না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ১৬
মাইশা জান্নাত নূরা
খান ভিলার ড্রয়িংরুম ঝাড়বাতির ঝলমলে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। সোফায় বসে আছে খান ভিলার সকল সদস্য। সারফারাজের বাবা জামাল গম্ভীর কন্ঠে সারফারাজের ছোট চাচী আতুশিকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—”নীরার সাথে কথা হয়েছিলো তোমার? কবে আসবে বললো সে?”
জামালের প্রশ্ন শুনে প্রথমে আতুশির মুখশ্রী জুড়ে কিছুটা মলিনতার ছাপ স্পষ্ট হলেও পরপই তিনি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললেন….
—”সারফারাজ বাবার বিয়ের কথা শুনে তো নীরা অনেক এক্সাইটেড হয়েছিলো। কতো গল্প ওর। হলুদে, মেহেন্দীতে, বিয়েতে, রিসিপশনের দিন কি কি পড়বে তা নিয়েও কতো কথা বললো। কেনাকাটাও শুরু করে দিয়েছে সে। চলে আসবে কয়েকদিনের ভিতরেই বড় ভাইয়া।”
জামাল খানের স্ত্রী তাহমিনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে আতুশি যে কথাগুলো বানিয়ে বললেন তা এড়াতে পারলো না। তাহমিনা শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেললেন। জামাল বললেন….
—”সপিং কি বাংলাদেশে এসে করা যাবে না? ওকে বলে দিও যেনো ২দিনের মধ্যে আমার সামনে এসে হাজির হয়। নয়তো কিভাবে ওকে আনতে হবে সেটাও আমার খুব ভালো ভাবেই জানা আছে।”
আতুশি মাথা নুইয়ে নিলেন। খান বাড়ির প্রধান কর্তা মোস্তফা খান তার বড় ছেলে জামাল খানকে উদ্দেশ্য করে বললেন…..
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
—”জায়েদ, জাবির কবে আসবে জামাল?”
জামাল বললেন….
—”শুরুতে তো বলেছিলো আরো কয়েকদিন দেড়ি হবে কিন্তু আপনার বড় নাতীর বিয়ের কথা শুনে প্রেসার নিয়ে ৪দিনের কাজ ১দিনে সেরে ফেলেছে ওরা। আগামীকাল রাতের ফ্লাইটেই লন্ডন থেকে রওনা করবে ওরা।”
মোস্তফা হাসিমুখে বললেন….
—”অনেক বছর পর এই বাড়িতে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হবে তাই সবাই অনেক খুশি এ নিয়ে।”
ওদের কথার মাঝেই খান ভিলার মূল দরজা পেরিয়ে সারফারাজ পিহুর হাত ধরে ভিতরে প্রবেশ করলো। ওদের দু‘জনের উপর সর্বপ্রথম নজর পড়লো সারফারাজের মেজো চাচী শিউলির। শিউলি হাসিমুখে বললেন….
—”আরে পিহু মা যে।”
সকলের দৃষ্টি এবার সারফারাজ আর পিহুর উপর পড়লো। পিহুর মুখশ্রী জুড়ে চাপা লজ্জা ও ভ*য়ের ছাপ ফুটে আছে। কিন্তু সারফারাজ পিহুর হাতটা শক্ত ভাবে ধরে রাখায় ভিতরে ভিতরে অনেকটা ভরসা পাচ্ছে সে। সারফারাজ পিহুকে নিয়ে ড্রয়িংপ্লেসে এসে দাঁড়ালো।
ড্রয়িংরুমে উপস্থিত মোস্তফা খান, জামাল, তাহমিনা, শিউলি, আতুশি সবার চোখে-মুখেই কৌতূহলতার ছাপ ফুটে আছে। সবার সামনে দাঁড়িয়েই সারফারাজ কণ্ঠ শক্ত করে বললো…..
—“আজ আমি আপনাদের সামনে আমার নেওয়ার একটা বিশেষ সিদ্ধান্ত পেষ করতে এসেছি। আমি চাই, আজই পিহুর সাথে আমার বিবাহকার্য সম্পন্ন হোক।”
সারফারাজের মুখে এরূপ কথা শুনে এক মুহূর্তের মধ্যেই পুরো খান বাড়ি জুড়ে একপ্রকার নি*স্ত*ব্ধতা নেমে এলো যেনো।
জামাল খান ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর কন্ঠে বললেন….
—“আজই? কিন্তু কেনো? আর পিহু মায়ের সাথে তোমার বিয়ে তো হবেই আমরা কি না করেছি এই সিদ্ধান্তে? তাহলে এতো তাড়া কিসের? আমাদের মধ্যকার শেষ কথা কি হয়েছিলো তা কি তুমি ভুলে গিয়েছো সারফারাজ?”
সারফারাজ দৃঢ় কন্ঠে বললো….
—”কিছুই ভুলি নি আমি বাবা। সবই মনে আছে আমার। কিন্তু যখন আমাদের মধ্যে সেইসব কথপোকথন হয়েছিলো তখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলো আর আজকের পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ ভিন্নই। তাই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করেছি আমি।”
মোস্তফা খান বললেন…..
—”হুট করে কি এমন হয়ে গেলো বড় দাদুভাই যে তুমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলে?”
সারফারাজ এবার সকল ঘটনা উপস্থিত সবাইকে খোলাসা করে বললো। সবটা শুনে আতুশি আর শিউলির মুখে হাত চলে গিয়েছে। তাহমিনা বললেন…..
—”ওরা মা-মেয়ে তো দেখছি ভারি ব*জ্জা*ত টাইপের। ঠিক করেছো তুমি বাবা ওদের প্রত্যেককে উপযুক্ত শা*স্তি দিয়ে।”
জামাল গম্ভীর কন্ঠে বললেন…..
—”বিষয়টা এতোদূর পর্যন্ত গড়িয়ে গিয়েছিলো এটা তো ভাবতেই কেমন লাগছে আমার। অন্যের কথার প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে কিভাবে একজন বাবা পেরেছিলেন নিজের মেয়ের জীবনটাকে ন*ষ্ট করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে! ছিহ্!”
শিউলি বললেন….
—”জন্ম দিলেই যে সব পুরুষ বাবা হতে পারে না তার প্রমাণ আজ আবারও পেলাম।”
মোস্তফা বললেন…..
—”যাই হোক সেসব কথা ছাড়ো এখন। পিহু দিদিভাইয়ের বাবা যেহেতু নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন আর অনুশোচনাও করছেন তাই তাকে নিয়ে আর খারাপ মন্তব্য না করাই ভালো। আমাদের উচিত জবরুলের জন্য দোয়া করা। তিনি যেনো দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন এই কামনা করা।”
পিহু মাথা নুইয়ে রেখেছে। সবকিছুর পরেও ওর বুকের ভিতরে চাপা একপ্রকার য*ন্ত্র*ণা কাজ করছে। তাহমিনা বললেন…..
—”কিন্তু আজ কিভাবে বিয়ের আয়োজন করা সম্ভব? তোমার চাচারা আগামীকাল রাতের ফ্লাইটে রওনা করবে তারা তো পড়শু সন্ধ্যার আগে ছাড়া বাসায় আসতে পারবে না। আর নীরারও আসতে মিনিমাম ২দিন সময় প্রয়োজন। ওদের ছাড়া বিয়ে হলে কি সেটা ঠিক হবে বাবা?”
শিউলি বললেন….
—”আমাদের সবারই কতো স্বপ্ন ছিলো সারফারাজ বাবা তোমার বিয়ে নিয়ে। আমরা তো ধুমধাম করে মনের মতো আয়োজনের মধ্য দিয়ে তোমাদের দু’জনের বিয়ে দেবো ভেবেছিলাম!”
সারফারাজ দৃঢ় স্বরে বললো….
—“এসবে আমার কোনো আপত্তি নেই মেজো চাচী। চাচারা আর নিশা এলে তোমরা বড় আয়োজন করবে, সমাজের সবাইকে দাওয়াত করবে, মনের মতো করে পুরো বাড়ি সাজাবে আমি এসবে কোনো বাঁধা দিবো না। কিন্তু আমি চাই না, আজকের পর আর কোনো সুযোগ কারোর সামনে আসুক আমার থেকে পিহুকে ছিনিয়ে নেওয়ার। তাই আজই আমার সাথে পিহুর বিয়ে হবে সেটাও খুবই ছোট পরিসরে এবং মসজিদে হবে। এরপর পৃথিবীর কোনো শক্তিই আর আমাদের আলাদা করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।”
মোস্তফা মাথা নেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন….
—“যেহেতু এটাই তোমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তবে আজই হোক এই নিকাহ।”
তাহমিনা এগিয়ে এসে পিহুর মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন….
—“আজ থেকেই তুমি আমাদের বাড়ির বড় বউ হবে। আমাদের সবার আদরের বড় মেয়ে হবে পিহু মা। তুমি ভ*য় পেয়ো না একদম। তোমার পাশে আমরা সবাই আছি।”
পিহুর দু’চোখ বেয়ে কয়েকফোটা অশ্রু ঝড়ে পড়লো। শিউলি পিহুর কাছে এগিয়ে এসে ওর থুঁতনি ধরে মুখটা হালকা উঁচিয়ে পর চোখের পানিটুকু স্বযত্নে মুছিয়ে দিয়ে বললেন….
—“আজ তোমার চোখ থেকল যে অশ্রুরা ঝড়ে পড়লো এটাই যেনো হয় তোমায় শেষ কান্না পিহু মা।”
আতুশি হেসে বললেন….
—“আমাদের ঘর আজ থেকে পিহু মায়ের মতো চাঁদের আলোায় আলোকিত হয়ে যাবে।”
পিহুর ঠোটে ফুটে উঠলো লজ্জামাখা হাসির রেখা। সারফারাজ এক দৃষ্টিতে পিহুর দিকে তাকিয়ে আছে।
কি যে স্নিগ্ধ লাগছে আজ এমপি সাহেবের প্রিটিহার্টকে তা সে নিজেও ভাষায় বলে প্রকাশ করতে পারবে না।
ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত নামকরা “উত্তরা ক্লাব লিমিটেড” এর অভিজাত পরিবেশে মুখোমুখি বসে আছে নির্ঝর আর তেজওয়ার। টেবিলের উপর পড়ে আছে দু’টি খালি ওয়াইনের বোতল। তেজের নিঃশেষিত নেশার সাক্ষী হয়ে। তৃতীয় বোতলটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে তেজ নিজের হাতে। একটু পর পর তাকে চুমুক দিচ্ছে আর বলছে…..
—”ঐ মেয়ের এতো বড় সাহস এই তেজওয়ার খান তেজকে ব্লা*ক*মে*ইল করে! আমাকে বলে কিনা যদি আমি ওকে বিয়ে না করি তাহলে ও আমার সব সত্য সবার সামনে ফাঁ*স করে দিবে! তার আগে ওর অবস্থা আমি এমন করবো যে ও নিজেই নিজের গলাতে ফাঁ*স পড়াতে বাধ্য হবে।”
তেজ এখন পুরোপুরি নেশায় ডুবে গিয়েছে। তেজের এই অভ্যাস নতুন নয়। নেশার ঘোরে ডুবে গিয়ে আবোল-তাবোল বলা তেজের নিত্যদিনের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আর নির্ঝরের কাজ সবসময় একই থাকে এক্ষেত্রে। তেজ যখন সম্পূর্ণরূপে বে*সামাল হয়ে সেন্স হারায় তখন তাকে নিরাপদে অন্য বাসায় নিয়ে যেতে হয়। কারণ তেজ যতোক্ষণ হুঁশে থাকে ততোক্ষণ তাকে তার স্থান থেকে সরানো যে অসম্ভব তা নির্ঝর খুব ভালো করেই জানে।
প্রথম দিকে নির্ঝর চেষ্টা করেছিলো তেজকে বোঝাতে, কম ওয়াইন খেতে। কিন্তু সেই চেষ্টার জন্য ভ*য়*ঙ্কর পরিণতি বয়ে এসেছিলো নির্ঝরের জীবনে। একদিন নেশার ঘোরে রাগে অ*ন্ধ হয়ে তেজ নির্ঝরের মাথায় আ*ছ*ড়ে ভে*ঙে*ছিলো একটা ফাঁকা ওয়াইনের বোতল। সেই ঘটনার পর থেকে নির্ঝর আর কখনো ভু*লেও তেজকে এই বিষয়ে কিছু বোঝানোর দুঃসাহস করে নি।
তাই আজও নির্ঝর নিশ্চুপ বসে আছে। কেবল অপেক্ষা করছে সেই মুহূর্তটার জন্য যখন তেজ পুরোপুরি হুঁশ হারাবে আর তখনই সে তেজকে নিয়ে ফিরবে নিরাপদ আশ্রয়ে।
সারফারাজ তাহমিনাকে বললো…
—”মা! তেজ আর নির্ঝর কোথায়? রুমে নাকি? ওদেরকেও ডাকো।”
তাহমিনা কিছু বলার পূর্বেই আতুশি বললেন….
—”ওরা তো সেই বিকেলে বেড়িয়েছে বাড়ি থেকে। এখনও ফেরে নি।”
সারফারাজ বললো…
—”আমি কল করছি তেজকে।”
এই বলে সারফারাজ তেজকে কল করলো। কিন্তু ফোন বাজতে বাজতে আপনা-আপনি কেটে গেলো। এরপর নির্ঝরকে কল করলেও সেইম জিনিসটা হলে সারফারাজ বললো….
—”ফোন তো দু’জনের একজনও রিসিভ করলো না।”
তাহমিনা বললেন….
—”কোনো বিশেষ কাজে ব্যস্ত আছে হয়তো তাই ফোন উঠাতে পারছে না। ওদের কথা ছাড়ো তুমি। আমরা পিহু মা’কে সুন্দর করে বধুর সাজে সাজিয়ে আনছি আর তুমিও তোমার ঘরে যাও। ফ্রেশ হয়ে একটা ভালো পান্ঞ্জাবি পড়ো।”
পিহু মাথা নোয়ানো অবস্থায় লজ্জামাখা হাসি হাসছে। সারফারাজ পিহুর দিকে একপলক তাকিয়ে ‘আচ্ছা’ বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজরুমে চলে গেলো।
তাহমিনা, শিউলি আর আতুশি তিনজনে মিলে পিহুকে নিয়ে গেলেন তাহমিনার ঘরে।
ঘরে আনার পর বিছানায় বসিয়ে দিলেন পিহুকে। পিহুর দু’পাশে হাসিমুখে বসে আছেন শিউলি ও আতুশি। তাহমিনা আলমারী খুলে ভিতর থেকে একটা পুরোনো দিনের গাড় লাল রংয়ের ভাড়ি ও নিখুঁত কাজ বিশিষ্ট বেনারসি বের করে আনলেন। শিউলি আর আতুশি মুগ্ধ চোখে তাহমিনার হাতে ভাঁজ করে রাখা শাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। আতুশি বললেন….
—”এই শাড়িটা শ্বাশুড়ি মা তোমাকে দিয়েছিলো তাই না বড় ভাবী!”
শিউলি বললেন….
—”এই শাড়িটা তো বড় ভাবী নিজের বিয়েতেও পড়েছিলেন।”
তাহমিনা মৃদু হেসে বললেন….
—”হুম, এটা আমাদের শ্বাশুড়ি মায়ের দেওয়া আমার বিয়ের শাড়ি। এই শাড়িটা আজও আমি খুব যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম আজকের দিনটার জন্য।”
পিহু চোখ তুলে তাকালো তাহমিনার দিকে। তাহমিনা আবারও বললেন….
—”এখন তো অনেক মেয়েকেই দেখি বিয়েতে নিজের মায়ের বিয়ের শাড়ি পড়ে। আমার মেয়েটা তাহলে বাদ যাবে কেনো? জন্মদায়িনী মায়ের বিয়ের শাড়ি না পড়তে পারলেও শ্বাশুড়ি মায়ের বিয়ের শাড়ি তো পড়াই যায়! কি বলো তুমি পিহু মা?”
পিহুর দু’চোখ খুশিতে ছলছল করে উঠলো। আতুশি পিহুর দিকে তাকিয়ে বললেন….
—”মেজো ভাবী আর কাঁদতে না করেছিলো না? বড়দের কথা অমান্য করছো তুমি এখনও এ বাড়ির বউ হও নি। এতো বড় সাহস তোমার?”
আতুশির এমন কথায় পিহু হেসে ফেললো। আতুশি সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে বললেন….
—”আমরা তিনজনই তোমায় মেয়ে হিসেবে গ্রহন করেছি। তাই মায়ের কথা অমান্য করলে কিন্তু দ*জ্জা*ল শ্বাশুড়ির রূপ নিয়ে হলেও শাষণ করবো। বুঝলে!”
আতুশির এরূপ কথায় তাহমিনা আর শিউলিও নীরবে হাসলেন। পিহু বললো….
—”আমার এতো সাহস আছে নাকি তিন তিন জন মায়ের কথা অমান্য করার!”
তাহমিনা বললেন….
—”ছোট এবার ছাড় তো আমার মেয়েকে। আদর পরেও করতে পারবি। এখন ওকে আগে ফ্রেশ হয়ে আসতে দে। তারপর তো সাজাতে হবে ওকে নতুন বউয়ের সাজে।”
আতুশি বললেন….
—”হুম হুম, ঠিক আছে।”
এই বলে আতুশি পিহুকে ছেড়ে দিলেন। পিহু উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
কিয়ৎক্ষণ পর পিহু ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলে তাহমিনা, আতুশি ও শিউলি ৩জন মিলে খুব যত্ন নিয়ে পিহুকে প্রথমে বেনারসিটা পড়িয়ে দিলেন। পিহুর হরিণের ন্যয় টাকা চোখজোড়ায় গাড় করে কাজল দিয়ে দিয়েছে। মুখে হালকা মেক-আপ দিয়েছে যা সম্পূর্ণ পিহুর শরীরের বর্ণের সাথে মিশে গিয়ে ওকে আরো বেশি সুন্দর করে তুলেছে। ঠোঁটে নুড লিপস্টিক দিয়েছে।
পিহু ওয়াশরুমে যাওয়ার পর শিউলি আর আতুশি নিজেদের ঘর থেকে নিজেদের বিয়ের সবথেকে ভালো গহনার সেট নিয়ে এসেছে। সেগুলোই পিহুকে ওনারা পড়িয়ে দিলেন। নতুন তিন মায়েরই বিয়ের সাজ আজ পিহুর নিজের বিয়েতে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
অতঃপর পিহুর হাটু ছুই ছুই চুলগুলো খোঁপা করে সেখানে বেলিফুলের গাজড়া দিয়ে পিহুর পুরো সাজ সম্পন্ন করলেন ওরা। শিউলি পিহুর থুতনি স্পর্শ করে নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে বললেন…..
—”মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ কি ভিষণ মিষ্টি লাগছে আমাদের মেয়েটাকে!”
আতুশি সঙ্গে সঙ্গে নিজের চোখের কোণ থেকে সামান্য কাজল ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙুলে নিয়ে পিহুর বাম কানের পিছনে ছুঁইয়ে দিয়ে বললেন…..
—”নজর না লাগুক কারোর আমার মেয়েটার উপর।”
তাহমিনাও মুগ্ধ নয়নে পিহুর দিকে তাকিয়ে আছে। শ্যম বর্ণের হলেও যে একটা মেয়েকে দেখতে এমন নজর কাড়ার মতো সুন্দর লাগতে পারে বিষয়টা সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতোই।
পিহুর ঠোঁটে ফুটে আছে লজ্জা মাখা মিষ্টি হাসির রেখা। পরমুহূর্তে ওনারা তিনজন মিলে পিহুকে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন। ড্রয়িংরুমে ইতিমধ্যেই সারফারাজ রেডি হয়ে অপেক্ষা করছিলো পিহুর আসার। অন্যপাশে মোস্তফা ও জামাল দু’জনেই বসে আছেন।
সারফারাজের পরণে রয়েছে গাঢ় লাল রঙের একটা পাঞ্জাবি। যে পান্ঞ্জাবিতে রয়েছে সূক্ষ্ম সোনালী জড়ির নিখুঁত কারুকাজ। পান্ঞ্জাবির উপরে কালো রংয়ের ভারী কাজ করা একটা কোটিও পড়েছে সে। আর নিচে পড়েছে মোলায়েম সিল্ক কাপরের তৈরি চুড়িদার ডিজাইনের পাজামা।
সারফারাজের গাঢ় নীলাভ মনি বিশিষ্ট তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন চোখজোড়া স্থির হলো পিহুর দিকে। সারফারাজের সরু নাক আর পূর্ণ ঠোঁটের গড়নে আজ ওর মুখশ্রীকে দিয়েছে দৃঢ় ও আকর্ষণীয় রূপ। ফর্সা বর্ণে জ্বলজ্বল করা চেহারার সঙ্গে মানিয়ে গিয়েছে কপালে ছড়িয়ে থাকা হালকা এলোমেলো চুলগুলো। পিহু একটু একটু করে এগিয়ে আসছে এদিকেই। রুম থেকে বের হওয়ার আগে পিহুর মাথায় হালকা পালতা বেনারসির সাথে মানানসই ওড়না ঘোমটার মতো করে পড়িয়ে দিয়েছিলেন তাহমিনা। যার ফলে এখন পিহুর মুখশ্রী ঘোমটার আড়ালে ঢাকা অবস্থায় আছে। পিহুর এই সাজানো-গোছানো নববধূর রূপ দেখে সারফারাজের জোড়া ঘন ভ্রুর নিচের সেই চাহুনি ধীরে ধীরে আরো শাণিত হয়ে উঠছে।
পিহু ঘোমটার আড়াল থেকেই চোখ তুলে একপলক দেখেছিলো সারফারাজকে। তখুনি সারফারাজকে নিজের দিকে এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে পিহুর লজ্জার মাত্রা এবার কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। আর চোখ তুলে তাকানোর জোঁ হলো না পিহুর।
অতঃপর ওরা সবাই একত্রে খান ভিলা থেকে বের হলেন মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। খান ভিলা থেকে কয়েক মিনিটের পথ অতিক্রম করার পরই সেখানে অবস্থিত পুরোনো এক বড় মসজিদ ওদের চোখে পড়লো। চারপাশটা ভিষণ পরিষ্কার ও শান্ত। আজ এখানেই আয়োজন করা হয়েছে সারফারাজ আর পিহুর বিয়ের।
মসজিদের বারান্দায় প্রবেশ করলো খান পরিবারের সদস্যরা। মোস্তফা খান, জামাল সেখানে বসলেন। সারফারাজ একটি সাদা জায়নামাজের উপর বসলো কাজী সাহেবের সামনে। পিহুকে নারীদের জন্য নির্ধারিত সেই আলাদা পর্দাঘেরা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেখানে তাহমিনা, আতুশি আর শিউলিও ছিলেন। তবে তা খুব বেশি দূরে না। এখানে হওয়া কথপোকথন ওখানে থেকে স্পষ্ট শোনা যাবে এমনই।
কাজী সাহেবের পরণে সাদা রংয়ের পান্ঞ্জাবি-পাজামা রয়েছে। পেট ছুঁই ছুঁই দাড়ি ও মাথায় টুপি পড়েছেন। তাকে দেখতে পরিমিত ভদ্রলোক লাগছে। কাজী সাহেবের সামনে কুরআন শরীফ খুলে রাখা রয়েছে। কাজী সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন…..
—“বিবাহ হলো মহান সুন্নাহ। এখানে উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে আজ আমরা এমপি সারফারাজ ইউসুফ খান এবং কন্যা প্রহেলিকা পিহু বিনতে জবরুলের মধ্যে ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক বিবাহ সম্পন্ন করবো ইনশাআল্লাহ।”
সবার দৃষ্টি স্থির হলো সারফারাজের দিকে। কাজী সাহেব বললেন…..
—“কনের অভিভাবক কে?”
জামাল খান হালকা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন….
—“আমি পিহুর ওয়ালি হিসেবে এই বিয়ের অনুমতি দিচ্ছি।”
কাজী সাহেব সারফারাজকে উদ্দেশ্য করে বললেন…
—”দেনমোহর কতো ধার্য্য করবো, বা’জান?”
সারফারাজ পাঞ্জাবির ভেতর হাত ঢুকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে বুঝলো মানিব্যাগটা আনতে সে ভুলে গিয়েছে। কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে পাজামার পকেটে হাত ঢুকাতেই বের হয়ে এলো একটি ১০০ টাকার নোট আর ১ টাকার একটি কয়েন। সারফারাজ ঠোঁট কাঁমড়ে একটু উঁচু স্বরে পিহুকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—”এই ১০১ টাকা দেনমোহরানা হিসেবে নিয়ে কি তুমি তোমার স্বামীকে কবুল করবে বউ?”
পিহু লজ্জামাখা হাসি হেসে বললো….
—”কাগজের ১০০ টাকার নোটটাকে আমি আপনার দেওয়া আমার প্রতি শতো প্রতিজ্ঞার ভাষা হিসেবে নিচ্ছি। আর ১ টাকার কয়েনটাকে আমি নিচ্ছি আপনার সঙ্গে স্বাধীনভাবে বাঁচার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে। তাই দেনমোহরানায় ১০১ টাকা আমি সানন্দে কবুল করছি, এমপি সাহেব।”
অতঃপর কাজী সাহেব পিহু যেখানে আছেন সেইখানে গেলেন। কাজী সাহেব প্রশ্ন করলেন…..
—“পিহু বিনতে জবরুল, আপনি কি স্বেচ্ছায় খুশি মনে মোহরানা ১০১ টাকা নির্ধারণ করে সারফারাজ বিন জামাল খানকে নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করছেন?”
পিহুর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। চোখ বেয়ে নীরব অশ্রু ঝরে পড়লো। এই অশ্রু নিশ্চিত সুখকে কবুল করে নেওয়ার। পিহু বললো….
—“জি, আমি কবুল করছি।”
কাজী তিনবার একইভাবে জিজ্ঞেস করলেন। প্রতিবারই পিহুর জবাব একই এলো….
—“জি, আমি কবুল করছি।”
সাক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন। তারা সমস্বরে বললেন…
—“আমরা সাক্ষী রইলাম।”
এরপর কাজী সাহেব তার আগের জায়গায় ফিরে এসে বসলেন। সারফারাজের দিকে তাকিয়ে বললেন…..
—“সারফারাজ বিন জামাল খান, আপনি কি স্বেচ্ছায়, খুশি মনে, মোহরানা ১০১ টাকা নির্ধারণ করে পিহু বিনতে জবরুলকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছেন?”
সারফারাজের চোখদুটি আজ নিজের ভালোবাসার মানুষকে পুরোপুরি নিজের করে পাওয়ার জন্য আবেগে টলমল করছে। সারফারাজ হাসিমুখে বললো…..
—“জি, আলহামদুলিল্লাহ আমি কবুল করছি।”
একইভাবে কাজীসাহেব সারফারাজকে তিনবার একই প্রশ্ন করলেন আর সারফারাজও একই উত্তর দিলো।
পরপরই তাকবীর ধ্বনি ভেসে এলো…..
—“আল্লাহু আকবর! আল্লাহু আকবর!”
কাজী সাহেব কাগজে স্বাক্ষর করে বললেন….
—“আজ থেকে তোমরা দু’জন শরীয়ত অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী হলে। আল্লাহ তোমাদের দাম্পত্যজীবন বরকতময় করুন, ভালোবাসায় পূর্ণ করুন।”
তাহমিনা আর শিউলি আনন্দে নিজেদের দু’চোখ মুছতে লাগলেন। আতুশি হেসে বললেন….
—“আমাদের পিহু মা আজ সত্যিই খান বাড়ির বড় বউ হয়ে গেলো।”
মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর সারফারাজ একপাশে সরে দাঁড়িয়ে পিহুকে পথ দিলো সামনে এগোনোর জন্য। ঘোমটার আড়ালে লজ্জামাখা চোখজোড়া নামিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছিলো পিহু। বাড়ির সকল সদস্য ওদের থেকে অনেকটা সামনে এগিয়ে গিয়েছেন। হঠাৎ সারফারাজ পিহুর দিকে নিজের ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো। পিহু সারফারাজের হাতে নিজের হাতটা রাখলো। পরক্ষণেই সারফারাজ ফিসফিস করে বললো….
না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ১৫
—“দেখলে তো না চাইলেও আজ তুমি পুরোপুরি আমারই হয়ে গেলে! আজ যেই হাতে হাত রাখলে এই হাতটা ছাড়ার অনুমতি তোমায় কোনোদিন দিবো না বউ।”
পিহুর দু’চোখ বেয়ে আবারো খুশির অশ্রুরা ঝরে পড়লো। এই অশ্রুর আড়ালে লুকানো ছিলো প্রশান্তি আর সারফারাজের প্রতি পিহুর অগাধ ভরসা।