নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১২
ঝিলিক মল্লিক
ভোর সবে সাড়ে ছয়টা বেজেছে তখন। আজ চট্টগ্রামে আসার প্রথম দিন-ই বলা যায়। গতকাল সবার ক্লান্তির পর বিশ্রামে কেটেছে। সবার সাথে ঠিকঠাকমতো পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এখানে আশেপাশে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। সেগুলো ঘুরে দেখার পরিকল্পনা হয়েছে বাসে আসার সময়েই।
তাজরীন তখন মাথায় হাত চেপে ধরে বিছানার ওপরে বসে আছে। ঘুম ভালো হয়নি। দীর্ঘ জার্নির পরে আরো কিছুটা ঘুম প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার আগেই ওর বৌমণি এসে টেনে ধরে উঠিয়ে দিয়ে গেছে ওকে। জেসি, রিক্তি এখনো ঘুম। তহুরা হাতে ব্রাশ, পেস্ট ধরে ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে আছে বিরক্ত মুখ করে বসে থাকা তাজরীনের দিকে। ওদিকে পর্দা তুলে দেওয়া হয়েছে দুই ঘরের মাঝখানে। কি যেন ফুসুরফাসুর চলছে ছেলেদের ওইপাশটাতে। তাজরীন লেপ থেকে মুখ উঠিয়ে মাথায় টেনে নিয়ে বিপরীত দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, আসলে কাহিনী কি। তহুরা সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। বড়খাটে আফিম, হাসান, শোয়েব, রায়ান বসে আছে। রুবায়েত, রুস্তম আর জীম ইতিমধ্যে নিচে গেছে ফ্রেশ হতে৷ এই পুরুষগুলো এখনো মাঞ্জা মেরে বসে আছে। কি যেন ফিসফাস করছে। জরুরি মিটিং বসেছে মনে হচ্ছে। সবাই গোল হয়ে বসে আছে। উদ্ভট ব্যাপার-স্যাপার। তাজরীন রিনরিনে আওয়াজে পাশে একদৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকা তহুরাকে জিজ্ঞাসা করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তহু, কী হয়েছে ওখানে?”
“হারামজাদাটার ব্রেকআপ হয়ে গেছে।”
তহুরা ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থেকেই আনমনে জবাব দিলো তাজরীনের প্রশ্নের। তাজরীন ভ্রু কুঁচকে আবার প্রশ্ন করলো,
“কার ব্রেকআপ হয়েছে?”
“আফিমের। গার্লফ্রেন্ড হারানোর বেদনায় বেচারার হৃদপিণ্ড ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ হয়ে গেছে মনে হয়।”
“তাই বলে এভাবে..”
“ফালতু একটা! গার্লফ্রেন্ডও সেরকম নিব্বি৷ ওর গার্লফ্রেন্ডকে সম্ভবত ভোর ছয়টার মধ্যে গুড মর্নিং জানানোর কথা ছিল। কাজটা হয়নি বলে নিব্বিটা ব্রেকআপ করে চলে গেছে। আর এদিকে বসে হারামজাদাটা হা-হুতাশ লাগিয়েছে। তামাশা যে আরো কত দেখবো দুনিয়ায়!”
তহুরা যে মহাবিরক্ত এই ঘটনায়, তা ওর কথাবার্তার ধারেই বোঝা যাচ্ছে। তাজরীনের আর কি করার! উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো বিছানা থেকে এই মুহূর্তে উঠতে মন চাইছে না। তাই মাথায় লেপ ঢেকে বসে বসে তহুরার কথায় ‘তামাশা’ দেখতে দর্শক হলো।
পুকুরের ওপাশটাতে গোলপাতার বেড়া দেওয়া। আর এপাশে কিছু নারকেল, সুপারি আর কাঠবাদাম গাছ। সকাল সকাল মাহমুদ উঠেছে কাঠবাদাম গাছে৷ কাঠবাদাম পেড়ে সব গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেপেলেদের হাতে দিচ্ছে। জীম পুকুরঘাটে বসে আছে। হাত-পা ধুচ্ছে৷ ওদিকটায় বড় ভবনে খুব মানুষের ভীড়। এখানে পুকুরঘাটের সামনের উঠোনে মুরব্বি আর বাড়ির বউরা টুল, পিঁড়ি পেতে বসে চিনা হাঁস পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়েছেন। জীম সিঁড়ির মাথায় বসে পা ধুতে ধুতে মুখ উঠিয়ে সরু চোখে একবার শাহবীরকে দেখলো। শাহবীর ইমরান ভাইয়ের সাথে কথা বলছে হেসে হেসে। পাশে রুবায়েত দাঁড়িয়ে। তাদের হাত-মুখ ধোয়া হয়েছে আগেই। আগামীকাল সকালে নাকি পুকুরে নামা হবে চাষ করা মাছ জালে ওঠাতে। সবাই নামবে। এমনকি শাহবীর, রুবায়েত আর বাকিরাও।
শাহবীরের সাথে গত রাত থেকে জীমের কথাবার্তা বন্ধ। এমনকি ওই লোকও একবারও জীমের সাথে যেচে কথা বলেনি। বরং জীম কিছু বলতে চাইলে আরো এড়িয়ে গেছে। ঘরে গিয়েই নির্বিকারভাবে সোজা ঘুম। জীমের অসহ্য লাগছে সেই তখন থেকেই। ঘুমটা ভালোমতো হয়নি ওর। এখন সকালটাও খারাপ যাচ্ছে। এই একজন মানুষ ওকে এড়িয়ে গেলে ও মেনে নিতে পারে না। ভীষণ কষ্ট হয়। মনে হয়, হৃৎপিণ্ড এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজের ভেতরের অবস্থা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না জীম।
ইকবাল ভাইয়ের স্ত্রী হাফসা এসে জীমের হাতে ওর তোয়ালেটা দিলো। হাফসা খুব মিশুকে স্বভাবের। বয়সে জীমের চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। একটা ছোট ছেলেও আছে তাদের৷ বয়স চার বছর হবে। হাফসার কাছে সবসময়ই এক-দুইটা পরিকল্পনা গোছানো থাকে। এখন ও জীমকে জানালো, আজ বিকালে নদীর চরে ঘুরতে নিয়ে যাবে সবাইকে। ওদিকটাতে নদীর মাটি কেটে ডাঙায় ওঠানোর কারণে পাহাড়ের মতো আবিষ্টের সৃষ্টি হয়েছে। তার ধার ঘেঁষে আবার জমির মালিকরা অনেক গাছপালা লাগিয়েছেন সেখানে। আম, কাঁঠাল, পেয়ার, জাম হতে শুরু করে সবকিছু। আজ সেসব-ই অতিথিদেরকে দেখাতে নিয়ে যাবে ওরা। জীম সানন্দে সম্মতি জানালো। ও এক পায়ে খাঁড়া। জীম গিয়ে বসলো ওর শাশুড়ির পাশে। মেজো খালা শাশুড়ি এসেছেন। তাকে বিয়ের সময়ে দেখেছিল জীম। এরপর আর কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। মেজো খালাশাশুড়ি জীমকে পাশে বসিয়ে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করলেন। প্রশ্ন করছিলেন জীমকে। তখনই ওর ডাক আসলো। তাজরীন উঠোনের কোনায় দাঁড়িয়ে জীমকে ডাকছিল চেঁচিয়ে। জীম দ্রুত উঠে গেল। তাজরীনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ও বললো,
“বৌমণি, আমরা একটু পরে বের হবো। ভাইয়া সবাইকে নিয়ে সড়কের ওপাশের হাটবাজার ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। ওইদিকে নাকি একটা পুকুর আছে। সেই পুকুরের পানি সম্পূর্ণ পরিষ্কার। পুকুরটার বেশ ইতিহাস আছে। তারপর নতুন একটা পার্কও করা হয়েছে এই অঞ্চলে। কালভার্ট, নদীর ঘাট.. সব ঘুরে আসবো৷ তুমি তো হাত-মুখ ধুয়েছো। দোতলায় গিয়ে রেডি হতে লাগো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
জীম জিজ্ঞাসা করলো,
“ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে কে?”
“ভাইয়া।”
“আমি যাচ্ছি না তাহলে। তোমরা ঘুরে আসো।”
“কেন বৌমণি? এরকম করছো কেন? ভাইয়ার সাথে মিটমাট হয়নি তোমার? কথা বলেছো?”
“প্রয়োজন মনে করিনি। তাছাড়াও তার কাছে আমার কোনো গুরুত্ব নেই। আর এরকম যে কেন করছি, তা আজ না হোক; সঠিক সময়ে ঠিক বুঝে যাবে।”
জীম হাঁটা দিলো সামনের পথে। টিলা থেকে উঠে পেছনের দরজার ভেতরে চলে গেল। রুস্তম এতোক্ষণ দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। তবু একবার ঘুরেও দেখলো না জীমকে। ব্যাপারটা জীম গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে। এতে যেন ওর রাগের মাত্রা আরো বেশি বেড়ে গেছে।
আফিম বিছানার ওপর বসে একের পর এক ফোনকল করে যাচ্ছে। ফোন কেটে যাচ্ছে বারবার। তবু ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না ও। ওপাশের ঘরের দরজা আঁটকে মেয়েরা তৈরি হয়ে নিচ্ছে। বাইরের ঘরে এখন আছে শুধু আফিম, রায়ান আর তহুরা। ওর তৈরি হওয়া শেষ। একটা গাউনের সাথে লেডিস জিন্স আর তার ওপরে শাল চাদর জড়ানো। চুলগুলো একপাশে বেণী করে ফেলে রাখা। তহুরা সচারাচর সাজে না। অন্যের কাছে নিজেকে জাহির করার তোড়জোড় নেই ওর। যতটুকু সাজে, শুধুমাত্র নিজের জন্য। নিজেকে মুগ্ধ করার জন্য। তবে আজ সে ভীষণ আপসেট। সাজটা যদিও অন্যকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নয়। তবে বিশেষ কেউ একজন দেখছে না। সে অন্য কাজে ব্যস্ত। এই ব্যাপারটা তহুরাকে মুষড়ে ফেলছে।
ছেলেদের মধ্যে বাকিরা নিচে গেছে ফ্রেশ হতে। এখনো আসছে না দেখে পেছনের বারান্দায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এসেছে তহুরা। তারা বিরাট কাঠবাদাম গাছে উঠে গেছে ইকবাল ভাইয়ের কথায়। শক্তপোক্ত মগডালে বসে বাদাম ছিড়ছে।
আফিমের মূলত মেজাজ ভালো নেই। গার্লফ্রেন্ড তাকে ফেসবুক, মেসেঞ্জার থেকে ব্লক করেছে। ব্রেকআপও করে দিয়েছে মেসেজে। তারপর ফোন করেছিল আফিম। ফোন নাম্বার ব্লক করার পরে হাসানের ফোন থেকে কল করেছিল। প্রথমে কল রিসিভ করে তারপর আফিমের কন্ঠস্বর শুনে সেই নাম্বারও ব্লক করে দিয়েছে ওর গার্লফ্রেন্ড। তহুরা এখন বিছানার ওপর আফিমের ঠিক সামনাসামনি বসে কিন্ডার জয় চিবোচ্ছে আর দেখছে ওকে। আফিম এবার বিরক্ত হয়ে ফোনটা ঠাস করে বিছানার একপাশে ফেলে তহুরার দিকে তাকালো। তহুরা কিছুটা আড়ষ্ট হলো৷ কিন্তু আফিম তা লক্ষ্য করলো না। বরং অনুরোধের সুরে বলে উঠলো,
“তহু…”
এরকম মহব্বত করে ডাকার লোক আফিম নয়। অন্তত তহুরার ক্ষেত্রে কখনোই নয়। তহুরা এবার বুঝতে পারলো। মনে মনে ভীষণ রাগ হলো ওর৷ তবে প্রকাশ করলো না। সহজভাবেই জিজ্ঞাসা করলো,
“কী হয়েছে? এভাবে ডাকছো কেন?”
হাসান পাশ থেকে আফিমকে খোঁচা মেরে তহুরাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“বুঝিস না, ওর কি সমস্যা!”
হাসান বিরক্ত আফিমকে নিয়ে। এবার উঠে গেল ও। বেচারার ছ্যাঁকাছুকা নেওয়া যাচ্ছে না আর। বসানো দরজার পাল্লা সরিয়ে লম্বা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল ও।
আফিম এবার আচনক একটা কাজ করে বসলো। তহুরার শাল চাদরের আড়ালে থাকা হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বললো,
“তহু, সোনা একটু কনভিন্স কর প্লিজ। তোর ফোনটা জাস্ট দুই মিনিটের জন্য দে। ওকে একটা কল করে দুই মিনিট কথা বলেই দিয়ে দেবো। বিলিভ মি।”
তহুরা তখন মরে মরে অবস্থা। ওর হাতদুটো উষ্ণ ছিল। আফিমের হাত ঠান্ডা। আফিম হয়তো সেরকম মনোভাব নিয়ে হাত ধরেনি। হয়তো না, আসলেই স্বাভাবিকভাবে ধরেছে। শুধুমাত্র অনুরোধ করে ওকে রাজি করানোর জন্য। কিন্তু তহুরা আড়ষ্ট হলো। পরমুহূর্তেই ওর মনে পরলো, সামনে বসা তার থেকে বছর চারেকের বড় এই ছেলেটা অন্য মেয়ের জন্য তার হাত ধরেছে। সম্পূর্ণ নিজের স্বার্থের জন্য। সবাই বলে, আফিম আর তহুরা আপাতদৃষ্টিতে বেস্টফ্রেন্ড। অবশ্য তাই-ই বটে। তাদের সম্পর্কটা বেস্টফ্রেন্ডের মতো। তহুরাও তাই মানে। আবারও মানলো। বেস্টফ্রেন্ডের কাজ-ই হলো হেল্প করা। তহুরা এবার টেনে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে আসলো। তারপর সাইড ব্যাগ থেকে সেলফোন বের করতে করতে বললো,
“বিনিময়ে কী দেবে?”
“কী চাস তুই?”
“আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। তোমার যা মন চায় দিও।”
তহুরা ফোনটা আফিমের হাতে তুলে দিলো। আফিম ওর ফোনের লক জানে। নিজেই লক খুলে নিলো। তারপর কনট্যাক্ট লিস্টে ঢুকে নাম্বার বসাতে ব্যস্ত হলো। তহুরা এক ধ্যানে ওর কার্যকলাপ দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করলো,
“তুমি কী ওই মেয়েটাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছো?”
“ওই মেয়েটা কী রে? প্রেমিকা হয় আমার। সম্মান দিয়ে কথা বল।”
“ওহহ আচ্ছা!”
“হু।”
“তুমি কিন্তু কথা ঘুরাচ্ছো। সত্যি করে বলো, তুমি মেয়েটাকে ভালোবাসো?”
আফিম এবার ফোন থেকে মুখ তোলে। তারপর বলে,
“চুউপ! বেশি কথা বলিস। কথা বলবো এখন ওর সাথে। ডিস্টার্ব করিস না।”
“আমি তাহলে উঠি?”
“না, বসে থাক। ও যদি না মানে, তাহলে একটু হেল্প করবি কনভিন্স করার জন্য। এই মেয়েমানুষ নিয়ে ভারী জ্বালা!”
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১১
তহুরা আর একটা কথাও বললো না। আফিম কল দিলো ওর গার্লফ্রেন্ডকে। কল রিসিভ হওয়া মাত্রই ওপাশের মানুষকে খুব কাকুতিমিনতি করে কথা বলতে শুরু করলো। তহুরা স্থির বসে দেখতে লাগলো আফিমকে, ওর প্রেমিক সত্ত্বাকে…