না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ১০
মাইশা জান্নাত নূরা
সারফারাজ পিহুকে নিয়ে নিজের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই আহাদ উচ্চস্বরে পিহুকে উদ্দেশ্য করে লম্বা সালাম দিলো…..
—”আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ভাবী জি।”
হঠাৎ এমন অপ্রস্তুত ডাক শুনে পিহু চমকে গেলো।সারফারাজ ভ্রু কুঁচকে আহাদের দিকে এমনভাবে তাকালো যেনো মুহূর্তেই ওকে গি*লে খেয়ে ফেলবে। আহাদও ভ্যা*বা-চ্যা*কা খেয়ে মাথা নুইয়ে নিলেও একটু পর পর কৌতূহলী চোখে ওদের দিকে উঁকি মা*র*ছে।
পিহু নিজেকে সামলে নিয়ে বললো…
—“ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইয়া। কিন্তু আমি তো আপনার ভাবী…!”
পিহুর বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই সারফারাজ বললো….
—“ভাবী ডাকটা একদম পছন্দ হয় নি তোমার তাই না প্রিটি-হার্ট? তাহলে বলো তো কি বলে ডাকলে তোমার মন খুশি হবে? ওরা ঠিক সেই নামেই ডাকবে।”
পিহু চোখের আকৃতি ছোট করে তাকালো সারফারাজের দিকে। পিহুর চোখে নিজের তীক্ষ্ণ নজরখানা বুলিয়ে সারফারাজ ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে বললো…
—“বুঝে গিয়েছি। আমি তোমার চোখের দিকে তাকালেই তোমার মনের সব কথা পড়ে ফেলতে পারি প্রিটিহার্ট।”
সারফারাজ কপাল কুঁচকে আহাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো….
—“শোনো আহাদ! আজ থেকে তুমি সহ সবাই আমার হবু বউকে চাচী বলে ডাকবে। কনফার্ম!”
আহাদ চোখ বড় বড় করে বললো….
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
—“কি বললেন বস? চাচীইই…!”
সারফারাজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিহু ওর কোমরে হাত রেখে চোখ মুখ কুঁ*চ*কে বললো….
—“আমাকে কোন এঙ্গেল থেকে চাচীর মতো দেখায় হ্যাঁ? আপনার কি এখানে দাঁড়িয়ে মশকরা করার জায়গা কম পড়ে গিয়েছে?”
সারফারাজ ওর ঠোঁটের কোণে দু*ষ্টু হাসি টেনে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো…..
—“আরে, ওদের মুখে তোকে ভাবী বলে ডাকাটা আমার কেমন পোষাচ্ছিলো না। তাই ফাইনালি ডিসিশন চেইঞ্জ করলাম। বয়সটা এখানে মেটার করছে না তাই। এখন থেকে তুমি হলে ওদের সবার প্রিয় আর সম্মানীয় চাচী জি। আর আহাদ সহ বাকিদের আজ থেকে ভাইয়া নয় আব্বা বলে ডাকবে তুমি। ঠিক যেমন নিজের বোন-ভাইয়ের পুতেদের আদর করে বাপজান, আব্বা বলে ডাকা হয় তেমন। বুঝেছো প্রিটি হার্ট!”
পিহু সারফারাজের উপর থেকে চোখ সরিয়ে মুখ হালকা বাঁ*কালো। সারফারাজ আহাদের দিকে তাকিয়ে বললো….
—“তুমি অন্য গাড়ি করে চলে এসো। আমি আমার হবু বউ মানে তোমাদের চাচীকে নিয়ে যাচ্ছি।”
আহাদ ওর মাথার পিছনে চুলকাতে চুলকাতে বললো…..
—“মানে বস, আপনাকে কি তাহলে আজ থেকে চাচা বলে ডাকবো আমরা?”
সারফারাজ বললো….
—“আবার জিগায়? আমার হবু বউকে চাচী বললে আমাকেও তো চাচা বলেই ডাকতেই হবে। বুঝছো ভাতিজা?”
আহাদ দাঁত বের করে হেসে বললো….
—“জ্বি বস, থুক্কু চাচা। পুরোপুরি বুঝতে পারছি।”
সারফারাজ এবার পিহুর জন্য ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটা খুলে দিলো। পিহু সেখানে উঠে বসলো। সারফারাজ বললো…..
—“চাচা ডাকটা শুনতে কেমন যেনো ভালোই লাগছে! আসলে আমার কোনো বড় ভাই নেই তো। যে দু’জন আছে তারা আমার বয়সে ছোট। তাদের ল্য*দা-পু*দে*রা তো আমায় বড় বাবা বা জ্যেষ্ঠা বলে ডাকবে আর তোমাকে বলবে বড় মা বা জ্যেষ্ঠী বলে ডাকবে। চাচা-চাচী ডাকার সুযোগ তো আমরা কেউ পাবে না। তাই এই দায়িত্ব আমি আমার নতুন পাতানো ভাতিজাদের উপরেই দিলাম!”
পিহু বি*র*ক্তি*তে নাক ছি*ট*কে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। সারফারাজ হাসতে হাসতে দরজা বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো।
গাড়ি স্টার্ট হতেই আহাদ দম ফেলে হাত দু’টো মাথার উপর রাখলো। গাড়ি দূরে চলে যেতেই আহাদ বিড়বিড় করে বললো….
—“হায়রে, চাচীকে নিয়ে চাচা দেখছি বহুত পজেসিভ। চাচী আমায় ভাইয়া বলে ডাকলো এতেই চাচা তো জেলাসের আ*গু*নে পু*ড়*ছি*লো। কারন ভাইয়া ক্যন বি ছাইয়্যা ছাইয়্যা।”
পরপরই আহাদ একটু থেমে নিজের মাথায় নিজেই চা*প*ড় মে*রে বললো…..
—“উফহহহ আহাদ মিয়া! বস যদি তোমার এই ওভার থিংকিং ডায়লগগুলো শুনে ফেলতেন তাহলে তোকে এতোক্ষণে নিশ্চিত গলা পর্যন্ত মাটির নিচে গেঁড়ে ফেলতেন! এমনিতেও তখন চাচীকে সালাম দিলাম ভাবী বলে ডাকলাম জন্য বস যেই চাহুনি নিয়ে তাকাইছিলেন! আল্লাহ বাঁচাইছে আজকে।”
এই বলে আহাদ নিজের চুল টে*নে ধরে গলির মতো এই রাস্তাটা হেঁটে হেঁটে অতিক্রম করতে শুরু করলো। আজ কোনো বডিগার্ড আসে নি সারফারাজের সাথে। নিজের পারসোনাল গাড়িটা নিয়ে আহাদের সাথে এসেছিলো এখানে। তাই আহাদকে সারফারাজের কথানুযায়ী অন্য কোনো গাড়ি করেই নিজ গন্তব্যে ফিরতে হবে।
সন্ধ্যাবেলা….
খান ভিলার বিশাল ড্রয়িংরুমে উঁচু ছাদের সাথে ঝুলানো ক্রিস্টালের ঝাড়বাতির আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে বসানল সোফাসেটে বসে আছেন খান পরিবারের প্রধান কর্তা মোস্তফা খান। বয়স তার যথেষ্ট হয়েছে। ৭০এর এপাশ-ওপাশ। মোস্তফার চোখেমুখে এখনো দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে থাকতে দেখা যায়। টকটকে ফর্সা শরীরের রং তার। চামড়াগুলো কুঁ*চ*কে এসেছে অনেকটা বয়সের ভারে। মুখভর্তি ধবধবে সাদা চাপ দাঁড়ি। যা দৈর্ঘে মোস্তফার পেট পর্যন্ত ছুঁয়ে নিয়েছে প্রায়৷ তার পরনে রয়েছে সাদা রংয়ের পাঞ্জাবি-পায়জামা। ডান হাতের তলপিঠ দ্বারা লাঠিটা ধরে রেখেছে। যার সাহায্যে চলা-ফেরা করা মোস্তফার জন্য কিছুটা সহজ হয়।
ডানপাশে বসে আছে মোস্তফার বড় ছেলে জামাল খানের স্ত্রী তাহমিনা খান৷ তাহমিনার বয়স ৪৫ পেরিয়েছে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে জামালের সাথে পারিবারীক ভাবেই তাহমিনার বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়েছিলো। ১৭ বছর বয়সে তিনি ১ম পুত্র সন্তানের জননী হন। খুব আদর করে নাম রাখেন সারফারাজ ইউসুফ খান। ২০ বছর বয়সে ২য় পুত্র সন্তান এর জন্ম দেন তাহমিনা। তার নাম রাখেন তেজওয়ার খান। আদর করে সবাই তেজওয়ারকে তেজ বলেই ডাকে। তাহমিনা এই খান বাড়িকে খুবই আপন করে নিয়েছেন। নিজের মতো করে সংসারটা সামলান তিনি। মাঝেমধ্যে উপরে উপরে হালকা কঠোরতা দেখালেও ভিতর থেকে তাহমিনা অনেক আন্তরিক স্বভাবের।
তাহমিনার পাশেই বসে আছেন মোস্তফার মেজো পুত্রবধূ শিউলি। শিউলির পুরো মুখ জুড়ে ভিষণ মায়া মাখানো। বয়স ৪২ হবে। ১৭ বছর বয়সে মোস্তফা খানের মেজো পুত্র জায়েদের সাথে আতুশির পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয়। বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছেন প্রায় ২৫ বছর হলো। বিয়ের ১ বছরের মাথায় ১ পুত্র সন্তানের জন্ম দেন শিউলি৷ নাম রাখেন নির্ঝর খান। এরপর অনেক চেষ্টা করেছিলেন আবারও সন্তান নেওয়ার জন্য। কিন্তু শারিরীক কিছু সমস্যার জন্য পারেন নি নিতে। শিউলি ভিষণই সহজ-সরল স্বভাবের। মনে কোনো প্যঁ*চ নেই বললেই চলে। বড় জা’কে অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করে সবসময়।
অন্যপাশে বসে আছেন মোস্তফার ছোট পুত্রবধু আতুশি। সে সবসময় প্রাণবন্ত ভাবে চলে। হাসতে ভিষণ ভালোবাসে আতুশি। আতুশির বয়স এখনও ৪০ এর ঘর ছোঁয় নি। মোস্তফা খানের ছোট পুত্র জাবিরের সাথে রিলেশন করেই বিয়ে হয় আতুশির প্রায় ২০ বছর হলো। আতুশি ওর বিয়ের প্রায় দেড় বছরের মাথায় ১ কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। নাম রাখেন নীরা খান। বাড়ি জুড়ে কোনো কন্যা সন্তান না থাকায় ও পরিবারের সবথেকে ছোট সদস্য হওয়ায় নীরা ছিলো সবথেকে আদরের।
আতুশি এরপর আরো কয়েকবার কন্সিভ করলেও বাচ্চা আটকে রাখতে ব্য*র্থ হয়েছে। কোনো বাচ্চা ৫ মাস চলাকালীন ন*ষ্ট হয়ে গিয়েছে কোনো বাচ্চা ৮মাসে গিয়েও ন*ষ্ট হয়ে গিয়েছে পেটের ভিতরেই। সেই সময়টাতে আতুশি যেনো হাসতেই ভু*লে গিয়েছিলো। পরিবারের সবাই মিলে বিশেষ করে তাহমিনা ও শিউলির সহায়তায় আতুশি স্বাভাবিক হতে পেরেছিলো আবারও। নিজের পুরোনো প্রাণবন্ত রূপে ফিরেছিলো সে।
আতুশি ও শিউলি কোনো কাজে ভু*ল করলে তাহমিনা ঠিক যেনো মায়ের মতো শা*স*ণ করে তাদের। আর ওরা দু’জনে হাসিমুখে তা গ্রহন করে।
নীরা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে কানাডাতে চলে গিয়েছে প্রায় ২ বছর হলো। কেবল ভিডিও-অডিও কলেই ফ্রী টাইমে পরিবারের সবার সাথে ভালো-মন্দ কথা বলে সে। যখনই বাড়ির সবাই নীরাকে দেশে ফেরার জন্য বলে তখুনি নীরা তাদের সামনে নিজের উজ্জ্বল ক্যরিয়ারকে দাঁড় করায়। মাঝপথে ব্রেক নিয়ে দেশে ফিরলে নীরার অনেক বড় ক্ষ*তি হয়ে যাবে এসব নানান কথা বলে দেশে ফেরার টপিক পরিবর্তন করে দেয়।
আতুশি সবার সামনে হাসিখুশি ভাবে চলাফেরা করলেও নিজের মেয়ের কথা মনে করে ঠিকই আড়ালে দু’চোখ ভিজায়। মা তো! সন্তান দূরে থাকলে কষ্ট হবেই। সে সন্তানের সংখ্যা ১০০ই হোক বা ১জন। একজন মায়ের কাছে তার সকল সন্তান-ই সমান হয়ে থাকে। আদরে, ভালোবাসায়, স্নেহে, শাষনে সর্বক্ষেত্রেই।
জামাল অফিস থেকে এখনও বাসায় ফেরেন নি। তেজ আর নির্ঝর বেড়িয়েছে অনেক্ষণ৷ সারফারাজ তো তিনদিন অতিক্রম হয়ে গিয়েছে খান বাড়ির ছায়া পর্যন্ত মা*রে নি।
জায়েদ ও জাবির ব্যবসার কাজে লন্ডন গিয়েছেন প্রায় ১মাস হলো। মজার বিষয় হলো জায়েদ ও জাবির দু’জনেই জমজ ভাই হওয়ায় তাদের একই রকম চেহারা। আচারণ, পছন্দ-অপছন্দের ও মিল রয়েছে তাদের মধ্যে। লোকে বলে জায়েদকে দেখলে জাবিরকেও দেখা হয়ে যায় তেমনই জাবিরকে দেখলে জায়েদকেও দেখা হয়ে যায় তাদের।
জামাল খান নিজেই জায়েদ-জাবিরের উপর ব্যবসার বড় একটা দায়িত্ব তুলে দিয়ে লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন। লন্ডনের কাজ শেষ হলে জায়েদ-জাবির দু’জনেই আবারও বাংলাদেশ ব্যাক করবেন।
খড়ের তোলা ঘরটার ভিতর একটা ভাঙা কাঠের চৌকির উপর পাতলা শাড়ি যার জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে যাওয়ায় কোনো রকম সুই-সুতোর বাঁধনে বেঁধে চাদর বানিয়ে বিছিয়ে রেখেছেন জমিলা। সেখানেই অচেতন জমিলাকে শুইয়ে রেখেছে অনু। জমিলার মাথার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অঝোর ধারায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে অনু বললো….
—“আম্মা, চোখ মেলে তাকাও না। তোমার অনু কাঁদছে কেমন দেখো একবার চোখ দু’টো মেলো। তুমি তো বলতে কাঁদলে আমায় ছি*চ*কাঁদুনে বাদরের মতো লাগে দেখতে। এখনও বলো না সেভাবে! ও আম্মা! আম্মা গো।”
অরূপের দেওয়া আ*ঘা*ত গুলোর পরিমাণ আজ অনেক বেশি ছিলো। যার ফলে জমিলার ফর্সা শরীরে কেমন কালচে দাগগুলো দেখা যাচ্ছে এখনই। সম্পূর্ণ মুখটাও ফুলে গিয়ে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। অনু দু’হাতে নিজের চোখের পানি মুছে চৌকি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বললো….
—“আমারে জন্ম দিছো পর থেকে এখন পর্যন্ত বহুত কষ্ট পাইছো তুমি আম্মা। তোমার জন্য আমি কেবল কষ্টের-ই কারণ হয়েছি। তোমায় কখনও সুখের ছিঁটেফোটাও এনে দিতে পারি নি। তুমি নিজেকে সর্বদাই একজন যোগ্য মা হিসেবে প্রমাণ করে গিয়েছো আর আমি একজন অযোগ্য সন্তান-ই রয়ে গেলাম। তোমার কষ্ট এবার কমে যাবে আম্মা। আব্বার কথামতো আমি সত্যিই চেয়ারম্যানের মানসিক ভারসাম্যহীন বুড়ো পোলারে বিয়ে করে নিমু। তাহলে এই বসতভিটাটা আর তোমাদের হারাতে হবে না। চেয়ারম্যান নিশ্চয়ই আব্বারে আমার বিনিময়ে মোটা অংকের অর্থও দিতে চেয়েছে। সেই অর্থ গুলো নিয়া আব্বা আব্বার মতো থাকবে। তোমারে অন্তত আর মা*ই*র খাইতে হবে না।”
অনুর কথাগুলো শেষ হতে না হতেই জমিলার জ্ঞান ফিরলো। শারীরির ব্য*থা*য় অনেকটাই কা*বু হয়ে গিয়েছেন তিনি। খুবই ধীর স্বরে ‘পানি পানি’ বলছেন। অনু মায়ের আধো আধো কন্ঠে পানি শব্দটা শুনতে পেয়ে দ্রুত দরজার আড়ালে থাকা মাটির কলসী থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে এসে যত্নের সহিত জমিলাকে খাইয়ে দিলো। অতঃপর বললো….
—“আম্মা! এখন কেমন লাগছে তোমার? খুব বেশি ব্য*থা করছে তাই না?”
জমিলার দু’চোখ দিয়ে নিরবে অশ্রুরা ঝরে পড়ছে। জমিলা বললেন….
—“শারীরিক এই আ*ঘা*ত গুলো এখন আর আমায় য*ন্ত্র*না দিতে পারে না রে মা। এখন আমার মানসিক য*ন্ত্র*ণা হয় অনেক বেশি। চিন্তা হয় তোকে নিয়ে। তোর বাপটা তোর জীবনটা নষ্ট করার জন্য উঠে পরে লাগছে। আমি বাঁইচা থাকতে তা কিছুতেই হইতে দিবো না।”
—“আম্মা, ছাড়ান দাও এবার। একটু ক্লান্ত হও তুমি। আমার জন্য আর কতোকাল লড়বা?”
—“শরীরের শেষ র*ক্ত বিন্দু পড়া পর্যন্ত ল*ড়*বো আমি তোর জন্য। এই বিয়া কিছুতেই হইতে দিমু না।”
—“আমি আব্বারে কইয়া দিছি এই বিয়া করতে আমি রাজি আছি আম্মা। তুমি আর বাঁধ সাইধো না। আমিও এবার চাই তুমি ভালো থাকো। আমার জন্য আর আব্বার কাছে মা*ই*র না খাও। তোমারও তো শখ আছে একটু ভালোভাবে বাঁচার। প্রাণটা খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার।”
অনুর এরূপ কথা শুনে জমিলা রাগে-দুঃখে নিজের মুখ অন্যপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন….
—“যদি তুই এই বিয়া করিস তাহলে মনে করিস এ বাড়ির চৌকাঠ পার হওয়ার আগে তোরে আমার লা*শ দেখতে হইবো।”
অনু দ্রুততার স্বরে বললো….
—“আম্মা, আল্লাহর দোহাই লাগে এমন কথা কইও না তুমি। আমার কলিজাটা বাহির হইয়া আসতে চায় তোমার মুখে এমন ধরণের কথা শুনলে। আমি তোমারে ম*রা মুখ দেখতে পারবো না আম্মা।”
জমিলা মুখ ঘুরালেন পুনরায় অনুর দিকে। ওর চোখে চোখ রেখে বললেন…
—“তাহলে তুই এক্ষণ আমার কসম খা। আর ক আমি যখন যা বলমু কোনো প্রশ্ন ছাড়া কোনো ঝামেলা ছাড়া চুপচাপ তা মাইনা নিবি। খা কসম!”
অনুর দু’চোখ দিয়ে বাঁধাহীন ভাবে অশ্রুরা ঝরে পড়ছে। অনু অসহায় কন্ঠে বললো….
—“আম্মা! কসম না খাইলে হয় না? কখন কি পরিস্থিতি হয় না হয়! আমি তো জানি তুমি আমারে এমন কিছু করতে কইবা যাতে তোমার কোনো ভালা হবো না। আমারে সুখের সাগরে ভাসাইয়া তুমি দুঃখের নদীতে ডুইবা ম*র*বা*র চাও!”
—“বেশি কথা কওয়াইস না আমারে তুই অনু। যা কইতে কইছি তা ক।”
কাঁদতে কাঁদতে হিঁ*চ*কি উঠে গিয়েছে অনুর। অনু কোনোরকমে বললো….
—“খাইলাম তোমার কসম আম্মা। তুমি যা যখন করতে কইবা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করমু। একটা প্রশ্নও করমু না।”
জমিলার বেদনাদায়ক ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
খান ভিলার মূল গেইট দিয়ে নিজের ব্লাক বিএমডব্লিউ গাড়িটা নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো সারফারাজ। পিহুর পাশের জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিয়েছে সে। পিহু অবাক চোখে বাহিরটাতে নজর বুলাচ্ছে। ঝলমলে কৃত্রিম আলোয় ভরপুর চারপাশ। সরু রাস্তার দুপাশ দিয়ে সুপারি ও নারিকেল গাছ লাগানো রয়েছে সারিবদ্ধ ভাবে। গাছ গুলোর একপার্শে ফুলের বাগান রয়েছে। সন্ধ্যার পরের পরিবেশ জন্য খুব একটা ফুটে উঠছে না ফুলের সৌন্দর্য কৃত্রিম এই আলোয়। আর অন্যপাশটায় সেভাবে নজর বুলাতে পারলো না পিহু এপাশে থেকে।
একটু পর সারফারাজ গাড়ির ব্রেক কষলো। পিহু সারফারাজের দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। সারফারাজ নিজের সিটবেল্টটা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পিহুর পার্শে এসে দরজাটা খুলে ওর সামনে হালকা ঝুঁকে ওর দিকে একহাত বাড়িয়ে কিছুটা রাজকীয় ভঙ্গিতে বললো…..
—”আমার মনের রানী বিনা নোটিশে আপনি আমার মনের দরজা ভে*ঙে একেবারে গহীনে ঢুকে বসে আছেন জন্য আজ বিনা নোটিশে আমার রাজপ্রাসাদে আপনাকে নিয়ে এলাম। আমার বাসস্থানটা দেখাতে এবং আমার পরিবারের সদস্যদের সাথে আপনাকে পরিচিত করাতে। এছাড়াও আপনার জন্য বিশেষ একটা সারপ্রাইজও অপেক্ষা করছে। ভিতরে যাওয়ার পর সবার সামনেই পেয়ে যাবেন সেটা।”
সারফারাজের কথায় ও কাজে পিহু যেনো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। পিহু বুকের ভেতরটা ঢি*প-ঢি*প আওয়াজ করছে। পিহু একবার ঢোক গি*লে বললো……
—”আমাকে আপনি আপনার পরিবারের সাথে পরিচিত করাবেন বলে এখানে নিয়ে এসেছেন?”
সারফারাজ বললো….
—”কোনো স*ন্দে*হ ছাড়া এই কঠিন সত্যটাকে বিশ্বাস করে নাও।”
পিহুর গলা কাঁপছে। আটকে আসা স্বরে বললো….
—”তা-তারা আমাকে দেখার পর বিষয়টা নিশ্চয়ই ভালোভাবে নিবেন না এমপি সাহেব। আমি গরীব ঘরের মেয়ে। মা নেই। বাবা থেকেও নেই। মাথার উপর যে ছাদটা আছে সেটাও অনিশ্চয়তায় ঘেরা। এমন একজন মেয়েকে আপনার পাশে তারা মেনে নিতে পা……!”
সারফারাজ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পিহুর চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে বললো……
—”ভিতরে চলো আগে প্রিটিহার্ট। যাদের তুমি এখনও পর্যন্ত চিনো না, জানো না তাদের নিয়ে এমন ধারণা করা ঠিক না।”
—”কিন্তু…!”
—”যদি আমার হাতে হাত রেখে পায়ে হেঁটে এইটুকু রাস্তা যাওয়া তোমার জন্য ক*ষ্ট কর হয়ে যায় তাহলে আমি তোমায় কোলে তুলে ভিতরে নিয়ে যেতে পারি। বলো তুলবো নাকি!”
পিহু তখুনি ঝটফটিয়ে গাড়ি থেকে নিচে নেমে বললো…..
—”না, না। চলুন যাচ্ছি আমি।”
—”আমি তোমার নানা হই না প্রিটি। হবু স্বামী হই। এগাদ বার অন্তত ওগো, কিগো বলেও ডাকতে পারো। পরাণটাতে বাতাস লাগতো।”
—”আপনাকে নানা বলে ডাকি নি আমি। না সূচক জবাব দিয়েছি। ওভার এক্টিং এর ব্যবসাদার নিজের এই বি*ভ*ৎ*স গুণটাকে এখন থেকে কন্ট্রোলে রাখবেন৷ কারণ আপনার মতো মানি-গুণি এমপির সাথে এমন আচারণ যায় না।”
—”এতো কিউট একটা আবদার করলাম তোমার কাছে, কিভাবে করবো খুঁজে না পেয়ে এভাবে করলাম। আর তুমি কি আমাকে ওভার এক্টিং এর ব্যবসাদার বানিয়ে দিলে! ষ্যা*হ। দুনিয়ায় ইমোশনের কোনো দাম নাই। তোমার কথায় আমি ইমোশনালি ড্য*মে*জ হয়ে গেলাম প্রিটি।”
—”এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মাথা-ই খা*বে*ন নাকি ভিতরেও নিয়ে যাবেন! আমায় তো আবার বাড়ি ফিরতে হবে নাকি! মা ও বড় আপার অনুপস্থিতি সময়ে নিয়ে এসেছেন এখানে ভুলে যাবেন না।”
—”এতো চিন্তা করো না। ওরা কোনো উ*ল্টো-পা*ল্টা কাজ করার কথা চিন্তাতেও আনতে গেলে এই এমপি সারফারাজ ইউসুফ খানের থো*ব*রাটা ওদের নিমের গোটার মতো চোখজোড়ার সামনে ঠিকই ভাসবে। তখন ওরা ওদের লিমিট ও বুঝতে পারবে।”
সারফারাজের এরূপ কথায় পিহু ফিঁক করে হেসে ফেলে বললো…..
—”তাই বলে ওদের নিমের গোটার মতো চোখ! সত্যিই?”
সারফারাজও হাসলো মৃদুস্বরে। এরপর পিহুর হাত ধরে খান ভিলার ভিতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো ওরা।
মূল দরজা পেরিয়ে পিহুকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো সারফরাজ। ড্রয়িংরুমে তখনও বসে ছিলেন মোস্তফা, তাহমিনা, শিউলি ও আতুশি। একটু আগেই জামালও অফিস থেকে ফিরেছেন তাই তিনিও উপস্থিত ছিলেন ওদের সবার মাঝে।
সারফারাজকে একজন অপরিচিত মেয়ের হাত ধরে নিজেদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে উপস্থিত সবাই অবাক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালো সারফরাজ পিহুকে নিয়ে। বাকিরাও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সবার সামনে সারফারাজের পাশে মাথাটা হালকা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামলা রঙের, টানা টানা কাজল কালো দু’চোখের অধিকারিনী মেয়েটা যার পরণে রয়েছে গাড় নীল রংয়ের একটা শাড়ি আর সাদা রংয়ের হিজাব তাকে দেখে মোস্তফা খান হালকা কাশি দিয়ে বললেন…..
—“কে এই মেয়ে বড় দাদুভাই?”
সারফারাজ শক্ত ভাবে পিহুর হাতটা ধরে রেখেছে। পিহুর বুকের ভিতরটা অশান্ত হয়ে আছে এই মূহূর্তে।অজস্র চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মন ও মস্তিষ্ক জুড়ে। আজ হয় ওকে এখান থেকে গরীব ঘরের ও শ্যমলা রংয়ের মেয়ে বলে অ*প*মা*নি*ত হতে হবে নয়তো এমন কিছু হবে যা পিহুর কল্পনা শক্তিরও বাহিরে। সারফারাজ ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মোস্তফার উপর স্থির করে দৃঢ় কন্ঠে বললো…..
—“দাদাজান! সে আপনার হবু নাতবউ এই খান বংশের আগামী দিনের ১ম বংশধরের হবু অর্ধাঙ্গিনী। যাকে আপনার বড় নাতী নিজের সর্বস্বটা দিয়ে হলেও নিজের করে পেতে চায়। যাকে সে পা*গ*লে*র মতো ভালোবেসে ফেলেছে। যাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কিংবা অন্য কারোর সাথে জীবন অতিবাহিত করার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না।”
ড্রয়িংরুমে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। পিহুর বুকের ভিতরের ধড়-ফড়ানি ভাবটা বেড়ে গিয়েছে এবার কয়েকগুণ। পিহু ভেবেছিলো সারফারাজ হয়তো আস্তে ধীরে ওর কথা ওর পরিবারের কাছে বলবে। কিন্তু এমন সাহসিকতার পরিচয় সে দিবে তা পিহু ভাবে নি।
জামাল গম্ভীর কন্ঠে বললেন…..
—“তুমি কি ঠিক করে ভেবেছো, সারফারাজ?”
সারফারাজ এবার নিজের বাবা জামালের দিকে তাকিয়ে বললো….
—“জ্বী বাবা। ভাবা-ভাবির কাজটা পিহুকে যেদিন ১ম দেখেছিলাম সেদিনই সেরে ফেলেছি। আপনারা আমার গুরুজন। আমি আপনাদের যথেষ্ট সম্মান করি, ভালোবাসি এবং আপনারাও আমাকে অধিক স্নেহ করেন তাই আপনাদের সাথে নিজের সিদ্ধান্ত শেয়ার করা নিয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যায় করলাম না। আমি চাই যতোদ্রুত সম্ভব পিহুর সাথে আমার বিবাহকার্য সম্পন্ন হোক।”
মোস্তফা খান মৃদু হেসে বললেন…..
—“যদি তুমি সত্যিই পিহু দিদিভাইকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমরা আম-দুধের একে-অপরের সাথে মিশে যাওয়ার পথে বাঁধা হতে চাই না। কথায় আছে না,
‘যাব মিয়া-বিবি দোনো হে রাজি তাব সাদি না কারাকে ওর কেয়া কারেগা কাজী।’
(বঙ্গানুবাদঃ যখন মিয়া-বিবি দু’জনেই থাকেন রাজি তখন বিয়ে না পড়িয়ে কি বা করবে কাজী।)”
তাহমিনা হেসে বললেন…..
—”আমাদের পরিবার সবসময় একে-অপরের সিদ্ধান্তকে সম্মান করে এসেছে। তোমার এই সিদ্ধান্তকেও আমরা সম্মান জানাচ্ছি সারফারাজ।”
পিহু চোখ তুলে তাকালো এবার ওর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিগুলোর দিকে। পিহুর কাছে কেমন যেনো সবকিছুই স্বপ্নের মতো লাগছে। এতো বড়লোক, প্রভাবশালী পরিবার এই খান পরিবার। অথচ এখানে থাকা মানুষগুলো কতো সহজ-সরল! পিহু কোথায় থাকে, ওর পরিবারের অবস্থা কেমন সেসব জানা নিয়ে কারোর মধ্যে কোনো ভাবনাই নেই। যেনো কেবল পিহুকে হলেই তাদের চলবে! এই কঠিন বাস্তবের যুগে এমন একটা পরিবার কি সত্যিই খুঁজে পাওয়া যায়!
শিউলি পিহুর কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওর হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে হাসিমুখে বললেন……
—“পিহু মা, তোমাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গিয়েছে আমার। এতো সরল, এতো ভদ্র মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে পাবো আমরা এই ভেবেই এখন থেকে গর্ববোধ হচ্ছে।”
আতুশিও শিউলির পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুঝে বললেন…
—“সত্যি, আমার বড় বাবার পছন্দ আছে বলতে হবে। কি মায়া ভরা মিষ্টি তোমার মুখখানা পিহু মা!আর সবথেকে বড় কথা কি জানো তুমি! তোমার এই কাজল কালো হরিণের ন্যায় টানা টানা চোখ জোড়ার দিকে কেউ একটু গভীর ভাবে তাকালেই বুঝে যাবে তোমার ভিতরটা কতোটা পরিষ্কার। কতোটা নিষ্পাপ তুমি। আমিও চাই আমাদের এই ঘরটাকে তোমারব আলোয় খুব শীঘ্রই বলোকিত করে তুলতে।”
পিহুর দু’চোখ ইতিমধ্যেই ছলছল করে উঠেছে।
তাহমিনা পিহুর হাতের বামপাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় নিজের আদর মাখানো হাতখানা রেখে বললো…..
—”তুমি হয়তো ভাবছো, আমরা তোমার জাত-পাত, পরিবার-পরিজন কিছুরই খোঁজ নিলাম না তাতেই বলছি তুমিই হবে আমাদের বাড়ির বউ এটা কেমন বিষয় হলো! কিন্তু একটা কথা শুনে রাখো মা, ভালোবাসা কখনও জাত-পাত মানে না। আমার বড় ছেলে সারফারাজ ইউসুফ ওর প্রতি আমাদের সবারই ভরসা, বিশ্বাসের স্থানটা অনেক মজবুত। যা কল্পনাতেও ভেবে উঠাটা সম্ভব হবে না কারোর পক্ষে। সারফারাজ কখনও মুখ ফুটে আমাদের কাছে কোনোকিছু নিয়ে এতোটা জোর গলায় দাবি করে নি। ছোট খাটো ইচ্ছে নিজের জীবনের চলার পথে তুলে ধরেছিলো ঠিকই কিন্তু সেগুলো আর আজকের এই ইচ্ছের মাঝে রাত-দিনের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাই তোমাকে নিয়ে এতো যাচাই-বাছাই করার কোনো প্রয়োজন আমরা মনে করছি না। আজ এইমূহূর্ত থেকে তুমি শুধু সারফারাজেরই না, আমাদেরও সবার প্রিয় হয়ে উঠলে। তোমাকে আমরা আমাদের বাড়ির হবু বউ না হবু মেয়ে হিসেবে গ্রহন করলাম।”
পিহুর দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রুরা ঝরে পড়ছে। গলার ভিতর শব্দরা দলা পেঁকে পেকে আসছে। পিহু কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো……
—“আমি, আমি এতো ভালোবাসা শেষবার পেয়েছিলাম আমার মা বেঁচে থাকতে। এরপর আর কখনো পাই নি। আজ আপনাদের থেকে এতো ভালোবাসা, এতো সম্মান পেয়ে নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে।”
পিহুর মা নেই শোনামাত্র তাহমিনা পিহুকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললেন…..
—”তোমার জন্মদায়িনী মা নেই তো কি হয়েছে! এই বাড়িতে তুমি একটা না দুইটা না তিনটে মা পাবে। এই তিন মায়েরই আদর-ভালোবাসা নিতে হবে তোমায়।”
শিউলি পিহুর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন….
—”আজ এই সুন্দর চোখজোড়া থেকে অশ্রুরা ঝড়ে পড়েছে, আর আজই এর ঝড়ে পড়ার শেষ দিন এটা মনে রেখো। এরপর কেবল ঠোঁটে হাসি ফুটে থাকবে সবসময়। যদি এই কথার অমান্যতা হয়েছে দেখেছি তাহলে পি*ট্টি করে দিবো তোমায়।”
পিহু তাহমিনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হেসে ফেললো। পিহুর হাসিমুখখানা দেখে উপস্থিত সবারই ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
সারফারাজ পাশ থেকে পিহুকে উদ্দেশ্য করে বললো…
—“আজ থেকে কেউ তোমায় কাঁদতে দিবে না প্রিটিহার্ট। আমার পরিবার এখন থেকে তোমারও পরিবার। আমার ঘর কিছুদিন পর তোমারও ঘর হয়ে যাবে।”
পিহু লজ্জা পেলো কিছুটা। জামাল খান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন……
—“যে মেয়ে ছোট থেকে অভাব-কষ্ট আর অবহেলায় বড় হয়েছে! তাকে সুখী করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আর সারফারাজ তোমার দায়িত্ব হবে সবচেয়ে বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ। কখনও যেনো নিজের এই দায়িত্ব থেকে পি*ছু হ*ট*তে চাওয়া না হয়।”
সারফারাজ বললো…..
না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ৯
—“পিহুর নামে আমার জানটা লিখে দিয়েছি আমি বাবা। ওর জন্য নেওয়া দায়িত্বে একচুল পরিমাণও অবহেলা করার কোনো প্রশ্নই আসছে না।”
পিহুর হৃদয়টা আবেগে ভরে গিয়েছে। রঙিন আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে ওর ভিতরটা। এতোগুলো বছর থেকে যেই মায়ের স্নেহ, বাবার ভালোবাসা, একটা হাসিখুশি পরিবারের মাঝে থাকার তৃষ্ণায় পিহু তৃষ্ণার্ত ছিলো আজ এই পরিবারের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা আকস্মিক ভাবে ঝর্ণার মতো ওর উপর বর্ষিত হয়ে ওর সকল তৃষ্ণা মিটিয়ে দিলো যেনো।