নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৫

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৫
ঝিলিক মল্লিক

ঘড়ির কাটায় তখন সকাল সাতটা৷ বাইরের পরিবেশ এখনো কুয়াশার চাদরে ঢাকা। সূর্য উঠেছে, কিন্তু মেঘের আড়ালে লুকোচুরি করছে। আবছা আলো। এখনো মোটামুটি আঁধার৷ স্ট্রিমলাইটের আলো এসময়েও জ্বলছে।
সবাই লাগেজ টেনে এনে ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়েছে। পরনে শীতের পোশাক। তাজরীন মাফলার গলায় পেঁচাতে পেঁচাতে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ ওর আবার গলায় বেশি ঠান্ডা লাগে। মূলত ঠান্ডার প্রবণতা বেশি। পা থেকে মাথা অবধি পুরোটাই শীতের পোশাকে মোড়ানো। মুখ বাদে শরীরের কোনো স্থান উন্মুক্ত নেই। ফ্রকের ওপর জ্যাকেট, তারওপর মাফলার, কানটুপি, মোজা, হাতে গ্লাভস, চুলগুলো বেণী করা, পায়ে একজোড়া জুতা— মোটামুটি কিম্ভূতকিমাকার লাগছে তাজরীনকে। তবে সেসবে কোনো তোয়াক্কা নেই ওর। ঠান্ডার প্রকোপ থেকে আগে নিজেকে বাঁচানো জরুরি। ফ্যাশন দেওয়ার সময় নেই। প্রতিবার-ই শীতকালে ঠান্ডার প্রকোপে পরে অসুস্থ হয়ে যেতে হয় তাজরীনকে। তাই ওর এমন সতর্কতা।

সবাই সোফার ওপর বসে কথাবার্তা বলছিল। আর মিনিট দশেকের মধ্যেই বের হবে এখান থেকে। তাজরীন গিয়ে দাঁড়ালো জেসিরা যেই সোফায় বসেছিল, সেই সোফার পেছনে। রিক্তি ওকে দেখে বললো,
“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, খুব বেশি ঠান্ডার সমস্যা আছে তোমার।”
তাজরীন জবাব দিলো,
“হ্যাঁ। আসলেই আমার মারাত্মক ঠান্ডার সমস্যা আর হাঁপানির প্রবলেম। এজন্য এই সেফটি।”
“তা ভালো।”
“ভাল্লুকের মতো লাগছে আমাকে, না?”
“এমাহ! ভাল্লুকের মতো লাগবে কেন? তোমার সাজটা ঠিকঠাক আছে।”
তাজরীনকে টেনে ধরে সোফার ওপরে বসিয়ে দেয় রিক্তি। তাজরীন বসে আড়চোখে একবার রুবায়েতকে দেখলো। রুবায়েত সোজাসুজি সোফায় বসে ফোনে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে রেখেছে। লোকটার যে ফোনে এতো কি! প্রেম-ট্রেম করে নাকি?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রশ্নটা তাজরীনের মনে এলো। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধিক্কার জানালো ও। লোকটা অতিথি ওদের। তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করা মানেও অনাধিকার চর্চা। আর অনাধিকার চর্চা করা মোটেও সমীচীন নয়। তবু তাজরীনের মাথা থেকে জোরপূর্বকও সরলো না বিষয়টা। কৌতূহল আরো বেড়ে গেল।
লোকে বলে, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ থাকে বেশি। প্রেম একটা নিষিদ্ধ জিনিস। তাই এর প্রতি সবার বিশেষ আগ্রহ থাকে। সে হোক নিজের প্রেম, কিংবা অন্যের।

আপাতত নিজেকে বুঝ দেওয়ার জন্য এই একটা যুক্তি-ই ওর মাথায় আসলো। তখনই রুবায়েত কেশে উঠলো। কাশতে কাশতে নিঃশ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম। কেউ ওঠার আগেই তাজরীন দৌড়ে গিয়ে ড্রয়িংরুম পার হয়ে ডাইনিং থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে আসলো। শোয়েব পাশে বসা ছিল রুবায়েতের। ওর পিঠে আলতো করে চাপড় দিয়ে অবাধ্য কাশি থামানোর চেষ্টা করছিল। হঠাৎ তাজরীন এগিয়ে এসে পানির গ্লাসটা রুবায়েতের সামনে ধরে। রুবায়েত পানির গ্লাস নিয়ে পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিতে ব্যস্ত হয়। এদিকে তাজরীন পরে যায় অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে। হঠাৎ কাছে এসে দাঁড়িয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত একটা জিনিস দেখে ফেলেছে ও। তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুবায়েতের ফোনটা তার হাতেই ধরা ছিল। ফোন স্ক্রিনের ব্রাইট এখনো জ্বলছে। মেসেঞ্জার অ্যাপের মধ্যে প্রবেশ করা। একটা কনভারসেশনের ভেতরে। আইডির নামটা ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো তাজরীন। “সানিয়া রহমান” আইডিটার নাম। সেখান থেকে লাস্ট মেসেজটা এসেছে কিছুক্ষণ আগে। মেসেজটা এমন— “আই লাভ ইউ। আই ওয়ান্ট টু কিস ইউ অন ইওর লিপস।”

ছিহ ছিহ! কি জঘন্য! কোনো মেয়েমানুষ যে এভাবে বলতে পারে, তা ধারণাতেও ছিল না তাজরীনের। মেয়েমানুষ হলো, নম্রতা-ভদ্রতার খোলস। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, এই মেয়ের সাথে হয়তো লোকটার বিয়ে-শাদি ঠিকঠাক। যদিও তার ভাইয়ের সব কলিগরা-ই এখনো পর্যন্ত সিঙ্গেল, বিবাহিত নয়। কারো ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানা নেই তাজরীনের। তবে রুবায়েত নামক লোকটার ব্যাপারে একটু বেশিই আগ্রহ দেখিয়ে ফেলছে সে। এতোটাও আগ্রহ দেখানো উচিত নয়।
তাজরীন প্রায় ফোনের ওপর ঝুঁকেই পরেছিল। রুবায়েত সবটুকু পানি শেষ করে মুখ উঠিয়ে গ্লাসটা তাজরীনের হাতে দেওয়ার সময় ওর কর্মকাণ্ড আর চাহনি লক্ষ্য করলো। ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই এমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো, তাজরীনের বুক কেঁপে উঠলো হালকা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ছিটকে দূরে সরে গেল ও। দ্বিতীয়বার আর সরাসরি রুবায়েতের চোখের দিকে তাকালো না। তবে বের হওয়ার আগে আড়ে আড়ে কয়েকবার তাকালো। রুবায়েত তখন কঠিন মুখে ফোনে টাইপ করে চলেছে। ওই মেজাজি চেহারা তাজরীনের সহ্য হলো না।

সবাই বেরিয়ে গেছে বাইরে। মেইন গেইটের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকক্ষণ হলো। একটা বাস পুরোটাই ভাড়া করা হয়েছে। এখান থেকে চট্টগ্রাম অবধি যাবে। বাস মূল সড়কের ওপাশে। ড্রাইভার আয়েশ করে সিগারেটের পর সিগারেট গিলছে আর অপেক্ষা করছে। হেলপার ব্যাকসিটের ওপর আধঘুম। অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছে তারা। আধ ঘন্টাখানেক তো হবেই।
জীম এখনো বের হয়নি। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর ওর মনে পরলো, ও ভুল করে চার্জারটা নেয়নি। এটা অতি জরুরি জিনিস। অন্যের ফোন চার্জার দিয়ে ও চার্জে দেবে না। এতে ওর ফোনে সমস্যা হবে৷ তাছাড়াও, রুস্তম এখনো ভেতরে। বের হতে দুই মিনিট দেরি হবে। সবার শেষে বেরোনোর কথা বলছিল। জীম দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলো। নিজেদের ফ্ল্যাটের ভেতরে প্রবেশ করেই সোজা শোবার ঘরের দিকে গেল। জীম নিঃশব্দে হেঁটেছে। ওর ধারণাও ছিল না, ওর এই নিঃশব্দতা ওকে ভয়াবহ একটা গোপনীয় দৃশ্যের সম্মুখীন করবে।

নিজেদের শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জীম। হাত দেয়ালে রাখা। হাতের আঙুল কাঁপছে ওর। শরীর অবশ লাগছে। মাথা ঝিম মেরে গেছে। মস্তিষ্কের নিউরন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। রুস্তম সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় কিছুটা উল্টোদিকে ঘুরে। ওর মুখ অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। মুখশ্রীতে খুবই চতুরতা আর নিষ্ঠুরতা। চোখে-মুখে খেলা করছে এক ধ্বংসলীলার পরিকল্পনা! ওকে দেখে এমনটাই মনে হলো জীমের। বিছানার ওপর পরে আছে একটা কালো রঙের রিভলবার। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কতগুলো বুলেট! শীষা। এর একটা শ্যুট করা হলে নির্ঘাত জান শেষ! রুস্তম রিভলবার হাতে নিয়ে সেটা একটা কাপড় দিয়ে মুছছে অতি যত্নসহকারে। জীম তখনই বিস্ময়ের সাথে দরজার কাছে দাঁড়িয়েই হালকা চেঁচিয়ে উঠলো,
“শাহবীর!”

জীমের কন্ঠস্বর শোনা মাত্র চমকে ফিরে তাকালো রুস্তম। সঙ্গে সঙ্গে কপালে ভাঁজ পরলো ওর। চিন্তিন্ত এবং কিছুটা ভড়কে গিয়ে এগিয়ে আসলো দরজার কাছে জীমের দিকে। জীম ওকে এগোতে দেখে বেপরোয়াভাবে পেছাতে লাগলো। হাত উঠিয়ে নিষেধ করার সুরে বললো,
“খবরদার! দূরে থাকুন। আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না।”
রুস্তম ওর কথা শুনলো না। আরো এগোলো। জীম আরো কিছুটা পেছালো। এবার রুস্তম খপ করে ওর হাতের বাহু চেপে ধরে কাছে টেনে আনলো। ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। তখনও ওর হাতে সেই ব্ল্যাক কালারের রিভলবারটা। জীম সেটার দিকে তাকিয়েই আরো কঠোর হলো। রুস্তমের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলো। রুস্তম এবার ওর দৃষ্টি খেয়াল করে পিস্তলটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে বললো,
“শোনো, আমি এক্সপ্লেইন করছি..”

“চুপ! একদম চুপ! কোনোকিছু এক্সপ্লেইন করার প্রয়োজন নেই। এসব নিয়ে প্ল্যানিং করছেন আপনি?”
“নো জীম, শোনো!”
“কোনোকিছু শুনতে চাই না। আপনি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন শাহবীর। আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে যাচ্ছেন। কি করার চিন্তা করছেন আপনি? সব জায়গায় কেন আপনার ওই প্রফেশন টানতে হবে? কেন?”
জীম শাহবীরের শার্টের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে কথাহুলো বলতে থাকে। তারপর প্রায় কেঁদে ফেলে বলে,
“একটু শান্তি চাই। অশান্তি ভালো লাগে না। সেই অশান্তি আপনি টেনে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন! এই, আপনি প্রফেশনের বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না, তাই না? পরিবার নেই আপনার? ওরা-ও কি কোনো মতলব নিয়ে যাচ্ছে আপনার সাথে?”

জীমের নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে। মুহূর্তের মধ্যে আচনক রুস্তম ওকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। কোমর চেপে ধরে। তারপর কোমর থেকে হাত সরিয়ে গালের দুই হাত রেখে ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে নেয়। জীমের নিঃশ্বাস আঁটকে আসতে থাকে। রাগে-দুঃখে আরো কান্না আসে। ঠোঁট ফুলে উঠতেই আলতোভাবে একটা কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয় রুস্তম। তারপর আবার এগিয়ে গিয়ে জীমের গলায় হাত রেখে আরেক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“শুধুমাত্র সেফটির জন্য। আর কিছু নয়। বিশ্বাস করো।”
“সর ব্যাটা। তোরে আমি বিশ্বাস করি না।”

নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে শাহবীরের পায়ের গোড়ালিতে আলতোভাবে একটা লাথি মেরে কথাটা বলে জীম। অসহ্য লাগছে ওর। যা ভেবেছিল, ঠিক তাই হচ্ছে। এই লোক বদলাবে না। বদলানোর নয়। জীম আবার বললো,
“সেফটির জন্য রিভলবার কেন সাথে নিতে হবে আপনার? সেফটির জন্য তো আম্মাকে জানিয়ে রেখেছেন, চট্টগ্রামে যাওয়ার পরে আপনাদের জব নিয়ে যেন একটা কথাও না ওঠায়। সেখানে একমাত্র সেই খালাশাশুড়ী জানে আপনার জবের ব্যাপারে। তাকে বুঝিয়ে বলা যাবে। বাকিরা দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তারা জানবে, আপনারা কর্পোরেট অফিসে জব করেন। এরচেয়ে আরো বেশি সেফটির দরকার আছে? যে রিভলবার প্রয়োজন?”
শাহবীর এবার টুপ করে জীমের ঠোঁটে আরো একটা চুমু বসিয়ে বলে,

“বেশি বোঝা, বেশি কথা বলা, বেশি বেশি করা— এসব তোমার স্বভাব। একটু চুপ যাও না রে ভাই!”
“না, পারলাম না রে ভাই! আপনি নিশ্চয়ই কোনো মতলবে চট্টগ্রামের বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছেন। আপনার ভাবগতিক আমার সুবিধার লাগছে না। ওই শালার ব্যাটা, আমার সাথে ফিরিঙ্গি মারান? সিলভির সাথে?”
“মাফ চাই ভাই। ছাড়ো আমাকে।”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৪

শাহবীর এবার সরে দাঁড়াতে চায়। জীম ওর ঘাড় বরাবর নখের আঁচড় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনি যা করতে চলেছেন, এর শেষ দেখে ছাড়বো আমি। নাহলে জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে ইস্তফা দেবো।”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৬