নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৪

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৪
ঝিলিক মল্লিক

উঠোনে বিছানো শীতল পাটির ওপরে বসেই সবার সকালের নাস্তার আয়োজন চলছে। যদিও পুরোপুরি সকাল এখনো হয়ে ওঠেনি। বাইরে দূর-দূরান্তে শুধুই কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। উঠোনের ওপাশেই সরু মাটির রাস্তা। সেই রাস্তা সোজা চলে গেছে অনেকটা দূরে। এই মাটির রাস্তা পেরিয়ে তারপরেই মেইন রোড। দীর্ঘ এই মাটির রাস্তার দুই পাশে অনেক ধানক্ষেত, বিল, অসংখ্য খেজুর, নারকেল আর তালগাছ। আগামীকাল সকালে নাকি খেজুরের রস সংগ্রহ করা হবে। তাই আজ ইকবালের বড় চাচা জামশেদ ভুঁইয়া ও তার ছোট চাচা আজাদ ভুইঁয়া বেশ কয়েকজন ছেলেপেলেকে সঙ্গে নিয়ে দেখতে গিয়েছেন খেজুর গাছগুলো।
গ্রামের শীতের সকাল। তাই গরম গরম ধোঁয়া ওঠানো লাল চাউলের ভাত, ঝাল ঝাল বেগুন ভাজা, ডিম সিদ্ধ আর দেশি মুরগির ঝোল রান্না হয়েছে।
সবাই বেশ তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে।

জীম কখন থেকে এক লোকমা প্লেটে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। এখনো অনেকটা খাবার বাকি রয়েছে ওর। বাকিদের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। মূলত জীম খেতে খেতেই সময় কাটিয়ে দিতে চাইছে অনেকটা। যাতে অন্যরা ঘুরতে যাওয়ার জন্য তাড়া দিলেও খাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে যাওয়া নাকচ করতে পারে।
জীমের পাশে বসেছিল তাজরীন। কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে ও। খাওয়ার মাঝেই বেশ কয়েকবার আড়চোখে নিজের ভাইকে, তারপর আবার বৌমণিকে লক্ষ্য করেছে। বড়ভাই তো নিজের মতো খেয়েই চলেছে। কোনোদিকে তাকাতাকি নেই। এদিকে আবার বৌমণিও কিছু কম যায় না। একবারের জন্যও মুখ তুলে চায়নি। এতগুলো সিঙ্গেল মানুষের মধ্যে তারা যে স্বামী-স্ত্রী, তাদের দেখলে তা বোঝাই যায় না। তাজরীনের মনে হলো, হয়তো আবার কোনো ঝামেলা হয়েছে তার ভাই-ভাবীর মধ্যে। অবশ্য এটা কোনো আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। এমন ঝগড়াঝাঁটি তাদের মধ্যে প্রায়ই লেগে থাকে। সামান্য সামান্য ব্যাপার নিয়ে বিরাট কাইজ্জাকাইজ্জি বেঁধে যায়। তার বড়ভাই বিয়ের পর যতোবার বাড়িতে এসেছে ছুটিতে, ততোবার তার বৌমণির সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে তবেই ফিরেছে সেনানিবাসে। এছাড়াও ফোনকলে ঝগড়াঝাঁটি তো আছেই!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাজরীন ডানপাশে বসা তহুরাকে দেখলো একবার। অন্যান্য দিনের তুলনায় মেয়েটাকে ভীষণ মনমরা দেখাচ্ছে। এমন তো থাকার কথা নয়। তহুরা হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে। আর তাজরীন সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পছন্দ করে। কিন্তু আজ আসরে সবাই-ই চুপচাপ রয়েছে। যেন কোথাও শোকের কোনো ঘটনা ঘটেছে। সামনের সারিতে বসা ছেলেগুলোকে দেখলো তাজরীন। শোয়েব আর রায়ান নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ করছে। রুবায়েতকে গম্ভীর মুখে খেতে দেখা গেল। ওদিকে একবারের বেশি তাকালো না তাজরীন। হাসান নিজের মতো করে খাচ্ছে। আফিম ফোন স্ক্রল করছে খেতে খেতে। সম্ভবত গার্লফ্রেন্ডের সাথে টেক্সটে কথা বলছে। আফিমকে একবার দেখে সরু চোখে পাশে আনমনে খেতে ব্যস্ত তহুরাকে দেখলো তাজরীন। কি বুঝলো কে জানে! হঠাৎই তহুরার হাতে কনুই দ্বারা খোঁচা মারলো ও। তহুরা এক লোকমা খাবার মুখে তুলতেই যাচ্ছিল। খাওয়া বন্ধ রেখে তাজরীনের দিকে তাকালো ও। তাজরীন এবার কেউ যেন শুনতে না পায়, এজন্য গলার স্বর যথেষ্ট নিচু করে বললো,

“তোমার কী মন খারাপ তহু?”
“না তো!”
চমকে উঠে জবাব দিলো তহুরা। যেন গুরুতর কোনো প্রশ্ন করা হয়েছে ওকে, নয়তো ও কোনো অপরাধ করেছে। তহুরা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে এদিক-ওদিক তাকালো। তাদের কথোপকথন কেউ শুনে ফেললেই বুঝি সমস্যা। তহুরা একবার সামনে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তাজরীন ওর কানের কাছে মুখ এনে বললো,
“হৃদয়ের কথা মুখের বুলি হয়ে না ঝরলে তাতে তোমারই ক্ষতি। অপরকে দোষারোপ করে লাভ কী বলো?”
তহুরা আবারও চমকে তাকালো তাজরীনের দিকে। পরপরই মুখ নুইয়ে খেতে খেতে বললো,
“কিছু কথা চাইলেও বলে ফেলা যায় না। সম্পর্ক নষ্ট হয়। যেটুকু আছে, তা-ও দূরত্ব বাড়িয়ে নেয়। দরকার কী?”
“নিজেকে কষ্ট দেওয়ার চাইতে একটুখানি যেচে এগোলে কোনো ক্ষতি নেই। ভালোবাসার ক্ষেত্রে এই শব্দটা এক্সিস্ট করে না৷”

“নিজেকে কী স্বান্তনা দিয়ে এগোবো? যেখানে মানুষটা অন্য কারো!”
“সুযোগ তৈরি করে দিয়েছো কেন?”
“কখনো সেই সম্পর্ক হয়েই ওঠেনি! নামমাত্র অধিকার খাটাতে পেরেছি শুধু। অথচ কখনোই বুঝিনি, তাকে আটকে রাখার অধিকার আমার নেই। যা খুশি করুক। আমার তাতে কী?!”
“তোমার কী?”
“কিছুই না।”
“তাহলে তড়পাচ্ছো কেন?”
“তুমি বেশি বুঝো।”
“আমি সঠিকটা বুঝি। একজন মেয়ে আরেকজন মেয়ের মন পড়ার ক্ষমতা রাখে।”
“আমার কোনো মন নেই।”
“তাহলে চোখের কোনো জল চিকচিক করছে কেন?”
“কই? না তো!”

অবাক ভঙ্গিতে কথাটা বলেই হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা তাড়াহুড়োয় চোখের কোনা মুছে নেয় তহুরা। তারপর বলে,
“কিছু কিছু জিনিস দূর থেকে সুন্দর। আর কিছু সম্পর্ক অধরা থাকা ভালো।”
তাজরীন আর তৎক্ষণাৎ কথা বাড়াতে পারলো না। খাওয়া শেষ করে ওঠার আগে বললো,
“তবু একবার ভেবে দেখো তহু।”
“আমার কাছে অপশনটা-ই নেই তাজ। থাকলে কি আমি চেষ্টা করতাম না ভেবেছো?”
“তুমি অপশন তৈরি করে নাও। টাইম পাস আর ভালোবাসার মধ্যে কিন্তু আকাশ-পাতাল তফাত।”
“আমি কনফিউজড! তাছাড়াও অপজিটের মনোভাব সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।”
“ধারণা নেই, তবে জেনে নাও। কনফিউশান দূর করো।”
“উপায়?”

তহুরা আর তাজরীন ততক্ষণে উঠে গেছে খাওয়া।শেষ করে। বাড়ির পেছন দিকের আম-কাঠালের বাগানের দিকটায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগলো ওরা। তাজরীন বললো,
“অপজিটের মাইন্ড হ্যাক করা যায় কীভাবে জানো?”
“কীভাবে?”
পাল্টা প্রশ্ন করলো তহুরা। তাজরীন বিজ্ঞদের মতো পরামর্শ দিতে শুরু করলো—
“জেলাসি। জেলাস ফিল করাতে হবে। যদি ফল করে তাহলে বুঝবে অ্যাট্রাকশন আছে, আর যদি না করে তাহলে বুঝবে কিচ্ছু নেই। নাথিং!”
তহুরা কয়েকবার মাথা নেড়ে সায় জানালো তাজরীনের কথায়। বললো,
“একজন ছেলে আছে। আমাকে পছন্দ করে। আমার বাবার বাড়ির এলাকায়। ফেসবুকে অ্যাড আছে। আমাকে প্রপোজ করেছিল মাঝে একদিন। বিনাবাক্যে না করে দিয়েছিলাম। ছেলেটা বলেছিল, অপেক্ষা করবে আমার জন্য।”
“বাহ! তাহলে তো ভালোই হলো৷ ওই ব্যাটাকেই কাজে লাগাবে এখন। প্রপোজাল একসেপ্ট করো। তারপর দেখবে জেলাসি কাকে বলে!”
“দেখি কি হয়!”

কথাটা বলে কিছুক্ষণ থামে তহুরা। তারপর ফিচেল হেঁসে বললো,
“প্রেম-ভালোবাসা বিষয়ে খুব ধারণা রাখো দেখছি।”
তাজরীন ভীষণ উৎফুল্ল। সবাইকে মাতিয়ে রাখতে ভালোবাসে ও। মনমরা পরিবেশ পছন্দ হয় না। তহুরার মন ভালো হতে দেখে খুব খুশি হয়েছে। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ও বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ। জানো, আমাদের ডিপার্টমেন্টের অনেকের প্রেমের জন্য ঘটক হয়েছে আমি। মহিলা ঘটক। দারুণ না?”
“খুব দারুণ।”
“এসব বিষয়ে ভালো জ্ঞান আছে বলেই তো বুঝতে পারছি, ভাইয়া আর বৌমণির মধ্যে ঝামেলা বেঁধেছে আবার, বুঝলে!”
“কি বলো! ঠিক হয়নি কিছু?”

তহুরা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো। তাজরীন হতাশার সুরে বললো,
“না গো। ওরা দু’টো একইরকম। কেউ কারো চেয়ে কম না। ইগো প্রচুর। এর আগেও বহুবার দেখেছি তো! যদিও পরে আবার দু’জনে মিলে গেছে। কিন্তু আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসে এখন ঝগড়াঝাঁটি করে দূরে দূরে থাকা মানায় না। আমি ভাবছি, ওদেরকে মিলানোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা!”
“কিন্তু কীভাবে?”
তাজরীন তহুরাকে নিয়ে এবার উল্টোপথে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“প্ল্যানিং চলছে মনে মনে। তবে এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ একজনকে দরকার।”
“কাকে দরকার?”
“মেজর রুবায়েতকে।”

তাজরীন নারকেল গাছের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ালো। সামনেই পাটির ওপরে এখনো বসে আছে সবাই। রুবায়েতকে দেখা যাচ্ছে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বরই গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের মাঝখানটায়। তহুরা এবার ওকে টেনে ধরে বললো,
“রুবায়েত ভাইকে দিয়ে কী করবে?”
“উনি আমাদের হেল্প করবে এই কাজে। উনাকে দরকার।”
“রুবায়েত ভাই করবে না, আমি শিওর। আমাদের টিমে মেজর আর রুবায়েত ভাই অনেক স্ট্রিক্ট। তাদের সাথে আমরা কাজের বাইরে বাড়তি কথা বলি না। আর রুবায়েত ভাই তো গম্ভীর, চুপচাপ স্বভাবের। ভাই কোনোদিনও রাজি হবে না।”

“আমি রাজি করাবো।”
তাজরীন কথাটা অনেক আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো। তারপর নারকেল গাছের ওপাশে দাঁড়িয়ে থেকেই সামনাসামনি হাত সাতেক দূরে থাকা বরই গাছের সামনে দাঁড়ানো উঁচুলম্বা লোকটার দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো। রুবায়েতের নজর ছিল দূরে পুকুরের দিকে। এদিকে খেয়ালও করেনি ও। কিন্তু তাজরীনকে ইশারা করতে দেখে ফেললো শোয়েব। ও সবে উঠেছে। রুবায়েতের পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“ভাই, আপনারে মেয়েমানুষ ডাকতেছে। ইশারা করতেছে দেখেন।”
শোয়েবের কথা শুনে রুবায়েত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো এদিকে। শোয়েবের হাতের আঙুল লক্ষ্য করে সামনে তাকালো। তাজরীনকে ইশারা করতে দেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। মুখে ‘চ’ জাতীয় শব্দ উচ্চারিত হলো। শোয়েবের মুখ উজ্জ্বল। ও এবার উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১২

“ভাই, এই ইশারা কিন্তু সাধারণ ইশারা না, প্রেমের ইশারা। দ্রুত যান। ইশারায় আশারা দেন!”
রুবায়েত পরেছে মহাবিপদে। ওদিকে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা-ই নেই ওর। লম্ফঝম্প করা মেয়েটা ডেকেই চলেছে সমানে। ইতিমধ্যে শোয়েব নেগেটিভ মাইন্ডে নিয়ে নিয়েছে। ও আবার পেট পাতলা। এখুনি গিয়ে দেখা গেল সবাইকে বলে দিয়েছে। তারমধ্যে আবার এই ঘটনা অন্যদের নজরে পরলে তারাও ভালোভাবে নেবে বলে মনে হয় না। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রুবায়েত হেলান থেকে দাঁড়িয়ে পকেট হতে হাত বের করে সামনের দিকে এগোলো। ওদিকে কেউ নেই মেয়েটা ছাড়া। আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মন চাচ্ছে, আজ ঢ্যাঁড়া মেয়েটাকে ঠাটিয়ে একটা চড় মেরে বসতে!

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৫