড়ে বলল,
“ কি ব্যাপার ভাই আমি তো তোর কাজের ব্যাঘাত ঘটাতে যাই না।তবে তুই কেন এসেছিস আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে।বা..বা মিস কানা নাউডুবা চশমিশের এত্ত ঝাঁঝ? গালফেন্ড নাকি তোর?”
নীলাদ্র জবাব দিলো না।সেও হনহন করে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন ছেড়ে।
সাদাফ দৌঁড়ে এলো এদিকটার খবর শুনে।
“ কি ব্যাপার তোর? আবার কার সঙ্গে কি অঘটন ঘটিয়েছিস? নিষেধ করিনি তোকে এসব করতে।”
“ আরে চিল ভাই। জীবনে একটু হাসি মজা না করলে কি আর জীবনে একটু ইনজয় করা করা যায় বল।
সাদাফ চিন্তিত মুখশ্রীতে নীবিড়ের পানে চাইলো।
ছেলেটাকে নিয়ে তার মাঝে মাঝে বড্ড চিন্তা হয়।
বড্ড ছেলেমানুষী। কখন না জানি আবার কোনো অঘটন ঘটায়।কে জানে।
নাওমী বাহিরে বেরিয়ে এলো কোনো রকমে।
তার চারপাশের সমস্ত কিছু কেমন ঝাপ্সা ঝাপ্সা।
নাওমী দ্রুত ব্যাগ হাতরিয়ে তার নতুন চশমাটি বের করে নিলো।
আজ বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছে সে।
ভাগ্যিস আরেকটা চশমা সে আজ সঙ্গে এনেছিল।
নাহলে কি করে পথ চলতো সে।
তার চোখে সমস্যা সেই কয়েকবছর আগে থেকেই।
চশমা ছাড়া সবকিছুই তার কাছে ঝাপ্সা।
হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।
নীবিড় না শিবিড় কোথাকার। দেখে নেবে সে তাকে।সিনিয়র হয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি।
নাওমী কোনো রকমে রিক্সায় চেপে বসলো।
রাস্তার মানুষজন তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে উঠছে।
কোনো রকমে সে হস্টেলে পৌঁছাতে পারলেই শান্তি।
মাহরিসা আকাশ পানে চেয়ে ছিলো উদাস ভঙ্গিতে।
হাজারো পড়া তার ঝুলিতে জমে আছে।অথচ কোনো পড়ায় তার মন দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
তার মন কি চাইছে কে জানে।
হঠাৎ ফোনের রিংটনের শব্দে মাহরিসা চমকে উঠলো।
অপরিচিত নম্বর দেখে তার ভ্রুদ্বয় আপনা আপনি কুঁচকে গেল।
মাহরিসা রিসিভ করলো না।
অপরিচিত নম্বর রিসিভ করতে তার বড্ড আলসেমি। কে না কে।রং নম্বর ও হতে পারে।শুরু কথা বলে তার এনার্জি লস হবে।কি দরকার।
পর পর আরো দুবার ফোন এলো। তবুও সে রিসিভ করলো।
বিরক্ত হয়ে সে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিলো।
পাঁচ মিনিট পর পুনরায় সে ফোনটা হাতে নিতেই চমকে উঠলো মাহরিসা। ওও মাই গড দশ বার মিস কলড।
হতভম্ব নেত্রে চেয়ে রইলো নম্বর খানার দিকে।
ওপাশের মানুষটা কি পাগল।
তার ভাবনার মাঝে পুনরায় ফোন বেজে উঠলো।
রিসিভ করে সে কিছু বলতে নিবে, কিন্তু ওপাশের ব্যক্তির তীব্র ঝাঁঝালো ধমকে মাহরিসার আত্ম শুকিয়ে কাঠ কাঠ। এই বুঝি তার কলিজা খানা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পরবে বুকের মধ্যিখানে।
“ ফোন ধরিস না কেন? ফোন যদি আসমানেই উঠিয়ে রাখবি তবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করিস কেন? প্রেমিকের সঙ্গে লুকিয়ে কথা বলতে ফোন লাগে তোর?”
মাহরিসা শুষ্ক ঢোক গিললো। ওপাশের আদ্রিতের গলা চিনতে তার এক সেকেন্ড ও লাগলো না। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“ ফোন সাইলেন্ট ছিলো আদু ভাইয়া?।”
“ কেন তোর ফোন সাইলেন্ট থাকবে কেন? প্রেমিক ফোন দেয় তোকে? বাসার মানুষের থেকে লোকাতে তোর ফোন সাইলেন্ট করা লাগে?”
“ আসতাগফিরুল্লাহ। কিসব বলছেন।আমার কোনো প্রেমিক নেই।”
“ তোর প্রেমিক থাকুক আর না থাকুক তুই এই মুহুর্তে নিচে নামবি।নয়তো শুধু তোর প্রেমিক না তুই নিজেও আস্ত থাকবিনা।”
মাহরিসা হতবাক হয়ে সুধালো,
“ পাগল হয়েছেন আপনি।এই মুহুর্তে আমি কি করে নিআে নামবো সবার সামনে।”
“ খোঁদার কসম, পাঁচ মিনিটের মাঝে যদি তুই নিচে না নামিস আমি উপরে এসে তোকে সোজা বেলকনি দিয়ে নিচে ফেলবো।এরপর পঙ্গু করে ঘরে বসিয়ে রাখবো।”
মাহরিসা আঁতকে উঠলো।
তার আদু ভাইকে দিয়ে কোনো বিশ্বাস নেই।
তীব্র চিন্তায় পায়চারি করতে লাগলো সে।
কি করবে এখন সে। কি বলবে মা কে সে।ভাইয়ের চোখ কি করে ফাঁকি দেবে।
মাহরিসা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“ নিচে গিয়ে কি করবো আদু ভাইয়া?”
“ আমি দাঁড়িয়ে আছি। তোর অলরেডি ওয়ান মিনিট ফিনিস।”
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৫
“ আপনি দাঁড়িয়ে আছেন মানে?”
মাহরিসা বেলকনি দিয়েই উঁকি ঝুঁকি মারলো।কই?
“ তুই আসবি? নাকি আমি আসবো?এ্যাজ ইউর উইস। উপরে আসতে আমার এনার্জি লস হবে। সেই শাস্তি মোতাবেক তোকে নিচে ফেলবো।”