নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৩
ঝিলিক মল্লিক
“ও জীম, শোবার কী ব্যবস্থা হলো রে মা?”
বেসিনে বাসনকোসন ধুতে ব্যস্ত ছিলেন ডলি বেগম। জীম চা বানাচ্ছিলো তখন৷ রাতের খাবার খেয়ে সবাই গোল হয়ে ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে মোটা তোশক বিছিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসেছে আধা ঘণ্টা হলো। জীম এসেছে তাদের সবার জন্য চা বানাতে। খাওয়ার পর একটুখানি চা না হলে জমে না৷ আর অতিথিদের আপ্যায়নে এতোটুকুও কার্পণ্যতা করতে রাজি নয় জীম।
চা কাপে ঢালতে ঢালতে ও জবাব দিলো,
“বড়ঘরে ছেলেদের পাঁচজনের ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে আম্মা। আরেক ঘরে মেয়ে তিনজনের। তোমার ছেলে তার ঘরে। আমি, তুমি আর তাজরীন ঘুমাবো তোমার ঘরে।”
শেষোক্ত কথাটা শোনা মাত্র ডলি বেগম হাতের কাজ ফেলে এগিয়ে আসলেন জীমের কাছে। ওর হাতের কব্জি আলতোভাবে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“তুই আমাদের সাথে থাকবি ক্যান?”
“তো কই থাকবো?”
চায়ের কাপ রেখে ভ্রু কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করলো জীম৷ ডলি বেগম বললেন,
“তুই থাকবি পোলার সাথে একঘরে। তোদের দু’জনের জন্যই তো ওই ঘরটা ছেড়ে দেওয়া। নাইলে পোলারে ওদের সাথে পাঠিয়ে দু’টো ঘরে আলাদা আলাদা করে দিতাম। গ্যাদারিং কম হতো।”
জীম এবার কাজে মনোযোগ দিতে দিতে বললো,
“তোমার ছেলের সাথে আজ আমি থাকছি না আম্মা। তোমার ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা করেছি। এমনকি আমার কম্বল, কম্ফোর্টার সব তোমার ঘরে নেওয়া হয়ে গেছে।”
“হঠাৎ কী হলো তোদের দু’টোর? তোরা তো ঝামেলা করার মানুষ না!”
বেশ বিস্ময়ের সাথে কথাটা বললেন ডলি বেগম। জীম কোনো জবাব না দিয়ে চায়ের কাপে চিনি মেশাতে লাগলো। তখনই তাজরীন একটা ছোট প্লাস্টিকের পাত্র হাতে নিয়ে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালো জীমের পাশে। তারপর ওকে জিজ্ঞাসা করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“বৌমণি, তোমাদের রুমের ফ্লোরে কাঁচের এসব কী? ভেঙে টুকরো হয়ে পড়ে আছে দেখলাম। আরেকটু হলেই তো আমার পায়ে ঢুকে পা কেটে যেতো।”
“তোমার ভাইয়ের কাজ। কাঁচের গ্লাস ভেঙেছেন তোমার মহামান্য ভাই। সুতরাং, আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো৷”
ডলি বেগম আর তাজরীন একবার একে অপরের দিকে তাকালেন। তারপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হলেন তারা। জীম ট্রে-তে চায়ের কাপ সবগুলো সাজিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সরু বারান্দা পার হয়ে ড্রয়িংরুমে গেল।
হাসানের সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়েছে জেসি৷ নাইন/ইলেভেনের ট্রাজেডি নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছে তাদের মধ্যে। তর্কাতর্কি তুমুল পর্যায়ে। যে যার অবস্থানে দৃঢ়। নিজস্ব মতামতকে প্রধান্য দিতে সর্বদা প্রস্তুত। এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ছাড়তেও রাজি নয়। হাসান সম্ভবত আঙুল উঁচিয়ে বলছিল, “জেসি তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো৷ নর্মাল টপিক নিয়ে এমন ছেলেমানুষি তর্ক আমার পছন্দ নয়।”
তর্ক আরো এগোনোর পথে, তখন জীম এসে ওদের থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আরে ঝামেলা হচ্ছে কী নিয়ে?”
জেসি জবাব দিলো,
“সিস্টার বলো তো, নাইন/ইলেভেন ট্রাজেডির মূল হোতা কে বা কারা? যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পক্ষ? নাকি তাদের মতবাদ অনুযায়ী, আল-কা’য়দা সংস্থা?”
জীম এবার চায়ের কাপ সবার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“এটা খুবই জটিল একটা প্রশ্ন জেসি। তর্ক-বিতর্ক অনেক রয়েছে এই ট্রাজেডি নিয়ে। তাছাড়াও আমরা ভেতরকার খবর জানি না। চোখে যা দেখা যায়, সবসময় তা সঠিক না-ও হতে পারে৷ চোখের দেখার বাইরেও আরো অনেক ঘটনা থাকে। সেসব সম্পর্কে আমরা অবগত নই।”
“হ্যাঁ এটাই। আমিও তো একথা বলছি, চোখের দেখার বাইরে আরো অনেককিছু থাকতে পারে; যা আমাদের অজানা। তাই সব দোষ না জেনেশুনে আমরা একটা সংস্থা বা রাষ্ট্রের ওপর ফেলে দিতে পারি না।”
“এখানে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ব্যাপার আছে।”
জীমের কথা শেষ হওয়া মাত্র হাসান এবার জবাব দিলো,
“আমিও জেসিকে এতোক্ষণ এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি সিস্টার। মেয়েমানুষ দুই লাইন বেশি বোঝে। যেহেতু আমরা কেউ-ই নিশ্চিত নই, তাই একটা কথার ওপর বেশি জোর দিয়ে ওভার-কনফিডেন্স দেখানো উচিত নয়। ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, ও কীভাবে সমানে তর্ক করে চলেছে!”
জীম অগোচরে সামান্য মুচকি হাসে। যতদূর বুঝলো, এদের দু’জনের মধ্যকার সম্পর্ক উত্তর-দক্ষিণ মেরুর মতো। বিপরীতমুখী। একজন যদি চলে ডানে, তাহলে আরেকজন চলে বাঁয়ে। বৈরী সম্পর্ক যাকে বলে৷ জীম এবার খেয়াল করলো, রুস্তম এখানে নেই। কিছুক্ষণ আগেও জীম যখন তাদের ঘর থেকে নিজের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে পাশের ঘরে যাচ্ছিল, তখন বারান্দার ওপাশ থেকে অগোচরে খেয়াল করে দেখেছে, শাহবীর এখানে বসে সবার সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত ছিল। সবাই খুব খোশমেজাজে গল্প করছিল। এখন শাহবীর উপস্থিত নেই। সবাই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। দু-একজন ফোন চালাতে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে খাওয়ার সময়েই ডাইনিং-এ সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিয়েছে জীম। এরা সবাই খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। জীম নিজেও এমন। এজন্য ব্যাপারটা ওর দারুণ লেগেছে। আফিম ফোনে কথা বলছিল ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে। পাশ থেকে তহুরা ওকে খোঁচাচ্ছে। মুচকি মুচকি হাসছে ওর ফোনের দিকে তাকিয়ে। এক পর্যায়ে আফিম উঠে দাঁড়ালো আড্ডাস্থান থেকে। জীমকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলো,
“সিস্টার, একটু নিরিবিলি জায়গা পাওয়া যাবে?”
“অবশ্যই যাবে। ড্রয়িংরুমের ওই পেছনের দিকে লম্বা বারান্দা। ওখানটাতে সহজে কেউ যায় না। আপনি ওখানে যেতে পারেন ভাইয়া।”
আফিম হাঁটা দিলো ড্রয়িংরুমের পেছনের দরজার দিকে। যাওয়ার সময়ে তহুরার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো একবার। তহুরা “কিছুই হয়নি”— এমন ভান ধরে একটা ভেংচি কাটলো আফিমের দিকে চেয়ে। ওপাশে বারান্দা পুরো অন্ধকার। কেউ নেই বোধহয়। জীম এবার আড্ডায় বসলো সবার সাথে। একে একে সবার জব কোয়ালিফিকেশন জানলো। যতদূর বুঝলো, এরা সবাই লাইফে অনেক স্ট্রাগল করে আজকের এই অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ সময় কঠোর পরিশ্রমে দিন কেটে যায় এদের সবার।
রিক্তি, তহুরা আর জেসির সাথে কথাবার্তা বলছিল জীম। আগামীকাল ভোরবেলা বের হবে তারা৷ সবাই সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। তাই ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো না করে শুধু নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে নিলেই হবে। যেহেতু যাত্রা দীর্ঘ হবে, তাই জীম ঠিক করলো ভোরে উঠে কিছু হালকা নাস্তা তৈরি করে সঙ্গে নিয়ে যাবে। বাইরের খাবারে অসুস্থ হয়ে পরার ঝুঁকি বেশি। এই কথাগুলো জেসিদের বলছিল জীম। তখনই রিক্তি বলে উঠলো,
“তাহলে আমরাও নাহয় ভোরে উঠে তোমাকে হেল্প করবো। একা হাতে সবকিছু করতে পারবে না।”
বাকিরাও রিক্তির সাথে তাল মেলালো। জীম একবার মানা করলো ওদের। কিন্তু ওরা বড্ড নাছোড়বান্দা। দ্বিতীয়বার আর বলতে দিলো না জীমকে। তাজরীন হাত-মুখ ধুয়ে এসে জীমের পাশে বসেছে মাত্র। রুবায়েত ফোনে মেসেজ করায় ব্যস্ত ছিল। লম্বা বিনুনি করা কোমর সমান চুলের মালকিনকে একপলক দেখলো ও। তারপর আবার ফোনের দিকে মনোযোগ দিলো। দ্বিতীয়বার আর মুখ তুলে দেখার আগ্রহ দেখালো না। তবে মাঝেমধ্যে মেয়েদের ওপাশ থেকে একটা সরু হাসির ঝংকার ওর কানে এসে বিঁধতে লাগলো বারবার। একটু অন্যরকম হাসি! নাকি ওর-ই এমন লাগছে! রুবায়েতের অস্বস্তি হতে শুরু করলো হঠাৎ। এতোক্ষণ প্রতিক্রিয়াহীনভাবে বসেছিল ও। এবার উঠে দাঁড়িয়ে ফ্লোরের একপাশে রাখা স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে পেছনের বারান্দার দিকে হাঁটা ধরলো। তাজরীন এতোক্ষণ অগোচরে খেয়াল করছিল লোকটাকে।
শুরু থেকেই দেখছে, এই লোক একটু বেশিই চুপচাপ আর গম্ভীর স্বভাবের। আড্ডার মাঝে থেকে হা, হু ছাড়া আর একটা কথাও বলেনি। এসে থেকে এখনও পর্যন্ত মনে হয় হিসাব করলে পাঁচশ’র বেশি শব্দ খরচ করেনি। এজন্য তাজরীনের নজরে পরেছে বেশি। এমন গম্ভীর, মুখগোঁজা লোক তার চরম অসহ্য লাগে। সে হোক অতিথি কিনা! তাজরীন ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে আবারও আড্ডায় মনযোগী হলো। এখন লুডু খেলার পরিকল্পনা চলছে। জীমের ফোনটা সামনে। পাঁচজন গোল হয়ে বসলো। রাত সবে দশটা। তারা বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকবে। সময় কাটাতে লুডু খেলা শুরু হলো। ছেলেরা সব ফোন চালাতে ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে দু-একজন উঠে পেছনের বারান্দায় যাচ্ছে-আসছে। কিন্তু শাহবীরকে একবারের জন্যও দেখা গেল না এদিকে৷ লোকটাকে সেই রাতের খাবারের পর থেকে একবারও দেখেনি ও। তবে সন্ধ্যায় শোবার ঘরের ভেতরের সেই ঝামেলার পর আর একটাও কথা বলেনি দু’জন দু’জনার সাথে। এমনকি জীম তো শাহবীরের চেয়ারের পাশে গিয়েও দাঁড়ায়নি। তাজরীন-ই ভাইকে খাবার বেড়ে দিয়েছে। জীম ভাবলো, আর একবারও ওই লোকের কথা মনে করবে না। ওই লোক ওর ওপর চিল্লিয়েছে আজ! ভাগ্যিস অতিথিরা কেউ টের পায়নি ওদের এই মনোমালিন্যের ব্যাপারে।
রাত তখন সাড়ে বারোটা। ছেলেরা সবাই ঘুমাতে চলে গেছে। জীম তখন ওপাশের বারান্দার একেবারে শেষ মাথায় অবস্থিত ঘরটায় জেসি, রিক্তি আর তহুরার ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে বের হয়ে নিজের শাশুড়ির ঘরের দিকে যাচ্ছিলো ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। তখন সামনে পরলো তাজরীন। ওকে কিছুটা দ্বিধান্বিত মনে হলো৷ জীম সরু চোখে তাকালো। ওর চাহনি তীক্ষ্ণ। তাতে যেন আরো কিছুটা ভীত হয়ে উঠলো তাজরীন। এমনিতে দুই বছরের বড় বৌমণির সাথে তার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আবার বৌমণিকে ভীষণ ভয়ও পায় সে। জীম এবার জিজ্ঞাসা করলো,
“কী হয়েছে? ঘুমাতে যাওনি? এখনো জেগে আছো কেন?”
“বৌমণি, তোমাকে ভাইয়া তোমাদের রুমে ডাকছে।”
দ্বিধান্বিত কন্ঠেই কথাটা বলে জীমের দিকে ঠোঁট চেপে তাকায় তাজরীন। জীম এবার সরু চোখে বললো,
“তোমার ভাই কোথায় ছিল এতোক্ষণ?”
“আড্ডার সময়টাতে ভাইয়া বারান্দাতেই ছিল। তুমি খেয়াল করোনি।”
“তুমি জানলে কীভাবে?”
“ওঘর থেকে কম্বল আনার সময়ে আমি দেখেছিলাম ভাইয়াকে।”
“আড্ডায় না থেকে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলেন তোমার মহামান্য ভাই?”
“স্মোকিং করছিল।”
নতমুখে কথাটা বলে তাজরীন। জীম এবার কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে রেখে তারপর মুখ খোলে,
“ও আচ্ছা আচ্ছা! সিগারেট গিলছিল না! তা তোমার ভাই এখন আমাকে ডাকছে কী কারণে?”
“তা তো জানি না বৌমণি। তুমি শুনে আসো। দেখো, কি বলে।”
“কি বলেছে তোমার ভাই?”
“আমাকে বলেছে, ‘তাজরীন সিলভিকে রুমে পাঠিয়ে দাও।’ এটাই।”
তাজরীন কিছুটা রুস্তমের মতোই গম্ভীর স্বরে বলার চেষ্টা করে। জীম বলে,
“তোমার ভাই তোমাকে আজ ‘তুমি’ করে কথা বলেছে। আর এখনও পর্যন্ত আমার জীম নামটা মুখে নেয়নি। সিলভি নামে সম্বোধন করেছে। এ-ই তো?”
“হু।”
“তারমানে ওই লোক এখনো রেগে আছে। এখন ওখানে গেলে আবার একটা ঝামেলা বাঁধবে। যা মোটেও চাইছি না। আমি ওঘরে যাবো না তাজরীন। জানিয়ে দিও তোমার ভাইকে।”
“প্লিজ বৌমণি। তোমার হাতটা ধরি। যাও না। একবার শুনে আসো কি বলে। তুমি না গেলে ভাইয়া আমাকে তুলে আছাড় মারবে৷ ছোটবেলায় ওষুধ না খাওয়ার বাহানা ধরতাম বলে একবার সত্যিই তুলে আছাড় মে’রেছিল। বাবাও কখনো আমাকে একটা ধমক দেয়নি। সেখানে ভাইয়া আমাকে তুলে আছাড় মেরেছিল৷ জানো তো, ভাইয়ার কি রাগ!”
তাজরীন কাকুতিমিনতি করে কথাগুলো বলে। জীম পাল্টা জবাব দেয়,
“এই গল্প আমি বহুবার শুনেছি তোমার মুখ থেকে। আমার প্রয়াত শ্বশুরমশাই মানুষটা খুব ভালো ছিলেন। সবাই তার প্রশংসা করে৷ কিন্তু তার যে অমন জাঁদরেল, জল্লাদ একটা ছেলে হলো কিভাবে, এটাই ভাবলে আমার অবাক লাগে মাঝেমধ্যে!”
“এখন ওসব কথা ছাড়ো। চলো তোমাকে ভাইয়ার রুমে দিয়ে আসি।”
জীমের মেজাজ একটু স্বাভাবিক হতে দেখেই এই সুযোগে ওকে টেনে ধরে বারান্দা থেকে ড্রয়িংরুম তারপর আরো একটা সরু বারান্দা পার হয়ে সেই বারান্দার একেবারে শেষ মাথায় রুস্তমের ঘরের সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো তাজরীন। দরজায় একটা টোকা দিয়ে দেখলো খোলা-ই আছে। শুধু ভেজিয়ে রাখা। তাজরীন ঠেলে জীমকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো।
আচনক ঘটনায় আশ্চর্য হওয়ারও সময় পেল না জীম। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো, শাহবীর ট্রাউজারের ওপরে পরনের টি-শার্টটা খুলছে। শীতের এই মৌসুমে এতো গরম আসছে কোথা থেকে! গায়ের চাঁদরটা আরো ভালোভাবে টেনে জড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে দুই কদম এগিয়ে গেল জীম। শাহবীর ওকে আগেই দেখেছে। তবু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এতে আরো বেশি রাগ উঠছে জীমের। ওকে ইগনোর করছে! ওকে কেউ ইগনোর করলে ও সহ্য করতে পারে না। প্রচন্ড ইগোতে লাগে। এখনও তাই-ই হচ্ছে। তবে রাগ যথাসম্ভব সংবরণ করার চেষ্টা করছে জীম। ঠোঁট কামড়ে শাহবীরের কাজকর্ম দেখছে। প্রথম টি-শার্ট খুলে তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঠিকঠাক করে পেছনে ফিরে জীমকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়ে আধখোলা দরজা লক করে দিয়ে আসলো৷ তারপর বিছানার ওপর আয়েশ করে বসে পাশের মিনি কেবিনেট থেকে বেনসনের প্যাকেট আর নীল রঙা লাইটার বের করে আনলো। লাইটার জ্বালানোর আগেই জীম একপ্রকার তেড়ে এসে সেটা কেড়ে নিলো শাহবীরের হাত থেকে। চোখ থেকে তখন যেন আগুন ঝরছে ওর। রুস্তম দেখেও দেখলো না। জীম সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে জোরপূর্বক নিজের মুখোমুখি বসিয়ে দিলো। ওর মুখের দিকে চাইলো। জীম তখন মুখ ঘুরিয়ে নিলো। রুস্তম এবার চোয়াল শক্ত করে বললো,
“আমার দিকে তাকাও।”
“পারলাম না।”
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেই জবাব দিলো জীম। রুস্তম এবার ওর হাতের কব্জি কিছুটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
“ত্যাড়ামি আর সবার সাথে করলেও আমার সাথে করার চেষ্টা করো না। আমি কিন্তু মানুষ ভালো না।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ জানি তো। এ আর নতুন কী?”
এবার রুস্তমের দিকে তাকালো জীম। রুস্তম দাঁতে দাঁত পিষে প্রশ্ন করলো,
“আজ ডাইনিং-এ সবার সামনে ওরকম ব্যবহার করছিলে কেন?”
“কীরকম?”
“সবার প্লেটে তুমি খাবার উঠিয়ে দিলে নিজে। তাহলে আমার প্লেটে দিলে না কেন? সবাই মাইন্ডে নেবে না এসবে?”
“না নেবে না। আপনার মতো অতো মাইন্ড নেই সবার।”
“বাড়াবাড়ি করছো সিলভি!”
হালকা ধমকের স্বরে কথাটা বললো রুস্তম। জীম উত্তর দিলো,
“বাড়াবাড়ি আপনি করেন সবসময়। আপনার জন্য আমাকে বাজে পরিস্থিতিতে পরতে হয়।”
“আমি কী করেছি?”
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নটা করলো রুস্তম। জীম জবাব দিলো,
“কি করেছিলেন, মনে করেন। সন্ধ্যায় রুমের ভেতরে গ্লাস ভেঙেছিল কে?”
“অবশ্যই তুমি।”
“না, আমি ভাঙিনি। আপনি ভেঙেছেন। আপনার অকাজ ওটা।”
“মোটেও আমার কাজ নয়। মনে করে দেখো, তুমি ভেঙেছিলে।”
“বললাম তো, আপনি করেছেন। আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন?”
“কারণ, তুমি দোষী। নিজের দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে না।”
গ্লাসটা যে কে ভেঙেছিল— সেই তদন্তের রিপোর্ট উদ্ধার করা গেল না। কিন্তু মহা এক তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে জীমকে নিজের কাছে টেনে নিলো শাহবীর। জীম নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েও পারলো না। প্রতিদিন এক্সারসাইজ করা ওই শক্তপোক্ত শরীরের সাথে পেরে ওঠারও কথা নয়। বরং আরো ঘনিষ্ঠ হলো দু’জন। তবে রুস্তমের রাগ তখনও একটুও কমেনি। জীমের গলার পেছনে শক্ত হাত বিচরণ করতে করতে গলার ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলো,
“সিলভি।”
জীমের তখন মারমুখো অবস্থা। হাতদুটো রুস্তমের গলায় শক্ত করে পেঁচিয়ে রাখা। মুখ লুকিয়ে রেখেছে রুস্তমের বাহুতে। এবার আলতোস্বরে ও জবাব দিলো,
“হু।”
“আমাকে সব ব্যাপারে প্রশ্ন করবে না। প্রফেশনাল লাইফে নাক গলানো আমি পছন্দ করি না। তুমি আজ সেই ভুল করেছো। আমার রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারছো?”
জীম কোনো জবাব দিলো না প্রথমে। তারপর আবার কথা ঘুরিয়ে বলে উঠলো,
“আপনি সবসময় সব মেজাজ আমার ওপরে দেখান। ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন কোনোকিছু নিয়ে ঝামেলা হলেও কল দিয়ে আমার ওপর রাগ ঝাড়েন। এমন করেন কেন শাহবীর?”
রুস্তম এই প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে গাঢ় একটা চুমু খায় জীমের গ্রীবায়। তারপর ওকে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে বলে,
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২
“ঘুমাও এখন চুপচাপ। জ্বালিয়ো না আর। ভোরে উঠতে হবে। ডেকে দিও আমাকে। ক্লান্ত লাগছে খুব। চুল টেনে দাও তো একটু।”
রুস্তম জীমকে পেঁচিয়ে ধরেই বালিশ মাথার নিচে টেনে শুয়ে পরলো। জীম চুপ করে শুয়ে রইলো রুস্তমের বুকে। মাথা উঁচিয়ে ওর ক্লান্ত মুখশ্রী দেখতে লাগলো। শাহবীর তখন চোখ বুঁজে একহাত কপালে ঠেকিয়ে আদেশের সুরে গম্ভীর গলায় বললো,
“সিলভি, চুল টেনে দাও। ঘুম প্রয়োজন আমার।”
