ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৬২
মাহিরা ইসলাম মাহী
সূর্যিমামার উত্তপ্ততা মাথার উপরে জেঁকে বসেছে।
ভোরে কিংবা গভীর রাতে শীত শীত আবেশে আচ্ছাদিত প্রকৃতি, অথচ সারাটিদিন সূর্যিমামার কঠোরতায় মোড়া।
আদ্রিতের কথা মতন মাহরিসা কলেজের গেটের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
লোকটার হঠাৎ তাকে তলবের কারণ বুঝতে পারছে না।
মিনিট কয়েক কাটতেই আদ্রিতের নীল রঙের প্রাইভেট কারটি মাহরিসা’র সামনে এসে দাঁড়ালো। কদিন আগেই না দেখলো রঙটা কালো।হঠাৎ ব্লু হলো কেমন করে? অবশ্য নীল রঙ মাহরিসার সবচাইতে পছন্দের।
মাহরিসার সুদর্শন ডাক্তার মহাশয় নেমে এসে ফ্রন্ট সীটের দরজা খুলে দিলো।
“ উঠ।”
রমণী আড় চোখে চায়।আদ্রিতের পড়নে কালো টাউজার,সাদা টি-শার্ট। এসব নরমাল ড্রেসআপে কোথায় যাবে তাকে নিয়ে লোকটা?কে জানে।
“ উঠতে বলেছি তোকে কানে যায়নি?“
মনের ভেতর কুন্ঠা নিয়ে মাহরিসা নিঃশব্দে উঠে বসলো গাড়িতে।
গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো অচেনা পথে।এ পথ মাহরিসা চেনে না।
সে আড়ষ্ট কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“ আমরা কোথায় যাচ্ছি? “
“ বাসর করতে।”
মাহরিসা চোখ বড়সড় করে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
“ লজ্জা পাচ্ছিস যে বড়? কিছু বলেছি তোকে?”
মাহরিসা বিরবির করে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ কিছু না বলেও যে আপনি বিশাল সাংঘাতিক কথা বলে ফেলেছন আদ্রিত ভাই।”
আদ্রিত কন্ঠের টোন পাল্টে বলল,
“বিরবির করবি না জান,যা বলার মুখে বল। তুই আর আমিই তো তাইনা।আর কেউ তো নেই আমাদের মাঝে। শুধু তুই আর আমি ওকেহহহহ…”
আদ্রিতের নেশাক্ত কন্ঠের ধারালো অস্ত্রে মাহরিসা একবার চোখ বন্ধ করে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে তো একবার এক হাত দিয়ে অপর হাত ঘসতে লাগলো।
নাহ তবুও শান্তি হচ্ছে না। বরং বুকের ধুকপুকানি বেড়ে চলেছে দ্বিগুণ গতিতে।
গাড়ি এগিয়ে চলল অচেনা পথ ধরে।
হাইওয়ে ছাঁড়িয়ে, শহর ছাড়িয়ে গ্রাম্য একটি এলাকার মতন জায়গায় একটি চায়ের দোকানের সামনে আদ্রিত গাড়ি থামালো।
মাহরিসা মুগ্ধ নয়নে চারপাশ অবলোকন করতে ব্যস্ত।আশে পাশে কেমন সবুজে সবুজে সবুজারণ্য।
মাহরিসা কৌতুহলী চোখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে সুধালো,,
“ এখানে কেন নামলাম আমরা? হাঁটবো? সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে? সত্যিই?”
মাহরিসার কন্ঠে ব্যাকুলতা।প্রেয়সীর উৎফুল্লতায় আদ্রিত হাসলো।
মুচকি হেসে বলল,
“ উঁহু। চা খেতে।”
“ চা খেতে?”
“ হুম। নেমে আয়।এখানকার মালাই ভাইয়ের মালাই চায়ের দারুন টেস্ট। “
“ মানুষের নাম মালাই হয় বুঝি?”
“ হয় তো।”
মাহরিসা টিপটিপ করে চেয়ে গাড়ি থেকে নামলো।
সাদা অ্যাপ্রনটা গাড়িতে উঠেই খুলে রেখেছে সে।
তার পরণে এই মুহুর্তে সবুজ থ্রি পিচ। তার নাদুসনুদুস শরীরে ফুটে আছে বেশ। চারপাশে সবুজ তার মাঝে সুন্দরী সবুজ যুবতী।আদ্রিত বুঝতে পারছেনা কাকে রেখে কাকে দেখবে সে?
গাড়ি থেকে তুলে মাহরিসার গলায় ওড়নাটা দিতে দিতে রাগত স্বরে বলল,
“ ওড়নাটা গায়ে জড়াবে কে? আমি? খেয়াল থাকে কোথায় তোর?ইডিয়েট।”
মাহরিসা মনে মনে বলল,
“ কেন আপনি তো আছেন আমার ওড়না ঠিক রাখার জন্য । আর এই যে একমাত্র বউয়ের দ্বায়িত্বটাও নিতে শিখে গেছেন কেমন করে।”
আদ্রিত চমকপ্রদ কন্ঠে চিৎকার করে বলল,
“ মালাই মামা দুটো স্পেশাল স্পেশাল মালাই চা দেবেন দ্রুত।বউ নিয়ে এসেছি বুঝতেই পারছেন।একটু স্পেশাল। “
মালাই মামা হাসলেন। সেও চিৎকার করে বললেন,
“ বহুত দিন পরে আইছেন ভাইজান। দিতাছি, দিতাছি বউদিমনির জন্য এখুনি দিচ্ছি এই মালাই মামার স্পেশাল মালাই চা।একদম চিন্তা করবেন না।”
“ বউ!”
কার বউ সে? তার একমাত্র আদু ভাইয়ের? হ্যাঁ তাইতো।
মাহরিসা অবাক চোখে চেয়ে।আদ্রিত কে এমন হাস্যরসাত্নক ভঙ্গিতে কথা বলতে সে কখনো দেখেনি।
লজ্জা মিশ্রিত বদনে মাহরিসা নামলো।
পাশা-পাশি দু’জন কপোত-কপোতী বসে চা খেলো।
হাসলো,কথা বললো।ইয়ার্কি ফাজলামি চলল সমান তালে।
খালি পায়ে হাতে হাত ধরে ঘাসের মাঝে নিজেদের পা’জোড়াকে বিলিয়ে দিলো।
হাতখানি ধরার সময় রমণী লজ্জায় মূর্ছা যায়।আর আদ্রিত সে দৃশ্য নিজ চক্ষু দিয়ে অবলোকন করতেই ব্যস্ত।
দু’জনের মুখশ্রী প্রাণোচ্ছল।
আদ্রিতের মুখশ্রী হতে হারিয়েছে গম্ভীরত্ব আর ধমকের লেশ।
আদ্রিত যেন আজ নিজেকে সর্বোচ্চ বেহায়ার খেতাব আর মাহরিসাকে ভুল প্রমাণের সঙ্গে অবাক করার মিশনে নেমেছে।
এ যেন এক অন্য জগতের সুদর্শন হাস্যউজ্জ্বল,প্রাণোচ্ছল রাজপুত্তুর।
সন্ধ্যা নদীর পাড়।আদ্রিতের গাড়িটা এবারে এসে থামলো একটি শুনশান নদীর কিনারায়। চারপাশ ফাঁকা, নিরবতায় আচ্ছন্ন।
খানিকক্ষণ পর বোধহয় মাগরিবের আজান পড়বে।
গোধূলি আকাশ কালো হয়ে এসেছে
সূর্যিমামা বিদায় নিয়েছে সেই কখন।
“এখানে কেন আনলেন আদ্রিত ভাই?”
“ কেন মানে? এই নদীর পাড়েই বাসরটা সেড়ে তোকে মেরে কুঁচি কুঁচি করে কেটে এই নদীতে ভাসিয়ে দিবো বলে। এখনো বুঝতে পারছিস না।স্টুপিড!”
মাহরিসা ফিসফিস করে বলল,
“ তোমার মেরিগোল্ড কে মেরে ফেলার মত দুঃসাহসিক কলিজা তুমি এখনো তৈরি করতে পারোনি আদু ভাইয়া। তাই তোমার ওসব অবান্তর কথা বলে আমায় ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। একদম লাভ নেই। বিশ্বাস করো তোমার মেরিগোল্ড একফোঁটাও ভয় পাচ্ছে না। বরং লজ্জায় সে বারবার থমকে যাচ্ছে। “
আদ্রিত নিজের টাউজার গুটিয়ে নদীর পাড়ের ঘাসের উপড়েই চট করে বসে পরলো।দাঁড়িয়ে থাকা মাহরিসাকেও একটানে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো।
মাহরিসা বিরবির করে বলল,
“ কোথায় আপনার বাসর আদ্রিত ভাই? পাশে বসিয়ে রেখে বাসর করবেন বুঝি?”
নিরবতায় কাটল দীর্ঘক্ষণ।
চারপাশ অন্ধকার কে গ্রাস করে নিতে আরম্ভ করেছে।সেই মুহূর্তে নদীর পানির সৌন্দর্য যেন বৃদ্ধি পেল দ্বিগুণ। পানির উপরে ভেসে থাকা পাতা শেওলা আর কচুরিপানা মিলে যেন গভীর বন্ধত্ব পাতিয়ে একে অপরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে।
কচুরিপানার পাতার মাঝে মেজেন্টা কালার ফুলের চাপড়িতে আঁকা চোখ গুলো দেখ কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখছে আদ্রিত আর তার মেরিগোল্ড কে।
মাহরিসা তাদের দেখতে পেলে ঠিক অ্যাখ্যা দিলো লুচু ফুল পরিচয়ে।
কিন্তু রমণীর সে দিকে খেয়াল আছে বুঝি? উহু একদমি নেই। সে তো দেখতে ব্যাস্ত তার অর্ধাঙ্গের পায়ের আঙুল গুলোকে।যেন নিখুঁত হাতে তৈরি করেছে কেউ তা। নখ গুলো যেন সমান সাইজে ছন্দ তুলে কাটা।
মাহরিসার হিংসা হচ্ছে, ভীষণ হিংসা হচ্ছে সেই সঙ্গে কাজ করছে জেলাসী। তার নিজে পায়ের আঙুল নক কোনো টাই তো ওমন সুন্দর নয়। নখগুলোও তো সে কাটতে পারে না সুন্দর করে।বাঁকা তেরা হয়ে যায় কেমন চট করেই।
আচ্ছা আদ্রিত ভাইকে বললে কি নিজের মত সুন্দর করে মাহরিসার গুলোও কেটে দেবে?
মাহরিসা জবাব পায় না। অথচ বাতাসের দল ফিসফিস করে কানে কানে বলে গেল,
“ একবার বলেই দেখনা হে বোকা রমণী। শুধু পায়ের নখ কেন। তোমার পায়ে চুমু খাবে সে শত সহস্র বার। এই আর কিছু কাল,লগ্ন পাড় হওয়া বাকি।”
বাতাসের সে গুনগুন বুঝতে সক্ষম হয়না মাহরিসা।বরং তার হৃদয়ে তোলে তোলপাড়। মনে জন্মে তার আরেক শঙ্কা।
এমন সুদর্শন পুরুষকে আজকালকার কিছু বেহায়া মেয়েদের থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা।
মাহরিসার কপালে চিন্তা ভাঁজ পরে।
কোনো রমণী তার বরের পায়ের ওমন সুন্দরী নখগুলোর দিকে চাইতেই তো প্রেমে পড়ে যাবে। তখন তার কি হবে? নিজের বরকে অন্যের সঙ্গে ভাগ করতে একদম রাজি নয় সে, একদমই রাজী নয়।
তার কি উচিত লোকটাকে সবসময় জুটো পরিয়ে রাখা? ট্রাই করাই যায়।মন্দ নয়।
মাহরিসার ভাবনার মাঝ পথেই নিরবতা ছিন্ন করে আদ্রিতের পর পর প্রশ্নের দাবানলে রমণী চমকে উঠে।
“আমায় পছন্দ করিস?নট ভালোবাসা”
“মাহরিসা নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।”
“মুখে বল”
মাহরিসা ছোট্ট করা জবাব দিলো,
“ করি”
“কবে থেকে”
“ ছ..ছোট থেকে?”
অদ্ভুত জড়তায় মাহরিসা কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসলো।
“ লাইক সিরিয়াসলি? কই বলিস নি তো কখন ও?”
আড়ষ্টতায় মাহরিসা মাথা নিচু করে নিলো।থুতমা ঠেকলো তার বুকে।
আদ্রিত চট করে দুহাতের মুঠোয় অর্ধাঙ্গিনীর মুখখানি তুলে ধরলো।আহত স্বরে ফিসফিস করে বলল,
“ ডোন্ট বি সিরিয়াস জান। নরমাল হ প্লিজ।”
মাহরিসা চোখ বন্ধ করে চুপটি করে রইলো।
আদ্রিত আবারো বলল,
“ মেরিগোল্ড?”
গভীর সম্মোধনে মাহরিসার বন্ধ চোখের পাতা কেঁপে উঠলো সামান্য। সাড়া দিলো দ্রুত,
“ হুউউ?”
আদ্রিত মুগ্ধ চোখে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইলো নিজ অর্ধাঙ্গিনী অপরূপ সে মুখশ্রীর পানে।
মেয়েটা দিন দিন যেন আরো আদুরে হচ্ছে। দেখলেই ইচ্ছা করে জাপ্টে ধরে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে।
আদ্রিতের হঠাৎ আর কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে মাহরিসা চোখ মেলে চাইলো।
মুহুর্তে পুরুষালী ঠোঁটের ছোঁয়া পড়লো তার ললাটে।
রমণী কেঁপে উঠলো সামান্য। মাহরিসার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসলো।কিন্তু অর্ধাঙ্গের সে চোখের গভীরতায় চেয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করার মত দুঃসাহস দেখাতে পারলো না।
মানুষটার ওই চোখ দুটো যেন রাগী স্বরে বলছে,
“ চোখ বন্ধ কর শুধু তুই, বিশ্বাস কর তোর ওই চোখ দুটো আমি উপড়ে ফেলবো।”
দু’জনের দু’জোড়া চোখের আলিঙ্গনের মাঝেই আদ্রিত ফিসফিস করে বলতে আরম্ভ করলো তার সেই হৃদয়ের গভীরে লুকায়িত অজস্র বাক্যের বহর,
“আমি তোর সঙ্গে কথা বলতে চাই। প্রাণ খুলে গল্প করতে চাই মেরিগোল্ড । অতীতের স্মৃতির পাতা মেলে ধরতে চাই তোর সামনে।বর্তমানের খুনসুটিময় আলাপ সারতে চাই দু’জনে একত্রে। ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলোকে সাজাতে চাই।ছোট বেলার তোর সেই প্রাণখোলা হাসি, কথার ফুলঝুরি, কন্ঠের তুবড়ি সব চাই।সব।
এই মাহরিসাকে আমি চিনতে পারি না। ভীষণ কষ্ট হয় চিনতে।
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৬১
আমার তোকে সেই ছোট আগের মারু টাকে পুনরায় চাই। যে আমার বকা শুনে, ধমক শুনে নাক টেনে ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে আবার আমাকেই জরিয়ে ধরবে। আমার তাকেই চাই।”
মাহরিসা মুচকি হেসে বলল,
“নিজেকে একটু ম্যাচিয়ূর করার চেষ্টা করছি আদ্রিত ভাই বুঝলেন তো। এত ন্যাকা কান্না করলে তো সকলে ন্যাকা বলে।”
“ কিন্তু আমার যে সেই ন্যাকাবতী কেই চাই।”
