নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৩১

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৩১
ঝিলিক মল্লিক

ঘড়ির কাটায় রাত তখন দশটা প্রায়।
কুলগাঁও বালুছড়া এলাকা।
সামনেই সেই আতিয়া মহল।
অপারেশন টুলাইট।
স্থানীয় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের স্পেশাল ইউনি সোয়াট ও প্যারা-কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সম্মিলিত একটি অভিযান।

সামনেই ভবনটি দেখা যায়। আবছা আলো-আঁধারির মাঝে মাথা তুলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বহু পুরোনো এই ভবনটি। ইটের গা হতে সিমেন্ট-বালি খসে পরেছে। শ্যাওলার আস্তরণ জমা হয়েছে। পরগাছারা ইটের ফাকে বাসা বেঁধেছে দেদারসে। গতদিন এই ভবনটা অত্যন্ত সতর্কতার সহিত দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে গেছে রুবায়েত এবং স্নাইপার আসাদুল্লাহ৷ আজ-ও দু’জন একই অবস্থানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ওপাশের ঝোপঝাড়ে ঘাপ্টি মেরে আছে হাসান এবং রায়ান। বাকিরাও নির্ধারিত পজিশনে। সবাই আজ কালো পোশাক পরিহিত৷ নিকষ কালো অন্ধকারে মিশে গেছে তারা।
ওরা মোট চৌদ্দ জন। মেজর শাহবীর রুস্তম নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই সম্পূর্ণ অপারেশনের। ওদের সাথে রয়েঠে সোয়াট টিমের বেশ কয়েকজন সদস্য। রুস্তম কানের সাথে সংযুক্ত ব্লুটুথ হেডফোন ঠিক করে নিলো। গ্রুপ কলে ছিল ওরা। রুস্তম ফিসফিসিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আসাদুল্লাহ্ পজিশন চেঞ্জ করুন। রুবায়েত আরো কিছুটা পেছনে সরো। দূরত্ব মেপে পেছাও। তবে খুবই সাবধান। আমার ধারণা, ওরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মাটির নিচে মাইন পুঁতে রাখতে পারে। একবার ভুলক্রমে মাইনের ওপর পা পরলে কিন্তু জান বাঁচানো অসম্ভম। সাবধানের মার নেই!”
রুস্তমের কন্ঠস্বরে কঠোর সতর্কবার্তা আসাদুল্লাহ পা টিপে টিপে নিঃশব্দে সামনে এগোলো। আর রুবায়েত কমান্ড শুনে মিনি টর্চাটা জ্বালিয়ে মাটির ওপর তার আলো ফেলে দেখেশুনে পেছাতে লাগলো। রায়ান আর শোয়েবকে একগাদা মশায় ধরেছে। প্রতিটা কামড়ে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। রায়ান দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিয়ে ফিসফিসিয়ে ফোনকলে বললো,
“ক্যাপ্টেন, ড্রাগ মুরাদ ভেতরেই আছে। এতোটুকু শিওর আমি। সামনের রাস্তায় যেই গাড়ির চাকার দাগ, সেটা ওর-ই গাড়ির। অন্য কোনো গাড়ির নয়। ওর গাড়িটা সম্ভবত ভবনের পেছনের দিকে রাখা আছে।”
শোয়েব বললো,

“ভেতরে কমসে কম বারো থেকে পনরো জন অবস্থান করছে।”
শোয়েবের কথা শুনে রুস্তম স্পিকারটা টেনে মুখের সামনে এনে বলে,
“ওরা আজ এই ভবন উড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যানিং করেছে। রিক্তি, রেডি থেকো। এ্যনি টাইম, তোমাকে প্রয়োজন পরবে। তহুরা, সিগন্যাল দেওয়ার সাথে সাথেই এগোতে শুরু করবে।”
রুস্তম দুই পা এগিয়ে আবার পিছিয়ে গেল। তাড়াহুড়োয় দ্রুত বললো,
“না, না! কেউ এক পা-ও এগোবে না। যে যেখানে আছো, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।”
সবাই দাঁড়িয়ে পরলো। দূর থেকে একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। রুস্তম রিক্তিকে নির্দেশনা দিতে বললো,
“রিক্তি, যেহেতু তুমি ইওডি ট্রেনিং নিয়েছো; সুতরাং মাইন নিষ্ক্রিয়করণের দায়িত্ব তোমাকে দিচ্ছি। ওরা আমাদের জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে। ওরা জানে, আমরা আসবো। তাই ভবনের চারপাশে অবস্থান বিশেষে মাইন পুঁতে রেখে। মাইনের পজিশন ওরা ব্যতীত আর কেউ জানে না। তবে আমাদের কাছে উপায় আছে। রিক্তি?”
“ইয়েস ক্যাপ্টেন, আ’ম রেডি!”

রিক্তি মাটিতে শুয়ে পরলো উল্টো হয়ে। তারপর অত্যন্ত সতর্কতার সহিত এলোপাতাড়িভাবে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগলো সামনে। ওর একহাতে মেটাল ডিটেক্টর, অপর হাত শূন্যে। মেটাল ডিটেক্টর মাটি হতে কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে সর্বত্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও। রিক্তি শুধু পেটের ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগোচ্ছে। বাহুতে ভর দিয়ে শরীর ঠেলে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই পায়ের দ্বারা মাটি স্পর্শ করছে না। ওর এই কাজটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আর কোনো উপায়ান্তরও নেই। একটু এদিক-ওদিক হলেই বিস্ফোরণ। সবাই দম বন্ধ রেখে রিক্তির কাজ দেখছে আড়াল থেকে। রিক্তি নরম মাটি আলতো করে স্পর্শ করে দেখছে। পুরো ভবনের সামনের স্থানটা সাপের মতো নিঃশব্দে ঘুরেফিরে শেষমেশ দু’টো জায়গায় গোল করে দাগ দিলো রিক্তি। তারপর ইশারায় ডাক দিলো সবাইকে। তবে রুস্তম, রুবায়েত, আসাদুল্লাহ আর সোয়াট টিমের বোম্ব টেকনিশিয়ান নিরব এজাজ এগিয়ে গেল। কাছাকাছি গিয়ে তারা গোল হয়ে দাঁড়াতেই রিক্তি নিরবকে ইশারা করলো। নিরব নিচে বসে অত্যন্ত সতর্কভাবে আলতো হাতে ধীরেসুস্থে মাটির আবরণ সরাতেই মাইনটা স্পষ্ট হলো। রিক্তি নিচু স্বরে জানালো, দু’টো মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে। ভবনের দ্বারে। এখান থেকে কেউ না জেনে ভেতরে প্রবেশ করতে গেলেই নিশ্চিত পায়ের নিচে অন্তত একটা মাইন পরতো। আর তাতেই কাজ হয়ে যেতো। রিক্তি আর নিরব দু’জনে মিলে মাইন নিষ্ক্রিয়করণের কাজ শুরু করে দিলো দক্ষ হাতে। বাকিরা চারিপাশটা সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

জীম রীতিমতো অস্থির হয়ে উঠেছে। দুশ্চিন্তায় মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ওর। বিছানার ওপর বসে আছে ও। সামনে তাজরীন চিন্তিত মুখে গালে হাত রেখে ভাবনায় মত্ত, অনবরত পায়চারি করছে। কাঠের দোতলায় ওরা। বিয়েবাড়িতে মেহমান সংখ্যা আজ কিছুটা কমেছে। যেহেতু বিয়ের মূল অনুষ্ঠান শেষ, একারণে। জীমদের নাকি কাল যেতে হবে। ডলি বেগম সন্ধ্যায় সেকথা জানালেন। আরো দু’দিন থাকার কথা ছিল এখানে। অর্থাৎ, আজ শুক্রবার। কাল বাদে পরশু দুপুরের পরে রওয়ানা হওয়ার কথা। কিন্তু জীমের শাশুড়ি কাল দুপুরের পরেই ফিরতে চাচ্ছেন। এর অবশ্য বিশেষ কারণও আছে। পরশু জীমের শ্বশুরের মৃত্যুবার্ষিকী। সেই দিনটা তিনি একান্ত নিজের মতো করে কাটান। আর যেহেতু জীমের শ্বশুরের জন্ম, মৃত্যু ও কবরস্থান সবকিছুই রাজশাহীতে; তাই তার শাশুড়ি ওই দিনে ওখানেই মিলাদের আয়োজন করেন। এতিমখানার বাচ্চাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। এখানে আসার আগেও বেড়ানোর পরিকল্পনা করার সময়ে নিতান্তই ভুলোমনা হওয়ার কারণে মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তার। তাই এতোগুলো দিন থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গতকালই নাকি তার মনে পড়েছে এ ব্যাপারটা। তাই যেকোনোভাবেই আগামীকাল তাকে রাজশাহীতে ফিরতেই হবে। নিজের ভুলোমনার জন্য অনেক আফসোসও করেছেন তিনি।

জীম আর তাজরীন আপাতত এসব নিয়ে ভাবছে না। ব্যাগপত্র সব গুছিয়েই রেখেছে তারা। কিন্তু শাহবীর আর তার টিমের একজন মানুষকেও দুপুরের পর থেকে দেখা যায়নি এবাড়িতে। আশেপাশে কোথাও নেই। তাজরীন নিজে গিয়ে খুঁজে এসেছে। বাকিরাও ওদের কথা অনেকবার করে জিজ্ঞাসা করছিল। ডলি বেগম সারাদিন কাউকে দেখতে না পেয়ে সন্ধ্যার দিকে বড়ঘর থেকে জীমকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শাহবীর আর তার বন্ধুদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। একপ্রকার জেরা করা-ই বলা যায় কিন্তু জীম কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। আপাতত বেজায় নাজেহাল দশা ওর। ইতিমধ্যে, রাত দশটার দিকে ওর শাশুড়ি কল দিয়েছেন আবার শাহবীরদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে। জীম কোনোমতে কথা কাটিয়ে ফোন রেখেছে। এমনিতেও দুশ্চিন্তায় জান যায় যায় অবস্থা ওর। বুঝতে পারছে, শাহবীররা কোন উদ্দেশ্যে যেতে পারে। বিপদের আভাস পাচ্ছে ও। তাজরীনও জানে এ ব্যাপারে। আপাতত কোনো সান্ত্বনা দিতে পারছে না বৌমণিকে। নিজেই চিন্তায় পরেছে ও। জীম কাঠের দেয়ালে হেলান দিয়ে মাথা চেপে ধরে বললো,

“আমি আর সহ্য করতে পারছি না তাজ। ফোন করো উনাকে। এখুনি।”
তাজরীন পায়চারি থামিয়ে বললো,
“ফোনে তো পাওয়া যাচ্ছিল না ভাইয়াকে। ওদের কারো ফোন নাম্বারও নেই আমার কাছে। কি যে করবো! বুঝতে পারছি না।”
তাজরীন এবার পায়চারি থামিয়ে ধপাস করে এসে বসে বিছানায়। জীম মাথা তুলে উঠে বসে কিঞ্চিৎ বিরক্তি দেখিয়ে বললো,
“আমি-ই ফোন করছি ওই লোককে৷ কল রিসিভ না করলে বাচ্চার ব্যাপারে কখনো জানাবো না আমি। আর কল রিসিভ করলে এই মুহূর্তেই জানাবো।”
তাজরীন বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,

“বোকামি কোরো না বৌমণি। এখন ভাইয়াকে এই খবরটা জানানোর উপযুক্ত সময় নয়।”
“না। তোমার ভাইয়ার জানা উচিত। সন্তানের কথা চিন্তা করেও যদি নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভাবে। নাহলে আমি, তুমি, আম্মা— কেউই নই তার কাছে। কারো পরোয়া করেন না তিনি!”
জীম আর সময় নষ্ট না করে ফোন হাতে তুলে নিয়ে কললিস্টের শুরুতেই শাহবীরের নাম্বারে কল দিয়ে বসলো। রিং বাজছে। কিন্তু কল রিসিভ হলো না। প্রথম দুইবার রিং বেজে কেটে গেল। তৃতীয়বার কল দিতেই কল কেটে দেওয়া হলো। অর্থাৎ, শাহবীর অবগত, জীম কল দিচ্ছে। তবু ইচ্ছা করেই কেটে দিচ্ছে। কল রিসিভ করছে না। জীমের হঠাৎ মনে হলো, তার সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধাকার। পুরোপুরি অন্ধকার। কান্নারা এসে জমা হলো কন্ঠনালীর কাছটায়। দলা পাকিয়ে আটকে রইলো।

মাইন নিষ্ক্রিয়করণের কাজ শেষ। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো যেন। তাদের অপারেশনের কাজ কিছুটা সহজ হলো। এবার মূল পদক্ষেপ নেওয়ার পালা। সবাই ভেতরে যাবে। ক্যাপ্টেন রুস্তম পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দূরের অন্ধকার গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে হাত উঠিয়ে ইশারা করলো। সঙ্গে সঙ্গে সবাই দৃঢ় পদক্ষেপে বিনা শব্দে এগিয়ে আসলো। সবাই সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ঠিক সেই মুহূর্তে শাহবীরের সেলফোনে আবারও কল আসলো। সাধারণত এসব গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে সেলফোন বন্ধ করে রাখে শাহবীর। তবে আজ কেন জানি করেনি। দু’বার কল কেটে দিয়েছে সিলভির। এবার আর পারলো না। কোনো এক অজানা আকর্ষণে কল রিসিভ করে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ওপর পাশ থেকে হাউমাউ করে কান্নার শব্দ। শাহবীর কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরে তার ব্যক্তিগত নারীর কান্নার শব্দ শুনলো। তারপর একসময় শান্ত স্বরে বললো,
“চুপ করো। কান্না থামাও।”

আস্তে আস্তে কান্নার শব্দ ক্ষীণ হলো। শাহবীর নিজেই বলতে শুরু করলো,
“আমার হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই সিলভি। দুই মিনিটে কনভারসেশন শেষ করবে। আমি যা বলছি, চুপচাপ শোনো। তারপর তুমি বলবে, আমি শুনবো।”
সিলভি তবু চুপ করে রইলো। শাহবীর বলতে শুরু করলো,
“আমার দায়িত্ব কখনোই আমি এড়িয়ে যেতে পারি না সিলভি। আর আমার পেশাটা-ই তো এমন। আগুন নিয়ে খেলা করা। আমার দেশটাকে নিরাপত্তা দেওয়া একজন সৈনিক হিসেবে আমার দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব হতে দুনিয়াবি কোনো মোহমায়া-ই আমাকে পিছু হটাতে পারবে না। অবশ্যই এটা আমার প্রথম কর্তব্য, তাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমি এটাকেই বেশি গুরুত্ব দেবো? চট্টগ্রাম শহরটাকে ওরা ধ্বংস করে দিচ্ছিলো প্রায়। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী একা হাতে হ্যান্ডেল করতে পারছিল না ওদেরকে। সম্ভবও নয়। ওরা খুব ডেঞ্জারাস। ওদের নাগাল পাওয়া যায় না সহজে। ওদের কারণে দু’জন পুলিশ সদস্য মারা যাওয়ার-ও লজ্জাজনক রেকর্ড রয়েছে প্রশাসনের। পুরো চট্টগ্রাম শহরটাকে নেশার কারখানা আর ড্রাগের ত্রাস বানিয়ে ছেড়েছে ওরা। এই ড্রাগ কক্সবাজার, পটুয়াখালীতেও সাপ্লাই করছে ওরা। এভাবে চলতে থাকলে ওদের এই মূল কেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে পুরো দেশে বিস্তৃতি ছড়িয়ে পরবে। দেশের একাংশ যুবকসমাজ নেশার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। আর এই যুবক সমাজ-ই দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে ওদের গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা প্রয়োজন। সুতরাং আমাদেরকে বিশেষ নির্দেশনায় এখানে আসতেই হলো ড্রাগ মুরাদ এবং তার সন্ত্রাসী গ্যাংকে ধরার জন্য। যৌথবাহিনীর অপারেশন এটা। কিছুটা বিপজ্জনক। তবে তুমি চিন্তা কোরো না। সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া কোরো শুধু।”

শাহবীর থামলো। তারপর আবার বললো,
“এবার তোমার কি বলার আছে, বলো।”
জীম এবার শাহবীরকে চমকে দিয়ে নিরবতা ভেঙে এক নিঃশ্বাসে বলর ফেললো,
“আপনি সন্তানের বাবা হতে চলেছেন। আমাদের সন্তান আসছে। এখন আমার গর্ভে। ইন শা আল্লাহ আট মাস পরে দুনিয়ার আলো দেখবে। আমি আশা করবো, সে দুনিয়াতে আসার পরে যেন তার বাবাকে দেখারও সৌভাগ্য তার হয়!”
শাহবীর এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ বনে গেল জীমের কথা শুনে। তবে বেশি সময় নেই ওর কাছে। পরমুহূর্তেই বলে উঠলো,

“সিলভি তুমি তো জানো-ই, আমার জীবনের প্রায় পুরো অংশটা-ই দেশ-রক্ষা নামক দায়িত্বের সাথে বাঁধা। এই দায়িত্বের হেলাফেলা আমি করতে চাই না। দেশ আমাকে ডাকলে আমি পেছনে ফিরতে পারি না। কিন্তু আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী এবং আমাদের ছোট্ট সন্তানের জন্য আমি প্রতি মুহূর্তে ফিরতে চাইবো।”
শাহবীরের কথার মাঝেই ডুকরে কেঁদে ওঠে জীম। শাহবীর তড়িঘড়িতে বলে ওঠে,
“চুউপ, একদম চুপ। জানো, তোমার চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি হাসবে, আমাদের সন্তানকে হাসাবে, আমাদের বাড়িটাকে হাসিখুশি রাখবে— এতোটুকু প্রতিশ্রুতি দিলেই আমি শান্তিতে নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারবো। অনুরোধ করছি সিলভি।”
জীম চোখের জল মুছে শান্ত হয়ে বললো,

“দিলাম তবে প্রতিশ্রুতি।”
শাহবীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও বললো,
“আমি ফিরে আসার অনর্থক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না। কারণ, সৈনিকদের জীবনের কোনো প্রতিশ্রুতি বা নিশ্চয়তা থাকে না। যেহেতু আমার ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই এবার, তাই কিছু কথা বলে রাখি। আর দুই মিনিট আছে আমার কাছে।”
হাতঘড়িতে সময় দেখে বললো শাহবীর। ঠিক সাড়ে দশটায় ভেতরে প্রবেশ করবে ওরা। এখন দশটা বেজে উনত্রিশ মিনিট। জীম বললো,
“জি, বলুন।”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৩০

“আমার না থাকাটা কখনো যেন তোমার দুর্বলতার কারণ না হয়। বরং, গর্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তুমি যদি কখনো আমার অভাববোধ করো, তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটা শুনো। যদি আমার কথা মনে করে খুব কষ্ট পাও, তবে আমার দেওয়া সেই পুরোনো শালটা জড়িয়ে নিও; আমার অস্তিত্বের সান্নিধ্য পাবে। আর যদি কখনো মনে হয়, আমি তোমাদের ছেড়ে চলে গেছি— তবে রাতের তারাভরা আকাশে দিকে তাকাবে। হয়তো লক্ষ তাঁরার মাঝে কোনো এক তাঁরা হয়ে আমি তোমাদেরকেই দেখছি।”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৩২