নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৫

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৫
ঝিলিক মল্লিক

তাজরীন উঠোনের মাঝখানে বসে আছে মাটির ওপর। কোনোকিছু-ই বিছানো নেই। ঠান্ডা লাগছে তাজরীনের। মস্তিষ্কে অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই কথাগুলো পেটে চাপিয়ে রাখা দায়। এখন কী করবে সে? কাকে বলবে? বড্ড অসহায় লাগছে। তখনই এমন অসহায় পরিস্থিতি থেকে ওকে উদ্ধার করতে সেখানে তহুরা এলো। তহুরাকে টেনে ধরে নিজের পাশে বসালো তাজরীন। তারপর ওকে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠলো,
“আচ্ছা তহু, একটা কথা বলো তো। তোমরা এখানে আসলেই কি বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে এসেছো? নাকি অন্য কোনো কাজে?”

তাজরীন সচারাচর এধরনের কথাবার্তা বলে না। এমনকি এরকম সিরিয়াস কথা বলার মেয়েও সে নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এহেন প্রশ্নে তহুরা কিঞ্চিৎ হোঁচট খায়। থতমত খেয়ে বলে,
“কী ধরনের কথা বলছো তাজ? কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে তোমার কথার ধরন।”
তাজরীন কঠোর গলায় পাল্টা জবাব দিলো,
“আমি তোমার কাছে একটা প্রশ্নের জবাব চেয়েছি তহুরা। আমার কথার ধরন কেমন, তা সম্পর্কে কোনোরকম এক্সপ্লেশন নয়! কথা ঘোরানো তোমাদের স্বভাব হতে পারে। কিন্তু আমার নয়।”
তহুরা চমকে তাকালো তাজরীনের দিকে। আজ মেয়েটা কেমন আচরণ করছে, তা বুঝে ওঠা দায়। তবে স্বাভাবিক নয়। তহুরা এবার জিজ্ঞাসা করলো,
“তোমার কী হয়েছে তাজ? রাতে খাওয়ার পর থেকেই দেখছি কেমন মনমরা হয়ে আছো। এখন এভাবে কথা বলছো। স্পষ্ট করে বলো তো।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি স্পষ্ট কথা বলতেই পছন্দ করি তহু৷ সেই হিসেবে বলছি, তোমরা যেসব কাজকর্ম করছো না; এগুলো কিন্তু ঠিক না। মানুষের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে খেলা কোরো না। খুব খারাপ এটা। মানুষের আবেগ যে কতোটা মূল্যবান তা তোমরা ডিফেন্সের মানুষেরা বুঝতে পারবে না। আর বুঝতে পারো না বলেই গেইম খেলতে জানো।”
“তুমি কি বলছো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
“তুমি সব বুঝতে পারছো। বরং অবুঝ আমরা। আমার আম্মা, বৌমণি সবাই। সেদিন রাতে যখন ভাইয়ারা নিখোঁজ হলো, তখন তোমরা অতোটা নিশ্চিন্ত ছিলে কীভাবে বলো? সবাই দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারেনি সারারাত। তোমাদের দেখে তো মনে হয়নি, তোমাদের কোনোরকম দুশ্চিন্তা হয়েছিল! তারমানে তোমরা জানতে, ভাইয়ারা কোথায় গিয়েছিল? রাইট?”

তাজরীন বেশ জোরেই কথাগুলো বলছিল। তহুরা আশেপাশে তাকায়। সামনে অদূরে স্টেজের ওপর কতগুলো মানুষজন তাদের কাজে ব্যস্ত। মাহমুদ ভাই আর একজন লোক কিছুটা দূরত্বে চেয়ারে বসে গালগল্প করছিলেন। তহুরা এবার তাজরীনের হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
“চুপ করো তাজ। এতো কথা বলছো কেন? এসব উল্টোপাল্টা কথা তোমার মাথায় আসলো কীভাবে?”
তাজরীন এবার সামান্য হাসে তাচ্ছিল্যভরে। জবাব দেয়,

“একদিনে কথাগুলো আমার মাথায় আসেনি। বোকা থাকতে চেয়েছিলাম। সবাইকে নিয়ে হাসিখুশি কতগুলো দিন কাটাতে চেয়েছিলাম এখানে মেজবান বাড়িতে। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? জানো তহুরা, এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি সুখী হচ্ছে দুই ধরনের মানুষ। এক নাম্বারে থাকে, পাগলেরা; আর দুই নাম্বারে, বোকারা। তবে আমি বোধহয় আর বোকা থাকতে পারছি না। চেষ্টা করেও না৷ বরং, চোখের সামনের সাদা আব্রু উঠে গিয়ে স্পষ্ট সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। এতোদিন যা দেখেছি, দেখছি— সবকিছু মিথ্যা মনে হচ্ছে! সাজানো নাটক! আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, আসলে তা নয়। আমাদের আসলে দেখানো হচ্ছে, বোঝানো হচ্ছে। একটা কথা বলো, এই-যে তোমরা নাটকগুলো করছে না; করো, তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, এগুলো তোমাদের ব্যক্তিগত ইস্যু। আর কারো ব্যক্তিগত ইস্যুতে নাক গলানো আমারও পছন্দ না। কিন্তু এতগুলো মানুষের আবেগ! সব তোমাদের কাছে ফেলনা? শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য? তাছাড়া কাকে কি বলবো! যেখানে আমার নিজের ভাই-ই এসবের মাস্টারমাইন্ড ; সেখানে এতো নীতিকথা শোনাতেও লজ্জা লাগে। অথচ নীতিকথা তো তোমরা মেনে চলো, তাই-না?”
তহুরা এতোক্ষণে বুঝে গেছে, তাজরীন ঠিক কি বলতে বা বোঝাতে চাইছে। তবুও না বোঝার ভান করলো। অবশ্য এমনটা না করে উপায় নেই। নয়তো ধরা পড়ার ভয় থাকে। তহুরা তাজরীনকে চুপ করাতে বললো,

“তাজ আমার একটা কথা শো..”
“না! কোনো কথা আমাকে শোনাতে হবে না তহু। আমার, আমাদের বিশ্বাস ভেঙেছো তোমরা সবাই। আর বিশ্বাসঘাতকার যন্ত্রণা আমার থেকে ভালো কেউ বুঝবেনা।”
শেষের কথাটা অন্যমনস্ক হয়ে বলে তাজরীন। পরপরই নড়েচড়ে বসে গলার স্বর কিছুটা নিচু করে বললো,
“আজ কিছুক্ষণ আগে বাগানের ওদিকটায় কি হচ্ছিল, তা নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে? এটা অন্তত অস্বীকার কোরো না। আমাকে সেখান থেকে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। রুবায়েত নিজে এই কাজটা করতে চেয়েছিলেন। যেই মানুষটা বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের, কারো সাথে ঠিকমতো কথাও বলেন না; সেই মানুষটা ঠিক কোন ফ্যান্টাসিতে আমাকে ডেটের অফার করে; তা বুঝতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয়নি তহু। এতোটা অন্ধ নই আমি। বরং, স্বেচ্ছায় তার ছলনায় সায় দিয়ে সেখান থেকে সরে এসেছি। যতদূর জানি, তুমিও তাদের সাথে সম্মিলিত। যাইহোক, আমার-ই ভুল। অনাধিকার চর্চা করছি। শুধু এতোটুকু অনুরোধ করবো, আগামীকাল খালামণি মেয়েদের জন্য আলাদাভাবে মেহেন্দি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। দয়া করে আগামীকালের জন্য তোমাদের মঞ্চনাট্য-কার্যক্রম বন্ধ রেখো৷ আশা করছি, এই বিশাল আয়োজন, আনন্দ-আড্ডার মাঝে কোনো ঝামেলা হবে না।”

তাজরীন উঠে হাঁটা দেবে, তখনই তহুরা ওর হাত টেনে ধরলো পেছন থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“তোমাকে আজ অনেকটা অন্যরকম লাগছে তাজ। আগের তুমির সাথে এই মুহূর্তের তুমির কোনো মিল পাচ্ছি না আমি। কিছু কী হয়েছে তোমার? কেউ কিছু বলেছে?”
“নাহ। কে কী বলবে? আমাকে কেউ আঘাত করতেই পারে না। কারণ সবাই জানে, আমি কষ্ট পাই না কখনো। আর, অনুভূতিহীনদের কেউ আঘাত করতে পছন্দ করে না।”
তহুরা এবার সন্দিগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করে বসলো,
“তোমার বিয়ে ঠিক হওয়ার ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত শোনালো। তোমার আচরণে এই কয়দিনে একবারও মনে হয়নি, তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

তাজরীনের বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো। শেষবার এমন কবে হয়েছিল, তা ও কখনোই মনে করতে চায় না। প্রদীপশিখা জ্বলতে জ্বলতে যেমন হুট করে দর্পে ওঠে, তেমনভাবেই ওর হৃৎস্পন্দনেরও একই হাল হচ্ছে এই মুহূর্তে। তহুরার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো ও। পিছনে ঘুরে তাকালো তহুরার পানে। কিছুক্ষণ একটানা নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে থেকে সামান্য হাসলো। হাসিটা হয়তো জোরপূর্বক। আন্দাজ করা যায়। তাজরীনের হাসি সদা প্রফুল্ল। এমন নয়। জোরপূর্বক হাসিতে বোধহয় প্রফুল্লতা থাকে না, উজ্জ্বলতা থাকে না, আশেপাশে মুগ্ধতাও ছড়ায় না। হঠাৎ করেই তাজরীনের মুখ মলিন হয়ে উঠলো। বিষন্ন কন্ঠে আকুলতা সম্ভাব্যে ও জিজ্ঞাসা করলো তহুরাকে,
“কেন? আমার বিয়ে ঠিক হতে পারে না? আমিও একদিন লাল বেনারসি গায়ে জড়িয়ে, নাকে নথ, কপালে চন্দন, মাথায় টায়রা আর হাতে বালা পড়ে বউ সাজতে পারি না? আমার জন্য সানাই বাজতে পারে না? সবাই এমন কেন ভাবে? কেন বলো তো? অন্ধকার কাটতে চায় না কেন? আলোকশিখার আগমন কী কখনো হবে না এই সমাজে? হোক, আমি চাই হোক!”
তাজরীন আর এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ালো না। পেছনে একরাশ বিস্ময়, কৌতুহল আর প্রহেলিকা ফেলে রেখে ছুটো চলে গেল দুয়ারে। ওপাশে গানবাজনা চলছে। বিয়ের সানাই বাজছে। আজ বাদে কাল, তারপর পরশু;— তরশু যেয়েই বিয়ে। এই বিয়ের সানাই চলমান থাকবে টানা সপ্তাহখানেক। এই সানাই যে একজন মানুষের জীবনে সৌভাগ্য করে একবার-ই আসে!

পাহাড়াঞ্চলটির নাম “সাধুর পাহাড়।” এই উপজেলায় বেশ কয়েকটি পাহাড় রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ‘সাধুর পাহাড়’। এই পাহাড়টি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিপ্লবীরা এখানে আত্মগোপন করতেন নিজেদের রক্ষা করার জন্য।
এই পাহাড়ের চূড়া এখন ঢেকে আছে কালো ত্রিপলে। অনেকে সেই হিসেবেই জানে। তাই কখনো কারো যাতায়াত হয় না এখানে। কেউ পা-ও মাড়ায় না। পাহাড়ের শেষ মাথায় পুরোনো ধাঁচের একটা কাঠের ঘর। চারপাশে ঝোঁপঝাড়, পাহাড়ের আঁকাবাকা বিপজ্জনক ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া সরু পথটা এখানে এসে থেমে গেছে। রাতের অন্ধকারে ছায়ার মতো ছয়জন মানুষের অবয়ব ঘিরে আছে একটা ছেঁড়া মানচিত্র। কতগুলো কালো ছায়া। সামনে জ্বলছে একটা কুপি। ছয়জনের মধ্যে একজন বলে উঠলো,

“পথ তিনটা, কিন্তু মাত্র একটা নিরাপদ রাখাল।”
কথা শুনে নেতাগোছের লোকটা আরেকবার মানচিত্র ভালোভাবে দেখতে দেখতে জবাব দিলো,
“দরকার শেষ হলে প্রমাণ থাকবে না, ঠিক আছে?”
“প্রমাণ কখনোই ছিল না। কিন্তু আমাদের তো কাজ চালিয়ে যেতে হবে। থেমে থাকলে হবে না। তাহলে তো অস্তিত্ব রক্ষা করা যাবে না।”
সিগারেটের ধোঁয়া মিলিয়ে যায় শূন্যে, মিশে যায় কুয়াশার মাঝে। একটা পুরনো নোটবুক খুলে ফেলল একজন। লাল কালির দাগ টেনে একটা নামের ওপর ঘুরছে তার আঙুল।
হঠাৎ দূরে পাহাড়ের ওপার থেকে একটা মৃদু আলো জ্বলে উঠল, সাথে সাথে আলো নিভেও গেল। চিন্ময় সাহা আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলো,

“কেউ কী এসেছে এখানে? ওদের মধ্যে কেউ?!”
নেতা লোকটা জবাব দিলো,
“ওদের কেউ নয়। এখানে আসার সুযোগ-ই হবে না ওদের। সীমারেখায় পা রাখলে দেশি মাল দিয়ে উড়িয়ে দেবো। নয়তো কো-ও-প! এই সাম্রাজ্য ধ্বংস করা এতো সস্তা নাকি?”
লোকটার কন্ঠে ক্ষোভ। যেন আগুন ঝড়ে পরছে ওই কন্ঠে! সকলের গা ছমছম করে উঠে। কেউ কোনো কথা বলতে চায় না আর। তবে পূর্বের মতোই চিন্ময় সাহা সাহসের সাথে জিজ্ঞাসা করে বসে,

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৪

“ওরা জানে না আমরা আছি এখানে? নাকি ওরাও সময়ের অপেক্ষায়?”
নিঃশব্দে চারপাশের ঘুটঘুটে অন্ধকার গিলে নিচ্ছিল কথাগুলো। ঘরের ভেতর বাতিটা দপ করে জ্বলে উঠল, সাথে সাথে আবার নিভে গেল। শীত বাড়তে লাগলো হুহু করে। সাথে বাতাসে বারুদের গন্ধ আর ওদের ফিসফিসানিও।

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৬