নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৪

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৪
ঝিলিক মল্লিক

মিডনাইট পার্টির আয়োজন চলছে৷ রাত তখন দেড়টা হবে। কুঠিবাড়ি আজ জেগে আছে। এমনিতেও এতো মেহমানের ভিড়ে ঘুমানো কঠিন ব্যাপার। বরং জেগে থাকাতেই আনন্দ। সায়নের বন্ধুরা ডিজে চালু করেছে৷ এখন তারা নাচ-গান করবে। স্টেজের ওপর সাদা চাদর জড়িয়ে ভূত সেজে বসে আছে সায়নের বন্ধু আহসান। চোখে কালো সানগ্লাস। এখন সে উরাধুরা নাচবে। মুরব্বিরা নেই উঠোনে। রিমিলি বসে আছে উঠোনের মাঝখানের একটা চেয়ারে। ওর পাশে আরেকটা চেয়ারে বসে আছে মাহমুদ। রিমিলিকে বলছে,

“দ্যাখ। দেখে কিছু শেখ। নিজে তো কিচ্ছু পারিস না। অকর্মার ঢেঁকি!”
রিমিলি বিরোধ করে বলে উঠলো,
“কে অকর্মার ঢেঁকি হ্যাঁ? তুমি জানো? আমি সব ধরনের রান্নাবান্না পারি।”
“শুধু রান্না জানলেই হয় না৷ আরো ট্যালেন্ট থাকতে হয়।”
রিমিলি এবার ক্ষেপে গিয়ে বললো,
“এই জন্ন-ই বেশি শিক্ষিত মাইনষের সাথে কথা কইতে হয় না। থাকো তুমি!”
সেখান থেকে উঠে গেল রিমিলি। কুৃঠিবাড়ির পেছনের বাগানের দিকে চলে গেল।
জীম রান্না চড়িয়েছে। কতগুলো ইট জড়ো করে চুলো বানানো হয়েছে। এই আয়োজনের কথা গুটিকয়েক মানুষ জানেন। জীমের শাশুড়ি, খালা শাশুড়ি, তার ননদ এবং এবাড়ির কয়েকজন মেয়েমানুষ। বর্তমানে আসরে উপস্থিত আছেন একজন মুরব্বি। সবার থেকে বয়সে বড়। সে হচ্ছে, জীমের খালা শাশুড়ির ছোট ননদ সাইদা। সাইদা আন্টি বয়সে এখানকার মেয়েদের চেয়ে সর্বোচ্চ বছর পাঁচ-সাতেকের বড়। তাই, জীমদের সাথে তার মিলেছে ভালো। তার একটা ছয় বছর বয়সী ছোট মেয়ে আছে। মেয়েটাকে সে তার মেজো বোন যেখানে ঘুমিয়েছে, সেখানে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে। সাইদা আন্টি জীমকে বললেন,

“তুমি সরে এসে এখানে কাঁথার নিচে বোসো এবার। আমি খুন্তি নাড়ছি।”
জীম খাবারের লবণ, মশলা পরখ করে এবার এসে বসলো। সাইদা আন্টি উঠে গিয়ে খুন্তি নাড়তে লাগলেন। জেসি, রিক্তি, তহুরা আর তাজরীন লুডু খেলছে। রিমিলি এসে বসলো ওদের পাশে। গোমড়া মুখ দেখে সবাই জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে। রিমিলি জবাব দিলো না। চুপচাপ ওদের খেলা মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো। তাজরীন শুধু ফোনে লুডুর চাল দিচ্ছে। কিন্তু ওর ভেতরে আপাতত কোনো আনন্দ-অনুভূতি কিছুই নেই। যে যা বলছে, চুপচাপ তাই করছে। সতেজ ভাবটা আর তাজরীনের মধ্যে লক্ষ্য করা গেল না। আশেপাশে বেশ কয়েকটা মশার কয়েল জ্বলছে। নাহলে এখানে এতোক্ষণ পাটি বিছিয়ে বসা যেতো না। জীম সবে কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে আরাম করে বসে সাইদা আন্টির রান্না করা দেখছিল। টুকটাক কথাবার্তা বলছিল। তখনই পাশে রাখা তার পার্স ব্যাগের ভেতরে থাকা সেলফোনটা ক্রিংক্রিং শব্দে বেজে উঠলো। জীম পার্স খুলে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, শাহবীরের ফোনকল। আজ তাদেরকে ভুলভাল বুঝিয়ে এখানে এসেছে। শাহবীররা জানে, জীমরা সবাই সাইদা আন্টির সাথে পাশের বাড়ির আখতার চাচাদের বড়ঘরে শোবে। তাহলে এতোরাতে কল করার কারণ কি! জীম ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে ধীরেসুস্থে জিজ্ঞাসা করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কী হয়েছে?”
ওপাশ থেকে চেনাপরিচিত পুরুষালি কন্ঠস্বর গভীর ঘুমঘুম স্বরে বলে উঠলো,
“তুমি আসতে পারবে এখন?”
জীম আশ্চর্য হয়ে বললো,
“আসতে পারবো মানে? এখন কীভাবে আসবো? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“যেভাবে পারো আসো। সমস্যা তো একটা হয়েছে। আমার ঘুম হচ্ছে না। রুবায়েত, হাসান ওরা পাশের ঘরে শুয়েছে। আমি একা ঘরে। তুমি আসলে ভালো হতো।”
“কী হতো?”
“ভালো হতো।”
“আবার বলুন।”
“পারলাম না। আসলে আসো। নাহলে আমি আসছি তোমাকে নিতে। আখতার চাচাদের বড়ঘরে আছো না? বের হও৷ আসছি আমি।”

জীম পরেছে মহা ফ্যাসাদে। তারা তো আখতার চাচাদের বাড়িতে নেই। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আর শাহবীর মিথ্যা বলা পছন্দ করে না। এবার জানতে পারলে নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে এই শীতের রাতে চুবিয়ে ধরবে। জীম বাঁধা দিতে তাড়াহুড়োয় বলে উঠলো,
“না, না! প্লিজ আপনি আসবেন না। সবাই জেগে যাবে। তাছাড়াও এখানে মুরব্বিরা আছেন। তারা কি মনে করবে! ঘরের দরজার খিল তো আটকানো।”
“দরজা আটকানো তাতে কী হয়েছে? খুলে আসো বাইরে। কেউ দেখলে দেখুক। স্বামীর কাছেই তো আসছো। নাকি পরপুরুষের কাছে?”

“কিন্তু ওরা ভালোভাবে নেবে না ব্যাপারটা। আত্মীয় বাড়িতে এসে মাঝরাতে সবার মাঝখান থেকে উঠে স্বামীর কাছে যাওয়া। না, না! এটা বেয়াদবি হয়ে যায়। এমন অসভ্যতামি আমি করতে পারবো না।”
“এমনি সময় তো খুব আসো অসভ্যতামি করতে। এখন একটু করলে দোষ কোথায়? অসভ্যতামি তো তোমার রক্তের শিরায় শিরায় মিশে আছে। তাহলে এতো ভয় কীসের?”
“লোকলজ্জা।”
“লোকে লজ্জা দেয়-ই লজ্জা পাওয়ানোর জন্য। আর যেহেতু তুমি একজন নারী, তাই তোমার বেশি বেশি লজ্জা পাওয়া উচিত। এতে আমি লোক বা পরিস্থিতির দোষ দেখি না।”
জীম আর তর্ক করতে পারবে না। শাহবীরের কথায় যুক্তি আছে। জীম তা মানতে না চাইলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। শাহবীর এবার বললো, “আসছি আমি।”

জীম হতভম্ব হলো। কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিয়েছে। এখন কি করবে ও! জীম দ্রুত কাঁথা ফেলে উঠে দাঁড়ালো। সবাই খেলায় মগ্ন। সাইদা আন্টিকে ও বলে গেল, ওয়াশরুমে যাচ্ছে। আর তারপর-ই দৌড়। দ্রুত পেছনের বাগান থেকে ফিরে কুঠিবাড়ির সামনে আসলো। দেখলো, এখানে সবাই পুরুষরা উপস্থিত। ওপাশের কংক্রিটের বিল্ডিংয়ে আবার মহিলা মুরব্বিগণ আসর বসিয়েছেন। বিয়েতে কনেপক্ষের আয়োজন নিয়েই আলাপ-আলোচনা চলছে। জীম সেই পথও মাড়ালো না৷ কাঠের দোতলার উঁচু ভিটা ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে পাশের বাড়ির দিকে চলে গেল। ও বাড়ির খোলা উঠোন। দুপুরের দিকে একবার এখানে এসেছিল জীম। তাই চেনাজানা হয়ে গেছে বাড়িটা। জীম এগিয়ে গিয়ে বড়ঘরের সামনের ভিটায় দাঁড়িয়ে পরলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যে দেখতে পেল, শাহবীর একটা জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেট টানতে টানতে এদিকে আসছে। জীম এগিয়ে গেল। শাহবীর ওকে দেখামাত্র হাত টেনে ধরে বললো,

“চলো।”
জীম সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কোথায় যাবো?”
“দোতলায় চলো। আমাদের সেই রুমটাতে। আমি বিছানা ঠিক করে রেখে এসেছি তোমার জন্য।”
“আশ্চর্য! এখন আমাকে ওখানে যেতে হবে?”
“তা নয় তো কী? এজন্যই তো তোমাকে নিতে আসলাম।”
“জীম নিজের হাত টেনে সরিয়ে নিয়ে বললো,
“দেখেন, ভেতরে কেউ জানে না, আমি এখানে। জানলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ঠাট্টা করবে সবাই। আপনি বরং মন ভরে এখানে দাঁড়িয়ে দেখুন আমাকে। যা খুশি করুন। তারপর ভদ্র ছেলের মতো চলে যান।”
“তারমানে তুমি এখানেই তোমার সাথে অবগাহনে ডুবতে বলছো আমাকে? একটু তো লজ্জা-শরম ধরে রাখো। মেয়েমানুষ এরকম লজ্জা খুইয়ে ফেললে তো দুনিয়া উল্টে যাবে।”

জীম বিরক্ত না হয়ে পারে না। সে বলেছে কি, আর লোকটা বুঝেছে কি! সে কখন বললো, এখানে এসব করতে! লোকটা পারেও বটে! জীম প্রতিবাদ করা জরুরি মনে করলো না। এগিয়ে গেল শাহবীরের খুব কাছে। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে শাহবীরের গলা জড়িয়ে ধরলো। শাহবীর ওর দিকে তাকিয়ে আছে গভীর দৃষ্টি ফেলে। ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠেছে। জীম কিছুক্ষণ পাল্লা দিয়ে একটানা তাকিয়ে রইলো সেই চতুর চাহনির দিকে৷ তারপর হঠাৎ গলায় হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে কন্ঠনালীতে গাঢ়ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো। শাহবীর ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। হাতের সিগারেট পাশে ফেলে দিয়ে জীমের কোমর জড়িয়ে ধরেছে। জীমও সায় দিলো। শাহবীরের ঢোলাঢালা টি-শার্টের ভেতর ঢুকে গেল। ওর বুক মিশে গেল শক্তপোক্ত লোমওয়ালা পুরুষালি বুকের সাথে। শাহবীর ওর ঘাড়ে ঠোঁট চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,
“এটা উঠোন না হয়ে ওই ঘরটা হলে এতোক্ষণে তুমি এমন আবরণে থাকতে না সিলভি। আমার-তোমার সব…”
পুরো কথা শেষ করার আগেই জীম লজ্জায় নত মুখ রেখে ওর মুখ চেপে ধরলো। শাহবীর তখন হালকা হেঁসে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো,

“এই তোমার ওজন আটচল্লিশ কেজি? তারও কম হবে। নাহলে এরকম মিডিয়াম সাইজের একটা টি-শার্টের অর্ধেক জায়গার মধ্যে ঢুকতে পারতে না কোনোভাবেই। জাস্ট ইম্পসিবল। তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছো না? তোমার ওয়েট আরো কম। এই.. পয়তাল্লিশ কেজি হবে!”
জীম মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ, সে মিথ্যা বলিনি। জোছনা রাতে অনেকটা সময় দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো উঠোনের মাঝখানে। জীম আজ একটা নীল রঙের শাড়িতে নিজেকে আবৃত করে আছে। সেটা উপলব্ধি করেই শাহবীর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বলে উঠলো,
“নীল রূপে নীলাঞ্জনা তুমি,
আর সেই রূপেতে মুগ্ধ আমি!”

তাজরীনকে সাইদা আন্টি জীমকে ডেকে আনতে পাঠিয়েছেন। বৌমণিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না তাজরীন। কোথায় যে গেল! তাজরীন এসে দাঁড়িয়েছে কুঠিবাড়ির চারপাশে গোলপাতা দিয়ে ঘেরা সীমানার বাইরের রাস্তায়। এদিকটাতে জীম এসেছে কিনা, তাই দেখতে। অপ্রত্যাশিতভাবে ওর চোখ পরলো অদূরে দু’জন নারী-পুরুষের দিকে। আফিম আর তহুরা না? হ্যাঁ, ওরা-ই তো! তাজরীন ভালোভাবে খেয়াল করে নিশ্চিত হলো। ওকে তখনও দেখেনি ওরা। আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাজরীন এগিয়ে গেল। ওদের কাছাকাছি যেতেই দুজনের কথাবার্তা শুনতে পেল। তহুরা এখানে কখন আসলো! তাজরীন উঠে আসার সময় তহুরাকে ফোন স্ক্রল করতে দেখেছিল। আর এখন ও এখানে। তা-ও আবার আফিমের সাথে। অথচ, রাতের আসরেও তাজরীন দেখেছে, ওদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল৷ তাজরীন আরেকটু এগোতেই তহুরার কথা শুনতে পেল। ও বেশ রিনরিনে কন্ঠে উপহাসের সুরে বলছে,
“এক জীবনে কী আমরা কাঙ্ক্ষিত সবকিছুই পাই? সবকিছু পেয়ে গেলে ‘অপূর্ণতা’ বলে কোনো শব্দ বোধহয় বাংলা অভিধানে থাকতো না। কিছু ব্যাপার থাকুক না অপ্রাপ্তির তালিকায়! কী-ই বা এসে যায়? খুব বেশি হলে প্রথম দু’দিন দুঃখবিলাস, তৃতীয় দিন অভিমান, চতুর্থ দিন মরীচিকা; আর তারপর মরীচিকা ঝড়ে আবার নতুন পথচলা।”
আফিম সম্ভবত এসব কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ওকে পেছন থেকে দেখে তেমনই মনে হচ্ছে তাজরীনের। আফিম তহুরাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

“তুই কি বলছিস তহু! কিছুই বুঝছি না আমি। তোকে এখানে ডেকেছিলাম, তোর প্রবলেম কী;—তা জানার জন্য। কিন্তু তুই যে অপারেশনের মতো এমন থ্রিল টাইপ কথাবার্তা শুরু করে দিবি, তা বুঝতে পারিনি মাইরি!”
“সবকিছুই তোমার কাছে থ্রিল লাগে। সাসপেন্স মনে হয়। থাম্বানেইল অপারেশনের কথা স্মরণ হয়। কিন্তু তুমি আসল জায়গায় এসে হোঁচট খাও।”
“কি যে বলছিস উল্টোপাল্টা! যা, যেখান থেকে এসেছিলি সেখানে যা। গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খা৷ পারলে মাথায়ও ঢাল।”
আফিম আগে হেঁটে যেতে লাগলো। তহুরা পেছনে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলো,
“কী? পালাতে চাইছো?”

“আশ্চর্য! পালাবো কেন? আমি কি চোর-ডাকাত নাকি?”
তহুরা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তাজরীন তখন অদূরে। শুনতে পেল, আফিম তহুরাকে বলছে—
“থাক তুই। দু’টো সিগারেট টেনে আসি৷ গেলাম আমি।”
তহুরা চুপ করে রইলো। আফিম সামনের অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই ও ঠাট্টার সুরে বলে উঠলো,
“মানুষ বাঁচে বিশ্বাসে,
আর বিশ্বাসেরা বাঁচে অভিলাষে।”
তহুরা থামলো। চোখের কোণে বোধহয় অশ্রুকণা জমেছিল। তা সপাটে মুছে নিয়ে আবারও বিরবির করে বললো,
“কিছু বিশ্বাস থাকুক না মিথ্যা আশ্বাস হয়ে; আমরণ, অনন্তর! সৃষ্টিলোকের সৃষ্টিতে স্বেচ্ছাচারী না হয়ে স্রষ্টার সংকেতে সন্ধানী সুহৃদ স্বগতোক্তিতে স্বপ্নচারিতায় সত্য সবম সুন্দরম!”
তাজরীনের খুব কষ্ট হলো৷ বিচ্ছেদের যন্ত্রণা বড্ড কঠিন। তারচেয়েও বেশি কষ্টদায়ক, অপর পাশের ব্যক্তির বুঝেও অবুঝপনা করার ব্যাপারটা। সে নিজে কখনো এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়নি। তবে তহুরার ওই এক ফোঁটা চোখের পানি তাজরীনকে এই কঠিন সত্যি উপলব্ধি করাতে সক্ষম। তাজরীন তহুরাকে ডাকলো না। দু’টো সান্ত্বনাও দিলো না। ওকে কিছুক্ষণের জন্য একা ছেড়ে নিজের পথে পা বাড়ালো।

কুঠিবাড়ির উঠোনে গেল না তাজরীন। ওদিকে উঠোন কাঁপিয়ে গান-বাজনা চলছে। তাজরীন ওই পথে পা না মাড়িয়ে পুকুর পাড়ের গাছপালার মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগলো৷ এতো অন্ধকারেও দ্বিগ-দিশাহীন তাজরীনের আজ ভয় করছে না। হঠাৎ পেছন থেকে ওর হাতে টান পরলো। এবার তাজরীনের হুঁশ ফিরলো। মানুষের দুঃখে বড়োই দুঃখ পায় ও। দুঃখ বড় ছোঁয়াচে রোগ। ঠিক জন্ডিসের মতো। একজনের দুঃখ লাগলে আশেপাশের মানুষের মধ্যে সেই শোক ছড়িয়ে পড়ে৷ আপাতত তাজরীনও শোকে ছিল। কিন্তু এখন এই গভীর রাতে গ্রামের পুকুরপাড়ের গাছপালার মধ্যে তার হাত কেউ টেনে ধরায় সব দুঃখ উবে গেল। মনে ভয়ের সঞ্চার হলো। বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ হতে লাগলো। তাজরীন আল্লাহর নাম স্মরণ করতে করতে ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকালো। লম্বা-চওড়া মানুষটাকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এখানে দেখে প্রথমে চমকে উঠলো তাজরীন। তারপর হতভম্ব হলো। এরপর বিস্ময়ে দুই পা পেছালো। বিস্ফোরিত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো সামনে। ওই চোখে মাদকতা! কবির ভাষায় যাহাকে বলে— “তোমার চোখের মাদকতা, আমার জন্য এক পেয়ালা সুরার এক চুমুক, এক ফোঁটা, এক বিন্দু কিংবা এক কণিকা!”

নাহ, তুমি নয়। সম্বোধনটা আপনি হয়। তাহলেই যথাযথ ভাবনা। কল্পলোকের কল্পনায় কল্পিত কল্প-শ্লোক কল্পনাশ্রয়ী! একদম ঠিকঠাক হতো? নাকি না? কিসব অদ্ভুত-উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা! বাস্তবে ফিরলো তাজরীন। ভ্রম কাটলো ওর।
“তা-জরীন তাসনিইয়া!”
নিজের নামের উপহসিত উচ্চারণে ভ্রু কুঞ্চিত হলো তাজরীনের। সামনের লোকটাকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলো। সেই একইরকম দাম্ভিক ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। গাম্ভীর্য যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে! তাজরীন নিখুঁতভাবে লম্বা হলেও রুবায়েতের বুকের একটু ওপরে পর্যন্ত ওর মাথা পড়ে। রুবায়েত কিছুটা ঝুঁকে তাজরীনকে আলতো স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
“একটা অফার করবো। উড ইউ এগ্রি?”
তাজরীন ঠিক বুঝতে পারেনি রুবায়েতের কথা। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কী?”

“আপনাকে ডেটের অফার করছি। এখনই, এই মাঝ রাতে, এই মুহূর্তে। এক্ষেত্রে আপনার মতামত?
তাজরীন সাধারণত থতমত খায় না৷ বেশি বিস্মিত, হতবাক হওয়া কিংবা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর মেয়ে ও বরাবরই কখনোই নয়। তবে আজ একটু ভিড়মি খেলো। ও সরু চোখে চেয়ে বলে উঠলো,
“জি?”
“আই হ্যাভ সেইড দ্যাট, আপনি কী আমার সাথে ডেটে যাবেন? ওদিকে বিলের কাছাকাছি একটা মাচা আছে। সুন্দর দেখতে। আপনার খিদে পেলে খাওয়ার ব্যবস্থাও হবে। চা-সিগারেট এনিথিং..”
“সিগারেট! আস্তাগফিরুল্লাহ!”
রুবায়েত শেষের কথাটুকু আওড়াতেই তাজরীন অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো কথাটা। রুবায়েত নিজেকে পারলে নিজেই একটা পাঞ্চ মারে জোরেসোরে। কার সাথে কথা বলছে ভুলেই গিয়েছিল। বিরবির করে ‘ওহ শিট’ বলে ওঠে। তাজরীন তখন কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বলে,

“স্যরি। আমি আপনার ডেটের অফার গ্রহণ করতে পারলাম না৷ আমার ফিয়োন্সে জানতে পারলে খুব রাগ করবে।”
রুবায়েতের অন্ধকারে চোখদু’টো দর্পে উঠলো কিনা ঠিক স্পষ্ট নয় তাজরীন। তবে হঠাৎ ওর অস্বস্তি হলো। মনে হলো, রুবায়েত কেমন যেন অদ্ভুত চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তাজরীনকে ভুল প্রমাণ করে রুবায়েত বলে বসে,
“তুমি-আমি প্রেমিক-প্রেমিকা নই ডিয়ার। এতো সেন্টি খাওয়ার কিছু হয়নি। ডেটের অফারটাও ক্রিঞ্জ নয়। সিম্পলি অ্যা ফর্মালিটি। টাইমপাসও বলতে পারো।”
রুবায়েত শেষের কথাটা অবজ্ঞার সাথে বলে পেছনে ঘুরে হাঁটা ধরলো৷ তাজরীন ওখানেই দাঁড়িয়ে পেছন থেকে প্রশ্ন করলো,

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৩

“এরকম টাইমপাস আর ক’জনের সাথে করেছেন?”
রুবায়েত ঘাড় ঘুরিয়ে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে উপহাসের সুরে জবাব দিলো,
“অগণিত! হিসাবের বাইরে!”
তাজরীন থ মে’রে দাঁড়িয়ে রইলো৷ রাগে-দুঃখে, অপমানে কান গরম হয়ে উঠলো ওর। দাম্ভিকতা খুব খারাপ। তাজরীন ওপথে আর গেল না।

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৫