নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২
ঝিলিক মল্লিক
“আম্মা, ও আম্মা। রান্না কতদূর তোমার?”
জীম শোবার ঘরের বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে জোরে চেঁচিয়ে কথাটা বললো ওর শাশুড়ির উদ্দেশ্যে। ডলি বেগম রান্নাঘরে রান্না করতে ব্যস্ত ছিলেন। আজ তার ভীষণ ব্যস্ততা। বহুদিন পরে ছেলে ফিরছে তার। যখনই রুস্তম বাড়ি ফেরে, প্রতিবারই ডলি বেগম দিগ্বিদিক জ্ঞান হারান যেন। তার থেকে ব্যস্ত মানুষ তখন আর দেখা যায় না। এবার তো রুস্তম একা নয়। সাথে কলিগরাও আসছে। তাদের আদর-আপ্যায়নে কোনো কমতি হতে দেওয়া যাবে না। তাজরীন ফিরেছে কিছুক্ষণ আগেই। ও ফ্রেশ হতে গেছে নিজের ঘরে। আজ তাজরীনের নিজের ঘরটা ছাড়তে হবে ওর। বহুদিন পর হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরেই নিজের ঘর ছেড়ে দিতে হবে— একথা মায়ের কাছে শুনে ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল ও। কিন্তু ওর বৌমণি এসে বুঝিয়ে বলার পরে শান্ত হয় তাজরীন।
ডলি বেগম একটা বাটি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে জীমের ঘরে এসেছেন। জীম তখন কাজে ব্যস্ত। ডলি বেগম বাটি এগিয়ে জীমের মুখের সামনে কষা মাংস ধরে বললেন,
“খেয়ে দ্যাখ তো মা, লবণ আর মশলাপাতি ঠিকঠাকমতো আছে কিনা।”
জীম বালিশটা বিছানার ওপর রেখে মাংস উঠিয়ে মুখে দিলো। বললো,
“আরেকটু লবণ দাও। তাহলেই ঠিকঠাক।”
“আমার মুখে তো লবণ ঠিকই লাগলো। তোর কী হলো?”
“তোমার মুখের রুচি ঠিকই আছে। কিন্তু সমস্যা তো তোমার ছেলের। তিনি তো আবার কম লবণ গিলতে পারেন না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমার মাথা থেকে বের হয়ে গেছিল। আচ্ছা আমি গিয়ে আরেকটুখানি লবণ দিই।”
“তোমাকে এতো করে বললাম, আমি হেল্প করি রান্নায়। তুমি তো আমাকে রান্নাঘরের ধারেকাছেই যেতে দিলে না।”
“তোর এখন রান্নাঘরের ধোঁয়াতে ঘেমে-নেয়ে কদাচিত হতে হবে না। পোলা আসতেছে। একটু সেজেগুজে বসে থাক। আর শুধু ঘরটা গুছিয়ে রাখ। বেশি কাজ করার দরকার নাই।”
জীম এবার কোনো কথা বললো না। চুপ হয়ে গেল। বিছানা গোছানোর ব্যস্ততা দেখালো এবার। ওর শাশুড়িও জানেন, তার ছেলে আর বৌমার মধ্যে এখনো দূরত্ব চলছে। বিবাহিত জীবনের শুরুটাও সুন্দর কাটেনি তাদের।
শাহবীর রুস্তম তো নিজের কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে পগারপার হতে পারলেই বাঁচেন। জীম বহু চেষ্টা করেছে ওই জংলি, কাটখোট্টা লোকটাকে একটু মানুষ বানানোর। কিন্তু সে লোক তো মচকানোর নয়। লোকটাকে এবার সামনে পেলে একটা ঝামেলা করে ছাড়বে জীম। এই লোকের শান্তি সহ্য হয় না। অশান্তি এই লোক বেশ ভালো নিতে পারে।
ডলি বেগম বৌমার সাড়া পাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। আশানুরূপ সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি শোবার ঘরের বাইরে যেতে যেতে বললেন,
“ও জীম, তাজরীন বাথরুম থেকে বাইর হলে ওর জিনিসপত্র আমার ঘরে যেন নিয়ে যায় — এই কথা বলে দিস ওরে। চারটা বাজতে গেল তো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ওরা চলে আসবে। হাতে আর বেশি সময় নাই। সব কাজ সেরে ফেলতে হবে।”
“আচ্ছা আম্মা।”
জীম মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে আবার আলমারি গোছানোয় মনোযোগ দেয়। বিরক্ত লাগছে ওর৷ কোনো কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। আজ কি জানি হয়েছে ওর। নিজের সমস্যা নিজেই ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না। একবার মনে হলো, শরীর খারাপ লাগছে মনে হয়। আবার কি ভেবে যেন মনে হলো, বাইরে থেকে যতই মানুষকে স্বাভাবিক ভাবটা দেখাক; হয়তো শাহবীরের আগমন উপলক্ষে সিলভির এমন অস্বস্তি!
নিজের জীম পরিচয়টার থেকে সিলভি পরিচয়টা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতো ও। কীভাবে যেন বিয়ের পরপরই ওর সিলভি পরিচয়টা মিলিয়ে গেল! ও হয়ে উঠলো ঢালীবাড়ির বৌমা। লোকে বলে, জীম আফসোস কী আর লোককে বলে-কয়ে মেটানো যায়? কিছু কথা থাকুক না নিজের মধ্যে! তবে এই পরিচয়টাকেও কম ভালোবাসে না ও।
কলিংবেল বাজার শব্দ শুনে বসার ঘরের দেয়ালঘড়িতে সময় দেখলো জীম। সাতটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। রান্নাঘরে রান্না করায় ব্যস্ত ওর শাশুড়ি। তাজরীন তখন সোফায় বসে ফোন স্ক্রলিং-এ মগ্ন ছিল। জীম কেবিনেটের ওপর ফোনটা রেখে তাজরীনকে একপলক দেখে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ইশারায় তাজরীনকে বললো, মাথায় কাপড় তুলতে। তাজরীন ঠিকঠাক হয়ে বসতেই সদর দরজা খুলে দিলো জীম।
খোলা দরজার ওপারে সামনের দৃশ্যটা দেখে রীতিমতো অবাক হলো জীম। চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওর। এ তো রীতিমতো একটা যৌথ বাহিনীর আগমন! নয়জন লোক তো চাট্টিখানি কথা নয়। তবে এমন দৃশ্য কল্পনা করেনি ও। সামনে সিভিল ড্রেসে দাঁড়িয়ে আছে নয়জন মানুষ। তার মধ্যে একপাশে তিনজন মেয়ে। আরেকপাশে পাঁচজন ছেলে। মাঝখানে শাহবীরকে দেখে বাকিদের দেখতে লাগলো জীম। সবার হাতে এতোগুলা ব্যাগ-ব্যাডিং। সবার নজর জীমের দিকে। তাদের মধ্য থেকে একজন ছেলে ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বললো,
“ আসসালামু আলাইকুম ভাবী।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভেতরে আসুন আপনারা।”
সামান্য সৌজন্যতামূলক হেসে সবাইকে ভেতরে আসার জন্য জায়গা করে দিলো জীম। শাহবীর একবার মাত্র দেখেছে ওকে। তারপর-ই সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। একটা মেয়ে পেছনে ছিল সবার। ও জীমের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে মুচকি হেসে প্রশ্ন করলো,
“কেমন আছেন সিস্টার? আপনি-ই মেজরের ওয়াইফ, না?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। জি, আমি উনার ওয়াইফ। আপনি কেমন আছেন?”
“এইতো ভালো ছিলাম। আপনাকে দেখে আরো ভালো লাগছে। ভীষণ মিষ্টি দেখতে আপনি। কী নাম যেন আপনার?”
“সিলভি মাহমুদা জীম। আপনি আমাকে সিলভি বলে ডাকতে পারেন। এই নামটা আমার বেশি পছন্দের।”
“ওকে সিস্টার। আমি জেসি। জেসি হায়দার। মেজরের জুনিয়র।”
জীম মেয়েটার সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে দাঁড়িয়ে। মেয়েটা খুব মিশুকে। অল্প সময়ের মধ্যেই জীমের সাথে বেশ ভালো একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে গেল ওর। সবাই তখন ক্লান্ত শরীরে ড্রয়িংরুমের সোফার ওপরে এসে শোয়া, আধশোয়া হয়ে, হেলান দিয়ে বসে আছে। সবার অবস্থা দেখে অগোচরে সামান্য মুচকি হাসলো জীম। এদেরকে দেখে মনেই হচ্ছে না, এরা সবাই কলিগের বাসায় বেড়াতে এসেছে। বরং মনে হচ্ছে, খুব পরিচিত; কাছের কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছে। কোনো সংকোচ কিংবা জড়তা নেই কারো মধ্যে। ব্যাপারটা বেশ দারুণ তো!
জীম সবার জন্য হালকা নাস্তা নিয়ে আসলো। লেবুর শরবত করে নিয়ে আসলো তাজরীন। এখন আপাতত বিশ্রাম নিক সবাই। রাত নয়টার পরে খেতে দেওয়া যাবে। শাহবীরকে ড্রয়িংরুমে দেখতে পেল না জীম। একবার সেখানে নজর বুলিয়ে নিল। তাজরীন রান্নাঘর থেকে ঘরের দিকে যাচ্ছিল। জীমকে দেখে ওর হাতের কনুই টেনে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,
“বৌমণি, ভাইয়া আম্মার সাথে কথা বলে মাত্র তোমাদের ঘরে গেল। আমাকে বললো, তোমাকে ঘরে যেতে বলতে। শুনে আসো, দেখো কি বলে।”
জীমের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল কথাটা শুনে। চার মাসের বিবাহিত জীবনে দু’বার মাত্র চারদিনের জন্য শাহবীরের সাথে একসঙ্গে থাকা হয়েছে ওর। মনে পড়ে না, এরমধ্যে শাহবীর কখনো নিজে থেকে ডেকেছে ওকে। এই প্রথম শাহবীর ওকে ডেকেছে! আশ্চর্য হওয়ার মতোই বিষয়। জীম আর দাঁড়ালো না সেখানে। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নিজেদের ঘরে যাওয়ার সময়ে দেখলো, আটজন মানুষ চারটা সোফায় ফিট খেয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ ক্লান্ত সবাই। দু-একজন ফোনও স্ক্রল করছে। জীম তখন সামনের কেবিনেটের ওপর অবস্থান করতে থাকা সুবিশাল টেলিভেশন চালু করে দিয়ে বললো,
“আপনারা সবাই টিভি দেখতে পারেন।”
কয়েকজন মিলে এবার বললো,
“ভাবী, আমাদের খিদে পেয়েছে।”
“এইতো আর বিশ মিনিটের মধ্যেই খেতে বসবেন আপনারা।”
জীম মুচকি হাসলো। এরা তো ভীষণ মিশুকে! শাহবীরের মতো অমন মুখগোমড়া আর কাটখোট্টা নয়। জীম মনে করতো, মিলিটারির লোকেরা এমন হয় সব। আজ ওর ধারণা কিছুটা হলেও বদলালো।
“সিলভি!”
আওয়াজটার সাথে সাথে ঘরের ভেতর থেকে একটা বিকট শব্দ হলো৷ কিছু ভেঙেচুরে যাওয়ার শব্দ। তাজরীন তখন বারান্দার দিকে যাচ্ছিলো। বড় ভাই আর ভাবীর শোবার ঘরের বদ্ধ দরজার ওপারে এমন ক্যাচাল শুনে থমকে গেল ও। এমন ঝামেলা করার মানুষ তো তার ভাই-ভাবী নয়৷ হঠাৎ কি এমন হলো! তাজরীনের ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলে জীম। ওর চোখ-মুখ থমথমে। চোখ লাল। কেঁদে দেবে দেবে— এমন অবস্থা। তাজরীনকে দেখে থমকালো জীম। তাজরীন সরু চোখে তাকিয়ে বলো,
“রেগে গেলে ভাইয়া তোমাকে সিলভি নামে ডাকে। রাগারাগি হয়েছে তা জানি। কিন্তু রাগারাগির কারণটা বুঝছি না। বলার মতো না হলে বলো না।”
জীম কিছু বললো না প্রথমে। চুপ করে রইলো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১
“আম্মার ঘরে তুমি ঘুমাচ্ছো আজ, না?”
“জি বৌমণি।”
“ওঘরে আমারও থাকার ব্যবস্থা করো। তোমার জাঁদরেল ভাইয়ের সাথে এক ঘরে থাকবো না আমি। আর ওই লোক যেন আমাকে আর না ডাকে। বলে দিও তাকে।”