নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৮

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৮
ঝিলিক মল্লিক

তাজরীন তখনো ধুলোমাখা শরীর নিয়ে রুবায়েতের বুকে হাত ঠেকিয়ে রেখে মুখ ঢেকে কাঁদছে। বারবার ডাকার পরেও লোকটা ডাক শুনছে না। গম্ভীর গলায় কথা বলছে না। প্রথমেই তাজরীনের মাথায় এই মুহূর্তে নেগেটিভ চিন্তাভাবনা-ই আগে আসলো। তাই মরা কান্না করতে শুরু করেছে ও। সময় খুব বেশি গড়ায়নি। মিনিট খানেক হবে। তাজরীন হঠাৎ যেন হোঁচট খেলো। অদ্ভুত ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটতেই বিস্ময়ে হতবাক হলো। নড়েচড়ে বসলো। রুবায়েত হাতের বাহু চেপে ধরে উঠে বসতেই তাজরীন ওর কাঁধে হাত রেখে বেশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“ঠিক আছেন আপনি?”
“জি।”

রুবায়েত ঘাড় ঘুরিয়ে তাজরীনের মুখের ওপর অদ্ভুত দৃষ্টি ফেলে জবাব দিলো। তাজরীন এবার পারলে প্রশ্নের জালে জাপ্টে ধরে ওকে। রুবায়েত তা বুঝতে পেরে নিজেই আগে বললো,
“অ্যাটাক যে একটা হতো, তা আন্দাজ করেছিলাম অনেক আগেই। কিন্তু অ্যাটাকটা যে আপনার সঙ্গে থাকাকালীন এখন এই মুহূর্তে হবে, আগে আন্দাজ করতে পারিনি। অবশ্যই এটা আমার অসচেতনতা। প্রথমত, আগে আন্দাজ করতে পারলে কখনোই আপনাকে আমার সাথে নিয়ে আসতে রাজি হতাম না৷ দ্বিতীয়ত, সেফটি আর্মস অবশ্যই সাথে থাকতো। তাছাড়াও আমার জানা নেই, কে বা কারা এই অ্যাটাকটা করেছে।”
রুবায়েত উঠে দাঁড়ালো। প্যান্টের পকেট হতে অনেকগুলো টিস্যু বের করে বাহুতে চেপে ধরতেই তাজরীন ভ্রু কুঁচকে বেশ সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনার ওপর কেন-ই বা এই অপরিচিত জায়গায় হামলা হবে? এর আগে তো কখনো এখানে আসেননি। এমন না যে এখানে আপনার কোনো শত্রু আছে বা রিসেন্টলি তৈরি হয়েছে। অন্তত আমার তো জানা নেই৷ তাহলে আপনার ওপর যে অ্যাটাক আসবে এটা আপনি জানতেন কীভাবে? হু?”
“তোমাকে কেন এতো কৈফিয়ত দেবো? কে হও তুমি?”
রুবায়েত উঠে দাঁড়িয়ে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো তাজরীনের দিকে। তাজরীন অত্যন্ত আশ্চর্য হলো। লোকটার না কিছুক্ষণ আগে হাতের বাহুতে ছুরির আঘাত লাগলো? তাহলে এখন দিব্যি নড়াচড়া করছে কীভাবে? এখন আবার তাজরীনকে অপমানজনক কথা বলছে! অথচ এই খারাপ লোকটার জন্য কিছুক্ষণ আগেও দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে কান্নাকাটি করছিল তাজরীন। আচ্ছা, কেন কাঁদছিল ও? কারণ আছে এর কোনো? স্বাভাবিকভাবেই কী মানুষের মরণের কথা চিন্তা করে কোনো মানুষ কাঁদতে পারে? নাকি এটা কোনো বিশেষ ব্যাপার? এর আগেও তো তাজরীনের কত স্বল্প পরিচিত মানুষ মারা গেছেন, তখন তো তাজরীন এভাবে মরা কান্না কাঁদেনি। তাহলে এখন কেন? উত্তরটা জানা নেই তাজরীনের। আর ভাবতেও পারছে না। নিজের নির্বুদ্ধিতার ওপরই রাগ উঠছে। আগে কেন বোঝেনি, রুবায়েতের আঘাতটা সামান্য! এবার আলোতে আসার পরে তাজরীন ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো, রুবায়েতের বাহুতে অল্প আঘাত লেগেছে। রক্ত তেমন বের হয়নি। ব্যান্ডেজ করারও প্রয়োজন পরবে না বোধহয়। তাজরীন এবার ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

“যে আপনার ওপর অ্যাটাক করেছে, সে কী একটা দুধের শিশু?”
রুবায়েত প্রশ্নটা শুনে রাশভারী স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“না মানে দুধের শিশু আঘাত করলেও তো ভালোই আঘাত লাগে। সেখানে যে আপনাকে আঘাত করে গেছে, তার সম্ভবত ইন্টেনশন ছিল না, জোরালো আঘাত করার। যদি তাই-ই হতো, তাহলে আপনি এখনো জ্ঞান দেওয়ার সিচুয়েশনে থাকতেন না।”
রুবায়েত থমকে দাঁড়ালো তাজরীনের কথাবার্তা শুনে। এই মেয়ে অতিরিক্ত বেশি বোঝে তো! একটা মব সৃষ্টি করেই ছাড়বে মনে হচ্ছে। একে বাগে আনতে হবে। নাহলে এতোদিনের এতোসব সাধ্য-সাধনা বানচাল হয়ে যাবে। রুবায়েত সোয়েটারের হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে বললো,
“তোমার এতো বেশি বুঝতে হবে না মিস। চুপচাপ চলো।”
তাজরীন চুপচাপ চলতে পারলো না। সড়ক পেরিয়ে বাজারের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চুলের খোঁপা খুলে ক্লো ক্লিপ মুখে আঁটকে চুল আবারও ঠিকঠাক করে নিয়ে ক্লিপ চুলে আঁটকাতে আঁটকাতে বেশ অভিযোগের সুরে রুবায়তকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আপনারা সব এমন কেন?”
“আমরা সব মানে?”
“মানে আপনারা ডিফেন্সের লোকরা সব এরকম কেন?”
“কীরকম?”

“প্রচন্ড কাটখোট্টা আর খিটখিটে মেজাজের। অনেক রুডভাবে কথা বলেন। কেন বলুন তো?”
“কারণ, সিভিলিয়ানদের সাথে নরমালভাবে কথা বললে তারা বুঝতে চায় না। এদেরকে রুডভাবেই বলতে হয়। সিভিলিয়ানদের সাথে রুড বিহেভিয়ার-ই ভালো যায়। এরা ম্যাক্সিমাম-ই ভালো আচরণ পাওয়ার যোগ্য না।”
কথাগুলো খুব গায়ে লাগলো তাজরীনের। সে নিজেও সিভিলিয়ানের মধ্যে পড়ে। সিভিলের মানুষদের এভাবে বলায় তার গায়ে লাগার-ই কথা। তাজরীনের প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু বাজারের লোক সমাগমের মধ্যে চলে এসেছে বিধায় থেমে যেতে হলো ওকে। রুবায়েত ওকে দোকানের সামনের একটা বাঁশের তৈরি বেঞ্চির ওপর বসিয়ে রেখে ভেতরের দিকে গেল। এই দোকানে চা হতে শুরু করে প্রায় সকল মুদি পণ্য পাওয়া যায়। তাজরীন বসে আশেপাশের পরিবেশ দেখছিল। গ্রামাঞ্চলে বাজারের মধ্যে একজন মেয়েমানুষ দোকানে বসে আছে দেখে সবাই তাকিয়ে দেখছে ওকে। তাজরীনের প্রথম প্রথম অস্বস্তি হতে লাগলো। তখনই রুবায়েত দোকানের ভেতর থেকে ডাক দিলো,

“এই তাজ, তুমি কি চা খাবে?”
তাজ! তাজ বলে ডাকলো! তাজরীনের হৃৎস্পন্দন কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল। ওকে ‘তাজ’ বলে খুব কাছের অল্প কয়েকজন মানুষ ডাকে। এই লোকটা আসার পর থেকে এর আগে তাজরীনের নাম একবারও উচ্চারণ করেনি। হঠাৎ ‘তাজ’ সম্বোধনটা তাজরীনের শ্বাস-প্রশ্বাস মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ কেন হলো কে জানে! ও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না। শুধু মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝালো। এই মুহূর্তে তৃষ্ণা পাচ্ছে খুব। গলা শুকিয়ে গেছে। এখন গলা ভেজানো খুব জরুরি। নাহলে তাজরীন এই ভরা বাজারের মধ্যে যেকোনো মুহূর্তে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে নির্ঘাত!
রুবায়েত মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এক কাপ লাল চা নিয়ে আসলো হাতে করে। তাজরীনের হাতে ধরিয়ে দিতেই ও জিজ্ঞাসা করলো,
“আপনি খাবেন না?”
“না। তুমি খেতে থাকো। আমি পাঁচ মিনিটে আসছি। তোমার চা শেষ করতে নিশ্চয়ই পাঁচ মিনিটের কম সময় লাগবে না?”
কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে কিছু ঝুঁকে প্রশ্নটা করলো রুবায়েত। তাজরীন অপ্রকৃতস্থ হয়ে মাথা নাড়ালো। রুবায়েত তখনই তাজরীনকে সেখানে বসিয়ে রেখে দোকানের পেছন দিকে অন্ধকার জায়গাটার দিকে চলে গেল। তাজরীন উঁকি মে’রে দেখলো, রুবায়েত সেই অন্ধকারের মধ্যে গায়েব হয়েছে। ও বেশি ভাবলো না। নিশ্চিন্ত মনে চায়ে মনোযোগ দিলো।

রুবায়েত ফিরলো ঠিক মিনিট পাঁচেক পরেই। আসা মাত্র তাজরীনের সাথে কোনো কথাবার্তা না বলে দোকানের যেদিকটায় ফ্রিজ রাখা সেখানে চলে গেল। ফিরলো বড় বড় দু’টো পলিব্যাগে অনেকগুলো আইসক্রিম আর কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে। তারপর কোনোকিছু না বলেই তাজরীনকে ইশারা করে হাঁটা ধরলো। মূল সড়ক পার হয়ে নিচের দিকে ঢালের মতো নেমে যাওয়া মেঠোপথ পর্যন্ত আসতেই এতোক্ষণে তাজরীন বুঝতে পারলো, রুবায়েতকে যতোটা স্বাভাবিক দেখেছিল কিছুক্ষণ আগেও, দোকানের পেছন থেকে আসার পর আর ততোটা স্বাভাবিক লাগছে না। বরং কিছুটা অস্বাভাবিক, অগোছালো আর চিন্তিত মনে হচ্ছে। রুবায়েতের চুলের দিকে খেয়াল করলো তাজরীন। কয়েকদিনে দেখে যতোটুকু বুঝেছে, লোকটা বেশ ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করে চলতে পছন্দ করে। নিজেকে সবসময় স্ট্রেইট রাখে। পরিপাটি থাকে। চুলগুলোও সুন্দরভাবে সেট করা থাকে। এখন তার চুলগুলো উষ্কখুষ্ক, অগোছালো। মনে হচ্ছে চুল নিয়ে টানাহেচড়া করেছে। অথচ আসার সময়েও ঠিকঠাক ছিলো। হঠাৎ কি এমন হলো? তা-ও মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে! তাজরীনকে ব্যস্ত রেখে কোথায় গিয়েছিল লোকটা?
তাজরীনের ইচ্ছা হলো, মনের মধ্যে জমতে থাকা সব প্রশ্নগুলো উগড়ে ফেলতে৷ কিন্তু রুবায়েতের মুখের হাবভাব দেখে আর সাহস হলো না। বাকি রাস্তাটুকু নিরবতায় কেটে গেল।

তাজরীন তহুরার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। তহুরা বেশ মনোযোগ সহকারে শুনছে তাজরীনের কথা। আসরে সবাই গল্প-আড্ডায় মশগুল। শুধুমাত্র রুস্তম আর রুবায়েত নেই এখানে। জীম, তাজরীন সেটা ভালোভাবে খেয়াল করেছে। অবশ্য করারই কথা। কিছু একটা যে উল্টাপাল্টা হচ্ছে, তা শুধুমাত্র ওরা বুঝতে পারছে। পুরোপুরিভাবে না হলেও কিঞ্চিৎ আঁচ করতে পারছে। ছোট দিদার বাড়িতে আসা মাত্র-ই রুবায়েত রুস্তমকে দূরে দাঁড়িয়ে ইশারা করতেই রুস্তম উঠে গেছে আসর ছেড়ে। এই ব্যাপারটা তাজরীন খেয়াল করেছে। জীম বুঝতে পারলেও অতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিছু হলেও এখন ও কিছু বলতে চাইছে না। একটা ঝামেলা সবে কাটিয়ে উঠেছে। এখন আবার কিছু বললে আরো একটা ঝামেলা বাঁধবে। আনন্দঘন পরিবেশ বিনষ্ট করার কোনো মানে হয় না। এই ভুল আর দ্বিতীয়বার করার ইচ্ছা নেই জীমের। নিতান্তই বাধ্য না হলে নয়। তাজরীন তহুরাকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করছিল,

“ঘটনা কতদূর এগোলো?”
তহুরা হতাশ ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
“কিছুই না। নাথিং। ওর কিচ্ছু যায় আসে না আমার যেকোনো বিষয়ে। ফ্রেন্ড হিসেবে জাস্ট একটু জ্ঞান ঝেড়েছিল। এছাড়া আমি প্রেম করলাম, বিয়ে করলাম কি আমার বাচ্চা হলো; তাতে ওর কোনো আগ্রহ নেই। ও আছে ওর নিব্বি গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে। বাবু, বেবি, সোনা, পাখি! যেন একটা বাচ্চা পালতেসে হারামিটা! বিয়ে না করেই বাপ হয়ে গেছে! আশ্চর্য আশ্চর্য! দুনিয়া কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে আজকাল? যার বাবু হওয়ার কথা সে নিজেই বেবি হয়ে যাচ্ছে। আর যার যাকে বাবুর মা বানানোর কথা, তাকেই নিজের বাবু বানিয়ে দিচ্ছে! ধরণী দ্বিধা হও!— আমি না, জাহানারা ইমাম বলেছিলেন এই কথা। যদিও বর্তমান প্রজন্মের জন্য প্রযোজ্য।”
তাজরীন হতাশ হলো তহুরার কথা শুনে। তার ঘটকালিতে আজ পর্যন্ত কোনো কালিমা পরেনি। এটাতেও সে কোনোভাবেই পরতে দেবে না। তহুরার জন্য আবার নতুন কোনো পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। তাজরীন ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে সামনের ডিশ থেকে গরমাগরম পুলি পিঠা উঠিয়ে মুখে পুরতে লাগলো। খালি পেটে মাথা কাজ করে না। পেট ভরা থাকলে, মস্তিষ্কে কথা ধরানের জায়গা থাকে না!

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৭

দু’জন পুরুষ মানুষ বের হলো অনেকক্ষণ হয়েছে। এখনো ফেরার কোনো নাম নেই। দিদা তখন কাঠ-লাকড়ি সরিয়ে রাখছেন চুলার কাছ থেকে। মধ্যরাত। রান্না শেষ হয়েছে মাত্র। এখনই খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন শুরু হবে। জীম, তাজরীনরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে দু’জনের জন্য। তাদেরকে আফিম, শোয়েব, হাসান কলও দিয়েছে অনেকবার। জীম তো শাহবীরকে লাগাতার কল করেই যাচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে মেসেজ করেই চলেছে। রিং বাজছে। তবে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। রুবায়েতকেও কল করা হয়েছে। কিন্তু ফোন রিসিভ করছে না কেউ-ই। মেয়েলোকেরা এবার বেশ টেনশনে পরলো৷ এতোরাতে তারা কোথায় আছে এখনো! আলোচনা করছিল নিজেদের মধ্যে, কোথায় যেতে পারে তারা। তখনই আফিম আর হাসান ফোনে কিছুক্ষণ টাইপ করেই উঠে গেল আসর ছেড়ে। ওদেরকে বিধ্বস্ত লাগছে। শ্বাস-প্রশ্বাস উঠানামা করছে। দ্রুত জুতা গলিয়ে নামতে নামতে অস্থিরতার সাথে বললো,
“আমরা আসছি একটু। তোমরা থাকে সবাই। শোয়েব, রায়ান সবাইকে দেখে রাখিস!”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ১৯