নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৩

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৩
ঝিলিক মল্লিক

“যে সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই, সেই সম্পর্কে আমি আর থাকার প্রয়োজন মনে করছি না। শীঘ্রই আমি নিজেকে মুক্ত করে নেবো। নিজের মতো করে বাঁচতে শিখবো।”
লাগেজ থেকে কাজল বের করতে করতে উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে কথাটা বললো জীম। ওর কথায় কঠোরতার মাত্রা ভীষণ বেশি। অভিমানের ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে।

বাইরে সবাই কুঠিবাড়ির সামনের উঠোনে চেয়ার পেতে বসে আছে। খালামণি আর তার ছোট জা বলেছেন, সকালের নাস্তা না করে খালি পেটে কেউ এক পা-ও বাড়ির বাইরে রাখতে পারবে না। আর মিনিট পনেরোর মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। গ্রামের শীতের সকাল। কুয়াশা এখনো কাটেনি পুরোপুরি। সূর্যের দেখা মেলেনি। ঠান্ডার মাত্রা অনেকটা বেশি। ১৭° সেলসিয়াস তাপমাত্রা। সবাই যথেষ্ট গরম পোশাক-আশাক পরেছে। তবু শীত কমছে না। দু’টো বিশাল শীতল পাটি এনে পাশাপাশি বিছানো হলো। তারওপর গিয়ে রুবায়েত, আফিম, রিক্তি, তহুরা, তাজরীনরা সবাই বসলো গোল হয়ে। ওদের মাঝখানে একটা মালশায় কিছু কাঠখড় পুড়িয়ে দিয়ে রাখা হলো সবার আগুন পোহানোর জন্য। তাজরীন জড়োসড়ো হয়ে বসলো তহুরার কাছ ঘেঁষে। ওর ভাই-ভাবী এখনো আসেনি নিচে। দোতলায়-ই রয়েছে। তাজরীনও আর ডাকেনি। দু’জনকে একটু একা ছাড়া উচিত। তাদের মধ্যে মৌন মনোমালিন্য দূর হওয়া দরকার।
শাহবীর কাঠের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ছোট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছিল। জীমের কথা শোনামাত্র হাত থেমে গেল ওর। পেছনে ঘুরে একবার দেখলো ওকে। চিরুনিটা ফেলে এগিয়ে আসলো। জীম বোঝার আগের ওর কাঁধ চেপে ধরে নিজের দিকে ফেরালো। শাহবীরের চোখে চোখ পরতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো জীম। শাহবীর এবার ওর কাঁধ দুই হাতে চেপে ধরে রেখেই জিজ্ঞাসা করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কী বললে? আবার বলো।”
“ডিভোর্স চাই আমি।”
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেই জবাব দিলো জীম। শাহবীর এবার কিছুক্ষণ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জীমের দিকে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“কি বললি, সাহস থাকলে আবার বল।”
“ডিভোর্স চাই আমার।”
জীম একইভাবে বিনাবাক্য জবাব দিলো। শাহবীর এবার ধাক্কা দিলো জীমকে। আচনক ধাক্কা সামলাতে না পেরে পেছনে বিছানার ওপর পরে গেল জীম। শাহবীর এগিয়ে আসলো ওর কাছে। তারপর জীমের হাতের কব্জি শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
“ডিভোর্স নিয়ে কী করবি?”
“মরবো, জাহান্নামে যাবো। কোনো সমস্যা আপনার?”

জীমের ত্যাড়া ত্যাড়া জবাব। শাহবীর এবার ছিটকে সরিয়ে দিলো ওর হাত। ঝুঁকে জীমের চুলের মুঠো চেপে ধরে উঠিয়ে নিজের কাছে টেনে নিলো ওকে। কোমর পেঁচিয়ে ধরলো এক হাতে। খুব শক্ত করে। জীমের সহ্য হচ্ছে না আর। সহজে কান্না আসে না ওর৷ কিন্তু আজ আসছে। লোকটার কোনোকিছুর পরোয়া নেই! কি নির্দয়ভাবে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে ওকে! যেকোনো সময়ে সইতে না পেরে মূর্ছা যেতে পারে ও। শাহবীর ওর গ্রীবায় নিজের হাতের আলিঙ্গন দৃঢ় করলো। গলার ভাঁজে বেশ জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
“জাহান্নামেই যাহ। তুই যা চাস, তা-ই হবে। ডিভোর্স চাইলে ডিভোর্স পাবি। বাট, একটা কন্ডিশনে।”
জীম জিজ্ঞসু দৃষ্টিতে সরু চোখে তাকালো শাহবীরের মুখপানে। শাহবীর বুঝতে পেরে বললো,

“আমার কাজ, কি করছি না করছি— এসব নিয়ে একটা কথাও বলবি না। জাস্ট একটা টুঁশব্দও হবে না। বোঝা গেল?”
কথার সুরে শাসানোর ভাবটা স্পষ্ট। হুঁশিয়ারি করা যাকে বলে। এদিকে জীমের হৃৎপিণ্ড যেন এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে। লোকটা অনায়াসে তাকে ডিভোর্স দিতে রাজি হয়ে গেল! কতটা নিষ্ঠুর, পাষাণ! জীমের হঠাৎ কান্না পেল ভীষণ। কিন্তু এই লোকের সামনে কোনোভাবেই তা প্রকাশ করবে না। শাহবীর সহজে ক্ষেপে না। এখন নির্ঘাত মেজাজ বিগড়ে গেছে। তুইতোকারি করতেও দ্বিধা করছে না। জীম উঠে বসার চেষ্টা করলো। সরে যেতে চাইলো। শাহবীর ওকে সরতে দিলো না। একইভাবে চেপে ধরে বললো,

“সামান্য ইস্যুকে টেনে এতো বড় করে কী বোঝাতে চাইছিস তুই? নিজেকে খুব শেয়ানা আর বুদ্ধিমান মনে করিস? তোর কোনো অধিকার নেই আমার সব বিষয়ে প্রশ্ন করার, কৈফিয়ত চাওয়ার। সুতরাং, এখন থেকে যখন দূরে সরেই থাকবি, তাহলে এতটুকুও জেনে রাখ, তোকে কোনো বিষয়ে আমি কৈফিয়ত দেবো না। আগে যেটুকু অধিকার ছিল, তা-ও আজ নিজের দোষে হারালি। তোর মুখের ভাষা… জাস্ট মানুষকে পুড়িয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আঘাত করতে ছুরির প্রয়োজন হয় না। তোর মতো মেয়েমানুষের মুখের কথাই বা কম কীসে? আজকের পর থেকে আমাকে আর জ্বালাবি না। আমি টলারেট করবো না। এখন বল, তুই এই ঘরে থাকবি? নাকি আমি থাকবো?”
জীম হা করে তাকিয়ে থেকে শাহবীরের কথা গিলছিল। এই লোক এতো কঠোরভাবে বলতে পারে! ওর নাকি কোনো অধিকার নেই! আজ শাহবীর নিজের কাছে জীমের অবস্থান কেমন, তা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিলো জীমকে। পারিবারিকভাবে বিয়ের কোনো মূল্য-ই নেই ওর কাছে! হ্যাঁ এর আগেও বহুবার জীমকে বকাঝকা করেছে, ধমক দিয়েছে, কঠোর কথা শুনিয়েছে; কিন্তু আজকের মতো এমন কঠোর কখনো হয়নি৷ জীমকে কি তাহলে বুঝতে পারে না? নাকি জীম নিজেকে বোঝাতে পারে না?

জীম এবার ধাক্কা দিলো শাহবীরকে। ওড়না টেনে গায়ে জড়িয়ে নিলো। নিজের যেই লাগেজ খুলেছিল, সেটায় জিনিসপত্র সব ঠিকমতো ঢুকিয়ে নিলো। এই ঘরে থাকবে না সে। প্রশ্ন-ই আসে না। এমন নির্দয়ের সাথে এক ঘরে থাকা যায় না। ডিভোর্সের বিষয়টা সহজেই মেনে নিয়েছে। তারমানে অন্যকিছু আছে শাহবীরের মনে। ভাবতেই কান্না পায় জীমের। গলা অবধি দলা পাকিয়ে ঢোক গিলে নিলো ও।
শাহবীর উঠে দাঁড়িয়ে মানিব্যাগ পকেটে রেখে বের হওয়ার আগে বললো,
“আত্মীয় বাড়িতে যেন কোনো সিনক্রিয়েট না হয় সিলভি। কথাটা মাথায় রেখে নিচে আসবি।”

জীম উঠতেই যাচ্ছিল। শাহবীরের কথা শুনে সেখানেই বসে রইলো। হাতের লাগেজটা শক্ত করে ধরে রাখলো। ওকে কি মনে করে শাহবীর! জীমের প্রবল আত্মসম্মানে লাগলো। শাহবীর বেরিয়ে যেতেই দরজা আটকে দিলো ভেতর থেকে। ওড়না ছুঁড়ে ফেললো কাঠের ফ্লোরের ওপরে। ক্লিপ খুলে পরিপাটি করে গোছানো চুল এলোমেলো করে ফেললো। কাজল পরলো না চোখে। দূরে ছুঁড়ে মারলো কাজলটা। ঠোঁটে হালকা করে দেওয়া লিপস্টিকও মুছে ফেললো। বিছানার ওপর বসে কাঠের দেয়ালে হেলান দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো ও। এবার আর নিজেকে আটকাতে পারলো না জীম৷ হেঁচকি তুলে কান্না করতে লাগলো।

কান্নার আওয়াজ যেন কেউ না শোনে, এজন্য মুখে কাপড় গুঁজে রাখলো। জীমের আজ মনে হলো, শাহবীর তাকে কখনোই ভালোবাসেনি। ভেবেছিল— পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে, ধীরে ধীরে সবকিছু এগোবে। দু’জন দু’জনকে জানবে। স্বামীকে বন্ধুর মতোই ভাবতো জীম। কিন্তু আজ শাহবীর যেই রূপ দেখালো, তারপর মনে হয় না আর এই সম্পর্ক জোর করে এগোতে পারবে জীম। এতোদিন কম চেষ্টা তো করেনি ও! নিজের থেকে বিপরীতমুখী স্বভাবের একজন মানুষের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে গেছে। সেই মানুষটা-ই যদি দূরে সরিয়ে দেয়, আঘাত করে; তাহলে এরচেয়ে যন্ত্রণার আর কী হতে পারে? কান্না করতে করতে জীমের মাথা যন্ত্রণা হতে শুরু করলো। মাথা চেপে ধরে বসলো ও। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামছে না কোনোভাবেই। মনের অস্থিরতা কমাতে পারছে না জীম। এবার সত্যিই সম্পর্ক শেষ করে দেবে ও। এই চট্টগ্রামের ট্যুর শেষ করে ফেরার পরেই!

“বৌমণি, ও বৌমণি।”
দরজার ওপাশ থেকে তাজরীনের গলার স্বর শুনে দ্রুত উঠে সোজা হয়ে বসে জীম৷ চোখ-মুখ মুছে চুল খোপা করে নেয়। দরজা না খুলে কেশে গলা ঝেড়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কী হয়েছে?”
“তুমি আসবে না নিচে? সকালের নাস্তা দিচ্ছে খালামণি। তোমাকে ডাকছে সবাই।”
জীম এবার দরজার ওপাশ থেকেই বললো,
“আমার এখন খিদে নেই। মাথা ধরেছে খুব। গিয়ে বলো, আমি খাবো না। আমার জন্য চিন্তা না করতে। তোমরা নিশ্চিন্তে খেয়ে নাও।”

“খাওয়ার পরে যে আমরা ঘুরতে যাবো। তাহলে রেডি হয়ে থাকো। আমি আর রিক্তি তোমার খাবার নিয়ে আসছি এখানে। খাওয়া শেষ করে বের হবে আমাদের সাথে।”
“আমি কোথাও যাচ্ছি না তাজ। আর আমার জন্য খাবারও এনো না। খাবো না, শুধুশুধু খাবার নষ্ট হবে। প্লিজ, অনুরোধ করছি।”
শেষের কথাটুকু হালকা কঠোর গলায় বললো জীম। দরজার এপাশে তাজরীন আর রিক্তি ছিল। ওরা একে-অপরের দিকে অবাক হয়ে তাকালো জীমের কথা শুনে। তারপর আস্তে করে নিচে চলে গেল। ওরা যেতেই জীম সেখানেই হেলান দিয়ে বসলো। আবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তাজরীন এসে হাজির হলো। দরজায় কড়া নেড়ে ওপাশ থেকে জবাবের অপেক্ষা না করে জোরে বললো,

“বৌমণি, ভাইয়া ডেকেছে তোমাকে। মাথা ব্যাথা করলে খাওয়ার পরে মেডিসিন নিতে হবে। তবু নিচে যেতে হবে তোমাকে। ভাইয়ার আদেশ। যদি দুই মিনিটের মধ্যে না নামো, তাহলে কিন্তু ভাইয়া ওপরে আসবে। আর ভাইয়া ওপরে আসলে…”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১২

তাজরীন পুরো কথা শেষ করলো না। দরজা ধাক্কাতে লাগলো। জীম বিছানা থেকে নেমে ওড়না পরতে পরতে দরজার দিকে তাকিয়ে গজগজ করতে লাগলো। বিরক্তি মুখে বললো,
“ভাইও যেমন, তার বোনও সেরকম। নাছোড়বান্দা! সবগুলো খারাপ!”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৪