নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৬

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৬
ঝিলিক মল্লিক

এই অঞ্চলটাকে সৌন্দর্যের দিক থেকে তুলনা করলে খুবই কম করা হবে। এর সৌন্দর্য কোহিনূরকেও হার মানায় সম্ভবত! আসলে প্রকৃতির সৌন্দর্য সবকিছুর উর্ধ্বে। তার ওপরে কিছু নেই।
জীমরা সকালের নাস্তা করার পরপরই বের হয়েছিল। এখন ওরা হাঁটছে ধানক্ষেতের আঁইল ধরে। শীতকালে ক্ষেত শুষ্ক থাকে। তাই নিশ্চিন্তে হাঁটাচলা করা যায়। তাজরীন জীমের হাত ধরে হাঁটছিল। জীম খেয়াল করেছে, অনেকক্ষণ ধরেই তাজরীন ছুঁকছুঁক করছে। সবাই আশেপাশেই আছে। তাই জীম এখন সেকথা তুললো না। ইকবাল ভাই, শাহেদ আর মাহমুদ ছিল সাথে। আয়েশা ভাবিরও আসার কথা। সে জানিয়েছে, হাতের কাজ সেরে ধীরেসুস্থে আসবে। তাই সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। এখনো মূল সড়কে ওঠেনি তারা। গ্রামের রাস্তা ধরেই হাঁটছে। ধানক্ষেতের ভেতরের রাস্তা পেরিয়ে বিলগুলো ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। জীমের আসার কোনো আগ্রহ ছিল না। তাজরীন ওকে একপ্রকার টেনেই এনেছে।

দূরে যতদূরে দেখা যায়, সব ধানক্ষেত, বিল আর শাকসবজির মাঁচা। পেছনে পুরুষেরা কথাবার্তা বলছে কিসব। সম্ভবত আলাপ-আলোচনা করছে। পরিকল্পনা হচ্ছে, আগামীকাল সকালে নাকি কোথাকার কোন গাছ হতে খেজুরের রস ঘাপলা মে’রে আনা হবে। এমনকি কাঁচা খেজুর পেলে তা-ও। এরপর পানিতে ভিজিয়ে রাখার পরে পেকে গেলেই খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হবে।
জীম, তাজরীন, জেসিরা রীতিমতো অবাক হলো। দামড়া দামড়া পুরুষগুলোর কি অদ্ভুত সব পরিকল্পনা। এসব তো এককালে ছোটবেলায় করে বেড়াতো ছেলেপেলেরা। এরা এখনো তা করতে চাইছে! সত্যিই আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয়। তবে পরিকল্পনা চললেও একবারও তারা মেয়েদেরকে তাদের দলে শামিল করলো না। জীম ব্যাপারটা বুঝে মেয়েদেরকে সামনে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আজ বিকালে একটা প্ল্যানিং আছে। সবাই কুঠিবাড়ির পেছনের নারকেল বাগানে চলে আসবে। এখন চুপচাপ থাকো। তারা যা প্ল্যানিং করছে, করতে দাও তাদেরকে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওরা হেঁটে গিয়ে বিলের ওপাশে শুকনো ঘাসের ওপর বসলো। পাশেই মাষকলাই গাছের ক্ষেত। মাষকলাই দিয়ে ভর্তি। সকালের হালকা মিষ্টি রোদ পড়েছে। দেখতে ভালোই লাগছে। মনোরম পরিবেশ। জীম চেয়েছিল, তার শাশুড়িকেও নিয়ে আসতে। কিন্তু ডলি বেগম কাজে ব্যস্ত থাকায় আসেননি। তহুরা চুপচাপ রয়েছে অনেকক্ষণ ধরেই। জেসি আর রিক্তি কিছু একটা নিয়ে ফিসফাস করছিল। জীমের কিছুই ভালো লাগছে না। এতো মানুষের ভিড়েও নিজেকে প্রচন্ড নিঃসঙ্গ লাগছে ওর। ক্ষণে ক্ষণে ভেতর থেকে কান্নারা দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ জীম জোরপূর্বক হাসছে সবার সামনে। নিজেকে হাসিখুশি দেখানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কতটুকু পারছে, তা জানে না। তহুরা ঘুরে বসেছে। নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করছে। এরইমধ্যে ইকবাল ভাই এসে কিছু মাষকলাই দিয়ে গেলেন। ক্ষেত থেকে উঠিয়ে এনেছেন। জীমরা সেগুলোর খোসা ছিলে খেতে ব্যস্ত হলো। ছেলেরা ওপাশে হাত চারেক দূরে বসেছে। তাজরীন এবার তহুরাকে খোঁচা মেরে ফিসফিসিয়ে বললো,

“কাজ শুরু করবে কখন?”
তহুরা মনমরা কন্ঠে জবাব দিলো,
“এইতো, কিছুক্ষণ পরে।”
তাজরীন ওকে একটানা কিছুক্ষণ দেখে বললো,
“মনমরা আছো কেন? বি পজিটিভ। লাইফে সবসময় পজিটিভিটি ধরে রাখবে। তাহলেই দেখবে, জীবন সুন্দর।”
তহুরা তখনও চুপচাপ। তাজরীন এবার তহুরাকে কাতুকুতু দিলো। তহুরা হেঁসে উঠলো। তাজরীনও খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,
“হাসো হাসো। জিন্দেগী যায়ে গো ভাগাড় মে। তব ভি হাসতে রহো।”

তহুরা এবার আর মন খারাপ করে থাকতে পারলো না। সবার সাথে হাসি-মজা করতে লাগলো। একসাথে বসে আড্ডা দিতে লাগলো। তাজরীন জানালো, গ্রামের বিয়ে হলেও যেহেতু বংশের বড় মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, সেহেতু অনুষ্ঠান বড় করেই হবে। ইতিমধ্যে প্যান্ডেল সাজানোসহ সকল কাজ শুরু হয়ে গেছে। মেহমানের সংখ্যা-ই অগণিত। কোনো আত্মীয়-স্বজন বাদ যায়নি এই বিয়ের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ থেকে। এরইমধ্যে কতজন চলে এসেছে। থাকার জায়গার অভাব নেই। গ্রামের বাড়ি। সবার সাথে সবার বেশ ভালো পরিচয়। তাই ভুঁইয়াদের মেহমানদের থাকার ঘাটতি হচ্ছে না। আশেপাশের প্রতিবেশীদের বাড়িগুলোতেও তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান দু’দিন বাদে। তার আগের দিন মেহেন্দির অনুষ্ঠান। জীম, তাজরীনরা শাড়ি নিয়ে এসেছে সবগুলো অনুষ্ঠান উপলক্ষে। জেসি আর রিক্তিরও শাড়ি আছে। তবে তহুরা জানালো, তার কাছে মেহেন্দি আর হলুদ সন্ধ্যার জন্য কোনো শাড়ি নেই। এই ব্যাপারটা নিয়ে ওর মন খারাপ হলো। তাজরীন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, এখানকার স্থানীয় বাজার পেরোলেই দক্ষিণে সান্ধ্যবাজার। সেখানে কয়েকটা শপ আছে। যদিও গ্রামের এদিকে বলে খুব একটা চলে না। তবে সেখানে সবধরনের পোশাক-আশাক পাওয়া যাবে সম্ভবত। তহুরা চাইলে এখনই গিয়ে শাড়ি কিনে নিয়ে আসতে পারে। তহুরাও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলো। তাজরীন বললো, পুরুষ কাউকে নিয়ে যেতে হবে।

তহুরা কিছু বলার আগেই তাজরীন উঠে গেল। ছেলেদের সার্কেলের মাঝখানে গিয়ে আফিমকে ডাকলো। আফিম উঠে এগিয়ে আসতেই কিছু একটা বললো। তহুরা সেদিকে তাকিয়ে বুঝলো, তাজরীন ঠিক কি করতে চাইছে! তবে বাঁধা দিতে পারলো না। হয়তো নিষেধ করলেও তাজরীন শুনতো না। তাজরীন এবার তহুরার কাছে এগিয়ে এসে ওকে টেনে সাথে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আফিম ভাইয়া যেতে রাজি হয়েছে। তার সাথে গিয়ে শাড়ি কিনে নিয়ে এসো। মেইন রোডে উঠে বাজারের কাছে গিয়ে একটা অটোরিকশায় উঠে সান্ধ্যবাজারের কথা বললেই সেখানে নামিয়ে দেবে। সেখানকার শপ থেকে শাড়ি কিনে তারপর আবার ফিরে এসো। আর শোনো, ধীরেসুস্থে যাও। সময়, সুযোগের ব্যবস্থা করেছি। কাজে লাগাও। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।”
তহুরা অস্বস্তিতে কাদা। একবার ঘাড় নাড়িয়ে জানালো, সে যাবে না। তবে তাজরীন নাছোড়বান্দা। জোরপূর্বক ওকে পাঠিয়ে দিলো। আফিমের সামনে কিছু বলতে পারলো না তহুরা। চুপচাপ বিলের উঁচু রাস্তা পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে এগোতে লাগলো।

আফিমের মন-মেজাজ ফুরফুরে। নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্যাচআপ হয়ে গেছে। বিষয়টা চিন্তা করতেই আবারো মন বিষিয়ে গেল তহুরার। নিজেকে ধিক্কার জানালো বারবার। দিনকে দিন কি হচ্ছে ওর! হিংসুটে হয়ে যাচ্ছে। নাহলে এরকম ছোটখাটো ব্যাপারে জ্বলার কোনো মানে হয় না। আফিম পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ফোনে চ্যাটিং করছে। তহুরা সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে খালি গলায় রিনরিনে কন্ঠে গান ধরলো,
“তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম,
কি দোষ দিবি তাতে?
বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই,
সকাল-দুপুর-রাতে…”
“কাকে খুঁজিস?”

নিজ মনেই গুনগুন করে গান গাইছিল তহুরা। আফিম ওর পেছনে ছিল। তা-ও ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎ গান গাওয়ার মাঝেই ওর কন্ঠস্বর শুনে অপ্রস্তুত হলো তহুরা। পরপরই প্রশ্নের জবাবে বললো,
“তোরে।”
“এই ‘তুইটা’ কে?”
“আছে একজন।”
“সেই একজনটা কে?”
“একটা ছেলে। নাম অর্ণব। পছন্দ করে আমাকে। প্রপোজ করেছিল গতদিন। আজ একসেপ্ট করেছি।”
তহুরা গা ছাড়া ভাব নিয়ে জবাব দিলো। আফিম বেশ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কী করেছিস?”
“প্রপোজাল একসেপ্ট করেছি।”

“বাব্বাহ! তুই আর প্রেম-পিরীতি! টিকবে তো? শালা কেমন? আবার দু’দিন প্রেম করে ছেড়ে-টেড়ে যাবে নাকি?”
“ও তোমার মতো প্লে-বয় না। যে ছাড়বে-ধরবে — এমন করবে। ওর স্বভাব খুব ভালো। অনেক সিরিয়াস ও।”
“বাহ বাহ! একদিন প্রেম করে পারিসনি, অমনি টান হয়ে গেছে? এতো প্রেম আসে কোথা থেকে তোর?”
“যেভাবে প্রতিটা মানুষের আসে, সেভাবে।”
“সময় থাকতে ভালো হয়ে যা।”
“পারলাম না।”
“পরে পস্তাবি কিন্তু। কান্নাকাটি করা লাগবে শেষমেশ।”
“করলাম। তো?”
“তো তুই একটা বেয়াদব।”

“জানি আমি। প্রতিদিন অন্তত একবার করে বলো। মুখস্থ হয়ে গেছে তোমার কথা।”
“হলেই ভালো। তো, সান্ধ্যবাজারে যেন কী কারণে যাচ্ছিস?”
“শাড়ি কিনতে।”
“কীসের শাড়ি?”
“হলুদ সন্ধ্যা আর মেহেন্দি অনুষ্ঠানের।”
“বুঝি না, তোদের মেয়েদের কি ডিমান্ড! এসব অনুষ্ঠানে শাড়ি-ই পরতে হবে? আর কোনো অপশন নেই?”
“তোমাদের ছেলেদের কাছে বহু মেয়ের অপশন থাকে। আমাদের মেয়েদের কাছে সবকিছুর জন্য অতো অপশন থাকে না। আমরা নির্দিষ্ট একটা জিনিসের প্রতি দুর্বল থাকি। ওই উইকনেস সহজে কাটে না। আমাদের অন্যদিকে ঝোঁকও আসে না। হাজারটারও প্রয়োজন হয় না।”
”বুঝলাম না! নরমাল একটা কোয়েশ্চন করেছি। উল্টাপাল্টা অ্যান্সার করছিস কেন?”
তহুরা কোনো জবাব দিলে না আফিমের এই কথার। সোজা পথে হাঁটতে লাগলো। পেছনে ফিরেও তাকালো না।

তাজরীন একটা অত্যন্ত সাহসিকতার কাজ করে ফেলেছে। এটাকে দুঃসাহসিক কাজও বলা যায়। সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে বড়ভাইকে জরুরি তলব করে পেছনে ডেকেছে। জীম দাঁড়িয়েছিল সেখানে। ওকে তাজরীন বুঝিয়েছে, ওর সাথে কিছু গোপনীয় কথা আছে। সেগুলো এখনই বলা খুব জরুরি। তাই জীমও বিনাবাক্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তাজরীনের জন্য। রুস্তম জানতো না, জীম ছিল সেখানটাতে। তাজরীন তো ওকে ডাক দিয়েই খালাস। ওর একটা গাঢ় আত্মবিশ্বাস রয়েছে, ওর ভাই-ভাবী যতই রাগ-অভিমান করে দূরে থাকুক; কাছাকাছি এলে তারা নিষ্ঠুর হতে পারবে না নিজেদের ক্ষেত্রে। এই আত্মবিশ্বাস থেকেই দু’জনকে একত্র করে তাজরীন সরে গেল দূরে। জেসি, রিক্তি সামনে হাঁটছে। ওপাশে ছেলেরা সবাই আরো আগে। তাজরীন একা হাঁটছে। তাজরীনের হাতে তার সেলফোনটা। ভার্সিটির ফ্রেন্ড টিনাকে মেসেজ করলো ও।

“দোস্ত শোন।”
টিনা রিপ্লাই করলো,
“হ্যাঁ, বল দোস্ত। কী খবর?”
“খবর আর কি! বহুত ক্রিঞ্জ লাগে রে দোস্ত। লাইফটা পুরাই লাইফলেস হয়ে গেছে রেহ! মন চাইতেসে, আজিমপুরে গিয়ে ফিট খাইয়া থাকি। নয়তো মোহাম্মদপুর। গুলিস্তানও আমার জন্য পারফেক্ট। কী বলিস?”
“দোস্ত, তোর মন এমন টান মাইরা আছে বুঝতেছি। কিন্তু আজিমপুর, মোহাম্মদপুর, গুলিস্তান— এইসব জায়গায় ফিট খাইয়া থাকলে তো তোর-ই লস। কেউ কেয়ারও করবে না।
লাইফলেস লাগে বুঝলাম। কিন্তু লাইফ তো তোর-ই! কিছু একটা কর— আউটিং কর, নতুন কিছু ট্রাই কর।”
“লাইফে প্রায় সবকিছুই করা শেষ। এখন নতুন কিছু আর কী ট্রাই করবো? শুধু প্রেম করাটাই বাকি।”
“তাহলে প্রেম কর।”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৫

“নাহ রে দোস্ত। কেউ আমাকে বোঝে না। তাই প্রেম-ট্রেম আমার জন্য না।”
তাজরীন ফোন পার্সে রেখে ধানক্ষেতের ধানের শীষে হাত বুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করে গান গাইলো,
“আমারে বুঝলো না রে কেউ, আমার মনও বুঝলো না…”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৭