নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৬
ঝিলিক মল্লিক
সকাল সকাল প্যান্ডেলের মধ্যে ঝগড়া বেঁধেছে। চিল্লাপাল্লা সর্বত্র শোনা যাচ্ছে। অনেক রাত করে ঘুমানোর ফলে, তারওপর আবার শীতের সকাল; কুঠিবাড়ির কাঠের দোতলার কারোই ঘুম ভাঙতে চাইছে না এতো সহজে। জীম গতরাতে রুস্তমের সাথেই এখানে এসেছে। ঘুম কাঁচা। এতো সহজে ভাঙবে বলে মনে হয় না। পাশ থেকে শাহবীরের কন্ঠ শুনতে পেল ঘুমের ঘোরে। ওর নাম ধরে ডাকছে। হাতের বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে জীমকে। জীম এবার শাহবীরের হাত টেনে কোলের মধ্যে চেপে ধরে ঘুমের ঘোরেই বলে উঠলো,
“ঘুমাতে দে শালা। এমনিতেও কাল রাতে শালার ব্যাটার জন্য আমাদের পার্টি বানচাল হলো। আন্টি খিচুড়ি রান্না করছিলেন। খুব টেশও হইতো। কিন্তু সব তোর জন্য..”
জীম তাচ্ছিল্যের স্বরে এলোমেলো বাক্যে কথাগুলো বলছিল। মাঝে মাঝে থেমেও যাচ্ছিল। শাহবীর তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছে। বাইরে যাওয়ার জন্য জীমকে ডাকছিল। জীমের এমন অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে সন্দেহ জাগলো তার মনে৷ ভালোভাবে শুনতে জীমের মুখের কাছে কান এগিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কোন পার্টির কথা বলছো সিলভি?”
জীম শাহবীরের হাতটা আরো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে জবাব দিলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আরে ওইযে আমাদের মেয়েদের পার্টি ছিল না? বাগানের ওদিকটায়? গানবাজনা, এক ডেক খিচুড়ি, তারপর নাচানাচি..”
শাহবীর এবার ঘটনা কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। জীমের গালে হাত রাখে আদুরে ভঙ্গিতে। তারপর ভ্রু কুঁচকে কিছুটা রূঢ় স্বরে প্রশ্নে করে,
“তো তুমি কার অনুমতি নিয়ে ওই রাতে পার্টি করতে গিয়েছিলে?”
“কারো অনুমতি না তো। কার অনুমতি নিতে হবে মহাশয়?”
“আমার অনুমতি নিতে হবে। জানো না তুমি? বলে বোঝাতে হবে? সাহস আর পা, দু’টোই বেশ লম্বা হয়ে গেছে তোমার। আমাকে না বলে আজকাল যা খুশি করে বেড়াচ্ছো। যেখানে খুশি অবাধে ঘোরাফেরা করছো। আবার আমার সামনে মিথ্যা বলতেও তোমার মুখে বাঁধছে না। পেয়েছোটা কী হ্যাঁ? অনুমতি নিয়েছো আমার? বলো!”
শেষের কথাটা ধমকের সুরে বেশ জোরেই বলে ওঠে শাহবীর। জীম তখনও আধঘুমে। হালকা কেঁপে ওঠে ও। চোখের পাতা জোরপূর্বক খুলতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। ঘুমে চোখ লেগে আসছে। তবু জড়ানো কন্ঠে আঙুল উঠিয়ে শাহবীর থুতনিতে চেপে ধরে জীম বলে ওঠে,
“কার বাপের অনুমতি নিতে হবে রে? নিজে বারো ঘাটে ঘুরে আসলে কিছু না। আর আমি একটু পার্টি করলেই দোষ? শালার ব্যাটামানুষ! সব খারাপ। সব!”
শাহবীর জীমের আঙুল চেপে ধরে রুক্ষ স্বরে বলে,
“সব ব্যাটামানুষ খারাপ হলে তোর বাপও খারাপ।”
“আমার বাপ খারাপ না।”
জীম প্রতিবাদ করে ওঠে। শাহবীরও পাল্টা বলে,
“তোমার বাপ কী ব্যাটামানুষের বাইরে? নাকি মঙ্গলগ্রহের এলিয়েন?”
“এই ব্যাটা, খবরদার! আমার বাপ তুলে একটা কথাও বলবে না। তুমি নারীবিদ্বেষী।”
জীমের মুখে তুই-তোকারি, তুমি-আপনিসহ সব চলে। ও পারলে নতুন নতুন সম্বোধন আবিষ্কার করে। যেমনভাবে ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন, ভ্রমণের মাধ্যমে আমেরিকা সম্পর্কে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন; সেভাবেই জীম পারলে তার নতুন নতুন সম্বোধনের জন্য পদক দাবি করে বসতে পারে। শাহবীর এবার জীমের নাক টেনে ধরে জবাব দেয়,
“আর তুমি হলে বিশিষ্ট নারীবাদী।”
জীম শাহবীরেরের কাছ থেকে দূরে সরে আঙুল দেখিয়ে তারস্বরে বলে ওঠে,
“তো, নারীবাদীর কাছ থেকে দূরে থাকো নারীবিদ্বেষী পুরুষ।”
শাহবীর উঠে গেল। এই পাগলের সাথে বকবক করে এনার্জি নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তারচেয়ে বরং নিচে যাওয়া যাক। আজ নাকি গোরু জবাই করা হবে। সেখানে শাহবীর আর রুবায়েতও যোগদান করবে সাহায্য করার জন্য। আরো অনেক কাজ আছে। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা যাবে না। শাহবীর উঠে বিছানার সামনে দাঁড়াতেই জীম ঘুমেে মধ্যেই হাতড়ে হাতড়ে হাত টেনে ধরলো শক্ত করে। শাহবীর তখন শীতে বেগতিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজের জ্যাকেটটা খুঁজছে। এক হাতে পেস্ট আর ব্রাশ। জীম এবার আধো আধো চোখ খুলে খ্যাক খ্যাক করে বললো,
“আমার কথা না শুনে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? এখন আর আমার সাথে ঝগড়া করতে ভালো লাগে না, তাইনা? অন্য মেয়েকে দেখেছো? তার কাছে যাচ্ছো?”
শাহবীর দ্রুত জীমের হাত সরিয়ে নিয়ে ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায়। সন্দেহজনক পরিস্থিতি। সরু চোখে তাকিয়ে ও আস্তে করে প্রশ্ন করে জীমকে,
“সিলভি, কাল রাতে কী তুমি কিছু খেয়েছো? উল্টাপাল্টা কিছু? যদিও আমি জানি, এখানে সেরকম বিপজ্জনক ব্যাপার ঘটার কথা নয়। তবু মনে হচ্ছে, তুমি কিছু খেয়েছো!”
“কী খাবো আমি? শুধু তো তোমাকে দু’টো চুমু খেয়েছি। কিন্তু ওগুলো তো উল্টাপাল্টা কিছু নয়। সঠিক জিনিস, না?”
“সরো তো! তোমার সাথে কথা বলা-ই বেকার। ধ্যাত!”
শাহবীর বিরক্ত হয়ে গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে বেরিয়ে গেল তাদের ঘর থেকে। জীম তখন আরামে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে রইলো। আরো কিছুক্ষণ শোবে ও। সবে আটটা। সময়কালটা দশটা নাগাদও হতে পারে।
কুট্টুস উঠোনের মাঝ বরাবর হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে। ওর মা পাশে কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে বিরক্তি সহকারে। তাজরীন মাত্র বড় ভবন থেকে আসছে। গিয়েছিল বিয়ের কনের সাথে দেখা করতে। খালাতো বোন তাহরিমার সাথে এককালে বেশ ভাব ছিল তাজরীনের। যখনই দেখা-সাক্ষাৎ হতো, দু’জন দু’জনের সাথে আঠার মতো লেগে থাকতো। তবে বড় হওয়ার সাথে সাথে দূরত্বও বাড়তে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দু’জনে অ্যাড থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনের ব্যস্ততার কারণে আর আগের মতো কথা বলা হয়ে ওঠে না। তবে যখনই দু’জনের দেখা হয়, তখন পুরোনো দিনগুলোর মতোই আড্ডায় মেতে ওঠে তারা। তাহরিমার সাথে ওর বিয়ের বিষয়ে গল্প করেই মাত্র এদিকটায় আসা তাজরীনের। মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল ওর। দূর থেকে ওকে এগিয়ে আসতে দেখেই কুট্টুস আরো বেশি হাত-পা ছড়িয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে ব্যস্ত হলো। গোলগাল বাচ্চাটার সিল্কি সোনালি চুলগুলোতে উঠোনের ধুলাবালি লেগে গেছে। পরনের সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিতে মাটি লেগে আছে। হাফপ্যান্টেরও একই অবস্থা। হাতের রূপোর ব্রেসলেটটা কাঁদায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাজরীন কুট্টুসকে খেয়াল করে দ্রুত এগিয়ে গেল সেদিকে। কুট্টুসের সামনে বসে ওর গোলগাল হাতদুটো ধরলো। কুট্টুস তখন ওর দিকে তাকিয়েই অতি আবেগে কাঁদছে। কুট্টুসের মায়ের দিকে তাকাতেই শায়লা রহমান বললো,
“তুমি আর ওকে আহ্লাদ দিও না তো তাজরীন। বেশি আহ্লাদ পেয়ে আজ এই অবস্থা। বাপের মতো হয়েছে। থাকুক এখানে, মাটিতে গড়াগড়ি খাক। কেউ ধরবে না ওকে। সারাক্ষণ ওর আহ্লাদ পূরণ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।”
শায়লা বেশ ক্ষেপে আছে বোঝা যাচ্ছে। তাজরীন জিজ্ঞাসা করলো,
“কী হয়েছে ওর?”
“কী আর হবে বলো! তার নাকি এখন স্পাইডার ম্যান লাগবে। এখন এই পাড়াগাঁয়ে ওকে স্পাইডার ম্যান কে কোথা থেকে এনে দেবে? ওর বাবা বাইক নিয়ে বেরিয়েছে কয়েকজনের সাথে গ্রাম ঘুরতে। সেই লোক থাকলে তো তার প্রোডাক্ট তার ঘাড়েই ঝুলিয়ে দেওয়া যেতো। কিন্তু তিনি তো পালাতে পারলেই বাঁচেন! যত জ্বালা সব আমার!”
“আমি ওকে নিয়ে যাই হাঁটে? ওখানে স্পাইডার ম্যান পেলে নিয়ে দেবো।”
“না না! অমন কাজ ভুলেও করতে যেও না। স্পাইডার ম্যান না পেলে তখন আরেক ঝামেলা। তাছাড়াও, অনেক আহ্লাদ দেওয়া হয়েছে ওকে। আর নয়!”
তাজরীন আর কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। তখনই পেছন থেকে একটা রাশভারী কন্ঠস্বর শোনা গেল—
“তাজ, কুট্টুসকে ক্লিন করিয়ে দিন৷ ওকে নিয়ে বের হবো।”
তাজরীন পেছনে ঘুরে তাকালো। রুবায়েত দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত রেখে। একইরকম ভাবভঙ্গিমা। তবে আজ চুলগুলো এলোমেলো। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, মাত্র কিছুক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। শায়লা রুবায়েতকে থামাতে চাইলো। কিন্তু লোকটার মুখের হাবভাব দেখে একটা শব্দও বলতে পারলো না। তাজরীন কুট্টুসকে কোলে তুলে নিয়ে গেল পুকুরঘাটে। হাত-মুখ ধুইয়ে দিতেই রুবায়েত এসে কুট্টুসকে নিয়ে গেল। কুট্টুস জোর করছিল তাজরীনকেও সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাজরীন কোনোভাবেই গেল না ওদের সাথে। কুট্টুস যেতে যেতে পেছন থেকে তাজরীনকে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে মারলো। তাজরীন হাত বাড়িয়ে সেটা ক্যাচ করে নিলো। রুবায়েত বুঝতে পারে কুট্টুসকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কী করছো তুমি?”
“আমি তু তাজ বাবুকে তুম্মা দিততি।”
“তুম্মা?”
“ইয়েছ।”
“সবাইকে কিসি দিতে হয় না কু্ট্টুস সোনা। তোমার তাজ বাবু খুব পঁচা। সে এসব ডিজার্ভ করে না।”
কথাটা শোনামাত্র-ই রুবায়েতের চুল টেনে ধরলো কু্ট্টুস। ঘাড়ে, গলায় খামচি দিতে দিতে বললো,
“না! আমাল তাজ বাবু পতা না। তুমি পতা কুতা বুলো কিনু? তুমি পতা৷ তাজ বাবু ভাণো।”
“একবার বললে বোঝো না? বললাম, ওই মেয়েটা ভালো না। তারপরও তর্ক করছো!”
“রুবাই আঙ্কেল তুমি কুউব খালাব। আমি তুমার তাতে তাবো না। চাড়ো আমালে৷ তাজ বাবুর কাতে তাবো।”
কু্ট্টুস জোর করে কোল থেকে নামতে চাইলো। রুবায়েত ওকে নামতে দিলো না। জোর করে কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটের দিকে হাঁটা ধরে বললো,
“পাগল-ছাগল মেয়েমানুষের নাম বারবার মুখে নিও না কুট্টুস। মেজাজ খারাপ হয়। চুপচাপ চলো আমার সাথে।”
রুবায়েত ওকে জোর করেই নিয়ে যেতে লাগলো নিজের সাথে। কুট্টুস তখন মাম্মা, তাজ বাবু বলে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগলো আকাশ-বাতাস এক করে। ততোক্ষণে কুঠিবাড়ি ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছে ওরা। কুট্টুসের কান্নাকাটি কারো কানে গেল না। কুট্টুস রুবায়েতের চুল টেনে ধরে রেখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৫
“তাজ বাবু তিকই বুলে। রুবাই আঙ্কেল তুমি চেলেধরা।”
আবার তাজ! সব জায়গায় এই এক নাম! রুবায়েতের মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হচ্ছে। তবু বাচ্চা মানুষ ভেবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ও। ওই মেয়েটা এই ছোট বাচ্চাটারও মাথা খেয়েছে। বশীভূত করে নিয়েছে!