নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৭

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৭
ঝিলিক মল্লিক

মেহেন্দি অনুষ্ঠানটা সাধারণত বাঙালি বিয়ের উৎসবে হয় না। শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য-ই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে আজ কুঠিবাড়িতে। তা-ও প্যান্ডেলের এদিকটায় মেয়েরা ব্যতীত অন্য কারো আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মুরব্বিরা। কাল গায়ে হলুদ। পরশু বিয়ে। তাই প্যান্ডেল আগেই পুরোপুরি সাজানো হয়ে গেছে৷
সন্ধ্যা গড়িয়েছে তখন। প্যান্ডেলে লাল-নীল-হলুদ সাজকবাতি জ্বলছে। তাজরীন বসে হাতে মেহেদী দিচ্ছিল। বাকিরাও মেহেদী লাগাচ্ছে নিজেদের হাতে। তাজরীনের মেহেদী দেওয়া প্রায় শেষের দিকে। কুট্টুস এসেছিল কয়েকবার। ওর খোঁপা করা চুল খুলে দিয়ে গেছে। এলোমেলো চুলগুলো নিয়ে তাজরীন পরেছে মহাবিপাকে। মুখের সামনে এসে বা’রি খাচ্ছে বারবার। মৃদুমন্দ হাওয়ার তালে তালে উড়ে বেড়াচ্ছে কিশোরী কন্যার ন্যায়।

জটিল সমস্যা। অতি দ্রুত এর সমাধান করা দরকার। এই জ্বালিয়ে মারতে চাওয়া রশিগুলোকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। তবে আশেপাশে সমস্যা সমাধানের কোনো জো-হুকুম ব্যক্তিকে পাওয়া গেল না। মেয়েরা তো সবাই মেহেদী দিতে ব্যস্ত। তাদের এখন কিছু বললে বরং ক্ষেপে যাবে। আপাতত এই শান্ত পরিবেশকে উত্তপ্ত করতে চাইছে না তাজরীন। প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে আসলো ও। আজ সব ভিড়-সমাগম এবং বিয়ে বাড়ির লোকজন সব এদিকটাতেই উপস্থিত। প্যান্ডেলের বাইরের উঠোনটায় চেয়ার নিয়ে বসে আছে সবাই। বড়ভাইকে সবার মাঝখানে দেখতে পেল তাজরীন। কি যেন বলাবলি করছে হাসাহাসি করে। বাকিদের মধ্যে আর কাউকে দেখা গেল না সেখানে। তাজরীন ভাবলো, ভাইকে বলবে চুলগুলো বেঁধে দিতে। সেই অনুযায়ী মেহেদী লাগানো হাতদুটো অতি সন্তপর্ণে ওপরের দিকে উঁচু করে রেখে সচেতন পদক্ষেপে সামনের দিকে এগোতে লাগলো ও। হলুদ আলোকরশ্মি চোখের ওপর পরতেই তা এড়াতে চোখের সামনে হাতটা টেনে আনলো তাজরীন। আলো আড়াল করার চেষ্টা করে পুনরায় সামনের দিকে দুই কদম এগিয়ে চোখের সামনে হতে হাতটা সরিয়ে নিতেই দেখলো, ওর ভাই উঁধাও! কিছুক্ষণ আগেই না এখানে ছিল?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাত্র সেকেন্ড পঞ্চাশেকের ব্যবধান। এরমধ্যে জলজ্যান্ত একজন মানুষ হ্যালির ধুমকেতুর মতো কীভাবে স্থান পরিবর্তন করে ফেললো? তাজরীনের খটকা লাগলো। এসব ওর ভাইয়ের দ্বারা অসম্ভব নয়। কিন্তু কোথায় গেল?
তাজরীন দ্রত প্রস্থান করলো সেখান থেকে। কয়েক জায়গায় খুঁজলো। কোথাও বড়ভাইয়ের দেখা পেল না। সবাই ওকে ডেকে কথা বলে সময় নষ্ট করালো কিছুক্ষণ। এখন ও এসেছে কাঠের বাড়ির পেছনের ভিটায়৷ লম্বা কতগুলো সুপারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। সুপারি গাছগুলো ছাড়িয়ে গেলেই ওদিকটা পুরো অন্ধকার। ওই অন্ধকার পথ, বাগান আর কয়েকটা ক্ষেত পেরোলে তারপর প্রতিবেশীর বাড়ি৷ কিন্তু এদিকটাতে কেন আসবে ওর ভাই?

আসার তো কথা নয়। এদিকে কী কাজ তার? প্রশ্নগুলো মনে আসলো তাজরীনের। সেইসাথে ভালোভাবে সুক্ষ্ম নজরে খেয়াল করে দেখলো, সামনে সবকিছুই অন্ধকার। এখানে একটা জনমানব অবধি নেই। সবাই বিয়েবাড়ির মূল আয়োজনে ব্যস্ত। তুমুল গান-বাজনা হচ্ছে ওদিকে। ভুলে ব্যক্তিগত সেলফোনটাও আনেনি তাজরীন। বৌমণির কাছে রেখে এসেছে। এতোটা বেখেয়াল যে কেন হলো! প্রস্থে কয়েক সেন্টিমিটারের সুপারি গাছটার সাথে নিজের মাথা ঠুকতে ইচ্ছা হলো ওর। কিন্তু আপাতত কালক্ষেপণ করা যাবে না। বড়ভাইয়ের সাথে এমনিতেও জরুরি কথা আছে তাজরীনের। আর এটাই সঠিক সময়। এখন ভাইকে অবসর পাওয়া যেতে পারে। শৈশব হতেই অজানা-অজ্ঞাত এক কারণে অকল্পিত, অদৃশ্য ভূতের ভয়ে রাত-বিরেতে সর্বদা কাবু হয়ে থাকা তাজরীন আজ বেশ মাপমাফিক সাহস সঞ্চার করে সামনের পথে মন্থর গতিতে হেঁটে চললো। মনে মনে নিজেকে কঠোর অনুপ্রেরণা দিতে লাগলো।

“তাজ তুই পারবি। আত্মবিশ্বাসী নারী তুই। ভার্সিটির সিনিয়রদের র‍্যাগ দেওয়ার মতো অতি দুঃসাহসিক কাজে সফলতার মুখ দেখতে পারলে এসব তোর কাছে তো মামুলি ব্যাপার। তুই একটা সুইট লেডিকেনি। আপেক্ষিক বিস্তর ভাষায় তোকে বলা যেতে পারে, লেডি শার্লোট ক্যানিং। তোকে দেখে ভূতেরও ডায়াবেটিস হয়ে যাবে। নিছক হিম্মত নিয়ে এগিয়ে যেতে থাক। খুঁজিয়া দেখিলে ভূতেও রত্ন মিলিবে। ভূত বলে কী মানুষ নহে? ওরা-ও তো এককালে মনুষ্যকূলে ছিল। অবশ্যই ওদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বলিয়া সামান্য মাত্র অবশিষ্ট থাকিবে। সুতরাং, নো ভয়ডর।”
তাজরীন একা একাই নিজমনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যেতে থাকলো। এটাই ওর আত্মবিশ্বাস। এভাবেই নিজেকে ভরসা দেয় ও। পেছনে গান-বাজনার সুর, ছন্দ, তাল সব ফেলে আসছে তাজরীন। কি-সব ডিজে গান চলছে ওদিকে। ক’টা দিন ধরে এসব শুনে শুনে কানের অবস্থা আপাতত বেগতিক। অত্যাধিক শব্দ তরঙ্গের কারণে মধ্যকর্ণ কেঁপে উঠছে বারবার।

তাজরীন গজরাতে গজরাতে অন্ধকার ঠেলে কোনোরকমে হোঁচট খেয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো। হঠাৎ অন্ধকারে সামনে অদৃশ্য কোনোকিছুর সাথে বারি খেল। ব্যাপারটা প্রাথমিক মুহূর্তে বুঝে ওঠা অস্বাভাবিক। কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সে সংকেত পৌছাঁতেই জ্ঞানীয় কার্যকলাপ তীব্র গতিতে সচল হয়ে উঠতেই হৃদস্পন্দন ১০০ বিপিএমের উর্ধ্বে চলে গেল। তাজরীন হার্টের কাছটায় যেখানে বিট হচ্ছিল, সেখানে কোনোমতে মেহেদী লাগানো হাত ঠেকিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে। আঁধারে অস্তিত্বের অনুসন্ধান চালালো। দু’হাত পরিপূর্ণ করে কিছুক্ষণ আগে লাগানো কাঁচা অর্গানিক মেহেদীর স্থায়িত্ব থাকলো কি না থাকলো— এই চিন্তা ওকে মোটেও প্রভাবিত করলো না। বরং মনন-মস্তিষ্কে সেসব তথ্য প্রবেশ করলো কখন? প্রবেশপথ তো কখন অন্য দ্বারে তালা দিয়েছে। অজ্ঞাত, পরিচয়হীন ভয়, সংকোচ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে ফেলছিল। এতোটা ভয় জীবদ্দশায় কখনো পায়নি তাজরীন। ভয়টা ওর শুরু হয়েছে মাত্র। যখন থেকে ওর মস্তিষ্ক একটা বিষয় বিশ্লেষণ করে ফেলেছে মুহূর্তের মধ্যে যে, এখানে এই নির্জনতার মাঝে আঁধার আবর্তনে ও একা একজন মেয়ে। আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। কারো আশা করা যায় না। বড়ভাইয়ের উপস্থিতি কয়েক’শ মিটার দূর থেকেও খুব সহজেই টের পেয়ে যায় তাজরীন। কিন্তু এখানেও বড়ভাই নেই। তাহলে কে? কে ওখানে?

পেছানোর সুযোগ নেই। তাজরীন পারছে না পিছু হটতে। শরীর অবশ হয়ে আসছে। ভাবলো, জ্ঞান হারানোর নাটক করবে। তারপর কেউ মারলো, কাটলো কিংবা ভয় দেখালো— তাজরীন তা দেখতে পারবে না। কারণ, ওর চোখ বন্ধ থাকবে।
তাজরীন কান্ডটা করতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে শ্যামলা গড়নের একটা পুরুষালি হাত ওকে আবছা অন্ধকার থেকে সম্পূর্ণ নিকষ কালো অন্ধকারের গহ্বরে টেনে নিলো। তাজরীনকে চেঁচানোর সুযোগ পর্যন্ত দিলো না। একটানে তাজরীন যে কোথায় এসে পরলো, তা বুঝতে ওর মুহূর্ত কয়েক সময় লাগলো।
এটা বাগানের দক্ষিণ পাশের পাঁচিলের দিকটা! এখানে কেন আনা হয়েছে ওকে? কে এনেছে? দেখা দরকার। সময় গড়ানোর সাথে সাথে ভয় এবং কৌতূহল — দু’টোই সমানতালে প্রতিযোগিতা করে বেড়ে চলেছে।
সামনের ব্যক্তি কে তা বোঝার হিম্মত জোগাড় করে খড়খড়ে শুকিয়ে যাওয়া মেহেদী লাগানো হাতটাই সামনের দিকে তুলে ধরে লোকটার সম্ভবত টি-শার্টের কলারের দিকটায়, তারপর সম্পূর্ণ মুখ-কান গলা হাতড়ে তাজরীন আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,

“কে আপনি?”
“আমি।”
প্রশ্নের জবাবে গম্ভীর, রাশভারী কন্ঠস্বর শোনামাত্র তাজরীন পারলে ছিটকে কয়েক’শ মিটার দূরে সরে যেতো। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না। রুবায়েতের এক হাতের মুঠোর মধ্যে তাজরীনের ডান হাতের চিকন বাহু। তাজরীনের শরীরের একাংশ একপ্রকার জোরপূর্বক টেনে ধরে নিজের বাহুর সাথে মিশিয়ে রেখেছে রুবায়েত। তাজরীন নড়াচড়া করে সরতে চেষ্টা করলো। আঁধার হতে আবারও অনাকাঙ্ক্ষিত লোকটা বলে উঠলো,
“সাপের মতো মোচড়ামুচড়ি করবেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। এমনিতেও আরেকটু হলেই ব্ল্যান্ডার করে ফেলছিলেন।”
তাজরীন আঁধারেই মুখ তুলে সামনের লোকটার মুখের দিকে নিশানা করে তাকিয়ে থেকে ভ্রু কুঁচকে রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করলো,
“কি ব্ল্যান্ডার?”

“অনএক্সপেক্টেডলি এখানে তো এসেছেন-ই, আবার লেজুড়ের মতো কতগুলো কুকুর সাথে করে নিয়ে এসেছেন। ওরা এখানকার স্থানীয় কুকুর। ফরচুনেটলি, আমাদেরকে দেখতে পায়নি ঠিকমতো। কিছু বুঝে উঠে ওদের নিজস্ব ভাষায় ডাকাডাকি করার আগেই আপনাকে নিয়ে ওখান থেকে সরে আসতে হলো। নাহলে..”
“নাহলে কী?”
তাজরীন রুবায়েতের মুখ থেকে শব্দটা কেড়ে নিয়ে আরেকটা শব্দ এবং প্রশ্নবাচক চিহ্ন জুড়ে দিয়ে প্রশ্নটা করলো। রুবায়েত হঠাৎ চুপ হয়ে গেল৷ কোনো জবাব দিলো না উক্ত প্রশ্নের। অন্যরকম সুরে বললো,
“একা একজন মেয়েমানুষ হঠাৎ এতো রাতে কী কাজে এসেছেন এদিকে?”
“ভাইয়াকে খুঁজতে। দেখেছেন আমার ভাইয়াকে?”
“না, দেখিনি। এদিকে নেই শাহবীর। এবার আপনি আসতে পারেন।”

“আসতে পারেন মানে?”
“মানে এখান থেকে যান। এখানে আপনার কোনো কাজ নেই।”
“আমার কোনো কাজ নেই বুঝলাম, আপনার কী কাজ? অজ্ঞাত, অপরিচিত; মাত্র তিনদিন হলো এখানে এসেছেন। তাহলে কী এমন জরুরি দরকার পরলো আপনার? যে এখানেই আসতে হলো! এমনিতেও আপনাকে বিকাল থেকে দেখিনি।”
“এতো কৈফিয়ত তো আমি আপনাকে দেবো না তাজ।জাস্ট গো অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার। এক কথা দ্বিতীয়বার বলতে পছন্দ করি না।”
“কিন্তু আপনি তো এইমাত্র দ্বিতীয়বার আমাকে চলে যেতে বললেন।”

তাজরীনের কি হয়েছে ও নিজেও অবগত নয়। ও শুধু জানে, এখান থেকে নিজের প্রশ্নগুলোর সব জবাব নিয়ে তবেই যাবে। রুবায়তকে বলতেই হবে। কীসের এতো লুকোচুরি? কেন এতো গোপনীয়তা? কী করছে তারা? কেন তাদের আচরণ, চলাফেরা এমন সন্দেহজনক ঠেকছে! তাজরীন আরো একটা প্রশ্ন করতে যাবে, তার আগেই ওর ডান হাতটায় আরো গাঢ় ছোঁয়া পেল। রুবায়েত আরো শক্ত করে চেপে ধরেছে তাজরীনের হাত। তাজরীন ব্যাথা পেল। কিন্তু বুঝতে দিলো না। ক্রুর হেসে বললো,
“গায়ের জোর কার ওপর খাটাচ্ছেন মেজর? অন্যের হবু বউ আর একজন ভাইয়ের ছোট বোনের ওপর? জানতে পারলে একটা হাঙ্গামা লেগে যাবে কিন্তু। প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা জানেন তো?”
রুবায়েত সঙ্গে সঙ্গে তাজরীনের হাতের বাহু ছেড়ে ছিটকে দূরে সরিয়ে দিলো ওকে। তারপর গাছের সাথে হেলান দিয়ে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

“লিসেন, অন্যের হবু বউয়ের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার। আপনি বেশ ভালো মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা সম্পর্কে ধারণা রাখেন তাজ। ওয়েল ডান। বাট, আমার চিন্তাধারা আপনার কল্পনারও ঊর্ধ্বে। আপনার প্যারালাল ইউনিভার্সও ম্যাচে টিকতে পারবে না৷ সো, কিপ ইট আপ। বারবার এই-যে হবু বউ, ফিয়োন্সে সম্বোধন করছেন নিজেকে অপরিচিত একজনের সামনে; এসব করে কী প্রমাণ করতে চাইছেন হ্যাঁ?”

তারস্বরে শেষের বাক্যটা শোনার সাথে সাথে তাজরীনের মনে হলো, এই মুহূর্তে ওকে এখান থেকে প্রস্থান করতে হবে। না, ঠিক প্রস্থান নয়। পালানো বললেই ভালো হবে বোধহয়। তাজরীনকে বড় বড় পা ফেলে ছুটে পালাতে হবে। ফ্যাসাদে পরবে না-হয় শীঘ্রই। নিজের কথার জালে নিজেই ভুলবশত ফেঁসে যাওয়াটা জগতের অন্যতম দুঃখহর। তাজরীন প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক পা, দুই পা করে পেছাচ্ছে। দরকার নেই কোনো রহস্য উদঘাটনের। কারো উদ্দেশ্য এবং গোপন কর্মকাণ্ড না জানলেও চলবে। এসবে লাভ-ক্ষতি কিছুই নেই। তাজরীন ছুট দেবে, ঠিক সেই মুহূর্তে চোখের পলক ফেলতেই বড় বড় কয়েক পা ফেলে সামনে এগিয়ে আসলো রুবায়েত। একেবারে খুব কাছে। তাজরীন জানে, এই লোকটার কাছে সে নিরাপদ। তাকে কিছু করবে না৷ তবু সে ভয় পাচ্ছে। ভয়ের কারণটা ওর নিজেরই অজানা। রুবায়েত তাজরীনের দুই হাতের বাহু-ই চেপে ধরলো এবার। তাজরীন অন্ধকার ঠিকমতো দেখতে না পারলেও অনুভব করতে পারলো, সামনে দাঁড়ানো লম্বাচওড়া লোকটার হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা মুখে অত্যাধিক পরিমাণে রাগের আভাস। কপালের নীল শিরাগুলো ফুলে থাকার কারণে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মাথাটা কিঞ্চিৎ নুইয়ে তাজরীনের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। রুবায়েত রূঢ় আওয়াজে প্রশ্ন করলো,

“এসব বলেকয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছেন তাজ?”
“কী প্রমাণ করতে চাইবো?”
তাজ পাল্টা প্রশ্ন করে জবাবের পরিবর্তে। রুবায়েত দাঁতে দাঁত পিষে জবাব দেয়,
“সিমপ্যাথি গেইন করতে চাইছেন?”
“কই না তো। প্রশ্ন-ই আসছে না!”
“তাহলে একজন দু’দিনের পরিচিত লোকের সামনে বারবার এধরনের ড্রামা করার কারণ কী? জানি, আপনি ড্রামা কুইন। বেশ ভালো ড্রামা করতে পারেন। বাট, হোয়াই আই এম? আমার সামনেই কেন? জানেন না আমি এসব অপছন্দ করি?”
“না, জানি না। আর আপনার পছন্দ করা না করাতে আমার কিছু যায় আসে না।”
“ওকেহ। না আসুক। কিছু না হলেই বরং ভালো৷ কিন্তু আপনি আমার কোয়েশ্চনের অ্যান্সার দিয়ে তবেই যাওয়ার অনুমতি পাবেন। বলুন, বারবার আপনার পার্সোনাল ইস্যু কেন তুলছেন?”
“পার্সোনাল ইস্যু হলো বুঝি?”

“হ্যাঁ। আমার কাছে এটা পার্সোনাল ইস্যু।”
“কিন্তু আমার কাছে তো নয়। আমার কাছে এটা জনে জনে বলে বেড়ানোর ব্যাপার৷ এমনকি ভরা সভায় চিল্লিয়ে বলতেও দ্বিধা নেই।”
“তাহলে তাই-ই করুন না। আপনাকে তো কেউ আটকাচ্ছে না। তবে আমার সামনে বলবেন না।”
“কেন বলবো না?”
রুবায়েত এবার তাজরীনের প্রশ্নে ওকে কিছুটা টেনে কাছে এনে চোখে চোখ রাখে। দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞাসা করে,
“বলছেন-ই বা কেন? একজন স্বল্প পরিচিত পুরুষকে জেলাস ফিল করাতে চাইছেন? বোকা আপনি? আপনার কী মনে হচ্ছে, আমি জেলাস ফিল করছি?”

রুবায়েতের বাম হাতটা তখন তাজরীনের বাম হাতের বাহুতে আলতোভাবে খামচে ধরা। আর ডান হাতটা তাজরীনের গলায় বিচরণ করছে। তাজরীনের শরীর অবশ হয়ে আসছে। এমনিতেও চড়া শীত। তারওপর এমন পরিস্থিতিতে আরো ঠান্ডা হয়ে আসছে ত্বক। অস্বস্তি বাড়ছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আড়চোখে একবার নিজের গলায় রূঢ়ভাবে বিচরণ করতে থাকা পুরুষালি শক্তপোক্ত হাতটা দেখে নিয়ে সামনে তাকালো। রুবায়েতের চোখে চোখ রাখলো। এই আঁধারেও যেন দু’জন একে-অপরের মুখের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারছে। রুবায়েতের চাহনি কেমন যেন অদ্ভুত, শীতল. . .রক্ত হিম করার মতো। তাজরীন তবু অতিরিক্ত সাহস দেখিয়ে জবাব দিয়ে বসলো,
“আপনি কি জেলাস ফিল করছেন মেজর? আপনার চোখে-মুখে কিন্তু তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমি কী ধরে নেবো, আপনি জেলাস?”

তাজরীন আকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিতে জবাবের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো রুবায়েতের মুখের দিকে। রুবায়েত একদম গম্ভীর। একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। শুধু বাম হাতের বাহু হতে হাত সরিয়ে কোমর চেপে ধরে টেনে নিজের কাছে আনলো। বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। পেছনে হাতদুটো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে তাজরীনের থুতনির নিচে হাত রাখলো। তারপর একটা অপ্রত্যাশিত, ভয়াবক কাজ করে বসলো। থুতনি হতে সরিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে সবচেয়ে দমবন্ধকর গম্ভীর গলায় বললো,

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৬

“আপনার আর আমার মহাবিশ্ব ভিন্ন তাজ। দু’টো নক্ষত্র কখনো একই কক্ষপথে অবস্থান করতে পারে না। প্রতিটি নক্ষত্র তার নিজস্ব কক্ষপথে স্থিতিশীল থাকে। যদি দু’টো ভিন্ন নক্ষত্র তাদের যাত্রাপথে খুব কাছাকাছি চলে আসে, তাহলে মহাজননী সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই আমাদের আলাদা কক্ষপথে অবস্থান করা-ই শ্রেয়। আপনি আর কখনো আমার সামনে আসবেন না।”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২৮