নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৬

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৬
ঝিলিক মল্লিক

বাস তখন রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের দিকে। এখান থেকে ঢাকা, তারপর সেখান থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে সবাই। ডলি বেগম বসেছেন একেবারে সামনের সিটে। হেলপার ছেলেটার সাথে তার বেশ ভালো ভাব জমেছে। ডলি বেগম ভীষণ হাসি-খুশি আর চটপটে স্বভাবের মানুষ। একটানা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে পারেন না। তাই একা বসে হেলপারের সাথে নানান গল্প-গুজব করছেন।
জীম বসতে চেয়েছিল তাজরীনের পাশে। কোনোভাবেই রুস্তমের পাশের সিটে বসবে না ও। কিন্তু শাহবীর ওকে টেনে জোর করে নিজের পাশের সিটে বসিয়েছে। জীম বসেছে জানালার পাশে। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। ওদের পাশাপাশি সিটটা খালি। রুস্তম সিটের সামনের পর্দা টেনে ওদেরকে আড়াল করে দিতেই চকিতে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো জীম। উত্তেজিত হয়ে বললো,

“কী করছেন? পর্দা টানলেন কেন? সবাই আছে। খারাপ ভাববে।”
“কেউ কিছু ভাববে না। হাসবেন্ড-ওয়াইফ এক সিটের মধ্যে বসে আছে। পর্দা টানা নর্মাল ব্যাপার। তাছাড়াও বাসের মধ্যে তোমার সাথে সহবাস করছি না তো।”
“ছিহ। মুখে লাগাম টানেন শালা!”
রুস্তমের হাতের বাহুতে আলতোভাবে একটা ঘুষি মে’রে কথাটা বলে জীম। রুস্তম “আউচ” শব্দ করে উঠে জীমের কোমর চেপে ধরে বসে৷ পায়ের সামনে পরে থাকা ব্যাগ থেকে চিপসের প্যাকেট বের করে এনে ছিঁড়ে জীমের সামনে ধরে বলে,
“খাও।”
“খাবো না।”
“খাওয়ার ওপর রাগ কীসের?”
“আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না তো!”
“জীম! বোঝার চেষ্টা করো, সব কথা তোমাকে বলা যায় না। কিছু সিক্রেট বিষয় থাকে। যা সবাইকে বলার মতো নয়। এতে আরো ক্ষতি বেশি।”
“না বললেন। তাতে আমার ছেঁড়া গেল!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“চুপ সিলভি! আর একটাও ফালতু কথা বললে কানের নিচে একটা দেবো।”
শাহবীর ক্ষেপে গেছে।
জীম আর একটা কথাও বললো না। শাহবীরের থেকে দূরে সরতে চাইলে ওকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বললো,
“সব জানতে পারবে। একটু সময় দাও আমাকে। সম এরিয়াস অফ চিটাগাং আর ভেরি ডেঞ্জারাস।”
কথাটা ভারী অদ্ভুত আর সন্দেহজনক শোনালো জীমের কাছে। এমনিতে ও মানুষটাই এমন৷ যেকোনো কিছুতে রহস্য আর সন্দেহের হদিস পায়। সেখানে মেজর শাহবীর রুস্তম আর তার টিমমেটরা প্রত্যেকেই যেন রহস্যে মোড়া। যেমন স্বাভাবিক দেখায় সবকিছু, আসলে তেমন নয়। কিছু তো একটা ব্যাপার অবশ্যই আছে!

তাজরীনের মন ভালো নেই এখন। কেমন যেন মরা মরা লাগছে সবকিছু। ও বসেছে তহুরার পাশে। তহুরাকে সামনের সিটে বসে কল করেছে আফিম। অনবরত বকবক করেই চলেছে। সব উল্টাপাল্টা কথা। ওদের দু’জনের কথাবার্তার বিষয়বস্তু সবসময় হয় রাজনৈতিক, না-হয় ভৌগোলিক। দু’জনের মতের মিল কখনোই হয় না। তহুরা যদি বলে উত্তর; তবে আফিমের উত্তর পছন্দ হলেও ও বলবে, দক্ষিণ। আর এসব টুকটাক স্বাভাবিক কথাবার্তার সূত্র ধরেই ওদের ঝামেলা, তর্ক বেঁধে যায়। এখন মূলত তর্ক-বিবাদ করতেই তহুরাকে কল দিয়েছিল আফিম। আজ কথাবার্তা হচ্ছে, আমেরিকা নিয়ে। তহুরা আমেরিকার পক্ষে নয়৷ আফিম আবার আমেরিকার সাফাই গেয়ে কথা বলছে। এই নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। তহুরার তখন মাথা গরম। ও বলে উঠলো,

“তুমি কী এই ফালতু টপিক নিয়ে তর্ক করার জন্য আমাকে কল দিয়েছো হাত দুয়েকের দূরত্বে বসে? আর কোনো কাজ নেই তোমার? যাও, তোমার গার্লফ্রেন্ডকে কল করো।”
গার্লফ্রেন্ডের কথা বললেও তহুরা নিজেও খুব ভালোভাবে জানে, এই টপিক নিয়ে আফিম কথা ওঠাবে না ওর সামনে। ব্যাটা ওকে এখন বিশ্বাস-ই করে না। আফিম কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে বললো,
“বোরিং লাগতেসে ভাই। আয় তর্ক করি।”
“কি আশ্চর্য! বোরিং লাগলে কেউ তর্ক করে?”
“আমি করি। ভালো লাগে।”
“ঘুমাও তুমি।”
“ঘুম আসছে না। খিদা লাগে।”
“খাও তাহলে।”
“কিছুক্ষণ আগে খেলাম।”
“তাহলে?”

“গিললে যে বোরিংনেস কাটে— একথা কোন সংবিধানে লেখা আছে?”
“না থাকুক। কিন্তু আমি জানতাম, খাওয়া-দাওয়া করলে মানুষের পেটের সাথে সাথে মাথাও ঠান্ডা থাকে। কিন্তু তোমার দেখছি একটা হয়েছে; আরেকটা হয়নি। তাহলে বুঝতে হবে, তোমার মধ্যে সমস্যা আছে।”
“সমস্যা? আমার মধ্যে কীসের সমস্যা? সামনে পাই একবার তোকে। থাবড়ে দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব।”
“আরে আগে সামনে তো পাও! আমি কী ছেড়ে দেবো নাকি তোমাকে? একটা লাথি দেবো।”
“আমি আরো এক্সট্রা দুইটা দেবো।”
“তাহলে আমি একশোটা দেবো।”
এভাবেই স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে বলতে এক পর্যায়ে তহুরা আর আফিমের মধ্যে ফোনালাপেই তর্ক বেঁধে গেল। তহুরা আর তাজরীনের পেছনের সিটে বসেছিল জেসি, রিক্তি। রিক্তি এবার চেঁচিয়ে উঠে বললো,
“এই তোরা ঝগড়াঝাঁটি করবি, বাসের বাইরে বের হয়ে কর। এমনিতেও আছি ফ্যাসাদে। আর মাথা ব্যাথা বাড়াস না।”

তহুরা এবার ফোন কান থেকে সরিয়ে পেছনের সিটে উঁকি দিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,
“তোর আবার কী হলো?”
“ফ্যামিলি বিয়ের কথা বলে। আপু মেসেজ দিলো মাত্র। কি করবো জানি না! অথোরিটি পারমিশন দিলেও এখন আমার বিয়ে-শাদি করার কোনো ইচ্ছা নেই।”
“তাহলে তুই মর ভাই। জিন্দেগীতে বিয়ে-শাদির ওপরে কোনো কথা আছে নাকি?”

রিক্তি মুখ ঝামটা দিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেললো। আপাতত কিছুই ভালো লাগছে না ওর। জীবনটাকে যেমনভাবে সাজাতে চেয়েছিল, ঠিক তেমন হচ্ছে না। আসলে এটাই বাস্তব। মানুষ যা করতে চায়, পরিকল্পনা করে; বাস্তবে তা সবসময় হয়ে ওঠে না। বাস্তবতা বড্ড নিষ্ঠুর এবং কঠিন। একজন হাসিখুশি মানুষকেও খুব সহজেই ভেতর থেকে মে’রে ফেলতে পারে৷ আপাতত রিক্তিরও হয়েছে সেই দশা। আজ দেড় বছর হলো, অনেককিছু থেকে দূরে ও। পুরোনো কথা স্মৃতিতে পাতায় উঠে আসতেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল রিক্তির। নিশ্বাস ঘন হয়ে এলো। ওর হাঁপানির সমস্যা আছে। তবু আজকাল নিজেকে বড্ড বেশি কষ্ট দিতে ভালোবাসে। ব্যাগ থেকে সালফ্লু, ইনহেলার বের করলো না ইচ্ছা করেই। মন-মেজাজ স্বাভাবিক করতে একটা গান চালিয়ে ইয়ারফোন কানে গুঁজে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে বসে রইলো। পাশে জেসি তখন গেইম খেলতে ব্যস্ত। অন্য কোনোদিকে মনোযোগ নেই ওর।
তাজরীন পরেছে মহা জ্বালায়। পাশে বসে তহুরা কথা বলছে আফিমের সাথে। তর্কাতর্কি তুমুল পর্যায়ে তখন। তর্ক-বিতর্কের মূল বিষয়বস্তু হলো— আফিম নিজের প্রেমিকাকে রেখে তহুরাকে কেন জ্বালাচ্ছে!

এই প্রশ্ন বারবার করে চলেছে তহুরা। ওপাশ থেকে আফিম প্রতিক্রিয়াহীন। দায়সারা জবাব দিয়ে যাচ্ছে দু-একটা।
তাজরীনের একবার মনে হলো, তহুরা চাইলেই কল কেটে দিতে পারে। কিন্তু তা-ও করছে না। বরং মেজাজ তুঙ্গে রেখেও কথা চালিয়ে যাচ্ছে আফিমের সাথে।
হঠাৎ একটা উদ্ভট সন্দেহ জাগলো তাজরীনের মনে। তহুরার মুখের ভাবভঙ্গি লক্ষ করলো ও। বেশ সুনিপুণভাবে। তারপর-ই যা বোঝার বুঝে নিলো। যদিও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তবে কিঞ্চিৎ হলেও আন্দাজ হলো ওর। বাকিটা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। দেখা যাক, কি হয়!

ওদের পাশাপাশি বিপরীত দিকের সিটে বসে আছে রুবায়েত আর হাসান। হাসান ঘুমে বিভোর যাত্রার শুরু থেকেই। তহুরা বসেছিল জানালার পাশের সিটে। তাজরীন তার পাশে। হুবহু রুবায়েতও সেভাবেই বসে আছে হাসানের পাশে। তাজরীন এতোক্ষণ ভীষণ অস্বস্তিতে ছিল। জড়তা কাজ করছে ওর মধ্যে। সকালে ডাইনিং টেবিলের সেই ঘটনার পর থেকেই রুবায়েত লোকটাকে মোটামুটি ভয় পেতে শুরু করেছে ও। লোকটার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা-ই ছিল না তাজরীনের। যা দেখেছে তার ফোনে! ওসব কোনো ভালো, ভদ্র-সভ্য পুরুষ মানুষের মেসেঞ্জারের কনভারসেশন হতে পারে না! কোনো ভালো লোককে মেয়েরা এধরনের মেসেজ দেবেও না৷ যদি না প্রেমিকা হয়। আচ্ছা, প্রেমিকা হলেও তো দেওয়ার কথা নয়। নিতান্তই নির্লজ্জ প্রেমিকা না হলে মোটেই নয়। তাজরীনের এবার কি হলো, তা ও নিজেও জানে না। নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ হচ্ছে না ওর। তাই সকল লজ্জা, ভয়-ডর আর আড়ষ্টতা কাটিয়ে পাশের সিটে ফোন হাতে নিয়ে ব্যস্ত থাকা জাঁদরেল মতোন দেখতে লোকটাকে এবার ডাক দিলো চিকন স্বরে,

“শুনুন।”
রুবায়েত ফোন রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তাজরীনের দিকে। বিনা প্রতিক্রিয়ায় গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
“জি বলুন।”
“প্রেমিকা কাকে বলে জানেন?”
রুবায়েত কথাটা বুঝতে পারলো না যেন। এই মুহূর্তে, এরকম পরিস্থিতিতে একজন স্বল্প পরিচিত মেয়েমানুষের থেকে এমন প্রশ্ন অত্যন্ত অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত শোনালো ওর কাছে। আর সেরকম ভাব নিয়েই তাজরীনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“কী বললেন? বুঝতে পারিনি ঠিক।”
“বলেছি, প্রেমিকা কাকে বলে জানেন?”
“প্রেমিকা?”
রুবায়েত আরো পাল্টা প্রশ্ন করে বসে। কথার ধরন এমন—যেন জীবনে কোনোদিন “প্রেমিকা” শব্দটা শোনেনি। তাজরীন এবার বেশ জোরের সাথে বলে,

“জি প্রেমিকা। কাকে বলে, বলুন তো?”
“স্যরি, জানা নেই আমার।”
“ইট’স ওকে। আমি-ই বলে দিচ্ছি।”
“নট ইন্টারেস্টেড।”
দায়সারা জবাব দিয়ে ফোনে মনোযোগী হলো রুবায়েত। ওর মুখ আরো গম্ভীর হয়ে উঠলো। তাজরীন তখন বেশ মুডে আছে। তাই তোড়জোড় করে বলে উঠলো,

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৫

“আরে, ইন্টারেস্টের দরকার নেই। কান আছে, শুনুন! যেসব মেয়েরা ছেলেদের ইনবক্সে ‘আই লাভ ইউ। আই ওয়ান্ট টু কিস ইউ অন ইওর লিপস’— এই টাইপ টেক্সট লিখে পাঠায়; এক্সুয়ালি তাদেরকেই প্রেমিকা বলে।”
কথাগুলো যে তাজরীন বেশ খোঁচা মেরে বলেছে, তা ওর কথার নাটকীয়তায় বেশ ভালোমতো বোঝা গেল৷ মুহূর্তের মধ্যে রুবায়েতের মুখ শক্ত হয়ে এলো। কপালের শিরা স্পষ্ট হলো। তাজরীন বুঝলো, ব্যাটা ক্ষেপেছে এহেন কথায়। বাস-যাত্রা কিছুক্ষণ আগেও অত্যন্ত নিরামিষ লাগছিল তাজরীনের কাছে। হঠাৎ-ই মেজর রুবায়েত নওয়াজকে ক্ষ্যাপাতে পেরে ওর দারুণ পৈশাচিক আনন্দ হতে লাগলো। সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চিল্লিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“ওই হেলপার ভাই, সাউন্ডবক্সে একটা গান লাগাও তো জলদি। ‘গোলমাল হ্যায় ভাই সব গোলমাল হ্যায়’ গানটা লাগাও।”

নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৭