নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৩২
ঝিলিক মল্লিক
আতিয়া মহলের ভেতরের আয়তন সুবিশাল। প্রথমেই বড় দ্বার থেকে ভেতরে প্রবেশ করে সুবিশাল বারান্দা, দালান। তারপর বড়ঘর। বড়ঘর সংযুক্ত আরো কতগুলো ছোট ছোট কক্ষ রয়েছে আতিয়া মহলে। মহলের ভেতরটা পুরোপুরি অন্ধকার। ব্যাপারটা প্রথমে দ্বার হতে ভেতরের বারান্দায় প্রবেশ করা মাত্র-ই অনুধাবন করা গেল। আবছা আলোর মাঝে ক্যাপ্টেন রুস্তম সবাইকে ইশারা করে সেইফ পজিশনে চলে যেতে বললো। প্রত্যেকে অতি সতর্কতার সাথে নিঃশব্দে দালানের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। রুস্তস হাতের ইশারায় সবাইকে নিজ নিজ জায়গাতে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে বললো। রুস্তম রেডিওতে জানালো, এখানে কোনো একটা ঘাপলা নিশ্চয়ই আছে।
নচেত, এতোবড় একটা সাম্রাজ্যে সন্ত্রা”স গোষ্ঠী কোনো পাহারার ব্যবস্থা করেনি— এই ব্যাপারটা নিতান্তই স্বাভাবিক নয়। বরং, অনেকটাই অস্বাভাবিক, সন্দেহজনক পরিস্থিতি। রুস্তম সরে দাঁড়িয়ে একবার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলো। সচেষ্ট চেষ্টা বিফল হলো। রুবায়েত ঠিক রুস্তমের পাশে দাঁড়িয়ে। রুস্তম নির্দেশ দিলো আসাদুল্লাহ আর নিরবকে ছাঁদে গিয়ে কভার নিতে। রায়ান আর শোয়েবকে বললো পেছনের গেটের দিককার পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে। আসাদুল্লাহ আর নিরব ততক্ষণে পজিশন নিতে নিতে বারান্দার উর্ধ্বমুখী সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। রায়ান আর শোয়েবও বেরিয়ে গেল। আফিম আর হাসান তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশটা দেখছে। হাসান ফিসফিসিয়ে নিচু স্বরে আফিমকে বললো,
“কিছু একটা ঠিক নেই এখানে। আমাদের ইমিডিয়েট পজিশন চেঞ্জ করা দরকার।”
আফিম জবাব দিলো,
“ক্যাপ্টেন কমান্ড দিক, তারপর।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আফিম আর হাসান তাদের সোজাসুজি দালানের দিকে তাকালো। রুস্তমের ইশারায় অপেক্ষা ছিল। রুস্তম হাতের দুই আঙুল নাড়িয়ে ইশারা করতেই তৎক্ষনাৎ পজিশন পরিবর্তন করলো আফিম আর হাসান। ওদের দু’জনের হাতে দু’টো অ্যাসল্ট রাইফেল। ওরা ভেতরের দিকে পা বাড়ালো। রুবায়েতও দক্ষিণ পাশের ঘরের দিকে এগোবে, তখনই রুস্তম ওকে টেনে থামিয়ে দিলো। দু’জনের মধ্যে কিছুক্ষণ কিছু একটা নিয়ে আলোচনা চললো নিরবে। তারপর তারা ফাইনাল অ্যাটাকের জন্য প্রস্তুতি নিলো। আসাদুল্লাহ আর নিরব ইতিমধ্যে ছাঁদে গার্ড দিতে থাকা দু’জনের ওপর হামলা করে ওদেরকে অচেতন করে হাত-পা এবং মুখ শক্ত করে বেঁধে ফেলে রেখেছে ছাঁদের এক কোণে। ওদেরকে পাল্টা হামলা করার সুযোগও দেয়নি। ওদের পরিকল্পনা সম্ভবত অন্যরকম কিছু ছিল। ওরা আক্রমণ পরে করতো বোধহয়। তবে আচনক সোয়াট টিমের আগমন সামাল দিতে পারেনি। এরা তুচ্ছ। কামলা খাটে। এসব চামচাগুলোকে না ধরে বাঘাগুলোকে ধরা-ই টিমের মূল কাজ।
রায়ান আর শোয়েবের কাছে দু’টো লোডেড পিস্তল ছিল তখন। ওরা হাত উপরে উঠিয়ে পিস্তল উঁচু করে ধরে এক পা, দুই পা করে এগিয়ে যেতে লাগলো ভবনের দেয়াল ঘেঁষে, আড়াআড়িভাবে। হঠাৎ ফিসফিসানোর আওয়াজ শুনতে পেল। আওয়াজটা দেয়ালের ওপাশ থেকে আসছে। তারমানে, ওরাও আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত। রায়ান এক পা এগিয়েই একটা গুলি ছুঁড়ে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত পাশ থেকে পাল্টা একটা সিসা খন্ড ধেয়ে আসলো ওদের দিকে। রায়ান আর শোয়েব কভার নিলো৷ দেয়ালের কাছ ঘেঁষে সারি বেঁধে রাখা সিমেন্টের বস্তার পেছনে আড়াল করলো নিজেদেরকে। সিসা খন্ডটা ওদের ঠিক কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। কান ছুঁতে পারেনি। নাহলে এতোক্ষণে পরিস্থিতি দাঁড়াতো ভয়াবহ পর্যায়ে। শোয়েব আর রায়ানের সাথে সাথে ওপাশে থাকা তিনজন গার্ডের অনেকক্ষণ যাবত আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ চলতে লাগলো।
ইতিমধ্যে আতিয়া মহলের ভেতরে এবং বাইরে আরো কয়েকদিক থেকে গোলাগুলি ও বন্দুকের ট্রিগারের আওয়াজ শোনা গেল। গোলাগুলি তো শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। রুস্তম আর রুবায়েত তখনও ভেতরের ঘরগুলোতে হন্যে হয়ে ড্রাগ মুরাদকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ ধরা পড়েছে। বলা চলে, বেশিরভাগ সদস্য-ই যৌথবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু আসল ব্যক্তি-ই এখনো হাতের নাগালে এসে পৌঁছায়নি। ড্রাগ মুরাদ সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড। এমনকি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সাথেও তার যোগাযোগ আছে। অনেক গোপন তথ্য আছে তার কাছে। ড্রাগ মুরাদকে ধরতে না পারলে সকল পরিশ্রম বৃথা। একমাত্র ড্রাগ মুরাদ-ই আরো হর্তাকর্তাদের সন্ধান দিনে পারবে। রুস্তম উত্তেজনায় রীতিমতো ঘেমে উঠেছে।
অন্ধকার হাতড়ে চলা কোনো কঠিন কাজ নয় ওদের পক্ষে। তবে সামনে এগোতে সংকোচ। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু ওদেরকে কাছে ডাকে। বিপদ সঙ্গে করে চলে ওরা। না জানি, সামনে কি আছে। কোন বিপদ অপেক্ষা করছে! তাছাড়াও, এখানে এর আগে কখনো আসা হয়নি তাদের। ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি, এমন একটা পরিত্যক্ত সরকারি তালিকাভুক্ত জমিদার বাড়িতে কুখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আস্তানা থাকতে পারে! সরকারি জমি দখল করে বসে আছে ওরা। সাহস কতোখানি! ভাবলেই রাগে রুস্তমের কপালের শিরা ফুলে ওঠে। নীল হয়ে যায়। রুবায়েত তখন সামনে এগোচ্ছে মন্থর গতিতে। রুস্তম হঠাৎ টেনে থামিয়ে দিলো ওকে। হাতের কনুই চেপে ধরে শক্ত গলায় ফিসফিসিয়ে বললো,
-“ভুলক্রমে আর এক পা-ও এগিও না মেজর! মারা পরবে। সামনের ঘরের দরজার ওপাশে মাইন পুতে রেখেছে হারামির বাচ্চাগুলো। দরজা খুলে ভেতরে পা রাখা মাত্র মাইন বিস্ফোরণ ঘটবে। বললাম না? ওরা আমাদের জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে!”
রুবায়েতের কান খাঁড়া হলো। সতর্ক হয়ে পিছু হটলো ও। রুস্তমকে জিজ্ঞাসা করলো,
“তুমি কীভাবে বুঝলে ক্যাপ্টেন? ধারণাও করতে পারিনি। ভয়াবহ ডেঞ্জারাস ওরা!”
“টের পাওয়ার কতগুলো নিশানা এখানে– আমাদের চোখের সামনেই আছে রুবায়েত। এই সামনের রুমে একটা জনমানবও নেই। সামনের ঘর পেরোলেই ভেতরে আরেকটা ঘর। আমি নিশ্চিত, ওখানেও কেউ নেই। এতোবড় দালানের এই বড়ঘরটা ফাঁকা থাকবে কেন? আর থাকলেও অস্ত্র সংরক্ষিত ঘরটা এমন হাট করে খোলা-ই বা থাকবে কেন? স’ন্ত্রাসীরা জানের থেকে নিজেদরর অস্ত্র বাঁচাতে বেশি বেপরোয়া থাকে। এটা আমার দীর্ঘদিনের অপেক্ষা। এখানে অতিরিক্ত পরিমাণে বারুদ মজুদ করা আছে। ওরা জানে, ধরা পড়ে গেছে। পালানোর পথ আরো আগেই বন্ধ হয়েছে। শহরজুড়ে পুলিশের পাহারা। শহরের বাইরে বেরোতে পারবে না ওরা। তাই এখানে আমাদেরই মে’রে ফেলার ফুল সেট-আপ করে রেখেছে। আমাদের কিছু হলে তা নিয়ে কোন্দল হবে। সেই সুযোগে ওরা-ও পালানোর পথ পেয়ে যাবে। ওই ছোট ঘরের দরজা বন্ধ। দরজা খোলা মাত্র কিছু একটা ঘটবেই। সুতরাং, আমরা ওদিকে যাবো না। বাকিদের সতর্ক করে দাও।”
রুস্তমের কথা শুনে রুবায়েত রেডিও স্পিকার টেনে ধরে বললো,
“টিম নাম্বার থ্রি, আফিম-হাসান ইউটার্ন নাও। দোতলায় আসো। আসার পথে সামনে যে কটা পরবে, সবগুলোকে ধরবে। হয় জীবিত, নাহয় মৃত। তবে ওদের দেহ আমাদের চাই। যতদূর সম্ভব জীবিত ধরার চেষ্টা করবে। আফিম তখন একাধারে শর্ট মেশিনগান চালাতে ব্যস্ত। অপর পাশ থেকে একের পর এক গুলি ধেয়ে আসছে। হঠাৎ ওদের গুলি শেষ হয়ে গেল বোধহয়। হাসান দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দু’টোর ওপর হামলা করে পাকড়াও করলো ওদেরকে। এদিকে আফিমের পেছন দিক থেকে একটা গুলি ছুটে আসতেই দ্রুত তীরের বেগে সরে গিয়ে দুই হাতে পিস্তল তুলে নিয়ে হেডশট করে বসলো ষণ্ডা মতন একটাকে। নিচে সব পরিষ্কার। সবগুলোকে একটা ঘরে আটকে রেখে বাইরে পাহারায় দাঁড়ালো, হাসান। আফিম শোয়েব আর রায়ান ফিরতেই ওদেরকে নিয়ে দোতলায় উঠলো। সোয়াট টিমের সবাই ততক্ষণে সেখানে উপস্থিত। একটাকে ধরে এনেছে। রুস্তম এগিয়ে গিয়ে ছোকরাটার কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞাসা করলো,
“মুরাদের বাচ্চা কোথায়?”
ছোকরাটা তখন আধমরা প্রায়। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে তবু দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“বলবো না।”
রুস্তমের এবার শিরায় শিরায় রাগ জেগে উঠলো। আরো শক্ত করে কলার চেপে ধরে হাতের শটগানটা ছোকরাটার কপাল বরাবর চেপে ধরে বললো,
“বল শুয়োরের বাচ্চা! কোথায় মুরাদ?”
তবু ছেলেটা চুপ করে থাকলো। এবার রুস্তম ওর অন্ডকোষ বরাবর লা’থি মারলো অত্যাধিক জোর প্রয়োগ করে। ছেলেটা অন্ডকোষে দুই হাত চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো৷ তবু কিছু বললো না। এবার রুবায়েত পেছন থেকে ওর হাঁটু বরাবর গুলি করে বসলো। ছেলেটা এবার যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে খুব সম্ভবত। মাটিতে পড়ে গেল ও। রুস্তম আর রুবায়েত দু’জন ওর দুই হাঁটুতে পিস্তল ঠেকিয়ে বললো,
“লাস্টবার জিজ্ঞাসা করছি। মুরাদ কোথায়?”
রুবায়েত গিয়ারে টিপ দিতেই যাচ্ছিলো তখনই ছোকরাটা হাত নাড়িয়ে বলে উঠলো,
“ওস্তাদ ওখানে। ওই ঘরে। তারা ছয়জন আছে।”
রুবায়েত উঠে দাঁড়ালো। বললো, ‘আমি যাচ্ছি।’
কারো কথা শুনলো না রুবায়েত। আপাতত মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া সম্ভব নয় ওর পক্ষে। আর না তো মেশিনগানের সিসা খন্ডকে। আফিম, রুস্তম, আসাদুল্লাহ বাকিরা সবাই নিষেধ করলো ওকে। তবু শুনলো না। পেছনে ওরা-ও কভার নিতে নিতে এগোলো। রুবায়েত ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজা আঁট করে বন্ধ করা। দরজার পাল্লায় ধাক্কা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে পাশের দেয়ালের দিকে সরে গেল রুবায়েত। সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ডজন গুলি একনাগাড়ে এসে দরজার সামনের দেয়ালে গেঁথে গেল। বাকিরা কভার নিলো আরেক পাশের দেয়ালে। এবার রুস্তম, আফিম, রুবায়েত আর নিরব একটানা কিছুক্ষণ মেশিনগান চালালো। ভেতরে একমাত্র ড্রাগ মুরাদকে টার্গেটের বাইরে রেখে বাকিদের ওপর একটানা গুলি ছুঁড়তে লাগলো। ওরা ছুঁড়ছিল। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চললো বিশ-পঁচিশ মিনিটের মতো। রাত তখন দুইটার ওপরে৷ ওদের অস্ত্রের ভাণ্ডার অঢেল৷ রুস্তম এবার সবাইকে ইশারা করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা এবার এগিয়ে এসে গোলাবর্ষণ শুরু করতেই রুস্তম সরে যেতেই রুবায়েত পাশ থেকে পরপর পাঁচটার ওপর গুলি ছুঁড়লো। ওরা পড়ে গেল মাটিতে।
আরো একজন আগেই কুপোকাত হয়েছে। এই-ই সুযোগ ভেতরে প্রবেশ করার। ড্রাগ মুরাদের নিরাপত্তায় ছিল এই ছয়জন। এখন নিরাপত্তাহীন ড্রাগ মুরাদকে অস্ত্রও কোনো নিরাপত্তা দিতে পারবে না। রুস্তম টিম নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ড্রাগ মুরাদের মাথা বরাবর মেশিনগান ধরলো। ড্রাগ মুরাদ দুই হাত তুলে সারেন্ডার করলো। ততক্ষণে নিচ থেকে সবাই ওপরে এসেছে গোলাগুলির আওয়াজ বন্ধ হওয়ায়। সবাইকে বেঁধে ফেলেছে। দীর্ঘ কতগুলো ঘন্টা টানা পরিশ্রমের পর অবশেষে সাফল্যের দেখা মিললো।
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৩১
সবাই ভীষণ উৎফুল্ল। রুস্তম ড্রাগ মুরাদকে ধরে রেখেছে তখনও। রুবায়েত মাটিতে পড়ে থাকা ছয়জনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। হঠাৎ পেছন থেকে পিস্তলের আওয়াজ হলো বেশ জোরে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পরলো রুবায়েত। ওর ফোনটা পকেট ছিটকে দূরে গিয়ে পরলো। বাকিরা সবাই চিৎকার দিয়ে উঠলো। দূরে রুবায়েতের ফোন স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছে তখন। ফোন স্ক্রিনে কল ভেসে উঠেছে। একটা নাম্বার জ্বলজ্বল করছে— আসমা! আহ! সহধর্মিণীর নামটা জ্বলজ্বল করছে তখনও!