নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৭
ঝিলিক মল্লিক
জীম আর রুস্তম পাশাপাশি হাঁটছে। জীম চুপ করে আছে। কোনো কথা বলছে না। রুস্তমকে অস্থির দেখাচ্ছে। জীমের নিরবতা ওর শান্ত হৃদয়ে ঝড় তুলছে। অভিমানের পাল্লা কি অনেকটা বেশি ভারী হয়ে গেছে? হয়তো। উত্তরটা জানা নেই রুস্তমের। কারণ সে জীমের মন পড়তে পারে না। জীম হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোলো। কাঁচা মেঠোপথ। এই পথটা একটু বেশিই সুন্দর। পথের দুইপাশে যতদূরে চোখ যায় কতক্ষণ পরপর সারি বেঁধে নারিকেল গাছ, তালগাছ আর খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে।
পথের ধারে নাম না জানা অসংখ্য বুনো ফুলের গাছ। কিছু বুনো গাছের নাম জানা আছে জীমের। ওইতো সামনে গাঢ় কালচে সবুজ রংয়ের হাতখানেক লম্বা গাছটাকে কালোমেঘ বলে। তাতে আবার বেগুনি রঙের কিছু ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে। এগুলোকে ঔষধি গাছ বলা হয়। ডায়াবেটিসের রোগের জন্য খুব উপকারী উদ্ভিদ। জীমের বাপেরবাড়িও আছে এই গাছ। ওর আব্বার প্রয়োজন হয়। তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। তার জন্য এগুলো-ই দরকারি। তুলসি গাছ দেখা গেল একটা ঝোপঝাড়ের ভেতরে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাপেরবাড়ির কথা মনে পরতেই জীমের হঠাৎ মনে হলো, কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে বাপের বাড়িতে চলে যেতে হবে। শাহবীর এক কথার মানুষ। সবাই জানে। বিশেষত জীম খুব ভালোভাবে চেনে ওকে। রাগের মাথায় হোক, কিংবা ঠান্ডা মাথায়; লোকটা একবার যেই কথা বলে, সেই কথার আর নড়চড় হয় না। আর এই ভাবনাটাই সবচেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছে জীমকে। কত স্বামী-স্ত্রী-র মধ্যেই তো ঝগড়া হয়। তারা তো আবার মিলেও যায়। এইতো সেবার তার আর শাহবীরের ফোনকলেই সে কি তুমুল ঝগড়া। সামনে থাকলে হয়তো মারামারি, কাটাকাটিও হয়ে যেতে পারতো। জীম রাগের মাথায় অনেকগুলো কথা শুনিয়েছিল শাহবীরকে। বিপরীতে শাহবীর তাকে বলেছিল, “তোর সাথে আমি আর কথা বলবো না, যতদিন না তুই যেচে এসে ক্ষমা চাইবি, ততোদিন কথা বন্ধ।”
হ্যাঁ শাহবীর তার কথা রেখেছিল। একমাস তেরোদিন কথা বলেনি জীমের সাথে। ওইটাই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ছিল জীম আর শাহবীরের কথাবার্তা বন্ধ থাকার। জীম সর্বোচ্চ একমাস দশদিন পেরেছিল শাহবীরের সাথে কথা না বলে থাকতে। তা-ও তড়পাতে হয়েছে ভীষণ। বহুকষ্টে সহ্য করেছিল৷ যেন গলায় একটা কাটা বেঁধে আছে। শেষ তিনটা দিন নাওয়াখাওয়া পুরোপুরি ছেড়েছিল জীম। ঘর থেকে পর্যন্ত বের হতো না। শাহবীরের সাথে যেভাবে হোক যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি।
শেষমেশ শয্যাশায়ী হতে হলো। তাজরীন তখন হোস্টেলে। জীমের শাশুড়ি তার অবস্থা আর সহ্য করতে না পেরে প্রতিদিনের মতো সেদিন রাতে কল দিয়েছিলেন বড় ছেলেকে। জীবনে প্রথমবারের মতো ইচ্ছামতো ঝেড়েছিলেন৷ শাসনের সুরে ছেলেকে এর আগে কখনো বলা হয়নি। জীমের জন্য বলেছিলেন প্রথমবার। তারপর শাহবীর ব্লক খুলেছিল। শাহবীর কল রিসিভ করা মাত্র সে কি কান্নাকাটি। এরকম কান্নাকাটি এ জীবনে কারো জন্য করেছে বলে ওর মনে পড়ে না৷ তারপর শিক্ষা হয়েছিল জীমের। দীর্ঘদিন শাহবীরের সাথে যেচে কোনো ঝামেলা বাঁধায়নি। সেই ঝগড়ার পরে এবার-ই আবার নতুন করে ঝামেলা হলো। জীমের হঠাৎ রাগ-জেদ হলো। সে কেন সবসময় সবকিছু ঠিক করবে? কেন সবসময় যেচে এগোবে? মানিয়ে নেবে? এভাবে তো জীবন চলে না৷ সংসার জীবনে সমানভাবে দু’জনের-ই এফোর্ট থাকা জরুরি। একজন এগোলো, আরেকজন পেছালো— এভাবে তো সংসার হয় না৷ জীম এতোক্ষণ ধীরে ধীরে হাঁটলেও এবার দ্রুত পা চালালো।
“সিলভি, এই মেয়ে। শোনো তো! দাঁড়াও বলছি।”
পেছন থেকে শাহবীরের অস্থির কন্ঠস্বর শোনা গেল। বারবার জীমকে ডাকতে লাগলো ও। জীম শুনলো না৷ পিছু ফিরেও তাকালো না৷ ঘাড়ত্যাড়ার মতো জেদ ধরে হাঁটতে লাগলো। শাহবীর একটু পেছনে পড়ে গিয়েছিল৷ এবার দ্রুত এগিয়ে গিয়ে জীমকে টেনে ধরলো পেছন থেকে। জীম সরতে চাইলো। শাহবীরের বাহুতে ধাক্কা মারলো। শক্তপোক্ত শরীরটা একটুও সরলো না। জীমকে টেনে খেজুর গাছের পেছনের দিকটায় নিয়ে গেল শাহবীর। রাশভারী কন্ঠে বললো,
“এই মেয়ে, ইগনোর করছো আমাকে? মেজর শাহবীর রুস্তমকে ইগনোর করছো! ভেরি ব্যাড!
জীম এবার ধাক্কাধাক্কি করতে করতে বললো,
“অহংকারী লোক। দূরে থাকুন। অহংকারীদের সাথে আমি কথা বলি না।”
“আমি অহংকারী?”
“জি আপনি। মেজর শাহ-বীর রু-স্তম! ওরফে অহংকারী রুস্তম।”
“এভাবে কথা বলছো কেন?”
“তো কীভাবে বলবো?”
“ভালোভাবে কথা বলো। বেয়াদবি করবে না।
“সরেন আপনি। আমি বেয়াদব। যেহেতু আমি বেয়াদব, তাই আমি বেয়াদব। সুতরাং আমি বেয়াদবি-ই করবো।”
“তোমাকে তো..”
“আমাকে তো কী?”
“কিছু না।”
“সরেন আপনি।”
“কই সরবো?”
শাহবীর প্রশ্ন করতেই জীম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে জবাব দিলো,
“যেখানে খুশি।”
“পেছনে খাদ। সামনে তুমি আর খেজুর গাছ, পাশে ধানক্ষেত। কই যাবো এবার তুমি বলো।”
“পারলে খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরুন৷”
“আমি মরলে তো তুমি বিধবা হবে।”
“হলে হবো। বিধবা ভাতা পাবো তো। জোশশ না?”
“মারে মা! কি চিন্তাভাবনা তোমার! এমন একটা পোষা কালনাগিনী আমার ঘরে আছে, এতোদিন বুঝতে পারিনি!”
“আপনি এমন কেন হ্যাঁ?”
“হোয়াট?”
“আপনার হোয়াট ইজ মাই ফুট!”
“আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু এমন কেন করছো?”
“কেন করছি আপনি বোঝেন না?”
দাঁতে দাঁত পিষে শক্ত গলায় বলতেই শাহবীর জবাব দিলো,
“বুঝিয়ে বললেই বুঝি।”
“আপনি সবসময় আমার সাথে রুড বিহেভ করেন। আমি সবার ভালোর জন্য চিন্তা করে গিয়েছি অলওয়েজ, আর আমাকে মানুষ দূরে ঠেলে দিয়েছে। আমার সিদ্ধান্তকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। আপনিও করেছেন। কারণ কী? তাহলে আমার এতো সাংসারিক হওয়ার দরকার নেই কোনো। আমি বরং নিজের মর্জিতে যা খুশি করে বেড়াবো। ওইযে পাশের বাসার হামিদ চাচার বড় পুত্রবধূ ছিল না, রাবিয়া? যে ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো। বিয়ের পরও দিনরাত ক্যারিয়ারের পেছনে ছোটাছুটি করতো। শ্বশুরবাড়ির মানুষের কোনো খোঁজ-খবর রাখতো না। শেষমেশ হাসবেন্ডকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেল। এখন নিজের ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছে। একটা ভালো কোম্পানিতে জব করছে। একা থাকছে ফ্ল্যাট নিয়ে।তারপর পরপুরুষদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে রাত কাটাচ্ছে। আমার তো এতো সাংসারিক না হয়ে ওর মতো হওয়া উচিত তাই-না? আপনাকে ডিভোর্স দেবো। তারপর একটা জব খুঁজে একা ফ্ল্যাটে থাকবো। পরপুরুষদের নিয়ে এসে রাত কা…”
বাকিটুকু আর বলতে পারলো না জীম। তার আগেই শাহবীর ওর মুখ চেপে ধরলো হাতের তালুতে। বাহু আঁকড়ে ধরে বললো,
“বেয়াদব! জানে মে’রে ফেললো একদম! হারামি! স্বামী থাকতে পরপুরুষের কথা চিন্তা করিস কিভাবে তুই! জাহান্নামে যাবি।”
“গেলাম। তাতে আপনার কিছু যায় আসে? সত্যিই? আমার তো মনে হয় না। আমি মরে গেলেও আপনার কিচ্ছু যায় আসবে না। আরেকটা বিয়ে করে আনবেন সানাই বাজিয়ে। দ্বিতীয় বউকেও প্রথম প্রথম ওরকম বেশি বেশি আদর-মহব্বত দেখিয়ে ছুঁড়ে ফেলবেন। তারপর অবহেলা-অনাদরে সেই হতচ্ছাড়িও আমার মতো মরবে। তারপর আবারও বিয়ে করবেন। তিন নাম্বার হতচ্ছাড়িও একইভাবে মরার পরে আরো একটা বিয়ে করবেন। এভাবে সবগুলো হতচ্ছাড়ি মরতে থাকবে, আর আপনিও বিয়ে করতে থাকবেন। ব্যাটা মানুষ চার বিয়ের স্বপ্ন দেখে, আপনার হবে অগণিত বিয়ে। গণিতের ভাষায় যাকে বলে, অসীম। যদিও আমি অংকে কাঁচা। ভুল-ত্রুটি ধরে বসবেন না আবার।”
কথা শেষ করেই চোখ-মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে জীম। রুস্তম পরেছে মহাজ্বালায়। একইসাথে মহাবিপদেও। গ্রামাঞ্চল বলে বিলের দিককার এই নির্জন রাস্তায় আশেপাশে কেউ নেই। যদি থাকতো, তাহলে জীমের মরা কান্নাকাটি শুনে এতোক্ষণে লোকজন জড়ো করে নিয়ে এসে বসে বিনোদন নিতো। হাসি পেল ওর। তবে এই মুহূর্তে চূড়ান্ত হাসিকে নিয়ন্ত্রণ করে শাহবীর জীমের কাঁধ ধরার চেষ্টা করে বললো,
“নো সিলভি। শোনো, তুমি ভুল বুঝছো। প্লিজ, আমার কথা শোনো। তুমি মরে গেলে আমার যায় আসবে। সো প্লিজ, মরার কথা বলো না। মেজাজ প্রচুর খারাপ হয় বুঝলে।”
জীম এবার আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে নিজের কাঁধ থেকে শাহবীরের হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে তুই-তোকারি সম্বোধনে বললো,
“তোর কিচ্ছু যায় আসবে না। আমি জানি। বিনা কারণে কারো জন্য কারো যায় আসে না। আমি মরলে তোর কেন যায় আসবে? বল কেন?”
“কজ, আই লাভ ইউ ড্যাম ইট!”
শাহবীরের চিৎকার করে বলা কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই জীমের কান্না থেমে গেল। হা করে তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে। ব্যাটা নাকি ভালোবাসাবাসির কথা বলেছে! অবিশ্বাস্য ব্যাপার! কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর শাহবীরের বুকে ঝাঁপিয়ে পরলো জীম। শার্টে নাক ঘষে টেনে টেনে বললো,
“সত্যি বলছেন?”
“এসব কেউ মিথ্যে বলে নাকি?”
“এরকম এর আগেও বহু মেয়েকে বলেছেন।”
“এসব ফালতু কথাবার্তা শোনায় কে তোমাকে?”
“কারো শোনানোর প্রয়োজন পড়ে না। আমি জানি।”
“তুমি তো সব জেনে উদ্ধার করেছো। জার্নালিজম নিয়ে পড়তে পড়তে এই হাল!”
জীম শাহবীরের বুকে কয়েকটা কিল, ঘুষি বসালো। কোথায় গেল ডিভোর্সের কথা! আর আলাদা থাকার কথাবার্তা! শাহবীর জীমের হাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল গলিয়ে ওকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো সামনের পথ ধরে। ওদের গন্তব্য মহাসড়কের ওদিকে। সেখান থেকে চরে ঘুরতে যাবে। সবাই সম্ভবত সড়কের কাছটায় অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।
রাত তখন সাড়ে এগারোটার ওপরে। জীম তাজরীন আর তহুরাকে নিয়ে পা টিপে টিপে কাঠের দোতলার পেছনের দিকের উঁচু টিলা ধরে হাঁটছে। শব্দ যাতে না হয়, এজন্য পায়ের জুতা জোড়া হাতে নিয়েছে৷ জেসি আর রিক্তি নিচে হাঁটছিল। ওরা আবার বেশ দক্ষ এসব কাজে। জীম ফিসফিসিয়ে তাজরীনকে জিজ্ঞাসা করলো,
“গান-বাজনার আওয়াজ তো ধানক্ষেতের ওপাশের বিলের দিকটা থেকেই আসছে। ওখানে কী রে তাজ?”
“ওপাশে তো খালামণির ছোট চাচা শ্বশুরের দ্বিতীয় বউয়ের বাড়ি। আর বিল শুকনো আছে। বিল ছেড়ে উঠতেই সেই দিদার বাসা। তোমরা যাবে? এমনিতেও দিদা আমাদের যেতে বলেছিল ও বাড়ি। আমরা গেলে পিঠা বানিয়ে খাওয়াবে বলেছিল। চলো নিয়ে যাই।”
“আচ্ছা, চলো।”
অন্ধকার রাত। চারপাশে শুধু ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ শোনা যায়। কুঠিবাড়ির পেছনের দিকের পুকুর ছাড়িয়ে সামনে হাঁটলে আম-কাঠালের বাগান। আরো অনেক গাছপালা আছে সেখানে। বাগানের মাঝখান দিয়ে সরু পথ চলে গেছে সামনের দিকে। বেশ লম্বা পথ। এই পথ পেরোলেই ধানী জমি। দীর্ঘ পরপর কয়েকটা জমি পেরোনোর পর তারপর আবার একটা শুকনো বিল। শীতকাল বিধেয় বিলে পানি নেই। সেখানকার জমিন খড়খড়ে। সেখানে আপাতত মাষকলাইয়ের চাষ চলছে। বিলের মাঝখানেও পায়ে হাঁটার একটা পথ আছে। সেই পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার পর উঁচু জমিতে গোলপাতা দিয়ে ঘেরাও করা পাঁচিল। পাঁচিলের মধ্যখানে একটা টিনের বাড়ি। গ্রাম্য কারুকার্যে অসাধারণভাবে তৈরি বাড়িটি। উঠোনে খুব সুন্দর করে মাটির প্রলেপ দেওয়া। বাড়ির মেঝেও মাটির তৈরি৷ সেখানে আলপনা করা। তাজরীন এইসব জায়গা আর মানুষদের খুব ভালোভাবেই চেনে। এর আগে বহুবার এসেছে। ছোট দিদা এক ছেলে, পুত্রবধূ আর ছোট এক মেয়ে নিয়ে থাকেন সেই বাড়িতে। তার স্বামী বেঁচে নেই। তবে খুব মিশুকে মানুষ তিনি। বিয়ের আয়োজন উপলক্ষে বেশিরভাগ সময় তার ব্যস্ত থাকা হচ্ছে। দিদা খুব ভালো মানুষ। যে-ই যায়, তাকে পাশে বসিয়ে গল্প-গুজব করেন। আদর-আপ্যায়ন করেন৷ নিজে হাতে রান্না করে খাওয়ান।
বিলের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কথাগুলো বলছিল তাজরীন। বাকিরা চুপচাপ শুনতে শুনতে সাবধানে হেঁটে সামনে এগোচ্ছিল। হঠাৎ জীম বলে উঠলো,
“গান-বাজনার আওয়াজটা দিদার বাড়ি থেকেই আসছে না তাজ?”
“হ্যাঁ, তা-ই তো। তোমরাও কী শুনতে পাচ্ছো?”
তাজরীন খেয়াল করে বাকিদের প্রশ্ন করলো৷ বাকিরা কান খাড়া করে শুনে বললো, “আসলেই তো!”
জীম এবার বললো,
“ব্যাটামানুষেরা হঠাৎ সুযোগ বুঝে আমাদেরকে দোতলায় রেখে কেন বেড়িয়েছে তা বুঝতে পারছো তোমরা?”
তাজরীন বুঝতে পারলো না। প্রশ্ন করলো,
“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বৌমণি। তুমি তো তাড়াহুড়োয় আমাদেরকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এলে। কি নাকি প্ল্যান আছে। ভাইয়াদেরকে খুঁজবে কোথায়? ওরা হয়তো গেছে ওদের কোনো কাজে। ব্যাটা মানুষের কত আজাইরা কাজ যে থাকে! মাঝরাতে আমাদেরকে লুকিয়ে বেরিয়ে পরেছে!”
জীম জবাব দিলো,
“দেখো, মেয়েরা নাচ-গান করছে দিদাদের বাড়ির উঠোনে। তাই হয়তো দেখতে গিয়েছে।”
কথা বলতে বলতে ওরা তখন ছোট দিদাদের উঠোনের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। গানের আওয়াজ এখন অনেক জোরে শোনা যাচ্ছে। দূরে কুঠিবাড়িতেও আজ কে যেন সাউন্ড বক্সে গান চালিয়েছে উঠোনে। সেখানে অনেকে আড্ডা দিচ্ছিল। লুকিয়ে আসার সময়ে জীমরা দেখে এসেছে। সেই গানের আওয়াজ এখানে আসতেই মিলিয়ে গেছে। এখন দিদার বাড়ির ভেতর থেকে গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাউন্ড বক্সে গান চলছে। কতগুলো সাউন্ড বক্সে গান চালু করেছে কে জানে! এতো বেশি জোরে চলছে, যেন কান ফেটে যাবে। এমনকি উঠোনের চারপাশে টুকটাক লাইটিংও করা হয়েছে। উৎসব তো ওই বাড়িতে। তাহলে এই বাড়িতে এমন সাজসজ্জা কেন?
জীমরা তখনও বিলের শেষ মাথায় বাড়ির উঠোনের নিচের জমিতে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের দিকটায়। গোলপাতা দিয়ে পাঁচিল করা। সেখানে দাঁড়িয়েই লুকিয়ে উঁকি মে’রে দেখলো সামনের খোলা উঠোনে লাল-নীল আলোর মাঝে কতগুলো পরিচিত ব্যাটামানুষ। চক্ষু চড়কগাছ হলো জীমদের। সবাই নাচানাচি করছে ধুমসে! দিদা উঠোনের এককোণে চেয়ারে বসে দেখছেন তাদের। আর উৎসাহ দিচ্ছেন।
বারা মাহিনে মে
বারা তারিখ কো ছে
তুঝকো প্যায়ার মে জিতাউঁগা রেএএএ….
ঢিংকা চিকা ঢিংকা চিকা ঢিংকা চিকা রে এ এ এ, রে এএ এ হে…
গানের তোড়ে থাকা যাচ্ছে না। ওদিকে শাহবীর, রুবায়েত, আফিম, হাসান, শোয়েব আর রায়ানের উরাধুরা নাচে মাটির উঠোন যেন কাঁপছে রীতিমতো। মনে হচ্ছে, ভূমিকম্প হচ্ছে ভূমিতে। পুরো বাড়ি আশেপাশের সবকিছুসহ কাঁপছে যেন। মনে হচ্ছে, বাড়িটা ঘুরছে। এতো জোড়ে গান চলতে থাকায় জীমরা কথাবার্তা বললেও পাশের কারো কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কান ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। মাথা ঘোরাচ্ছে। জীম শুধু অবাক হয়ে দেখছে। শাহবীরও এভাবে নাচতে পারে! ব্যাটামানুষের নাচ তো ভয়াবহ। না দেখলে বিশ্বাস-ই হতো না।
ছয়জন আর্মি ম্যান নাচছে। আর্মি ড্যান্স যাকে বলে। তাজরীন হা করে তাকিয়ে রুবায়েতের নাচ দেখছে। জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং অত্যাধিক আশ্চর্যজনক জিনিস দেখছে সে! জেসি, রিক্তি আর তহুরাও বিস্ময়ে রোবট বনে গেছে যেন৷ নড়তে-চড়তে পারছে না। একজন আরেকজনের গায়ের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জীম এবার অসাবধানতাবশত ঠাস করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল উঠোনের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ওকে আফিম দেখে ফেললো নাচের মধ্যেই৷ মুহূর্তের মধ্যে নাচ থামিয়ে শাহবীরের দিকে এগিয়ে গেলো। শাহবীর আর বাকিরা তখনও আনন্দ-ফুর্তিতে ব্যস্ত। বহুদিন পর তারা ব্যাচেলর পার্টির আয়োজন করেছে। লাইফে কোনো মেয়েলোক নেই আপাতত। শুধু শান্তি আর শান্তি। এই শান্তি বিনষ্ট করা যাবে না। নাচ-গান, আনন্দ-উল্লাস করে কাটাতে হবে।
বাকিরাও সুযোগ হাতছাড়া করেনি। জীবনে যতদিন মেয়েমানুষ নেই, ততোদিন আনন্দ-মজা করার সুযোগ ছাড়া যাবে না। নিজেদের ক্যাপ্টেনকে তো দেখেছে তারা। বেচারা বউয়ের যন্ত্রণায় মন খুলে একটু ফুর্তিও করতে পারে না। তাই যত আনন্দ, সব বিয়ের আগে করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক নেই। এজন্য তারা নিজেরা গোপনে পরামর্শ করে বিয়েবাড়ি হতে অনেকটা দূরে এই নির্জন বাড়িতে ব্যাচেলর পার্টির আয়োজন করেছে। দিদা নিজে সানন্দে তাদের মিডনাইট পার্টির খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। তার ছেলে, ছেলেবউ আর মেয়ে এখন বিয়েবাড়িতে বিয়ের কাজে ব্যস্ত। নিশ্চিন্তে, নিরিবিলিতে তিনি ছেলেপেলেদের জন্য রান্নার আয়োজন করেছেন উঠোনের এককোণে বেড়ার তৈরি রান্নাঘরে। মাঝেমধ্যে এসে ছেলেগুলোর নাচ-গান দেখে যাচ্ছিলেন৷
আফিমের কথা বোধহয় শাহবীর শুনতে পেল না। এবার আফিম শাহবীরের শার্টের হাতা টেনে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
“ক্যাপ্টেন, সিস্টার। মানে ভাবী৷ মানে আপনার বউ!”
শাহবীর তখন জীবনের সবচেয়ে আনন্দের নাচটা নাচছিল ব্যাচেলরগুলোর সাথে। হঠাৎ বিপজ্জনক কথাটা শোনামাত্র নাচ থেমে গেল ওর৷ তবে গান বন্ধ হলো না। বাকিরা নাচগানে মগ্ন। আফিমের আঙুলের ইশারায় পেছনের দিকে পাঁচিলের ওপাশে তাকালো ও। দেখলো, গোলপাতার আড়ালে অন্ধকারে হাতড়ে রিক্তির হাত ধরে উঠছে জীম। দৃষ্টিতে যেন অগ্নি ঝড়ছে। শাহবীরের দিকেই কটমট চোখে তাকিয়ে আছে। ওকে একঝলক দেখে দ্রুত উঠোন পেরিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসলো শাহবীর। তারপর অপ্রকৃতস্থ কন্ঠে দ্রুতগতিতে বললো,
“স্যরি স্যরি। আসলে আমাদের ব্যাচেলরদের পার্টি ছিল। এজন্য তোমাদের জানানো হয়নি। তোমরা কেউ রাগ কোরো না প্লিজ। আসো, ভেতরে আসো।”
সবাই বাঁধ সাধলো৷ তারা ভেতরে যাবে না। যেহেতু তাদের আগে থেকে আমন্ত্রণ করা হয়নি, হুটহাট চলে এসেছে তারা; তাই এখন কোনোভাবেই ভেতরে যাবে না। সবাই গেঁড়ে বসলো। ততক্ষণে নাচগান থামিয়ে বাকিরা সবাই এদিকে এসেছে। দিদাও উঠে আসলেন। ওদেরকে দেখে ভেতরে যেতে খুব করে অনুরোধ করলেন। একবারে রাতে চিনা হাসের মাংস আর লাল চালের গুড়া দিয়ে তৈরি আটার রুটি খেয়ে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালেন। দিদার খুব অনুরোধের পরে সবাই একে একে ভেতরে গেল। জীম পেছনেই ছিল। সবাই যেতেই শাহবীরের শার্ট পিঠের কাছটায় পেছন দিক থেকে লম্বা লম্বা নখগুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরে টান দিলো।
শাহবীর বুঝলো, এই বিপদ! এবার বাঁচার কোনো উপায় নেই। চলন্ত পা জোড়া থেমে গেল তার। সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। জীম তাকে টান দিয়ে বাড়ির পেছন দিকটাতে নিয়ে আসলো। এপাশে বাড়ির পেছনের টিনের বেড়া আর ছোটখাটো কিছু গাছপালা। পেছনের বামদিকের একটা জানালা খোলা। টিনের তৈরি বাড়ি হলেও মোটামুটি বেশ ভালোই বড় এই বাড়িটা। মশার গুনগুনানো সুর বেশ ভালোই শোনা যাচ্ছে। সেদিকে কোনো তোয়াক্কা নেই জীমের। শাহবীর ওর সামনে বেশ নিরীহ ভাবভঙ্গিতে বাদামি রঙের জিন্স প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি পরেছে জীমের চোখে। জীমের হাতদুটো শাহবীরের শার্টের বুকের কাছের অংশটা শক্তভাবে চেপে ধরে আছে। এবার ও মুখ খুললো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“ব্যাচেলর পার্টি?!”
“হু।”
শাহবীর ভয়ে ভয়ে জবাব দিলো। জীম এবার শার্টের ওপর থেকেই তার লোমশ বুকে আঁচড় কাটলো। তারপর আবারও জিজ্ঞাসা করলো,
“ওই শালা, তুই ব্যাচেলর?”
শাহবীর নিরীহভাবে জবাব দিলো,
“কই না তো!”
“তাহলে কেন তুই ব্যাচেলর পার্টির অ্যারেঞ্জমেন্ট করলি?”
“সে তো এমনি। আমার কলিগরা সবাই তো ব্যাচেলর। ওদের জন্য।”
“ওদের জন্য তো নরমাল পার্টির আয়োজন করা যায়। ব্যাচেলর পার্টি-ই কেন? তাহলে কী মনে মনে তুই নিজেকে ব্যাচেলর মনে করিস? দামড়া ব্যাটা! বিবাহিত হয়েও নিজেকে ব্যাচেলর মনে করে অন্য মেয়েদের ধারে টাঙ্কি মারতে যাস? বেয়াদব, অসভ্য ব্যাডা!”
জীম শাহবীরের বাহুতে, পিঠে, বুকে, পেটে কিল-ঘুষি মারতে লাগলো। যদিও শক্ত শরীরে এসব মারে কোনো লাভ নেই৷ শাহবীর ওর হাতের মুঠো নিজের হাতের মুঠোয় জোরপূর্বক পুরে নিয়ে থামানোর চেষ্টা করলো ওকে। তারপর বললো,
“তুমি যেরকম ভাবছো, সেরকম কিছু নয়।”
“তাহলে কীরকম? বোঝান আমাকে৷ আমিও একটু বুঝি।”
শাহবীর গম্ভীর দৃষ্টিতে জীমের চাহনি দেখতে লাগলো। জীম এমনিতেও প্রচন্ড অধৈর্য। শাহবীরের চুপ থাকা সহ্য হলো না ওর। বলে উঠলো,
“সবসময়.. উমম..”
পুরো কথা শেষ করতে পারলো না জীম। তার আগেই ঠোঁটে উত্তপ্ত, পোড়ো ছোঁয়া পেল। ছোঁয়াটা আছোয়া হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও বলার চেষ্টা করলো,
“আপনি..”
আওয়াজ করার আর উপায় রইলো না। শাহবীর আবারও ওর কথা বন্ধ করে দিলো৷ ঠোঁট নড়ানোর উপায় রাখলো না। জীমের গলায় পুরুষালি হাতের ছোঁয়া গাঢ় করে বললো,
“স্যরি বলেছি তো। আর কখনো এমন হবে না। এবার তো কুল হও।”
কথাটা বলেই শাহবীর জবাবের আশা না করে আবারও বলে উঠলো,
“না থাক। কুল হওয়ার দরকার নেই৷ তুমি বরং এমন হাইপার-ই থাকো সবসময়। এমনিতেও খুব হট আছো। হাইপার হয়ে গেলে হটনেস আরো বেশি বেড়ে যায়। তখন মন চায়..”
“চুউউপ! অসভ্য ব্যাডা!”
শাহবীরের মুখে হাত চেপে ধরে ওকে চুপ করিয়ে দিলো জীম। হাতের আড়ালে শাহবীরের ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো। এই অত্যাধিক সন্দেহবাতিক নারীকে চুপ করানোর এটাই একমাত্র উপায়। জীমকে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে হাঁটা দিলো শাহবীর।
দু’টো বড় বড় সাউন্ড বক্সের ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ এখন স্লো-মোশনে লো সাউন্ডে গান চলছে। উঠোনের মাঝখানে শতরঞ্জি বিছিয়ে বসেছে সবাই। সামনে পাটিসাপ্টা পিঠা রাখা স্টিলের গামলায়। সদ্য গনগনে চুলার ওপর থেকে উঠানো গরম গরম পিঠাগুলো সবাই আড্ডার মাঝে উঠিয়ে মুখে দিচ্ছে। দিদার হাতের বানানো পিঠা না যেন অমৃত!
দিদা রুটি বানাচ্ছেন এখন। জীমরা তাকে একা দেখে সাহায্য করতে গিয়েছিল৷ তিনি কড়া ধমক দিয়ে ওদেরকে আড্ডার মাঝে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরইমধ্যে তার ছোটমেয়ে রিমিলি এসেছে ও-বাড়ি থেকে। সম্পর্কে সে জীমদের ফুপি হলেও বয়সে তাদের সবার অনেক ছোট। বছর সতেরো-আঠারো হবে। মেয়েটা আসতেই আড্ডা আরো জমে উঠেছে। সে এখন ভূতের কাহিনী শোনাচ্ছে। তাজরীন তো তহুরা আর রিক্তির মাঝখানে বসে ভয়ে তহুরাকে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। ভূতের গল্প সে শুনতে চাইছে না। ব্যাপারটা খেয়াল করলো একজন। রুবায়েত তার হেডফোনটা পকেট থেকে বের করে সামনে তাজরীনের দিকে এগিযে দিলো। তাজরীন প্রথমে অপ্রস্তুত হয়ে তারপর হেডফোনটা নিয়ে ফোনের সাথে সংযুক্ত করে গান শুনতে লাগলো। রুস্তম তখন বললো,
“এই মোমেন্টে কিছু কোল্ড ড্রিংকস আর স্ন্যাকস হলে জম্পেশ হতো। দিদার রান্না কমপ্লিট হতে মাঝরাত। ততক্ষণ শুকনো মুখে জেগে থাকা ইম্পসিবল।”
রুবায়েত বলে উঠলো,
“আমি উঠছি। দেখি বাজারের ওদিকে যেয়ে আসি। দোকান তো খোলা পাওয়া যাবে এখনো, না?”
শাহবীর জিজ্ঞাসা করলো,
”একা যাবি?”
“হ্যাঁ।”
আফিম আর হাসান তখন বললো,
“আমরা আসি?”
রুবায়েত কিছু একটা ভেবে বললো,
“না থাক। দরকার নেই।”
তারপর আসরের সবাইকে জিজ্ঞাসা করলো,
“আইসক্রিম কোন ফ্লেভারের খাবে সবাই?”
জেসি জবাব দিলো,
“এতো ঝামেলা না করে বরং ভ্যানিলা ফ্লেভারের আনো রুবায়েত ভাই। আই থিংক, সবাই এই ফ্লেভারটা পছন্দ করে।”
জেসির আইডিয়াটা-ই নিলো রুবায়েত। শতরঞ্জি থেকে নেমে চামড়ার জুতা জোড়া পায়ে গলাতেই তাজরীন উঠে দাঁড়ালো তৎক্ষনাৎ। ওকে উঠতে দেখে রুস্তম ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
“তুই উঠলি কেন?”
“আমি একটু উনার সাথে দোকানে যাবো ভাইয়া। কাজ আছে আমার।”
“কী কাজ?”
“দরকারি কাজ। তোমাদের বলা যাবে না।”
রুবায়েতের পেছন পেছন হাঁটা ধরলো তাজরীন। রুবায়েত বাড়ির উঠোন পেরিয়ে বিলের সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে না তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করলো,
“কী কাজ তোমার?”
“আপনাকে একটা জরুরি কথা বলবো। এজন্য সাথে এসেছি।”
“জরুরি কাজ? নাকি বাহানা দিচ্ছো?”
রাশভারী অথচ স্বাভাবিক কন্ঠস্বর। তবু ভড়কে গেল তাজরীন। যতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে এসেছিল, ততোটা আর রইলো না। তবু চুপচাপ লোকটার সঙ্গে হাঁটতে লাগলো। ও নিজেও জানে না, রুবায়েতের সঙ্গে আসার কারণ। এখন মনে মনে একটা কারণ তৈরি করতে লাগলো। ততক্ষণে বিল, ধানী জমি, বিয়েবাড়ি পেরিয়ে কবরস্থানের পার্শ্ববর্তী পথে এসে পরেছে ওরা। এতোক্ষণ চিন্তাভাবনা করতে করতে হাঁটলেও এবার তাজরীনের খেয়াল হলো স্থানটা। রুবায়েত নিজের মতো করে হেঁটেই চলেছে৷ তাজরীন ডানপাশ থেকে বামপাশে সরে এসে হাঁটতে লাগলো রুবায়েতের কাছ ঘেঁষে। মনে হচ্ছে জ্বীন-ভূতের সাথে হাঁটছে ও। গম্ভীর পরিবেশ, সাথে আবার গম্ভীর একজন লোক! ভয়ে ভয়ে পথটা পেরোতেই লম্বা একটা পথ আসলো৷ রুবায়েত একবার বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে দেখলো তাজরীনকে।
আজব, হাবলা প্রাণী নিয়ে এসেছে সাথে! জ্বালিয়ে মারবে বোঝা যাচ্ছে। রুবায়েত যে কারণে একা এসেছে, সেই কাজটাও হবে বলে মনে হচ্ছে না। সড়ক তখন হাত ছয়েক দূরে। অন্ধকার মেঠোপথ প্রায় শেষ হলো বলে। তাজরীন গুনগুনিয়ে গান গাইতেই রুবায়েত ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটলো। চোখের পলকে, মুহূর্তের মধ্যে। তাজরীন কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুবায়েত পড়ে গেল মাটিতে। তাজরীন শুধু সামনে চেয়ে দেখলো একটা কালো ছায়ামূর্তি পথের পাশে নিচের দিকে ঢালের মতো নেমে যাওয়া সুদূর ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। চোখের পলক ফেলতেই মিলিয়ে গেল ছায়ামূর্তিটা।
উধাও হলো। ঘটনাটা সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কে ধরা দিলো তাজরীনের। আঁতকে উঠলো ও। বুক ধ্বক করে উঠলো। দ্রুত সময় নষ্ট না করে বসে পরলো মাটির ওপর। অন্ধকারে রুবায়েতের মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। এমনকি শরীরের অঙ্গভঙ্গিও না। আঘাতটা যে কোথায় লেগেছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তাজরীন রুবায়েতের মাথা নিজের কোলের ওপর তুলে নিয়ে গাল, গলা, পিঠ, বুক আর বাহুতে হাত বুলিয়ে কান্না জড়ানো কন্ঠে অস্পষ্ট প্রশ্ন করলো,
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৬
“এই, কোথায় লেগেছে আপনার? ওটা ছুরির আঘাত ছিল, না? বলুন না, কোথায় লেগেছে? উঠুন না। প্লিজ কথা বলুন। কি হলো? কথা বলছেন না কেন? এই!”
তাজরীনের কন্ঠ জড়িয়ে এলো। নেই। সব শেষ! লোকটা উঠছে না। কথাও বলছে না। সবকিছু নিস্তব্ধ!