নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৫

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৫
ঝিলিক মল্লিক

তাজরীন দাঁড়িয়ে আছে তালগাছের গুঁড়ির সাথে হেলান দিয়ে। ওর সামনে রুবায়েত এক হাত গাছের সাথে ঠেকিয়ে আরেক হাত পকেটে ঢুকিয়ে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাজরীনের অস্বস্তি হচ্ছে প্রচন্ড। তহুরাও নেই এখানে। রুবায়েতকে আসতে দেখে আগেই পগারপার হয়েছে। সম্ভবত ওরা সবাই এই লোকটাকে খুব ভয় পাই। তাজরীন লাফিয়ে যে সরে যাবে, সেই উপায়ও নেই। নিজেই টেনে ধরে রুবায়েতকে এখানে এনেছে।
বাড়ির পেছন দিকে ধানক্ষেত। ওপাশে বিল। ধানক্ষেতের ডিঙায় সারি সারি নারিকেল, আম-কাঁঠাল আর তালগাছের অবস্থান। রুবায়েত উঠোন থেকে আসা মাত্রই তাজরীন তার হাত টেনে ধরে এখানটাকে নিয়ে এসেছে। কিছু বলার সুযোগও দেয়নি। আর তার-ই ফল এখন হাতেনাতে, নগদে পাচ্ছে। রুবায়েত গম্ভীর কন্ঠে তাজরীনকে প্রশ্ন করলো,

“সমস্যা কী আপনার?”
তাজরীনের রাগ হলো খুব। সেই শুরু থেকে লোকটা তাকে “আপনি” সম্বোধন করছে। এর কোনো মানে হয় না! কই? বাকিরা তো স্বল্প পরিচয়েও ওকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে! তাজরীন এবার রুবায়েতের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“আপনি আমাকে ‘তুমি’ করে বলতে পারেন না?”
“হোয়াই?”
পাল্টা প্রশ্নে বিভ্রান্ত হলো তাজরীন। থতমত খেলো। তারপর আবার অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বেশ ভাব নিয়ে বললো,
“নিজের থেকে কম করে হলেও বয়সে ৭-৮ বছরের বড় কেউ যদি ‘আপনি” সম্বোধন করে, তাহলে নিজেকে অনেক সিনিয়র সিনিয়র লাগে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোহ?”
রুবায়েত বিনা প্রতিক্রিয়ায় প্রশ্ন করলো তাজরীনের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে। তাজরীন কিঞ্চিৎ অনুরক্তিতে জবাব দিলো,
“কিন্তু আমি তো আপনার সিনিয়র নই। জুনিয়র হই।”
রুবায়েত এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। প্যান্টের পকেটে হাত রেখে উল্টোদিকে ঘুরে মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“কি নাটক দেখাতে ডেকেছেন এখানে, তাড়াতাড়ি শেষ করুন। যেতে হবে আমাকে।”
“আগে আমাকে তুমি করে বলুন।”
তাজরীন হঠাৎ অনুচিত আবদার করে বসলো। রুবায়েত ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর গম্ভীর স্বরে বললো,

“দ্রুত আপনার নাটক শেষ করুন। কুইক!”
“আগে তুমি করে বলুন।”
তাজরীন নাছোড়বান্দা। জেদ ধরেছে, লোকটা তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন না করলে সে কিছুই বলবে না। চুপ করে বোবা হয়ে থাকবে। আচনক রুবায়েত গাছের দুই পাশে হাত রেখে তাজরীনকে আটকে নিলো। কিছুটা ঝুঁকে তীক্ষ্ণ নজরে ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
“আপনার কী মনে হয়? আপনার নাটক দেখার খুব শখ আমার?”
“হতেই পারে। অসম্ভব কিছু নাকি?”
তাজরীন গা ছাড়া ভাব নিয়ে জবাব দিলো। নিজের প্রতি প্রচুর আত্মবিশ্বাস ওর। কথাবার্তা খুবই নাছোড়বান্দা ধরনের। ছাড়াছাড়ি নেই। রুবায়েত এবার কঠোর গলায় বললো,
“আপনি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদেরকে আমি গুরুত্ব দিয়ে থাকি।”
তাজরীনের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ সুক্ষ্ম হাসি ছিলো। রুবায়েতের কঠোর কথাটা শোনামাত্র এবার মিলিয়ে গেল। মুখ মলিন হয়ে উঠলো। তবু প্রকাশ না করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে ও দৃঢ়ভাবে বললো,
“আপাতত গুরুত্ব দিতে হবে।”
“বাট হোয়াই?”
“কারণ..কারণ…”

তাজরীন এবার কথার খেই হারালো। মহা মুসিবত তো! এমনটা ওর সাথে কখনো হয়নি। মানুষকে ঘোল খাওয়ানোতে বরাবরই ওস্তাদ। ওকে কেউ সহজে টেক্কা দিতে পারে না। সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর দক্ষতা ওর আছে। এমনকি রাগী, বদমেজাজি খেতাব পাওয়া তাজরীনের বড়ভাইও ওর নিকটে নতস্বীকার যায়। কিন্তু এই আর্মি ম্যানের সাথে কোনোভাবেই পেরে উঠছে না তাজরীন! এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। সঙ্গে হতাশারও। হতাশা তো আর বলেকয়ে আসে না! হঠাৎ হঠাৎ চলে আসে। কুয়াশাচ্ছন্ন এই সকালের ঠান্ডা হাওয়ার সাথেও ভেসে আসে। এই যেমন এখন আসছে তাজরীনের। কানটুপি কানের কাছ থেকে সরে গিয়েছিল। সেটা টেনে ঠিক করে নিলো। শরীরে পেঁচানো শাল চাদরটা খুলে আবার ঠিকভাবে জড়িয়ে নিলো। তারপর আবার তাজরীনের আত্মবিশ্বাস যেন ফিরে এলো। কন্ঠস্বর কিছুটা নরম করার চেষ্টা করে বললো,
“ভাইয়া, প্লিজ একটু কনভিন্স করুন। তুমি করে বললে আমি কম্ফোর্টেবল ফিল করতাম। তারপর মন খুলে কথাগুলো বলতে পারতাম।”

তাজরীন এতোক্ষণ যতোটা ভাব নিয়ে ছিল, তা এখন আর রইলো না। রুবায়েত এবার বাঁকা হেসে বললো,
“বাচ্চা মানুষ অনুরোধ করছে, ফেলে দিতে তো আর পারি না। আচ্ছা! বলো কি বলবে।”
“আমার একটা হেল্প দরকার।”
“আমার থেকে? আমি কীভাবে হেল্প করবো তোমাকে?”
“ভাইয়া তো আপনার খুব ভালো বন্ধু তাই-না?”
“হ্যাঁ, তো?”
“তো আপনি ভাইয়াকে একটু কনভিন্স করবেন।”
“কি বিষয়ে?”
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো রুবায়েত। তাজরীন জবাব দিলো,

“আই থিংক, ভাইয়া-বৌমণির ঝগড়া হয়েছে। আপনি ভাইয়াকে কনভিন্স করাবেন, যাতে বৌমণির রাগ ভাঙায়।”
“হাসবেন্ড-ওয়াইফের পার্সোনাল ম্যাটার। ইন্টারফেয়ার না করা-ই বেটার।”
রুবায়েত এবার রুক্ষ স্বরে কথাটা বললো৷ তাজরীন কোমরে হাত গুঁজে বললো,
“আরেহ ওদের দুটোরই ইগো বেশি। ট্যুর শেষ হলেও ওদের মনোমালিন্য শেষ হবে না। ট্যুরটা মাটি হোক, আমি চাইছি না। বাসায় থাকলে একাই ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে পারতাম। কিন্তু এখানে পসিবল না। তাই আপনার হেল্প চাইছি। নাহলে আপনার কাছ থেকে হেল্প চাইতে আমার ছেঁড়া..”
তাজরীন পুরো কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই রুবায়েতের কঠিন দৃষ্টিতে চোখ পরতেই চুপ হয়ে গেল। রুবায়েতের হাত সরিয়ে দিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিয়ে বললো,

“আপনি আমাকে হেল্প করবেন কিনা তাই বলুন।”
“যদি না করি?”
“এই না করি মানে কী? তাহলে এতোটা সময় নষ্ট করলাম কেন আমি?”
“তোমার সময় নষ্ট হয়নি। উল্টো আমার সময় নষ্ট করেছো। বেশি কথা বলবে না। বেশি কথা বলা মেয়েমানুষ পছন্দ করি না।”
“না করলে না-ই। তাতে আমার ছেঁড়া..”
“আবার!”
রুবায়েতের জোরেসোরে দেওয়া ধমকটা খেয়ে এবার চুপ হয়ে গেল তাজরীন। রুবায়েত এবার কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বললো,
“হেল্প করতে পারি, একটা শর্তে।”
“কী শর্ত?”
তাজরীন কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে রুবায়েতের পেছনে হাঁটতে লাগলো। রুবায়েত গা ছাড়া ভাব নিয়ে জবাব দিলো,
“আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করো। ভদ্রভাবে থাকো৷ যদি তোমার আচরণ, মতিগতি পছন্দ হয়; তাহলে বিষয়টা ভেবে দেখবো।”
রুবায়েত আগে হেঁটে চলে গেলে। তাজরীন সেখানে কোমরে হাত গুঁজে মুখ হা করে দাঁড়িয়ে রইলো। বিস্ময় সীমা ছাড়াচ্ছে!

জীমের মন চাচ্ছে, উঠে গিয়ে শাহবীর রুস্তমের মাথাটা ফাটিয়ে দিতে। একবারের জন্যও জীমের দিকে তাকাচ্ছে না নিষ্ঠুর লোকটা। অথচ রিক্তিকে ওপাশে দাঁড়িয়ে নাকি বলেছে, জীমকে নিয়ে আসতে। সবাই ঘুরতে বেরোবে। জীম না করতেই আবারও কঠোরভাবে শাসিয়ে বলেছে রিক্তির কাছে। রিক্তিও অগত্যা জবরদস্তি করছে জীমকে৷ যেন হাঁটের দিকে ঘুরতে বের হয়। জীম বসে বরই খেতে খেতে উত্তরে পুকুর ঘাটের কোনার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। শাহবীর কথা বলছে তার ভাইদের সাথে। সবার সাথেই হেঁসে হেঁসে কথা বলছে। তবু একবার জীমের দিকে ঘুরেও তাকাচ্ছে না৷ লোকটা কী বুঝতে পারছে না? জীম কষ্ট পাচ্ছে! নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছে? জীম মনে মনে গালাগালি করলো রুস্তমকে। তারপর পাটি থেকে উঠতেই কোথা থেকে যেন মাহমুদ আসলো। মাহমুদের সাথে এরমধ্যে টুকটাক কথাবার্তা হয়েছে জীমের। মাহমুদ একটা মিষ্টির প্যাকেট জীমের হাতে ধরিয়ে দিলো বললো,
“ডিয়ার ভাবী, এরমধ্যে মিষ্টি আছে। শুধুমাত্র আমার সুইট ভাবীর জন্য। খেয়ে বলুন তো, কেমন? আমাদের এখানকার বিখ্যাত মিষ্টি। লুকিয়ে এনেছি। তাজরীন ওরা কোথায়?”

“ওরা তো ওইপাশে।”
“তাহলে আপনি খেয়ে দেখুন।”
মাহমুদ ছেলেটা এমনিতেই মিশুকে স্বভাবের। দেখলেই বোঝা যায়। জীমের বছর দুয়েকের বড় হতে পারে। তবে জীমের অস্বস্তি হতে লাগলো। এদিকটাতে বিয়েবাড়ির মেহমানরা নেই৷ জীম অস্বস্তি নিয়েই মিষ্টির প্যাকেটটা ধরে রাখলো। মুখ বিরস ওর। তবু জোরপূর্বক হাসি দিলো। তখনই পুকুরের দিকটায় চোখ পরতেই দেখলো, শাহবীর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। যেন ওই চোখ দিয়েই পারলে গিলে ফেলবে জীমকে। জীম এবার ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলো। সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখমুখের সব অস্বস্তি দূর হলো। মুখের জোরপূর্বক হাসিটা সরিয়ে জীম উৎফুল্ল ভঙ্গিতে হেঁসে বললো,

“থ্যাংক ইউ ভাইয়া। খেয়ে দেখছি আমি।”
“আরেহ থ্যাংক ইউ দেওয়ার কি আছে! আমরাই তো। এভাবে থ্যাংক ইউ বলে লজ্জা দেবেন না। আপনারা আমাদের মেহমান।”
জীম মুচকি হেঁসে সরু চোখে শাহবীরকে দেখলো। এখন কাছে থাকলে নির্ঘাত গলা টিপে জানে মেরে ফেলতো ওকে। ভাবলেই ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলো জীম। আবার বেশ খুশি খুশিও লাগলো। পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে ও। মাহমুদের সাথে হেঁসে হেঁসে আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললো। এমনভাবে কথা বলতে লাগলো, যেন কত বছরের পরিচিত, আপন মানুষ তারা!

শাহবীর এবার হঠাৎ আলাপ বাদ দিয়ে এগিয়ে আসলো এদিকে। জীমের ইচ্ছা হলো, ছুটে পালাবে। কিন্তু পারলো না৷ সেই সুযোগ-ই পেল না ও। তার আগেই শাহবীর কাছাকাছি এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। মাহমুদ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। জীমের হাতে মিষ্টির প্যাকেট। তখনও একটা মিষ্টিও মুখে দেয়নি ও। শাহবীর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জীমের হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা টেনে নিলো। প্যাকেটের মুখ খুলে একটার পর একটা মিষ্টি মুখে পুরতে পুরতে মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“মাহমুদ, ছোটভাই মিষ্টি এক প্যাকেট কেন? আমার জন্য আনিসনি? আমি তো আবার সুইট লাভার। এতো কম মিষ্টিতে চলে না বুঝলি। যাহ, হাঁট থেকে আরো এক প্যাকেট নিয়ে আয়।”
মাহমুদ কিছুটা অপ্রস্তুত হেঁসে বললো,
“আচ্ছা ভাইয়া। আমি এখনি যাচ্ছি।”

মাহমুদ সেখান থেকে সরতেই শাহবীর মিষ্টির প্যাকেট পাটির ওপর রেখে সেখানে রাখা গ্লাসের পানি দিয়ে হাত ধুয়ে জীমের ওড়নায় মুখ মুছে হাত মুছতে মুছতে দাঁতে দাঁত পিষে ফিসফিস করে বললো,
“মিষ্টি তোমাকে জনমের মতো খাইয়ে দেবো সিলভি। রাতে দেখছি বেয়াদব!”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৪

ব্যাটা যে ক্ষেপে গেছে, তা জীমের বুঝতে বাকি রইলো না “সিলভি” ডাকটা শোনামাত্র। মনে মনে ভীষণ ভয়ও পেল সে। তবে মুখে প্রকাশ করলো না। তারপর হঠাৎ মনে পরলো, রাতে ওকে পাবে কোথা থেকে? জীম তো তার ধারেই ঘেঁষবে না। এমনকি শাহবীর নিজেই তো বলে দিয়েছে, তারা আলাদা ঘরে থাকবে। মানে রাতে দেখাদেখি হওয়ার কোনো চান্স নেই। সুতরাং, জীম এখন উড়বে। কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এই লোককে ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই। জীম শাহবীরের পায়ের চামড়া জুতার ওপরে হঠাৎ নিজের মিডিয়াম উঁচু জুতা পরিহিত পা উঠিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ‘আউচ’ শব্দ করে উঠলো শাহবীর। জীম কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলো।

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৬