নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৯
ঝিলিক মল্লিক
রাত তখন আটটা বেজেছে প্রায়।
হাটহাজারী। বাজার এলাকা পেরোনোর পর ভেতরের সড়কপথ ছাড়িয়ে আরো ভেতরের দিকে একটা সরু রাস্তা। এই অঞ্চলটার চারিপাশ থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গ্রামাঞ্চল রয়েছে। তবে বাজার এলাকা বেশ সরব। রুস্তম, জীমরা যেই পথ দিয়ে হাঁটছে; তা অনেক নির্জন। আশেপাশে বাড়িঘর খুব কম। সবাই সারি বেঁধে পরপর হাঁটছে। জীম আর তাজরীন আলোচনা করছে জেসিদের সাথে। আবছা অন্ধকারে হঠাৎ জেসি হোঁচট খেলো। ছেলেরা সামনে ছিল। জেসির চিৎকার শুনে ফোনলাইটের আলো পেছন দিকে ফেরালো। জেসি পা চেপে ধরে ‘ও মা গো’ বলে বিলাপ করতে করতে বললো,
“রাস্তাটা এমন কেন? ঠিক করে না কেন? আমি হোঁচট খেলাম কেন?”
জীম আর তহুরা জেসিকে দাঁড় করাতে ব্যস্ত। ডলি বেগম সাব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসেছেন। তিনি আবার অতি অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পরেন। ইমার্জেন্সি ফার্মেসীতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। তখন ওপাশ থেকে হাসান খোঁচা মে’রে জেসিকে বললো,
“ট্রেনিং-এ ফাঁকি দিলে এমন-ই হয়। সামান্য হোঁচট খেয়ে মাইয়াডার এই ঢঙ!”
হাসানকে পাশ থেকে খোঁচা দিলো শোয়েব। কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“ব্রো, ট্রেনিং-ফ্রেনিং এর কথা তুলো না এখানে। কেস খেয়ে যাবো সবগুলো।”
হাসান চুপ হয়ে গেল। ওদিকে জেসি কোঁকাতে কোঁকাতে বললো,
“সমস্যা নেই। তেমন কিছু হয়নি। পায়ে হালকা ব্যাথা পেয়েছি। ঠিক হয়ে যাবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবাই আবার হাঁটা শুরু করলো। ওপাশে খাল। এপাশে সরু রাস্তা। ডানদিকে ঘন জঙ্গল। খালের ওপাশটাতেও মোটামুটি বড় বড় গাছপালা দিয়ে ভরপুর। শ্মশানঘাট। কতগুলো ডিঙি নৌকা বাঁধা কালভার্টের নিচের দিকটায়।রুস্তম আর ডলি বেগম সবার আগে হাঁটছেন। পথ দেখিয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সবাইকে। জীমের হাতে একটা ব্যাগ ছিল। ও দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রুস্তমের কাঁধে তুলে দিয়ে বললো,
“আমার হাত ব্যাথা করছে। এটাও নিন।”
রুস্তমের হাতে কতগুলো দই-মিষ্টির প্যাকেট। তবু মেনে নিলো জীমের চাপিয়ে দেওয়া দায়িত্ব। বউয়ের মেজাজ যেকোনো সময়ে বিগড়ে যায়। তাই না মেনে নিয়ে অশান্তি করার কোনো মানে হয় না। জীম পেছনে এসে আবারও হাঁটতে লাগলো মেয়েদের সাথে। ছেলেরা ওদেরই সামনে৷ প্ল্যানিং করছে, আজ রাতে কি করবে।
তাজরীন তখন ওদের কথাবার্তা শুনে জেসিদের বলতে লাগলো নিজেদের প্ল্যানিং-এর কথা। তার খালামণির শ্বশুরবাড়ি মূলত এই গ্রামাঞ্চলের ভেতরেই। যদিও এই এলাকার বাইরে হাটহাজারী বাজার অঞ্চল বেশ জনসমাগমে পরিপূর্ণ। তবে এদিককার সবটুকু গ্রামের অংশ। এখানে প্রতিটা বাড়ি বেশিরভাগই ইট-কাঠের তৈরি। বিশেষ আকর্ষণ হলো, কাঠের তৈরি দোতলা বাড়িগুলো। তাজরীনের খালামণিদের ইটের তৈরি বিল্ডিংও আছে। সাথে কাঠের দোতলা বাড়িও। বিল্ডিংয়ের বিপরীত পাশে আগে থেকেই তৈরি করা ছিল কাঠের দোতলা বাড়িটা। ইট-পাথরের বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে কিছু বছর হলো। আগে তাজরীনরা যখন আসতো, সবসময়ই কাঠের দোতলায় থাকার আবদার করতো। সেখানে থাকতেও আলাদা একটা প্রশান্তি। সব কাজিনরা একসাথে অনেক আনন্দ করতো। লুডু খেলতো, ভূতের গল্প করতো। সেই দিনগুলো-ই ছিল অন্যরকম।
তাজরীনের কথা শুনে জীম এবার বললো, “তাহলে আমরাও এবার যেয়ে ওই দোতলায়-ই থাকবো?”
হ্যাঁ থাকা-ই যায়।
তাজরীন সহমত জানালো। জেসি, তহুরা আর রিক্তিও খুব এক্সাইটেড। এর আগে কখনো তারা কাঠের দোতলা ভবন দেখেনি। তাছাড়াও তারা সবাই-ই শহরের মানুষ। গ্রামের বাড়িতে তাদের যাতায়াত খুবই কম। এজন্য এসব বিষয়ে বেশি আগ্রহী তারা। পাঁচজন মিলে পরিকল্পনা করতে লাগলো, রাতে কি করবে তারা৷ তখন সামনে হাঁটতে থাকা ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে শোয়েব বলে উঠলো,
“এ হাসান ভাই। দেখো, মেয়েলোকেরা কি যেন কওয়াকওয়ি করে।”
শোয়েব খুলনার ছেলে। কথাবার্তার মধ্যে দারুণ একটা খুলনাইয়া টান। শুদ্ধ আর আঞ্চলিক ভাষা মিলিয়ে কথা বলে। শুনতে দারুণ লাগে। ওর কথা শুনে হাসান এবার কিছুটা রাশভারী গলায় বলে,
“কথা বলছে মেয়েমানুষেরা। যা খুশি করুক গে ওরা। তোর কী রে?”
“ওরা কি যেন করবে। কাঠের দোতলা বাড়িতে থাকার কথা বলতেছে। আমাদের ব্যবস্থা করা যায় না সেখানে?”
কথাটা বলেই শোয়েব পেছনে ঘুরে জীমকে বলে,
“সিস্টার, আমাদেরও কাঠের দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করা যায় না? আমি খু্ব ছোটবেলায় একবার মায়ের মামাবাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে কাঠের দোতলায় ছিলাম। এখন অবশ্য নেই সেই বাড়ি। আপনাদের কথা শুনে মনে পরলো।”
জীম কিছু বলার আগেই তাজরীন মুচকি হেসে বললো,
“হ্যাঁ, থাকা যাবে না কেন? অবশ্যই যাবে। দোতলা তো বিশাল বড়। একটা রুম-ই প্রায় তিনটা মাঝারি সাইজের রুমের সমান। আর সেই রুমে তিনটা খাট। একটা বিশাল বড়৷ তাতে কমসে কম ছয়জন ধরে যাবে৷ আর দু’টো হচ্ছে মিনি সাইজের। তাতে চারজন অনায়সে ঘুমাতে পারবে। আরেকটা রুম আছে সেটা আলাদা। আপনারা নাহয় বড় খাটে ঘুমালেন। আর আমি, জেসি আপু, তহুরা আর রিক্তি বাকি দুটো খাটে।”
তাজরীনের কথা শুনে জীম বলে ওঠে, “আর আমি?”
তাজরীন জবাব দেয়, “তুমি আর ভাইয়া ওই আলাদা রুমটাতে।”
ছি ছি! জীমের লজ্জায় মাথা কাটা যায়। এই তাজরীনের মুখে কিছু আটকায় না৷ আর আটকাবেই বা কী করে? ওর-ই তো ননদ! এতগুলো মানুষের সামনে অনায়সে বলে দিলো এমন কথা! বাকিটা রাস্তায় ওরা সবাই একসাথে পরিকল্পনা করলো। দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তি আর নেই কারো চোখে-মুখে। রাতের জন্য দারুণ একটা পরিকল্পনা হতেই সবার ক্লান্তি মুছে গেল। রাস্তাটা বেশ লম্বা। আঁকাবাকা মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হবে আরো অনেকখানি। তারপর-ই হেলেন কুঠিবাড়ি।
রুস্তমের খালামণির শ্বশুরবাড়ির নামখানা দারুণ সুন্দর বলে মনে হলো সবার। হেলেন কুঠিবাড়ি! এই নামের পেছনেও একটা ইতিহাস আছে। পারিবারিক ইতিহাস। রুস্তমের খালামণির শাশুড়ির নাম ছিল, হেলেন খানম। তিনি বড্ড শৌখিন মানুষ ছিলেন। বেঁচে থাকাকালীন তিনি-ই নিজেদের ছনের তৈরি বাড়িটাকে কাঠের দোতলায় রূপান্তর করতে যথেষ্ট তাগাদা দিয়েছিলেন তার স্বামীকে। তার স্বামী ব্যবসা করলেও ঘর-সংসারের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না তার। যতদিন বেঁচে থাকা, ততদিন খেয়ে-পরে শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারলেই হলো— এই একটাই নীতি ধারণ করে চলতেন জম্মাদার ভুঁইয়া। কিন্তু হেলেন খানম তা মানেননি। স্বামীর কাছে একপ্রকার জোরালো আবদার করার পরে তার স্বামী ঘরের কাজে হাত দেন। সেই ছোট্ট ছনের তৈরি কুঁড়েঘরটা সুবিশাল কাঠের দোতলায় পরিণত হয় এরপর। জম্মাদার ভুঁইয়া তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন।
এজন্য তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে ভুঁইয়াদের সেই সীমানাটুকুর নাম রেখে দেন— হেলেন কুঠিবাড়ি। দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে সবাই এই নামেই চিনে আসছে ভুঁইয়াদের বাড়িকে। জম্মাদার ভুঁইয়ার মৃত্যুর পরে তার তিন ছেলে মিলে কয়েক শত জমিতে ছয়টা শোবার ঘর, প্রত্যেক ঘরে অ্যাটাচড বাথরুম, ড্রয়িংরুম, ডাইনিংরুম, দু’টো রান্নাঘরসহ একটা বিশাল ইট-সিমেন্টেন একতলা ভবন নির্মাণ করেন। এখন সেখানেই থাকে সবাই পুরো পরিবার নিয়ে। তবে ভবন তৈরি করা হলেও কাঠের দোতলার মায়া কেউ ছাড়তে পারেনি। দুটোতে মিলেমিশে থাকা হয় তাদের। আত্মীয়-মেহমান আসলে এখানেই চলে আসেন তারা।
রাত প্রায় সাড়ে আটটার পরে এখানে এসে পৌঁছেছে সবাই। আসার পরেই বড় ভবনে সবার রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পুরো হেলেন কুঠিবাড়ি মেহমানে ভর্তি। জীম, তাজরীন আর জেসিরা ঘুরে ঘুরে সব দেখছিল। এখনও বিয়ের প্যান্ডেল করা হয়নি। বিয়ের এখনো চারদিন বাকি। এরইমধ্যে খালাশাশুড়ি আয়েশা খাতুনের শ্বশুরবাড়ির দিকের অনেক আত্মীয়রা চলে এসেছেন। এই দুই বাড়ির আশেপাশের এলাকা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। পেছনের দিকে বিশাল বিল, জঙ্গল, ধানক্ষেত। কাঠেরবাড়ির সামনের দিকে বিশাল খোলা উঠোন। পেছনের বামদিকে একটা বড় পুকুর। শানবাঁধানো ঘাট। সেখানে নাকি সবাই গোসল করে। ডানদিকে, আরো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রতিবেশী আর আয়েশা খাতুনের স্বামীর চাচাতো ভাইবোনদের বাড়িঘর।
উঠোনে আমগাছের মাথায় লাঠি বেঁধে লাইটিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে। চেয়ারে বসে আছে অনেকে। মাদুর পেতেও বসেছে উঠোনের মধ্যে। জীমরা ছিল পুকুরের পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে। বারান্দা থেকে দক্ষিণ দিকের খোলা উঠোন বেশ ভালোভাবে চোখে পরে। ওরা এসেছে শুনে আয়েশা খাতুনদের প্রতিবেশী বাড়ির সবাই দেখতে এসেছে৷ আলাপ করছে সবার সাথে৷ জীম দেখলো, তার শ্বশুরবাড়ির মানুষদের এখানে বেশ সমাদার। তার শাশুড়িকে দেখে সবাই ভীষণ খুশি। জীম এদিক-ওদিক তাকালো। শাহবীর এখানে নেই। হাসান, আফিম, শোয়েবসহ সবাইকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে আসা মাত্র৷ তাদের সাথে আরো গিয়েছে খালাশাশুড়ির বড় ননদের বড় ছেলে মাহমুদ, আর ছোট ননদের ছেলেটা৷
মেজো ননদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। তারা এখনো পরিবারসমেত এসে পৌঁছাননি। আসতে দু-একদিন সময় লাগবে। তাজরীন আঙুল দিয়ে গুনে গুনে লোকসংখ্যা হিসাব করছে। পুরো হেলেন কুঠি মেহমান, প্রতিবেশী আর আরো মানুষজন দিয়ে ভর্তি। লোকসংখ্যা শ’খানেক ছাড়াবে মেহমান দিয়ে। ওরা-ই তো বারো জন। ডলি বেগম বোনকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলে এসেছেন, ছোটদের আবদারের কথা। নিশ্চিত হয়ে নিলেন, ওরা সবাই কাঠের দোতলায় থাকবে। আর ডলি বেগম তার বোনের সাথে এই ভবনে। গরম গরম চায়ের সাথে গাওয়া ঘি বিস্কুট খেতে খেতে গ্রামের ছিমছাম রাত উপভোগ করতে লাগলো ওরা।
অবশ্য ছিমছাম বলা যায় না। বাচ্চারা হুড়োহুড়ি করছে। বয়স্করা গল্প জুড়েছে। জীমদেরও একসময় তাদের মাঝখানে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু জীমের মন এখানে নেই। ওর মন পড়ে আছে শাহবীরের কাছে। মানুষটা এতগুলো দিন পরে কাছাকাছি এসেও কেমন যেন দূরে সরে রয়েছে!
তখনই উঠোনের টিমটিমে হলুদ আলোয় দেখা গেল, দূরের মেঠোপথ হতে কবরস্থানের পাশের পথ পেরিয়ে আসছে শাহবীর আর বাকিরা। সবাই বেশ উল্লাসে আছে। শাহবীর আর রুবায়েতের হাতে কতগুলো পলিব্যাগ। তাতে কি যে দেখা যায়।
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৮
ওরা এগিয়ে আসতেই স্পষ্ট বোঝা গেল পলিব্যাগগুলোতে হরেক রকমের চকলেট, চিপস, কোক, স্প্রাইট আরো নানান শুকনো খাবার। শাহবীর, মাহমুদ আর রুবায়েত এসে সব বাচ্চাদের মধ্যে ভাগ করে দিলো। তারপর ইশারায় জীমকে ডাক দিলো শাহবীর। ও আসর ছেড়ে উঠে গিয়ে দাঁড়াতেই শাহবীর কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
“তাজরীন, তহুরা ওদের সবাইকে নিয়ে কুঠিবাড়ির পেছনের দিকের এই বিলে চলে এসো। রাতের রান্না হতে নাকি এখনো ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। তোমাদের জন্য হেব্বি একটা জিনিস এনেছি।”