ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৬১
মাহিরা ইসলাম মাহী
রংধনুদের দিনগুলো চলছিলো ভীষণ চমৎকার ভাবে।বিশেষ করে আদ্রিত আর সাদাফের।
সাদাফ অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তার একমাত্র বউয়ের অতিব যত্নের তাগিদে সে যেন সুখের সাগরে ভাসছে। হাত- পা ভেঙেও ঠিক যেন পিঠে দুটো ডানা লাগিয়ে সে ডানা মেলে আকাশে উড়ছে।
নিস্তব্ধতা বসে থাকছে সারাক্ষণ হসপিটালে। শুধু হসপিটালে নয় বরং সাদাফে একদম মাথার নিকটে।
সাদাফের দুষ্টুমিতে নিস্তব্ধতা একবার কাচুমাচু মুখ করে চাইছে তো আরেকবার অগ্নি চোখের দৃষ্টিতে বর্ষণ ঝরাচ্ছে।
আর সাদাফ সে এখন বনেছে বেজায় সাহসী এক যুবক।তার জান প্রাণ সব সাহসে ফেটে পড়ছে।
প্রিয়তমা বউয়ের একটুখানি আদরে বুঝি এভাবেই সকল যুবকের হৃদয় সাহসে ফুলেফেঁপে উঠে।
নিস্তব্ধতা ফ্রেস হতে বাড়ি ফিরে যাবে না বলে একটুখানি গড়িমসি করলেই হয়েছে, তাসফি মেয়ে দিকে এমন ভাবে তাকায় যেন পুরো দুনিয়া শুদ্ধ উলোটপালোট হতে চলেছে।
এক রাম ধমক দিয়ে বলল,
“ যাবেনা মানে টা কি। বেচারা ছেলেটা অসুস্থ। হাত,পা ভেঙে বসে আছে, নড়তে পারছে না, চড়তে পারছে না আর তুমি বলছো যাবে না। ফাজলামো?
কোথায় সর্বক্ষণ তুমি তার যত্ন নেবে তা না ঘরে এসে ঘাপটি মেরে পরে আছো।স্ত্রী হিসাবে তোমার একটা দ্বায়িত্ব আছে নিশ্চয়ই। আর তা পালন করা তোমার কর্তব্য।
আমার তো ছেলেটার করুণ মুখের দিকে চাইলেই মায়া হয়। আহারে সারাক্ষণ হইহট্টগোল করে বেড়ানো ছেলেটা এখন বিছানায় সজ্জা শায়িত।
তোমায় এমন এক চটকানা মারবো না বাপের নাম ভুলে যাবে মেয়ে।
নিস্তব্ধ আহত চোখে চেয়ে বলল,
“ তুমি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারবে বউ।প্রত্যেক ছেলে মেয়ের তার বাপের নামটা মনে রাখা আবশ্যক। এটা তুমি করতে পারো না।”
তাসফি আগুন চোখে চাইতেই নিস্তব্ধ চুপসে গেল।
“ তোমার বাপের অসুখ হলে তো আমি তার কাছ থেকে সরিই না। আর তুমি পালাই পালাই করো সর্বক্ষণ কাহিনী কি।”
নিস্তব্ধ বিরবির করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ হ্যাঁ সেই সেই। নিজে থেকে থাকতে চাও না নেহাৎ আমি জোড় করি বলে।”
মায়ের কথার প্রত্যুত্তর নিস্তব্ধতা করলো না।
বরং হসপিটালের উদ্দেশ্য যেতে যেতে ফিসফিস করে বলল,
“ আমার পালাই পালাই করার অতি গোপন কাহিনী খানা তো তোমায় বলা যাবে না মা।সে যে বড় লজ্জার সঙ্গে সাহসী একটা কাজ।আমি তো এত সাহসী নই।বরং আমায় কুপোকাত করা ছেলেটা আজকাল বড্ড সাহসী হয়ে উঠেছে। আমি তো আমার একমাত্র ভালোবাসা কে যত্ন করতে চাই মা, ভীষণ করে যত্ন করতে চাই। কিন্তু তুমি তো জানো না মা। তোমার জামাই বাবা, বাবার মত ভদ্র ছেলেটি নয়। যে শান্ত ভঙ্গিতে তার যত্ন করবো।বরং সে ভীষণ দুষ্টু, ভীষণ। হাত পা ভাঙা থাকলে কি হবে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত সে প্রগতিশীল।মুখ,ঠোঁট আর ডান হাতটা তার চলতেই থাকে ক্রমাগত,চলতেই থাকে।তোমার মেয়েকে একমুহূর্ত সুস্থ থাকতে দেয় না সে। সারাক্ষণ জ্বালিয়ে মারে। তবে কি করে আমি এত জ্বালাতন সই বলো তো?”
শ্বাশুড়ি মায়ের এই প্রতিবাদে সাদাফ খুশিতে গদগদ। এমন কিউট একখানা শ্বাশুড়ি মা কে তার সালাম করতে ইচ্ছে করে।দীর্ঘ সালাম।কিন্তু এখন তো তা সম্ভব নয় সে তো বিছানা থেকে উঠে নিচু হতে পারছেনা।
একটু সুস্থ হলেই সে বিশাল করে সালাম করবে প্রমিস।
সুজন ছেলের পাশে বসে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“ বাইক নিয়ে ওমন বেদম ধাক্কাটা তোকে কে মারলো বলতো?”
আশা রাগত স্বরে বলল,
“ কে মারলো মানে।আমার পান্ডা তো আপনার মত ভিলেনি বুদ্ধি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না যে কে মারলো কে ছাড়লো তা দেখেছে চোখে দূরবিন লাগিয়ে।ছেলেটা আমার অসুস্থ, একটু সুস্থ হোক তারপর এসব জিজ্ঞেস করবেন। আপনার মাথায় আক্কেলের বড় অভাব দেখছি। যেখানে নীলাদ্র ছেলেটা সুস্থ সবল অবস্থায় পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে পারলো না সেখানে আমার আহত ছেলে বুঝবে কি করে কে ধাক্কা মারলো আর কে ছাড়লো।”
সুজন বিরবির করে বলল,
“ সালার মেয়ে মানুষ মানেই এক কাইন বেশি বুঝে।এদের ক পড়াতে গেলে ক,খ,গ,ঘ সব পড়ে নেয়। তবে পড়তে আসার দরকারটা কি শুনি।
হে দয়ালু এদের মাথায় তুমি আর একটুখানি বুদ্ধি যুক্ত করে দিয়ে দাও।”
আশা ছেলেকে যত্ন করে তরল খাবার খাইয়ে দিচ্ছে।
সাদাফ মুগ্ধ চোখে মায়ের যত্ন দেখে।
তাকে সারাক্ষণ দুঃছাঁই করা অথচ সে একটুখানি অসুস্থ হতেই তাকে নিয়ে চিন্তায় একসার।
মায়েরা বুঝি এমনই হয়।
তারা ছেলেমেয়েদের মন থেকে কখনো বদদোয়া দেয় না। ওসব বকাঝকা সবই যে লোভ দেখানো।
আদ্রিতের দিনগুলো সুখের হওয়ার অন এন্ড অনলি কারণ তার একমাত্র প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী।
ইদানীং মাহরিসা কে সে যা বলছে তাই করছে।সে উঠতে বললে উঠছে আর বসতে বললে বসছে।
এই যেমন আজকে সে মাহরিসা কে বলেছে কালকে ক্লাস শেষে তার জন্য ওয়েট করতে।
মেয়েটা একবাক্যে মাথা নাড়িয়েছে।গড়িমসি করেনি একফোঁটাও।
আদ্রিত কাল তার প্রেয়সী কে নিজ হাতে শাড়ি পরিয়ে কুৎসিত নয় বরং এবারে সুন্দর করে সাজিয়ে বড় একখানা চুমু খেয়ে লং ড্রাইভে বের হবে।সন্ধ্যা রাতে।
যখন আকাশ জুড়ে ঝলমল করবে তাঁরারা,মাথার উপরে চাঁদমামা হাজিরা দেবে বৃহৎ আকারে।
লুকোচুরি শেষে এমন সুখের দিনগুলো তার নিয়তিতে লিখা ছিলো আগে জানলে সে তো আরো বহু আগে বিয়ের কাহিনী সকলকে জানিয়ে দিতো বউয়ের বারণ না শুনে।
বোকা মেয়েটা শুধু শুধু চিন্তা করে মাথা খুইয়েছে।
ইদানীং নীবিড়ের দিনগুলো কেমন পানসে ভঙ্গিতে কাটছে।সাদাফ ব্রো অসুস্থ। নীলাদ্র ঝগড়া থামিয়ে মিত্র হয়েছে।প্রফেসর জাওয়াদের কারণে ভার্সিটি হইচই,র্যাগিয়ের কোনো সুবিধা নেই। আর নাতো করতে পারছে কোনো ইন্টারেস্টিং কিছু করতে।
জীবনটাই কেমন পানছে।
আগে তো নাউডুবা চশমিশের সঙ্গে সে ঝগড়া করতে পারতো কিন্তু ইদানীং তাও পারছেনা। মেয়েটা হঠাৎ কি হলো কে জানে। ভার্সিটি থেকে এসে সেই যে ঘরে দ্বার লাগিয়ে বসে থাকে আর বের হবার নামই করে না।
কাল নাকি সে আবার কোথায় যাবে আসতে কতদিন লাগবে কে জানে।
নীবিড়ের মনে হচ্ছে আগামীকাল থেকে তার দিনগুলো আরো পানসে হবে।
সাদাফ ব্রোর কাছে হসপিটালে বসে থেকে যে আড্ডা দেবে তাও তো সম্ভব নয়। নিস্তব্ধতা আপা আর ব্রো এতদিন পর আলাদা টাইম স্পেন্ড করার সুযোগ এসেছে, সে তো তাতে বাগড়া দিতে পারে না তাইনা।বড্ড দয়ালু কি না সে।সে কাউকে ডিস্টার্ব করে না শুধু তার নাউডুবা চশমিশ ব্যতীত।
তার চশমিশ? আসলেই? ইন্টারেস্টিং তো।
নীবিড় বিরক্ততে গায়ের টি-শার্টটা খুলে ছুঁড়ে ফেলল দূরে।
মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো বিছানায়। আহহ।কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।
সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কি করলে ভালো লাগবে তার? কি করলে।
নাউডুবা চশমিশ কে কি একটু ডিস্টার্ব করে আসবে?
কিন্তু এত রাতে একটা মেয়ের দরজায় টোকা দেওয়া কি ঠিক হবে?
ঘরের মাঝে এনার্জি লাইটের সাদা ফ্যাটফেটে আলোয় হঠাৎ-ই স্টাডি টেবিলের একটি শপিসের পাশে চোখ যেতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল নীবিড়ের।
কাজের মত কিছু না পেয়ে সময় কাটাতে কৌতুহল বশত লম্বা লম্বা পা ফেলে সেদিকেই এগিয়ে গেল সে।
একটা কাগজ।উহু কাগজ নয় চিরকুট, উহু বিশাল চিঠি।
নীবিড়,
আচ্ছা যদি কখনো সে তার অতি প্রিয় সকল আশা ভরসার চশমা খানা হারিয়ে আপনার হাত খানা ধরতে চায় ধরতে দেবেন তাকে নিজের হাত?
চশমা নয় আপনার চোখে নিজের চোখের ভরসা হতে চায় দিবেন তাকে সে ভরসা?
যদি মুষলধারে বৃষ্টিতে চশমা বিহীন সে আপনার হাত ধরে খুশিতে হাসতে চায়, প্রাণ খুলে ভিজতে চায় দেবেন তাকে সে সুযোগ?
জানেন তো নীবিড় ভেবেছিলাম জীবনে কখনো কোনো পুরুষকে ভালোবাসবো না।ভেবেছিলাম কখনো কোনো পুরুষের সঙ্গ আমার এজীবনে দরকারই পরবে না।
ভেবেছিলাম মা কে দেখিয়ে দেব দেখুন মিসেস মান্সা সেন এ জীবনে কাউকে ভালো না বেসেও আমি ভীষণ ভালো আছি। ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ ভালো আছি।অন্তত আপনার মতন মিথ্যা ভালোবাসার দোহায় দিয়ে কাউকে ঠকাইনি।
করিনি কারো সারাজীবনটা ধ্বংস। ভাঙিনি কারো সংসার।
কিন্তু দেখুন নীবিড় সেদিন ভার্সিটিতে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে নিজের সঙ্গে করা আমার প্রতিটি ওয়াদা একে একে ভঙ্গ হতে লাগলো।
কোনোদিন পুরুষ মানুষ লাগবে না বলা, মনে মনে পণ করে আসা এই আমার আপনি নামক ছেলেটাকে সর্বক্ষণ দরকার হলো।
নিঝুম রাতে, রাস্তায়,সাহায্যে,বৃষ্টির দিনে,ভার্সিটিতে সর্বক্ষণে। সব সময়।এমনি আমি যেই আস্তানায় থাকছি সেথায়ও।
আমার জীবনে এসে এলোমেলো সব কেমন করে যেন মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিলেন।
কি বলুন তো আমরা জীবনে যা ভেবে রাখি সব সময় তা ফলাতে পারি না।
এই আমাকেই দেখুন না কি ভেবে ছিলাম আর কি হয়ে গেল।আমার পরাণ পাখি অজানতেই উড়ে গেল আপনার কাছে।সে কি পারতো না খাঁচায় থাকতে? পারতো তো। কিন্তু থাকলো না তো।
আমি আমার পরাণ পাখিটা ফেরত চাই নীবিড় এখুনি চাই।এখুনি মানে এখুনহ।অতঃপর হারিয়ে যেতে চাই দূর অজানায়।আমার সঙ্গ দেবেন তো নীবিড়। হবেন আমার দৃষ্টি হারা ভরসার সঙ্গী?
ইতি
বলে কয়ে নাম দিয়ে বোঝাতে চাই না।
সবকিছু যে বলে বলে হয় না নীবিড়। বুঝতে হয় হৃদয় দিয়ে।
বিদ্রঃ চিঠিখানা আপনার জন্য ছিলো না নীবিড়। ১.চিঠি খানা ছিল আমায় বোকা বানিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে চট করে এই বোকা রমণীর গালে চুমু খেয়ে ফেলার মত ভয়ংকর কাজ করার মতো সাহসী এক যুবকের জন্য।
২.এই চিঠি খানা ছিল এই বোকা রমণীর বোকাত্বের সুযোগ নিয়ে ঝুম বর্ষণে কায়দা করে তার চোখের সুযোগ নিয়ে রমণীর আপাদমস্তক দীর্ঘক্ষণ অবলকন করা সাহসী যুবকটির জন্য।
৩.এই চিঠিখানা সেই যুবকের জন্য যে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে ভালোবাসে।কিন্তু ভালোবাসি কথাটা বলতে ভালোবাসে না।
ভালোবাসে ঝগড়া করতে।আর ঝগড়া করতে ভালোবাসে বলেই ভালোবাসে।বুঝলেন মাথামোটা মহিষের বাচ্চা।
নীবিড়ের ভেজা দু চোখের পাতা কোনো রকমে হাতের কব্জি দিয়ে মোছার বৃথা চেষ্টা চালালো সে।
চিঠি পড়া শেষে নীবিড় আর একমুহূর্ত ওও দাঁড়ালো না।এই শীত শীত মৌসুমে উদোম গায়ে ছুটলো সে ছাঁদের উদ্দেশ্যে।
শীত কি লাগছে না তার? কই লাগছে না তো।
চোখের সামনে পেছন থেকে নাওমীর শাড়ির আঁচল খানা দৃষ্টিগোচর হতেই নীবিড় হাঁটুতে ভর দিয়ে হাপাতে লাগলো।
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৬০
একটু আগের কান্নারত যুবকটি হাসতে আরম্ভ করলো। প্রাণ খোলা সে হাসির ধরণ।
তার ওমন প্রাণখোলা হাসি নাওমীর কাছে মনে হলো ডাকাতেরা ঠিক চুরি করার আগে যেমন হারে,রে.রেএএএ করে উঠে,নীবিড়ের যেন ডাকাতি করার সেই আগের মুহুর্তের গোপন বার্তা।
নাওমী বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,
“ এভাবে পাগলের মত হাসছেন কেন আপনি? আশ্চর্য! হাসের মাংশ খেয়েছেন? পাবনার পাগলা গারদে ভর্তি করে দিয়ে আসতে হবে?”
