নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১১
ঝিলিক মল্লিক
অন্যদের সক্ষমতা যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু হয় তাদের অপারেশন। ডু অর ডাই মোটোতে বিশ্বাসী তারা মৃত্যুকে পরোয়া করে না কখনোই।
হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড উপজেলা। এ যেন রহস্যের এক অপর নাম!
রাত তখন প্রায় তিনটা। শীতের দীর্ঘ রাত। পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা কুয়াশার মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। প্রত্যেকের সাধারণ পোশাক। প্রত্যেকের হাতে Glock-19 পিস্তল, তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য। কাজ শেষ হয়ে গেছে। রুবায়েতের হাতে সাইলেন্সার লাগানো হ্যান্ডগান। আফিমের হাতে থার্মাল বাইনোকুলার। কাজ শেষে বড় পকেটে রেখেছে সেটা। এখন ফিরতি পথ ধরতে হবে।
শাহবীর রুস্তম অন্ধকার পথ হাতড়ে সবাইকে ডিরেকশন দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই অপ্রত্যাশিতভাবে এতো রাতে তার ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। নিশুতি রাতে হঠাৎ এই রিংটোনের আওয়াজে প্রথমে চমকে ওঠে সবাই। তারা নিরাপদ এবং সতর্ক অবস্থানে আছে। তাই রুস্তম সবাইকে আশ্বস্ত করে সামনে যেতে বলে ফোন বের করলো পকেট থেকে। মহাবিরক্ত ও। কাজের সময়ে কে কল করছে! ফোনটা সামনে ধরতেই আশ্চর্য হলো ও। সিলভি নামটা জ্বলজ্বল করছে হোম স্ক্রিনে! সিলভি! ও কিভাবে কল দিচ্ছে এখন! এটা কীভাবে সম্ভব? আশ্চর্য হওয়ার সীমা নেই। রুস্তম প্রথমে কল রিসিভ না করে কেটে দিলো। সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করছে সামনে। হাঁটতে শুরু করলো ও। আবারও কল আসলো। এবার বিরক্ত হয়ে শাহবীর দ্রুত কল রিসিভ করলো। তারপর গা ছাড়া গলায় বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“হ্যালো।”
“হ্যালো।”
জীমের গলা শোনা গেল। শাহবীর কিছুটা রাগী স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
“কী? কী?”
“কী কী মানে কী? কল কেন কাটছোস তুই?”
“অ্যা?”
জীমের তুই-তোকারি শুনে শাহবীরের মুখ থেকে শব্দটা বের হলো। জীম এবার ক্ষ্যাপা স্বরে বললো,
“কী অ্যা! কল কে-ন কাটছোস তুই?”
টেনে টেনে প্রশ্নটা করলো জীম। শাহবীর আবারও শোনেনি এমন ভঙ্গিতে বললো,
“অ্যা?”
“একদম মেরে অ্যা সহ বাইর করে ফেলবো। অ্যা, অ, কী; এসব লাগাইছোস ক্যান?”
জীমের কন্ঠস্বর আরো ক্ষিপ্র হয়ে উঠছে। শাহবীরের নিজেকে অসহায় অনুভব হলো এই মুহূর্তে। এই মেয়েকে ঠেকিয়ে রাখা দায়! এবার ও বললো,
“কল কেন কাটবো? দেখো তোমার ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে হয়তো।”
“কোনো ব্যালেন্স শেষ হয়নি শালা! ব্যালেন্স এখনো বহুত আছে।”
শাহবীর এবার একটা লম্বা শ্বাস টেনে বললো,
“কী হয়েছে তোমার? ক্ষেপেছো কেন?”
“না ক্ষ্যাপার কথা ছিল বুঝি? তুই এখন এতো রাতে কই আছিস? তেহারিতে কী মিশিয়েছিলি? রাত বারোটা পর্যন্ত আমি সজাগ ছিলাম৷ তুই আমার কাছেই ছিলি। তারপর আমি বেহুঁশের মতো ঘুমিয়ে পরেছিলাম কেন? আর হঠাৎ ঘুম ভাঙার পরে এখন দেখি, তুই পাশে নেই। বাইরের ঘরে ছেলেরা কেউ নেই। মেয়েদের মধ্যে রিক্তি, জেসি, তহুরাও নেই। তাজরীন বেহুঁশের মতো ঘুমিয়ে আছে। নিশ্চয়ই তোর কারসাজি। আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে এসে এতো রাতে ওদেরকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার মানে কী? কীসব চলে?”
জীমের কন্ঠস্বর লাগাতার কঠোর হতে আরো কঠোর হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, প্রচন্ড রেগে আছে ও। রেগে গেলেই মুখ থেকে বেশি তুইতোকারি বের হয়। শাহবীর পাল্টা কোনো কঠোর কথা শোনাতে চাইলো না। আপাতত ঠান্ডা মাথায় এই চিজকে হ্যান্ডেল করা উচিত। সিলভি যে একটা ভয়ানক চিজ— এই কথায় কোনো সন্দেহ নেই। তাই শাহবীর এবার যথেষ্ট কোমল স্বরে বললো,
“সিলভি শোনো…”
“চুউপ! তোর কোনো কথা শুনবো না আমি।”.
“সিলভি প্লিজ! তুইতোকারি কোরো না। আমার মাথা ঠান্ডা রাখতে দাও। মেজাজ খারাপ হলে কিন্তু..”
“তোর মেজাজ খারাপ রাখ তোর কাছে৷ তাতে আমার বাল ছেঁড়া! অসভ্য লোক। বদমায়েশ! ফাতরামি করে বেড়ায়। নিজেক বউ, বোনকে আবার ঘুমের মেডিসিন খাইয়ে রেখে যায়। লজ্জা হওয়া উচিত তোর নিজের ওপর।”
“সিলভি, মুখে লাগাম টানো বেয়াদব। আমি আসলে কিন্তু আস্ত রাখবো না আজ।”
“আয় তুই। আজকে তোকে আমি মা’র্ডার করবো।”
জীম মুখের ওপর ঠাস করে কল কেটে দিলো। রুস্তম কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে হাঁটা ধরলো সামনের দিকে। সবাই ওর জন্য দাঁড়িয়ে আছে অদূরে। মেজাজের বারোটা বেজে গেছে ওর। টিম মেম্বাররা জিজ্ঞাসা করতেও এড়িয়ে গেল। আপাতত ফুল ফোকাস রাখতে হবে পথযাত্রা নিয়ে। এখান থেকে পায়ে হাঁটা মিনিট পঁচিশের পথ। হেঁটেই যেতে হবে বিলের মধ্য দিয়ে। আসার সময় কেউ টের পায়নি। হেলেন কুঠির দোতলায় ফিরতেও হবে বেশ সতর্কভাবে।
তাজরীন কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। একবার নিজের ভাই-বৌমণিকে, আরেকবার রুবায়েতকে দেখছে। লোকটা বয়সে তার ভাইয়ের প্রায় কাছাকাছি। তার ভাইয়ের পরে সে-ই এখানে সবচেয়ে সিনিয়র। লোকটা চাইলে এই ঝামেলা থামাতে পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াহীন, পক্ষপাতহীন ভূমিকা পালন করছে। যেন কিছুই যায় আসে না এসবে৷ বিরাট ব্যাপার হয়ে যায়নি। তাজরীনের আরো বেশি রাগ লাগছে এতে।
রাত এখন সাড়ে তিনটা প্রায়। এই কাঠের দোতলা ব্যতীত সম্পূর্ণ হেলেন কুঠি এখন ঘুমিয়ে আছে৷ গ্রামের বাড়ি হওয়ায় গেট লক, খোলামেলাভাবে চলাফেরা, বাইরে বেরোনো — এসব নিয়ে কোনো ঝামেলায় পরতে হয়নি রুস্তমদের। পেছনের বিল দিয়ে লুকিয়ে যাওয়া-আসা ঝঞ্ঝাটবিহীন হয়েছে। কিন্তু ঝামেলা বেঁধেছে দোতলায় আসার পরেই৷ অবশ্য ঝামেলা যেন হওয়ার-ই ছিল। জীম একেবারে সদর মুখে বসেছিল ওদের জন্য। কিছুটা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল ওকে। শাহবীররা ফিরতেই ননদকে ঘুম থেকে টেনে তোলে৷ তাজরীন প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও বৌমণি আর ভাইয়ের বাকবিতন্ডায় এতক্ষণে মোটামুটি পরিষ্কার হলো ঘটনা সম্পর্কে। জীমের হাতের বাহু ধরে রেখেছে ও। বাকবিতন্ডা অতোটা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায়নি তখনো। তার আগেই জীমকে টেনে পাশের ঘরে নিয়ে গেল তাজরীন। ওর সাথে গেল তহুরা। জীম বারবার করে জানতে চাইছে, ওরা কোথায় গিয়েছিল। কিন্তু শাহবীর তার সিদ্ধান্তে অটল। একটাও ইনফরমেশন দেবে না। আর না তো কোনো প্রশ্নের জবাব। নিজের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও সরেনি ও।
এমনকি জীমের অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি পড়েও নয়। ওই দৃষ্টিতে যে প্রকাশিত ক্ষোভের সাথে একরাশ দুশ্চিন্তা, উৎকন্ঠা লেপ্টে ছিল, তা কেউ না বুঝলেও তার চোখ থেকে এড়িয়ে যায়নি৷ বাকিরা ব্যাপারটাকে অতোটা জটিলভাবে নিলো না। এসব ঝামেলা ওদের কাছে মামুলি ব্যাপার। আর মেজরের ওপর তাদের সকলের ভরসা আছে। তিনি ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করে নেবেন খুব সহজেই। কেউ অবশ্য মুখ খোলেনি জীম-তাজরীনের সামনে। মেজরের কঠোর নির্দেশ — কোনোভাবেই মুখ খোলা যাবে না। আর ওদের সকলের কঠোরতাও ঠিক ততোটুকুই। জীমকে ঘরে দিয়ে বেরিয়ে আসলো তাজরীন, তহুরা৷ শাহবীর তখন মাত্র ঘরে গিয়েছে। আবারও ঘুমানোর প্রস্তুতি চলছে। ছেলেরা সবাই এতোক্ষণে লেপ-কম্বলের নিচে। রিক্তি, জেসি তো আসা মাত্রই আগে বিছানায় গেছে। তহুরাও মাত্র শুয়ে পরলো। তাজরীন গেল না বিছানায়। ঘরের পেছন দিকের বারান্দায় একজন দাঁড়িয়ে আছে।
আবছা অন্ধকারে অস্পষ্ট অবলোকন করা যায়। সেই ব্যক্তি ঘুমাতে যায়নি এখনো। তা দেখে তাজরীন এক-দুই কদম করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। যতই এগোতে লাগলো, আর দূরত্ব কমতে শুরু করলো; তাজরীন বুঝতে পারলো, লোকটা স্মোকিং করছে। তার ডান হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলজ্বল করছে জিনিসটা। সেকেন্ড কয়েক পরপর অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে তা মুখের সামনে উঠে যাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়া তাজরীনের সহ্য হয় না। শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে ওর। এ জীবনে যতোটা পেরেছে, এই ধোঁয়াকে এড়িয়ে গেছে। তবে আজ এই ধোঁয়াকে এড়িয়ে যেতে পারলেও, এই লোককে এড়িয়ে যেতে পারছে না। তাই সাহস করে এগিয়েই গেল ও। লোকটাকে নিজের শত্রু মনে হয় না তাজরীনের। তবু আজকের ঘটনার জন্য কিছু কড়া কথা শোনানোর উদ্দেশ্যেই লোকটার কাছে গেল সে। তাজরীনকে দেখেও রুবায়েত স্মোকিং থামায়নি। কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া নেই ওর। তা দেখে তাজরীন ভেতরে ভেতরে আরো জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। ওকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না! সামনে একজন বিপরীত আকর্ষণের মানুষ দাঁড়িয়ে। তবু লোকটা সিগারেটকর সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিচ্ছে কিভাবে! তাজরীন অবশ্য প্রকাশ্যে সেই প্রসঙ্গে গেল না। চিকন কন্ঠে আঁধার ছাপিয়ে বলে উঠলো,
“এই।”
“হু। কোনো দরকার?”
রুবায়েতের রাশভারী কন্ঠস্বর। তাজরীন যতোটা সাহস নিয়ে এসেছিল, এখন তা আর নেই। আত্মবিশ্বাসের অভাব ঠেকছে ওর। পুরুষ মানুষ যখন কোনো মেয়ের সাথে বিনা প্রতিক্রিয়ায় কথা বলে, তখন সেই মেয়ে যতোই কঠোর আত্মবিশ্বাস নিয়ে থাকুক না কেন; তার সেই আত্মবিশ্বাসে কিঞ্চিৎ হলেও ভাটা পড়ে। তাজরীনের ক্ষেত্রেও তাই-ই হলো। থতমত খেলো ও। অন্ধকারে তা কারো টের পাওয়ার কথা নয়৷ তবু কেন জানি তাজরীনের মনে হলো, সামনের কঠোর ব্যক্তিত্বের লোকটা ইতিমধ্যে তা টের পেয়ে গেছে। আঁধারে যেন তিরস্কার করছে ওকে। তবু দমে গেল না তাজরীন। আরো কঠোরতা দেখানোর চেষ্টা করে বললো,
“আপনি ঝামেলাটা হ্যান্ডেল করলেন না কেন?”
“আমাকে কেন হ্যান্ডেল করতে হবে?”
প্রশ্নের পিঠে পাল্টা প্রশ্ন। কঠের গলা। তাজরীন ভেতরে ভেতরে নিভে যাচ্ছে। অথচ প্রকাশ্যে মিছে আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছে। আবারও বললো,
“এখানে ভাইয়ার পরে আপনি সিনিয়র। আপনি তো পারতেন হ্যান্ডেল করতে। কেন করলেন না?”
“প্রয়োজন মনে করিনি। হাসবেন্ড-ওয়াইফের ইন্টারনাল ম্যাটার। তারা বুঝে নেবে।”
তাজরীনের এবার কান্না পেলো বোধহয়। মানুষ এমনও হয়। রসকষহীন! কথা বাড়ানোর কোনো অপশন নেই। অবশ্য প্রয়োজন-ই বা কীসের? তাজরীন কেন এই লোককে এতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে? কেন? আজীবন ছেলেদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো মেয়েটার আজ এ কি হাল! নিজের দশা দেখে তাজরীনের ভীষণ দুঃখ হচ্ছে নিজের জন্য। মন চাইছে, এই কাঠের দোতলা থেকে ঝাঁপ দিতে। তৎক্ষনাৎ ভারী কন্ঠস্বরটা আবার শোনা গেল—
“ঝাঁপ দেবেন? এখান থেকে ঝাঁপ দিলে মরবেন না। সর্বোচ্চ হলে হাত-পা ভাঙতে পারে। তারপর হসপিটাল, ব্যান্ডেজ, প্ল্যাস্টার৷ আরো কত কি! আপনার লম্ফঝম্প বন্ধ।”
রুবায়েত কী রসিকতা করলো? নাকি তিরস্কার আবারও? হবে দু’টোর একটা! তাজরীন আর সহ্য করতে পারছে না৷ করুণ গলায় এবার নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে বলেই ফেললো,
“আপনি এমন কেন রে ভাই?!”
“আর কোনো প্রশ্ন?”
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১০
না আর কোনো প্রশ্ন নেই। রুবায়েতের এই পাল্টা প্রশ্নের পিঠে আর কোনো প্রশ্ন আসে না। তাজরীনের আপাতত আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না। বিরবির করে “ফাতরা লোক” বলে সেই স্থান হতে প্রস্থান করে ঘরের ভেতরে চলে আসলো ও। পেছনে তখনও সিগারেট জ্বলজ্বল করছে। কুয়াশায় মিশে যাচ্ছে সেই ধোঁয়া।