নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৮
ঝিলিক মল্লিক
বাস তখন সবে কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে এসে থেমেছে৷ এখানে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি নিয়ে হাটহাজারীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। ঘড়িতে সময় দেখা হলো। সন্ধ্যা ছয়টা বেজে বাইশ মিনিট। বাসের সকল যাত্রী নেমে গেল একটু হাঁটাচলা করে আসার জন্য। আবার পনেরো-বিশ মিনিট পরে যাত্রা শুরু হবে। দীর্ঘ জার্নির পরে এখন একটু স্বস্তি দরকার। জীম বের হলো চাঁদরটা গায়ে জড়িয়ে। অনেকটা সময় ঘুমিয়েছে ও। ওকে ডেকে তুলেছে ওর শাশুড়ি। ঘুম থেকে ওঠার পরে রুস্তমকে বাসের ভেতরে দেখেনি জীম। সন্দেহ জেগেছে ওর মনে। বাসের বাইরে টঙের দোকানেও নেই। আশেপাশেও কোথাও দেখলো না। এরমধ্যে কোথায় গেল!
এরপর ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো, শাহবীরের কলিগদের মধ্যে অনেকেই নেই চোখের সামনে। উঁধাও সব! বাসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। জীমের শাশুড়ি খুবই ক্লান্ত। তিনি বাসের মধ্যেই রয়েছেন। বাইরে জীম, তাজরীন, জেসি আর রিক্তি। বাকিদের আশেপাশে বহু খুঁজেও দেখা গেল না। জীমের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক এতোটুকু ধরতে পারলো, রিক্তি আর জেসি যে ওদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে, নিশ্চয়ই ওদেরকে চোখে চোখে রাখার জন্য। কিছু একটা লুকোচ্ছে ওরা। কিন্তু কী? জীমের টেনশন বাড়লো। বিয়েবাড়িতে যাচ্ছে ওরা। এসময় কোনো ঝামেলা মোটেও সমীচীন নয়। ঝামেলা করছে শাহবীর। আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে ও। সবজায়গায় সবকিছু মানায় না।
এরইমধ্যে জেসি হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে গ্রুপে একটা মেসেজ সেন্ট করলো।
“এদিকে সবকিছু ওকে আছে। নো টেনশন।”
মেসেজটা সিন করেছে সবাই। জেসি ফোন থেকে মুখ উঠিয়ে তাকাতেই চমকে উঠলো। না! একটা ব্যাপার ঠিক নেই। তাজরীন এখানে নেই ওদের সাথে। চোখের পলকে সরে গেছে। কোথায় গেছে, তা-ও বোঝা গেল না। জেসি রিক্তিকে চোখের ইশারা করতেই রিক্তি সুযোগ বুঝে সরে গেল সেখান থেকে। জীম সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জেসিকে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কি একটা অবস্থা বলো তো! কাউকেই দেখছি না। তাজরীন আর রিক্তি ছিল সাথে। ওরা-ও যে কোথায় গেল!”
“টেনশন নেবেন না সিস্টার। ব্যাটা মানুষ তো। গেছে হয়তো কোনো টঙের দোকানে চা-পান খেতে।”
“ভদ্রভাষায় চা-পান হলেও বলা উচিত— সিগারেট। আমি বুঝি না বাপু, এরা সিগারেটে পায়টা কি!”
জীম জানে জেসি অভিনয় করছে। ওর কথার অনেকাংশ-ই মিথ্যা। এসব পাট বহু আগেই চুকিয়ে এসেছে ও। জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের ছাত্রীকে ভূগোল পড়ানো হচ্ছে। হাস্যকর লাগলো জীমের কাছে। তবু ও নিজেও সমানতালে অভিনয় চালিয়ে যেতে লাগলো। ফাঁকে ফাঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শাহবীরের টিমের খোঁজ চালাতে ব্যস্ত হলো। তবে জেসি ওর মাইন্ড ডাইভার্ট করে দিতে লাগলো বারবার। জীম মনে মনে ক্রুর হেঁসে বিরবির করলো, “পাকা খেলোয়াড়! মেজরের মতোই হয়েছে সবগুলো। মানতে হবে, মেজর জিনিয়াস লোক। সবগুলোকে দারুণ ট্রেনিং দিয়ে ছেড়েছে!”
তাজরীন যাচ্ছিল বাসের পেছনের দিকের বটতলা পেরিয়ে ওপাশের টঙের দোকানের পেছনে। সেখানে একটা দোকান উঁকি দিচ্ছে। কিছু খাবার কেনা জরুরি। কিন্তু ভাবতেও পারেনি, সরল মনে এদিকে এসে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে ও! তাজরীন মুখে হাত দিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলো। বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে। পা থমকে রইলো এক জায়গায়। মাথা সামান্য চক্কর কেটে উঠলো।
সামনে আলো-আঁধারির আবছা খেলা। এই জায়গাটাতে কোনো দোকানপাট নেই। বাসস্ট্যান্ডের শেষ মাথা এটা। দোকান-পাট সব ওই পাশে। এখান থেকে পার করে যেতে হবে। লোকসমাগম শূন্য। তাজরীন দেখলো, সামনে-পেছনে দুইদিকে বাস। তার মাঝখানের খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সাতজন। সাতজন আগন্তুক নয়। চেনা-পরিচিত। তাদেরকে খুব ভালোভাবে চেনে তাজরীন। নিজের বড়ভাইয়ের থমথমে মুখশ্রী চোখে পরলো অচিরেই। সাদাসিধা হাবভাবের শোয়েব আর রায়ানের ক্ষুব্ধ চাহনিও। রুবায়েত নামক লোকটার হাতে ব্ল্যাক কালার রিভলবার দেখে তাজরীনের বিস্ময় সীমা ছাড়ালো। দু’জন অপরিচিত ব্যক্তিকেও চোখে পরলো ওর। দেখে মনে হলো, লোকদু’টো কোনো লিভার-কুলি হতে পারে। এটা তাজরীনের আন্দাজ। হঠাৎ ওর কি হলো, তা ও নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না। তার আগেই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল।
আঁধারে গুরুতর আলোচনা চলছিল সম্ভবত। হঠাৎই কোনো মানুষের পায়ের আওয়াজে চমকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো সবাই। স্তব্ধ হলো। রুস্তম নড়েচড়ে দাঁড়ালো বোনকে দেখে। আফিম খোঁচাতে লাগলো ওর পাশে দাঁড়ানো হাসানকে। শোয়েব আর রায়ান আড়চোখে তাকাতে লাগলো। তাজরীন সবার মুখের ভাবভঙ্গি দেখলো একে একে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ওকে দেখে সবাই বেশ বিচালিত হয়েছে— বোঝাই যাচ্ছে। রুস্তম এগিয়ে আসতেই তাজরীন পিছিয়ে গেল দুই কদম। রুস্তম হাত নাড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে বললো,
“তাজ, কিছু দেখসনি তুই। নাথিং। বোঝা গেল?”
তাজরীন সরু চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ওর ভাইয়ের দিকে। রুস্তম বুঝলো, ব্যাপারটা জটিল হয়ে যেতে পারে। তখনই রুবায়েত এগিয়ে আসলো সামনে। রুস্তমকে ইশারায় বোঝালো, “আমি হ্যান্ডেল করছি।”
রুস্তম সরে যেতেই রুবায়েত তাজরীনের হাতের কব্জি ধরলো আলতোভাবে। তারপর ওকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে আসলো সেখান থেকে। জনসম্মুখে আসার আগের হাতের কোল্ট প্যানথন রিভলবারটা বুটের নিচের অংশে লুকিয়ে ফেললো। তাজরীন চোখ বড় বড় করে দেখলো তা। একসময় রুবায়েতের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে জোরাজুরি করলো। রুবায়েত নিজেই ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,
“তোমার নামটা খুব সুন্দর। কি যেন নাম. . তাজরীন তাসনিয়া. .”
তাজরীন চরম আশ্চর্য হলো! মানুষ কিভাবে ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলাতে পারে, তা সবার এই লোককে দেখে শেখা উচিত। ঘন্টাখানেকের ব্যবধানে সম্বোধন ‘আপনি’ থেমে তুমিতে নেমে এসেছে। এতো মধুর কন্ঠস্বর! অবিশ্বাস্য লাগছে সবকিছু! তাজরীনের বোধশক্তিতে এতোটুকু ধরতে পারলো, মেজর রুবায়েত কথা ঘোরাচ্ছে। ওর মন ভোলাতে চাইছে। কিন্তু তাজরীন তো ভুলবে না কিছুক্ষণ আগের সেই দৃশ্য। কখনোই ভোলার নয় ওই সাতজনের ক্ষুব্ধ মুখাবয়ব, হাতে অস্ত্র!
তাজরীন এবার আঙুল উঁচিয়ে বললো,
“একদম কথা ঘোরাবেন না বড়ভাই!”
“কথা তো ঘুরায়নি ছোট আপু।”
“আমি আপনার ছোট আপু হই?”
“এইযে মাত্র আপনি বড়ভাই বলে সম্বোধন করলেন!”
রুবায়েতকে এই মুহূর্তে সহ্য করতে পারছে না তাজরীন। ভীষণ পল্টিবাজ লোক। কথা ঘোরানোতে ওস্তাদ। মেয়েদের মন ভোলানোর অভিজ্ঞতাও আছে নিশ্চয়ই। উল্টোদিকে হাঁটা ধরলো ও। রুবায়েত এগোলো না। শুধু মেসেঞ্জারে ঢুকে তাজরীনকে একটা টেক্সট করলো, “আই হোপ, আপনি কাউকে কিছু বলবেন না।”
“আর যদি বলি?”
“তাহলে আপনি আমার সাথে কি কি বেয়াদবি করেছেন, সবার সামনে ফাঁস করে দেবো।”
তাজরীন জ্বলে উঠছিল তখন। রুবায়েতের এই মেসেজের পরে নিভে গেল সম্পূর্ণ। চুপচাপ বাসের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুই হয়নি— এমন একটা ভাব ধরলো।
জীম তখন বাসের ভেতরে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। তাজরীন, রিক্তি, জেসি সবাই যার যার সিটে। ওর শাশুড়ি ফোনে কথা বলছিলেন। আর পাঁচ মিনিটের মাথায় বাস ছাড়বে। ড্রাইভার এসে বসেছেন মাত্র। জীম জানালা দিয়ে বারবার বাইরে তাকাচ্ছিল। তখনই রুস্তম আর বাকি সবাই উঠে এলো বাসে৷ জীম তীক্ষ্ণ চাহনিতে দেখলো রুস্তমকে। কোনো কথা বললো না। রুস্তম পাশে এসে বসতেই জীম এবার কিছুটা ঝুঁকে ওর কাছাকাছি এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
“কাজটা হয়েছে স্যার?”
রুস্তম চমকে তাকালো জীমের দিকে৷ তারপর না বোঝার ভান করে বললো,
“কী কাজ?”
“বাহ! অ্যাক্টিং স্কিল তো খারাপ না আপনার। দেখতেও ঝাক্কাস আছেন। সেই একটা মাল৷ হিরো হতে পারতেন কিন্তু এক চান্সে।”
রুস্তম দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিলো জীমের কথাগুলো। তারপর আবারও বললো,
“আমরা একটু স্মোক করতে গিয়েছিলাম সিলভি। পুরুষ মানুষের পার্সোনাল টাইম। তুমি বুঝবে না।”
“হ্যাঁ, এজন্য তহুরাকে সঙ্গে নিয়ে স্মোকিং করছিলেন?”
“ছিহ! জঘন্য কথাবার্তা।”
“উচিত কথা জঘন্য-ই লাগে।”
“তুমি একটু চুপ যাবে সিলভি?”
“আমি চুপ করে গেলে আপনার ভুলটা ধরিয়ে দেবে কে?”
“কোনো ভুল করছি না আমি, যে তোমার থেকে জ্ঞান নিতে হবে৷ যথেষ্ট বোধ আছে আমার।”
“হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
“সিলভি আর একটা কথা বললেও. .”
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৭
শাহবীরের ক্ষুব্ধ চাহনি, হাতের মুঠো শক্ত করা, কপালের শিরা স্পষ্ট হতে দেখেও দমে গেল না জীম। আবারও কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই বাস যাত্রা শুরু করলো। বিপরীত পাশের সিটে হাসান আর আফিমকে বসতে দেখে চুপ হয়ে গেল ও। আর মাত্র ত্রিশ মিনিটের পথ। এরপর গন্তব্যে পৌঁছে যাবে ওরা। হাটহাজারী — এক রহস্য মণ্ডিত স্থানের নাম! খোলসে আবৃত একটা ফল যেন!