নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৪

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৪
ঝিলিক মল্লিক

“এইযে উঠুন উঠুন, সবাই উঠে পড়ুন। ভাইয়ারা, ভোর ছয়টা অলরেডি। উঠবেন না?”
বদ্ধ দরজার ওপাশ থেকে চিকন মেয়েলী কন্ঠস্বরের সাথে সাথে থালার ওপর খুন্তি দিয়ে বারি মারলে যেমন শব্দ হয়, তেমন ঝনঝন শব্দ ঘরের ভেতরে ভেসে আসতেই ধড়ফড়িয়ে ঘুমন্ত সবাই উঠে বসলো। আফিম চোখ ডলতে লাগলো ঘুম থেকে উঠে বসে। সারারাত নতুন গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করে রাত চারটার কাছাকাছি সময়ে ঘুমিয়েছিল ও। ঘুম পরিপূর্ণ না হওয়ায় মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। বিরক্তিভরে দরজার দিকে তাকালো। হাসান কম্বল সরিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। তাজরীন একটা মাফলার গলায় পেঁচিয়ে আর চাদর গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে না, সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে। বোঝা গেল, অনেকক্ষণ আগেই উঠেছে। হাসান ওকে ভেতরে আসার জন্য পথ করে দিলো। তাজরীন হাতের স্টিলের থালা আর খুন্তিটাকে পাশের ড্রয়ারের ওপর রেখে ভেতরে এসে কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো সবাইকে। আফিম এখনো ঘুমে ঢুলছে। শোয়েব কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে। রায়ান চুপচাপ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে হাবলার মতো। আর একজন লোক, রুবায়েতকে দেখা গেল বিছানার একপাশে বালিশে হেলান দিয়ে বসে ফোন স্ক্রল করছে। দেখে মনে হচ্ছে, তাজরীন আসার আগেই তার ঘুম ভেঙে গেছে। তাজরীন একবার মাত্র দেখলো তাকে। তারপর এগিয়ে গিয়ে সব কম্ফোর্টার-কম্বল গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত হলো। হাসান আর রায়ান এগিয়ে এসে বললো,

“আপনার করতে হবে না। আমরা করে দিচ্ছি।”
তাজরীন ওদেরকে বাঁধা দিতে চেয়েও পারলো না। ওরা একপ্রকার জোরপূর্বক টেনে নিয়ে কম্ফোর্টার-কম্বল ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত হলো। রুবায়েত নামক লোকটার ফোনে কল এলো বোধহয়। লোকটা উঠে গিয়ে বেলকনিতে চলে গেল ফোনকল রিসিভ করে কানে ধরতে ধরতে। তাজরীনের লোকটাকে খুব অদ্ভুত মনে হলো। কেমন যেন!
তাজরীন ঘর থেকে বের হয়ে সোজা রান্নাঘরে গেল। ওর মা আর বৌমণি খুব ভোরে উঠেই সকালের নাস্তা তৈরি করা শুরু করে। তাজরীন উঠেছে আরো পরে। ও রান্নাঘরে আসতেই জীম হাতের পেঁয়াজটা ঝাঁপির ওপরে রেখে একটা ন্যাকরায় হাত মুছে বললো,
“ও তাজ, তুমি একটু পেঁয়াজগুলো কুঁচিয়ে রাখো তো। আমি গিয়ে তোমার ভাইকে টেনে তুলে নিয়ে আসি। লোকটা বলেছিল, ভোরবেলা পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠবে। এখনও ওঠার নামগন্ধ নেই।”
জীম বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। নিজেদের শোবার ঘরের দিকে যাওয়ার আগে জেসিদের ঘরে উঁকি দিলো একবার। ওরা উঠে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে বাথরুমের সামনে। প্রত্যেকের হাতে ব্রাশ আর তোয়ালে। ওদেরকে নাস্তার জন্য ডেকে চলে গেল জীম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুস্তমের কাঁধ ধরে আলতোভাবে ধাক্কা দিতে লাগলো জীম। বেহুঁশে ঘুমিয়েছে এই লোক। জীম এবার বেশ জোর গলায় ডাকতে লাগলো,
“শাহবীর, এই?”
“উহহম।”
ঘুমের ঘোরে কিঞ্চিৎ শব্দে ডাক শুনলো রুস্তম। তবে চোখ খুললো না। জীম তখন আরো জোরে জোরে ধাক্কা দিতে দিতে বললো,
“ওই মিঞা, ওঠেন না ক্যান? হ্যাঁ?”
“কী বললে?”
এবার উল্টো পিঠে হয়ে চোখ বুঁজে, মুখ কুঁচকে প্রশ্নটা রুস্তম। জীম গলার স্বর আরো চড়াও করে বলে,
“বলেছি, মিঞা। মিঞাভাই। এবার ওঠেন রে ভাই!”
“পরে ডাকো রে ভাই! অনেক ধকল গেছে। আরেকটু ঘুমিয়ে নিই, প্লিজ?”
“না, আর ঘুমানো যাবে না ব্রো। বহুত ঘুমিয়েছেন। এবার উঠে পড়ুন।”

রুস্তম কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকলো। ওঠার কোনো লক্ষ্মণ নেই। জীমকে ঘুরেও দেখলো না। চোখও খুললো না। জীম টানা পাঁচ মিনিট ঘুরঘুর করলো পুরো ঘরময়। ড্রেসিং টেবিলের ওপরে সমস্ত জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। সেগুলো ঠিক করে গুছিয়ে রাখলো। তারপর আবার এসে এবার রুস্তমের গায়ে জড়ানো কম্বলের মাথা টেনে ধরে বললো,
“এই শালার ব্যাটা, ওঠেন না ক্যা? ওঠেন বলছি।”
“আহ, যন্ত্রণা দিও না তো সিলভি।”
“যন্ত্রণা? আমি যন্ত্রণা দিই?”
রুস্তম কোনো জবাব দিলো না। জীম এবার ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,
“শালা ওঠ বলছি। ওই শালা!”
এবার রুস্তম লাফ মে’রে উঠে বসলো শোয়া থেকে। কম্বল সরিয়ে জীমের সামনে এসে দাঁড়ালো দ্রুত পায়ে। কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞাসা করলো,
“কী বললে মাত্র?”
“যা শুনেছেন, তাই।”
প্রতিক্রিয়াহীনভাবে জবাব দিলো জীম। রুস্তম এবার আঙুল উঁচিয়ে শাঁসানোর সুরে বললো,
“একদম ফাতরামি করবে না আমার সাথে। জানো, বেয়াদবি নিতে পারি না।”
“বেয়াদবি করিনি তো।”
“চুপ বেয়াদব! বেয়াদবি করে আবার বলে, বেয়াদবি করিনি তো!”
বেশ রাগত স্বরে জীমের কথাকেই ব্যাঙ্গ করে বললো রুস্তম। জীম ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার বাইরে গিয়ে উল্টোদিকে ঘুরে বললো,
“ওই শালা, নাস্তা করতে আসেন জলদি।”
রুস্তম হাত উঠিয়ে থাপ্পড় দেখাতে গেল ওকে। জীম হেঁসে দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে।

খাওয়ার টেবিলে বসেও আফিম ফোনে মেসেজ করায় ব্যস্ত ছিল। একহাতে রুটি ছিঁড়ছিল। আরেক হাতে ফোন টিপছিল। ওর ডানপাশে বসেছিল রুবায়েত। রুবায়েত বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের। ও গম্ভীর মুখ করে খাচ্ছিল। মনোযোগ অন্য কোনোদিকে সরেনি একটুও। আফিমের কর্মকান্ডও খেয়াল করছিল না। তহুরা বসেছে আফিমের বামপাশে। ওদের দুটোর বরাবরই সবসময় লেগেই থাকে। তহুরা আফিমকে জ্বালায় বেশি। ও এবার বললো,
“ইফার সাথে কথা বলো নাকি ব্রোহ?”
“হ। ক্যান?”
“তোমার আইলস্যা গাপ্পেন এই সাত-সকাল বেলা উঠেছে যে?”
“আমার জন্য উঠেছে।”
“তোমার জন্য এতো কেয়ার? বাব্বাহ!”

বেশ বিস্ময়ের সাথে কথাটা বলে তহুরা। আফিমের আপাতত ওকে সহ্য হচ্ছে না। মেয়েটার জন্য ইফার সাথে কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে ওর। তহুরা বড্ড জ্বালাচ্ছে। এই আট নাম্বার প্রেমিকা না টিকলে আফিমের এ জীবনে আর প্রেম জুটবে না কপালে। এবারের প্রেম নিয়ে ও খুবই সিরিয়াস। আগের প্রেমটাও এই তহুরার জন্যই ভেঙেছিল। আফিমের আগের প্রেমিকার নাম ছিল, হেনা। মেয়েটার সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয়। খুব চুটিয়ে প্রেম চলছিল দু’জনের। ক্যান্টনমেন্টে ডিউটির সময়টা বাদে বাকি সময়টুকু পুরোটাই হেনাকে দিতো আফিম। মেয়েটা খুব স্মার্ট। একারণে ওর বেশি পছন্দের ছিল। একদিন তহুরা হেনাকে নক দিয়ে নাকি বলেছিল, “আপনি যার সাথে প্রেম করছেন; সেই লোক তো খুব ভালোমানুষ নয়। আমি তার কলিগ। তাকে খুব ভালোভাবে চিনি। এর আগেও বহু প্রেম করেছে জীবনে। যার সংখ্যা অগণিত। আমিই তো প্রায় দশ-বারোটার কথা জানি। জারা, রূপা, রাফিয়া, ফারিয়া, মীম, নিশি, আঁখি, মেহেরুন, মিরা আরো কত কত!”

ঠিক এভাবেই অতিব বিজ্ঞতার সহিত হেনাকে মেসেজ দিয়েছিল তহুরা। হেনাও খুব সতর্ক স্বভাবের মেয়ে। তহুরার এই মেসেজের স্ক্রিনশট আফিমকে দিয়েই ওর সাথে ব্রেকআপ করে নিয়েছিল।
অবশ্য আফিম নিজেকেই দোষ দেয়। যতই বনিবনা না হোক, তহুরার কাছে ওর কোনো রাখঢাক নেই। মেয়েটা এমন, ও কিছু জিজ্ঞাসা করলে না বলে পারা যায় না! তবু আফিম ওকে একদমই বিশ্বাস করে না। তহুরার ওপর খুব রাগ ওর। খেতে খেতে আফিম আড়চোখে চেয়ে বলে,
“তহু, খেতে দিস শান্তিতে। একটা উষ্টা দেবো কিন্তু!”
তহুরা এবার চুপচাপ খেতে খেতে সবার অগোচরে আফিমের লম্বা করে মেলে রাখা পায়ের গোড়ালি বরাবর একটা লাথি মেরে ফিসফিসিয়ে বললো,
“নাও, আমি-ই মেরে দিলাম বজ্জাত।”
আফিম পাল্টা কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। ততক্ষণে তাজরীন এপাশে এসে সবার প্লেটে ডিম তুলে দিচ্ছে। তহুরা আর আফিমের প্লেটে দেওয়ার পরেই রুবায়েতের প্লেটে দিতে যাবে, তখনই রুবায়েত প্লেটটা একটু সরিয়ে নিয়ে বললো,

“এটুকুই যথেষ্ট। আর খেতে পারবো না।”
তাজরীন জোর করে রুবায়েতের প্লেটে ডিম তুলে দিয়ে বললো,
“ভাই, একটা-ই তো জীবন। খেয়ে-পরে তারপর মরবেন। খাওয়া নিয়ে ভণিতা ভালো লাগে না।”
তাজরীনের মুখ চলে বেশি। ফটাফট কথাগুলো বলেই চুপ হয়ে যায় ও। নিজের ভুল বুঝতে পারে। অতিথির সামনে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। বৌমণি জানতে পারলে বকা দেবে। সামনের লোকটারও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। মনে হলো, যেন কিছুই শোনেনি। চুপচাপ খাওয়ায় ব্যস্ত হলো। তখনই টেবিলে হাতের কাছে রাখা রুবায়েতের ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। রুবায়েত ফোন রিসিভ করে মিনিটখানেক ওপাশের মানুষের কথা শুনলো। তারপর হালকা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৩

“ওই শু’য়োরের বাচ্চাকে কু পিয়ে ফেলবো। আমার বোনকে টিজ করে! হারামির বাচ্চার সাহস কত বড়! আমি রংপুর ফেরার আগ পর্যন্ত ওটাকে অঞ্চলে রাখার চেষ্টা করিস। এখন কিছু বলার দরকার নেই। আমি এসে দেখে নেবো।”
তাজরীন পাশেই দাঁড়িয়েছিল ট্রে হাতে নিয়ে। রুবায়েত কথা শেষ করে শব্দ করে ফোনটা টেবিলের ওপর ফেলতেই হালকা কেঁপে উঠলো তাজরীন। লোকটাকে যতটা শান্তশিষ্ট ভেবেছিল, ততোটা আসলে নয়। বরং রেগে গেলে অনেক বেশি অশান্ত, আর খুব মেজাজী। এটুকু বুঝে গেল তাজরীন। কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো ও।

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৫