নক্ষত্রের যাত্রাপথে শেষ পর্ব
ঝিলিক মল্লিক
এভারকেয়ার হসপিটালের দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের কেবিন-রুমটার সামনে ভীড় জমেছে। ডাক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে চিন্তা-মগ্ন হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা শাহবীর রুস্তমকে ডাকলেন। ওদিকে ইউনিফর্ম পরিহিত ওসি নিজাম কথা বলছিলেন ডাক্তার আশরাফ মাহমুদের সাথে। কেসটা পার্সোনালি হ্যান্ডেল করতে চাইছিলেন তারা৷ একারণে নিজে ছুটে এসেছেন হাসপাতালে। ওদিকে একবার দেখে ডাক্তার আহসানের দিকে এগিয়ে গেল রুস্তম। ডাক্তার সামান্য হেসে বললেন,
“কন্ডিশন এখন ভালোর দিকে। এমনিতেও আপনারা যখন এখানে তাকে নিয়ে এসেছিলেন, তখনও খারাপ কন্ডিশন ছিল না। গুলিটা মাংস সামান্য ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। রক্ত অবশ্য গড়িয়েছে বেশ। তবে গুরুতর আঘাত লাগেনি। বলতে হবে, ভাগ্য ভালো ওনার। তাছাড়াও কি কঠিন মানুষ! তার যতটুকু রক্ত ঝরেছে, তাতে একজন সাধারণ মানুষের কমপক্ষে সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ তিনি এখানে এডমিট হওয়ার শুরু থেকেই দিব্যি আছেন। এখনো গিয়ে দেখুন, বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বলছেন, তিনি এখনই রিলিজ নিতে চান। উদ্ভট জেদ!”
ডাক্তার রুস্তমকে কেবিনের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে করিডোর ধরে রিসিপশন হলের দিকে চলে গেলেন। রুস্তম কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করতে যাবে, তখনই পেছন থেকে কতগুলো কণ্ঠস্বর শুনে ঘুরে দেখলো। সবার আগে তাজরীনকে দেখা গেল। দৌড়ে ছুটে আসছে এদিকেই। তার পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছে জীম, জেসি, রিক্তি আর তহুরা। ওদেরকে আফিম, হাসান, শোয়েব, রায়ান আর রুবায়েতের লাগেজগুলো আনতে হয়েছে এই অবধি।
এখন সকাল নয়টা। রুবায়েতকে হসপিটালে আনা হয়েছিল রাত তিনটার দিকে। পুরোটা রাত এখানেই ছিল সবাই। ভোরের দিকে রুস্তমের পরামর্শে কুঠিবাড়িতে ফিরেছিল জেসি, তহুরা আর রিক্তি। রুস্তমের শিখিয়ে দেওয়া কথা এবং কাজগুলো-ই করেছে সম্ভবত। একারণে যেই ঝামেলার আশংকা করেছিল, সেটার সম্মুখীন আর হতে হবে বলে মনে হচ্ছে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শাহবীর করিডোরের শেষ মাথায় দাঁড়িয়েছিল। জীম দৌড়ে গিয়ে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা ওকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো হু হু করে কেঁদে দিলো। শাহবীর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, সবাই ওদের দিকেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ একজন স্ত্রী তার স্বামীকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। ব্যাপারটাকে এতোটা ঘটা করে নেওয়ার কী আছে? আর এভাবে দেখতেই বা হবে কেন? সবার এহেন উৎসুক দৃষ্টি শাহবীরের পছন্দ হলো না। শাহবীর জীমের পিঠে দুই হাত রেখে ওকে ঘুরিয়ে করিডোরের ওপাশে ফাঁকা সিঁড়ির দেয়ালের দিকটায় নিয়ে গেল। জীম তখনও কাঁদছে, ফোঁপাচ্ছে। কিছুক্ষণ ওর মাথা চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে মিশিয়ে রাখলো। তারপর আস্তে-ধীরে যখন কান্নার তোড় স্তিমিত হলো, তখন মাথাটা তুলে নিজের মুখ বরাবর রাখলো৷ জীমকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, খাওয়া-দাওয়া হয়নি, ঘুমও এড়ানো হয়েছে। জীম শাহবীরের আর্মি শার্টের হাতায় নাক ঘষে তারপর নাক টানতে টানতে ভাঙা গলায় বললো,
“ভেবেছিলাম আপনি . . আপনি আর. . .”
“কী ভেবেছিলে?”
জীমকে থামিয়ে দিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে পাল্টা প্রশ্ন করে শাহবীর। সঙ্গে সঙ্গে জীম দুইপাশে দ্রুত মাথা নেড়ে বললো,
“না। কিছু ভাবিনি আমি। সবটা ভ্রম ছিল৷ আর না-তো কিছু ভাবতে চাইছি। ভ্রম তার সীমানাতেই থাকুক।”
ওপাশে তখন হাঁটাচলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকটাতে সিঁড়ির নিচের গেটটা তালাবদ্ধ থাকায় সাধারণত কেউ আসে না। শাহবীর এবার দেয়ালের একপাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো, কেউ এদিকে আসছে কিনা। কেউ আসছে না দেখে ঘুরে দাঁড়ায় জীমের সামনে৷ সিঁড়ি সংযুক্ত দেয়ালে গিয়ে পিঠ ঠেকে জীমের। জীম ভাবে, শাহবীর হয়তো এখন ওর ঠোঁটে, কপালে, থুতনিতে না-হয় গালে চুমু খেয়ে বসবে। কিন্তু ওর ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে শাহবীর হঠাৎ এক হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে ওর সামনে। মুখটা গিয়ে ঠেকলো জীমের পেট বরাবর। শাড়ির আঁচলে আবৃত ওর পেটের দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শাহবীর। জীম কোনো কথা বলছে না। নিরিখ করে সবটা দেখছে। শাহবীরের প্রতিটি প্রতিক্রিয়া, কন্ঠনালীতে ঢোক গিলে নেওয়ার স্পষ্টতা, শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যাওয়া- সবটা। কাঁপা কাঁপা হাতে শাড়ির আঁচল আলতো করে খানিকটা সরিয়ে দিলো শাহবীর। জীম এবার চোখ বুঁজে ফেললো ইচ্ছাকৃত। শাহবীর ওর মুখপানে চায় না। ওর সুক্ষ্ম, সরু দৃষ্টি এখন তার গৃহিণীর ভেতরকার ছোট্ট অস্তিত্বের দিকে। মসৃণ চামড়ার ওপর থেকে কিছুই বোঝা যায় না। অথচ শাহবীর এমনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন সবকিছু দেখতে পাচ্ছে স্পষ্টভাবে। জীমের অস্বস্তি হচ্ছে। কেউ যদি চলে আসে এখানে, এভাবে এমতাবস্থায় দেখে নেয় ওদের! তাহলে শাহবীরের লজ্জায় নূন্যতম ভাটা না পড়লেও শরমে মুখ লুকোতে হবে জীমকে। জীম সরতেই যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ওর পেটের কাছটা দুই হাতে আলতোভাবে চেপে ধরে শাহবীর। মুখ এগিয়ে নিয়ে শক্ত একটা চুমু খায় পেটের মাঝ বরাবর। পরপর নরম ঠোঁট আরো কয়েকবার ছুঁইয়ে দেয়। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে,
“ছোট্ট সোনা আমার, তোমার সাথে প্রথম সাক্ষাতে কোনো উপহার আনতে পারিনি আমি। কী করবো বলো? পরিস্থিতি-ই যে এমন। অথচ, সবকিছু সুন্দর, ভিন্নরকমও হতে পারতো। মাফ করো তোমার বাবাকে। তোমার মা-তো এখনো বোধহয় রেগে আছেন আমার ওপর। তোমার আগমনের উছিলায় যদি একটু. . .”
জীমের মুখের দিকে চেয়ে পুরো কথা শেষ করতে পারলো না শাহবীর। তার আগেই অগ্নি দৃষ্টিতে ওর দিকে চায় জীম। পরমুহূর্তে নিচু হয়ে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে আধ-বসা হয়ে থাকা শাহবীরের শার্টের কলার ধরে টেনে দাঁড় করায় মুখোমুখি। যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত সে৷ শাহবীর বুঝতে পারে। ইতিমধ্যেই একদফা যুদ্ধ করে এসেছে জান বাঁচিয়ে। জীম মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই শাহবীর ওর গাল চেপে ধরে নরম ওষ্ঠদ্বয় পোড়ো ঠোঁটের মাঝে মিশিয়ে নেয়। জীম নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে লাগলো। শাহবীর এবার গাল হতে হাত সরিয়ে কোমর জাপ্টে ধরে বললো,
“প্লিজ হবু বাচ্চার মা– · আর ঝামেলা, যুদ্ধ করতে চেয়ো না দয়া করে। মাত্র একটা যুদ্ধ সামাল দিয়ে আসলাম। এখন আবার তোমাকে সামাল দিতে গেলে বিপি বেড়ে যাবে আমার। এরপর হার্ট-অ্যাটাকও আসতে পারে। আর হার্ট-অ্যাটাক হলে আইসিইউ, লাইফ-সাপোর্ট– · এতে কিন্তু আমাদের বাবুর-ই কষ্ট হবে। ভেবে দেখো!”
জীম আসলেই ভাবনায় পরলো। শাহবীরের সতর্কবাণী শুনে দুই মিনিট চিন্তাভাবনা করে শাহবীরকে আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আপনি গতকাল যা যা বলেছেন, প্রতিটা কথায় আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। বোঝেন আপনি? একজন সহধর্মিণীর আবেগ-অনুভূতি আর যন্ত্রণা বোঝার সক্ষমতা বাদে রব আপনাকে সকল গুণ দিয়েছেন মা শা আল্লাহ! এখন তো আমি সন্তানসম্ভাবা। আমাদের,· আপনার-আমার বাবু আসছে। বুঝতে পারছেন তো শাহবীর? এবার থেকে অন্ততঃ নিজের জানের পরোয়া করতে শিখুন একটু। আমার জন্য না–হোক · অন্ততঃ আমাদের বাচ্চাটার জন্য করুন!”
শাহবীর দেখলো, সিলভি এই বুঝি আবার কেঁদে ফেলবে। দ্রুত কাছে এগোলো ও। সামাল দিলো। দীর্ঘক্ষণ পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম সুরে বললো,
“রাখবো তোমার কথা। আমাদের বাবুর জন্য, আর তোমার জন্যও। এবার তোমাকে আমি একা ছাড়বো না। প্রমিজ। রাজশাহীতে ফিরে যাওয়ার কয়েকদিন পরে তোমাকে আর মা’কে আমার সাথে কোয়ার্টারর নিয়ে যাব। একটু সময় দাও আমাকে, আর একটু ভালোবাসা দিও; তোমাকে এ-জীবনে কখনো ছাড়বো না। কসম রবের নামে।”
শোয়েব আর রায়ান কেবিনের সামনের চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথা এলিয়ে বসে আছে। ওরা ভীষণ ক্লান্ত। রিক্তি আর জেসি আবারও হাসানের সাথে নিচে গিয়েছে ওদের লাগেজগুলো মাইক্রোবাসে তুলতে, হসপিটালের বাইরে। হাসান আর আফিম পরামর্শ করে ইতিমধ্যেই একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করেছে স্থানীয় এক ব্যক্তির সাথে আলাপ করে। মাইক্রোবাসেই সোজা ঢাকায় ফিরবে ওরা। ঢাকায় ফিরে বাকিটা দেখা যাবে। তহুরা চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে আফিমের সামনে৷ ওর পাশে তাজরীন৷ তাজরীনকে ভীষণ উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে চঞ্চল মেয়েটা একদম চুপচাপ। বোবা হয়ে আছে যেন। করিডোরের এপাশ ঘিরে নিরবতা৷ আফিম-ই সেই নিরবতা কাটিয়ে তহুরাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো,
“কুঠিবাড়িতে কেউ কিছু বুঝতে পারেনি? কোনো প্রশ্ন করেনি?”
তহুরা জবাব দেয়,
“বিয়েবাড়ি প্রায় ফাঁকা-ই হয়ে গেছে বলা যায়। প্রায় সবাই চলে গেছে। তেমন শোরগোল নেই। সবাইকে বিদায় দেওয়ার চক্করে আমাদের কথা ওদের সবার মাথা থেকে আউট-ই হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। তাছাড়াও তাজরীনরা ওদিকটা সামাল দিয়েছে রাতে। ওদেরকে বলেছিল, আমরা সবাই মিলে আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখতে গিয়েছি। রাত বারোটার আগেই ফিরে আসবো। এরপর আর কেউ খোঁজ-খবর নেয়নি। ঘুমিয়ে পরেছিল সবাই। ওরা ভেবেছিল, আমরা রাতেই ফিরেছি। তাই, সকালে আমরা যখন বাসার পেছন থেকে ঢুকে সব লাগেজ নিয়ে বের হচ্ছিলাম, তখন ওরা মনে করেছে, আমরা এখান থেকেই যাচ্ছি। তোমাদের কথা জিজ্ঞাসা করায় বলেছি, তোমরা মেইন রোডে আছো। তোমাদের লাগেজগুলো আমাদেরকে নিয়ে যেতে বলেছো। তোমাদের লাগেজগুলো নিয়ে নামার সময়ে প্রশ্ন করেছিল তাজরীনের মা আর খালামণি। আমরা জবাব দেওয়ায় যে খু্ব একটা বিশ্বাস করেছে, তা অবশ্য মনে হয়নি তাদের চেহারা দেখে। আমি বলেছি, আমাদের অফিসের ইমার্জেন্সি কাজ পড়ে গেছে। তাই ইমিডিয়েটলি, সবারই ফিরতে হবে।তাজরীন, জীম, রুস্তম স্যার আর আন্টি আলাদা ফিরবে। আমরা আগেই যাবো। জীম আর তাজরীনকে নিয়ে আসলাম ক্যাপ্টেনের দোহাই দিয়ে। ওরা জানে, ক্যাপ্টেন, জীম আর তাজরীন আমাদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে ফিরবে। এসব ইন্সিডেন্টের ব্যাপারে নূন্যতম কিছু জানাইনি ওদের। তবে আমাদের কথায় যে কিছুটা জটিলতা ওদের মনে তৈরি হয়েছে— এটুকু শিওর। কারণ, এরকম হুটহাট মেজবান বাড়ি থেকে চলে আসা কোথাও সহজে ঘটে না। ওরা বেশ আফসোসও করছিল, তোমরা যাওয়ার সময়ে দেখা করলে না তাদের সাথে। তবে এসবে কিছু যায় আসে না। আমরা যেই কাজে এসেছিলাম৷ সেটা কমপ্লিট হয়েছে; ব্যস!”
আফিম কিছুটা হতাশ হলো। সবাই বিশ্বাস করেনি, ওদের এহেন আচরণে কিছুটা মনঃক্ষুণ্নও হয়েছে — এই ভেবে। কিন্তু কিছু করার নেই এমন সময়ে। পরিস্থিতি জটিল। এখন কোনোভাবেই রুবায়েততে হসপিটালে ফেলে রেখে কেউ হাটহাজারী যেতো পারবে না। এজন্য জেসি, তহুরা আর রিক্তিকে ওরা আলোচনা করে ভোরেই কুঠিবাড়িতে পাঠিয়েছিল নিজেদের লাগেজ আনতে আর জীম ও তাজরীনকে পুরো ঘটনা ভালোভাবে বুঝিয়ে ম্যানেজ করতে। বাদবাকি কেউ যেন কিছু না জানে। সবকিছু হয়েছেও পরিকল্পনামাফিক। আজ-ই ওরা রুবায়েতকে নিয়ে ঢাকা ফিরবে। আর এদিকে রুস্তম তার পরিবারকে নিয়ে বিকালে রাজশাহীতে ফিরবে। কিন্তু কোথাও গিয়ে কেমন যেন একটা ফাঁড়া রয়ে যায়। আফিমের মনে হলো, ওরা এতগুলো মানুষের আবেগ নিয়ে এভাবে না খেললেও পারতো। আর যদিওবা এসব করেই ফেলেছে, তবু যাওয়ার আগে অন্ততঃ সবাইকে জানিয়ে আসা উচিত ছিল। যত যাইহোক, এতগুলো দিন ওই মানুষগুলোর ছত্রছায়া দারুণ একটা সময় কাটিয়েছে ওরা। এমন অকৃতজ্ঞ না হলেও পারতো। মনের কথা মনেই ধামাচাপা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হলো। রুস্তম ওপাশে। ফিরলেই সবাই কেবিনে ঢুকবে রুবায়েতকে দেখতে। তাজরীন তখনও স্থির দাঁড়িয়ে। আনমনে তাকিয়ে আছে বদ্ধ কেবিন রুমের দিকে। তহুরা ওকে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে দাঁড়াতেই আফিম তহুরাকে টেনে একপাশে নিয়ে এসে দাঁড় করায়। তহুরা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ওর চোখের দিকে। আফিম চোখ বুঁজে লম্বা শ্বাস টেনে শান্ত হয়ে তহুরাকে সরাসরি বলে বসে,
“এখান থেকে ফেরার পর তোর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। তুই জাস্ট বিয়েতে হ্যাঁ বলবি। বাকিটা আমি দেখে নেবো।”
তহুরা বেঁকে বসলো। জবাব দিলো,
“অসম্ভব! কোনোমতেই না। তোমার মতো প্লে-বয়কে আমি বিয়ে করবো না।”
আফিম হাসপাতালে সিনক্রিয়েট করতে চাইছিল না। তাই উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“দেখা যাবে।”
পরপরই রুস্তমকে ডাকতে চলে গেল। তহুরা তখনও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর যাওয়ার দিকে। ছেলেটা নাছোড়বান্দা!
রুবায়েত বেডের স্ট্যান্ডে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। সবাই ওর সামনে দাঁড়িয়ে। রুস্তম বসেছিল সবার সামনে চেয়ারে। রুবায়েতের সাথে কথাবার্তা বলে নিচ্ছিল, এখানে এডমিট থাকবে কিনা কিছুদিন; নাকি ঢাকায় ফিরবে। রুবায়েত সোজাসাপ্টা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ঢাকায় নিজ বাসায় ফিরতে চায়। তাকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় যেতেই হবে। এখানে আর অতিরিক্ত একটা দিনও সময় নষ্ট করা যাবে না। তাছাড়াও তার পায়ে আহামরি কিছু হয়নি। গুলিটাও ঠিকঠাকমতো লাগেনি। ওপরের চামড়া ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। আর সন্ত্রাসীদের সবাইকে পুলিশের হাতে সোর্পদ করা হয়েছে। সুতরাং, এখানে আর কোনো কাজ নেই।
একে একে সবাই এগিয়ে গিয়ে রুবায়েতের সাথে কথা বলতে লাগলো, ওর হালচাল জিজ্ঞাসা করলো। তাজরীন কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। রুবায়েত ওকে দেখলো দূর থেকেই। একপলক দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। তাজরীন আর সইতে পারলো না। এবার ভেতরে প্রবেশ করলো। সবার মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে এবার ভালোভাবে দেখলো রুবায়েতকে। লোকটা আহত পা নিয়েও দিব্যি নিজস্ব সেই দাম্ভিক, আত্ম-অহমিকার সহিত মুখ করে বসে আছে। একবারের জন্যও দেখছে না তাজরীনকে। নার্স এসে একটা ইনজেকশন পুশ করে গেলেন। এখনও ঘন্টা তিনেক পরে এখান থেকে রিলিজ নিয়ে বের হবে। ততক্ষণ রুবায়েতকে বেড রেস্টে-ই থাকতে হবে৷ একে একে সবাই কথা বলা শেষ করে বের হলো কেবিন থেকে৷ তাজরীন তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। জীম ওকে বের হওয়ার জন্য তাড়া দিয়ে নিজে বের হয়ে গেল। এখন কেবিন পুরো ফাঁকা। রুবায়েত চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। তাজরীন একবার ভাবলো, এগিয়ে গিয়ে কথা বলবে। কিন্তু লোকটার অহমিকা-ভাব দেখে আর এগোলো না। সবার সাথে হেসে হেসেই কথা বলছিল। তাজরীনকে এড়িয়ে গেল! তাজরীন বেরিয়ে আসতে যাবে, তখনই আবার কেবিনে শোয়েব, রায়ান আর হাসানরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে রুবায়েতকে ডেকে কথা বলতে শুরু করলো। বিরক্ত হয়ে তাজরীন সরে আসবে তখনই রুবায়েতের ফোনটা চোখে পরলো কেবিনেটের ওপর। ফোনে কেউ সম্ভবত কল দিয়েছে। দূর থেকে দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। সাইলেন্ট করে রাখা৷ তাই রিং বাজছে না। তাজরীন দেখলো, বেডের সামনে রুবায়েতকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হট্টগোল করছে সবাই। ফোনটা কি মনে করে যেন হাতে তুলে নিলো ও।
ফোন স্ক্রিনে কলদাতার নামটা দেখলো৷ “আসমা”- লিখে পাশে রেড হার্ট ইমোজি দেওয়া। এই নামটাতেই চোখ আটকে গেল তাজরীনের। কিছুটা অদ্ভুত লাগলো রুবায়েতের ফোনে একজন মেয়েমানুষের নাম এভাবে সেভ করে রাখা দেখে। একবার ভাবলো রুবায়েতকে ফোনটা দেবে। বলবে, আপনার কল এসেছে। রিসিভ করে কথা বলুন।
কিন্তু পরমুহূর্তেই মন পাল্টে গেল তাজরীনের। কি যেন হলো ওর। কল তখন প্রথমবার কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বার আবার দেওয়া হয়েছে। তাজরীন দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে কেবিনের বাইরে চলে এলো। কল রিসিভ করে কানে চেপে ধরতেই ফোনের অপর পাশ থেকে একটা বাচ্চা ছেলের কণ্ঠস্বর শোনা গেল – · “ওপ্পা তুমি কোথায় আচো? বুলো আমাকে। আমি যাবো তুমাল কাছে। ওপ্পা, কুথা বুলছো না কেন?”
আধো আধো স্পষ্ট-অস্পষ্টতা মেশানো বুলি। চমকে উঠলো তাজরীন। কে এই বাচ্চাটা? রুবায়েতের কী হয়? ‘ও অপ্পা’ বলছে কেন? এটা আবার কেমন ডাক? কথা অস্পষ্ট। তাজরীন ঠিক বুঝতে পারছে না এর মানে। তাই এবার হালকা কেশে জিজ্ঞাসা করে,
“হ্যালো কে বলছেন?”
ফোনের ওপাশ থেকে বাচ্চাটা বলে,
“আমি ফুনের মালিকের বাচ্চা বুলছি। আমার ওপ্পা কুথায়? তাকে ফুন দাও। কুথা বুলবো।”
“ওপ্পা মানে কী? তুমি কী বলতে চাইছো? পাপা?”
তাজরীন ধুকপুক করতে থাকা হৃদস্পন্দনের সাথে প্রশ্নটা করতেই এবার চঞ্চল কন্ঠে স্পষ্টভাবে বাচ্চা ছেলেটা জবাব দেয়,
“হ্যাঁ। আমাল পাপা। আমাল পাপার ছাথে কুথা বুলবো। তুমি কে?”
তাজরীনের হাত-পা তখন অবশ হয়ে গেছে৷ নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। রুবায়েত বিবাহিত! তার ছেলে সন্তানও আছে! আস্তে করে ঢোক গিলে নেয় তাজরীন। ধীর স্বরে কোনোরকমে শক্তি সঞ্চার করে জবাব দেয়,
“আমি এক আন্টি বলছি।”
সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ওপাশ থেকে অস্থির কন্ঠে বাচ্চাটা জবাব দিয়ে বসে,
“স্লামালেকুম আন্টি। আমাল পাপা বুলে, আংকেল-আন্টিদের ছাথে কুথা বুললে তাদেল ছালাম দিতে। ছালাম হয়চি আন্টি?”
তাজরীন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,
“তোমার পাপার কাছে ফোন দিচ্ছি। কথা বলো।”
তাজরীন সোজা কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। রুবায়েত তখনও হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলছিল। তাজরীন সবাইকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে সোজা রুবায়েতের সামনে দাঁড়ালো। ফোনটা ওর দিকে এগিয়ে ধরে বিমূঢ়ভাবে স্থির তাকিয়ে থেকে বললো,
“আপনার ছেলে কল দিয়ে খুঁজছে আপনাকে। কথা বলুন।”
রুবায়েত কয়েক মুহূর্ত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে তাজরীনের দিকে। তারপর ফোনটা টেনে কানে নিয়ে বলতে শুরু করে,
“হ্যাঁ সোনা, এইতো পাপা আসছে আজ-ই। তোমার জন্য কী আনতে হবে? অবশ্যই চকলেট বাদে অপশন দিবে।”
তাজরীন আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না এখানে। বের হওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখনই শুনতে পায়, জেসি, রিক্তি ওরা বলাবলি করছে,
“কে কল করেছে রুবায়েত ভাই? তিতান? এবার কিন্তু ওর সাথে দেখা করাবেন। সেই কবে দেখেছি। দেখতে দেখতে বাচ্চাটার পাঁচ বছর হয়ে গেল। কতোদিন হলো দেখি না!”
পাঁচ বছর! তাজরীন দৌড় দিলো কেবিন রুম থেকে। বাইরে বেরোতেই দেখে, ওর বড়ভাই চেয়ারে বসে ফোনে কথা বলছিল কারো সাথে। তাজরীন এগিয়ে যায় সেদিকে। ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওকে দেখেই ফোনটা কান থেকে সরালো রুস্তম। জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে?
তাজরীন বললো,
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ৩২
“ভাইয়া, একটা প্রশ্ন ছিল।”
“বল।”
“রুবায়েত কী বিবাহিত? তার কি ছেলেও আছে? আসলেই?!”
“হ্যাঁ, কিন্তু. . .”
তাজরীন আর কোনো কিন্তু-টিন্তু শুনলো না। যা শোনা দরকার, শোনা হয়ে গেছে ওর। এক দৌড়ে করিডোরের বাইরে চলে এলো ও। বসন্ত কখনো আসবে না। এদিকে তাজরীন কাউকে না জানিয়েই এশরাককে জানিয়ে দিয়েছে, সে বিয়েটা করবে না। অর্থাৎ, তাজরীন এশরাকের সাথে বিয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইতিমধ্যে। অথচ, বসন্ত ওকে আবারও নিরাশ করলো! বসন্তের আগমন অশুভ!