না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২২ (৪)

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২২ (৪)
মাইশা জান্নাত নূরা

বিয়ে নিয়ে আলোচনা শেষ হওয়ার পর পরেই সারফারাজ কাউকে কিছু না বলে একাই ওর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। কিয়ৎক্ষণ পর হাসপাতালের সাদা ভবনের সামনে এসে গাড়ির ব্রেক কষলো সারফারাজ। গাড়ি থেকে নেমে সরকারী এই ভবনটার মূল দরজার উপর লিখে রাখা নামটির দিকে দৃষ্টি স্থির করতেই ওর বুকের ভিতরটা হালকা ভার হয়ে এলো।

পিহুর জন্মদাতা পিতা জবরুল যিনি অবহেলা, অ*ব*জ্ঞার দ্বারা নিজের মেয়ের জীবনে অসীম কষ্টের কারণ হয়েছেন। এই হাসপাতালেই তিনি আজ কোনো এক কেবিনে থাকা বিছানায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন।
সারফারাজ নিঃশব্দে ভিতরে প্রবেশ করলো। জবরুলের কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে আসতেই দেখলো সাদা চাদর দ্বারা বুক থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছেন জবরুল। ভাড়ি, স্বাস্থ্যসম্মত চেহারার লোকটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছেন। বুঁজে থাকা চোখ নিচে হাফ ইন্ঞ্চি পরিমাণ গর্ত তৈরি হয়েছে। সারফারাজের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র জবরুল চোখ মেলে তাকালেন। তার এই চোখে আজ কোনো অহং*কার এর ছাপ বেই। বরং অ*প*রাধ*বোধ, অ*নু*তাপের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।।
জবরুল কাঁপা কণ্ঠে বললেন…..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“এমপি সাহেব, আপনি?”
সারফারাজ জবরুলের বিছানার দিকে এগিয়ে এসে সেখানে থাকা চেয়ারটি টেনে বসে শান্ত ও সংযত কণ্ঠে বললো….
—“হ্যা, আমি। আজ এসেছি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে।”
জবরুলের চোখে অশ্রুরা টলমল করছে। ঠোঁটজোড়া মৃদুভাবে কাঁপছে। জবরুল সারফারাজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। ঘাড় অন্যপাশ হালকা ঘুরিয়ে বললেন….
—“আমি জানি, আমি পি*শা*চের মতো ব্যবহার করেছি আমার মেয়ের সাথে। আমি পিহুকে জন্ম দিয়েও কখনও ওর বাবা হয়ে উঠতে পারি নি। ওকে ভালোবাসা, স্নেহ, শান্তির আশ্রয় কিছুই দেই নি আমি। কেবল একবুক ভরা কষ্ট, অভিমান, অবহেলাই দিয়ে গিয়েছি। এজন্য স্বয়ং আল্লাহর কাছে আর আমার সন্তানের কাছে আজ আমি অ*প*রা*ধী সাব্যস্ত হয়েছি। আমার কোনো ক্ষমা নেই। আমি ক্ষমা পাওয়ার কোনো যোগ্যতা রাখি না।”
সারফারাজের শান্ত দৃষ্টি জবরুলের উপর স্থির। সে ধীরস্বরে বললো….

—“ভুল সবাই করে, জবরুল সাহেব। কিন্তু ভু*ল করার পর যে বা যারা নিজের ভু*ল বুঝতে পারে তারা ক্ষমার অযোগ্য হয় না। আপনি বিগত সাল গুলোতে ভু*ল করেছেন তার বিনিময়ে আপনি আপনার যোগ্য শাস্তিও পেয়েছেন। নিজের শারিরীক ও মানসিক উভয় দিক দিয়েই। তাই আপনাকে ক্ষমা করা হয়েছে।”
জবরুল বিস্মিত চোখে সারফারাজের দিকে তাকিয়ে বললেন….
—“ক্ষমা? সত্যিই আমায় ক্ষমা করা যায়? আমার মেয়ে আমায় ক্ষমা করে দিয়েছে কি?”
সারফারাজ মৃদু ভাবে মাথা নেড়ে বললো…

—“হ্যা। আমার মন বলছে, পিহু আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। পিহুর মনে শত অভিমান জমে থাকলেও সে আপনার সাথে থাকা ওর রক্তের সম্পর্ককে, নিজের জন্মদাতা পিতাকে কি করে ঘৃণা করবে বলুন? নিজের জন্মদায়িনী মা’কে হারানোর পর আপনিই ছিলেন পিহুর একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার একমাত্র মাধ্যম৷ সেই আপনি নিজের ভালোর কথা চিন্তা করে আবারও বিয়ে করলেন। অথচ যেই মা হারা সন্তানটা আপনার আশায়, আপনার একটু আদর-স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষায় কাটিয়েছে তার দিকে গভীর ভাবে নজর টুকুও দেন নি আপনি। নতুন মায়ের, বোনের পিছন পিছন ঘুরেছিলো সর্বক্ষণ একটু ভালোবাসার খোঁজে। আমাদের আশেপাশে কোনো কাঙাল ঘুরঘুর করলেও তো তার দিকে আমরা দয়ার দৃষ্টিতে তাকাই। পিহু সেই দৃষ্টিটুকুও পায় নি। তাই আজও ওর ভেতরে যেই অভিমানেরা জমে আছে সেই অভিমানের দেওয়াল ভেঙে আপনার কাছে ছুটে এসে ও বলতে পারছে না, ‘বাবা আমি তোমায় ভালোবাসি, বড্ড ভালোবাসি তোমায় আমি। তুমিও আমায় একটু ভালোবাসো না বাবা! একটু আমার মাথায়ও আদুরে হাতটা রাখো! আমি যে ভালোবাসার কাঙাল বাবা! আমি যে ভালোবাসা চাই। শুধু শুধুই একটু ভালোবাসা চাই’।”

সারফারাজের কথাগুলো জবরুলের বুকটা কেঁপে উঠলো। দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রুরা গড়িয়ে পড়লো। নিজের হাতজোরা তুলে লজ্জায় জবরুল তার মুখটা ঢাকলেন। অতঃপর ভাঙা কণ্ঠে বললেন…..
—“আল্লাহ, আমি কতোটা অ*ন্ধ ছিলাম! কতোটা নি*র্দয় ছিলো! আমার মেয়েটা যে একটু স্নেহ, ভালোবাসা, যত্ন পাওয়ার জন্য হয়তো দিন-রাত কান্না করেছে। অথচ আমি ওকে শুধু ক*ষ্টই দিয়ে গিয়েছি। আমার মেয়েটাকে যেমন আমি একাকিত্বের মাঝে ফেলে দিয়েছিলাম তার কিছুটা হলেও আজ আমি অনুভব করতে পারছি। নিজের চারপাশে তাকালে আমি নিজের বলতে কাউকে খুঁজে পাই না। আজ আমি পুরোপুরি শূন্য, একেবারেই একা হয়ে গিয়েছি। আমি আমার মেয়েটার মাথায় আবারও হাত রাখতে চাই। আমার মেয়েটাকে আমি বলতে চাই, ‘বাবা তোমার পাশে আছে মা, তুমি তোমার ভু*লে ভরপুর বাবাকে ক্ষমা করে দাও, তোমাকে যেই ভালোবাসা-যত্ন থেকে এতোগুলো বছর ব*ন্ঞ্চি*ত করে রেখেছি এখন আমি সেই ভালোবাসা, যত্ন তোমায় ফিরিয়ে দিতে চাই।’ কিন্তু পিহু কি আসবে আমার কাছে? নিজ মুখে বলবে কি ও যে আমায় ক্ষমা করে দিয়েছে!”
সারফারাজ গভীর কণ্ঠে বললো…..

—“আপনাকে ওর সামনে দাঁড় করানোর দায়িত্ব আমার। এরপর আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি পুরোপুরি বদলে গিয়েছেন। শেষবার শেষ চেষ্টাটা আপনাকেই করতে হবে। একজন বাবার যা যা দায়িত্ব হয়ে থাকে তা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে হবে। পিহুর অভিমান যতো বেশিই হোক না কেনো, একজন মেয়ে হিসেবে ওর হৃদয়ে আপনার জন্য তৈরি হওয়া জায়গাটা আজও খালি হয়েই আছে। আপনি পিহুকে ভালোবাসা, স্নেহ দিয়ে ওর মনের সেই জায়গাটা পূর্ণ করবেন। ওর সমস্ত অভিমান এক নিমিষেই দূর হয়ে যাবে তখন। মনে রাখবেন, পিহু আপনারই মেয়ে। বাবার একটু ভালোবাসা ওর কাছে কোটি কোটি টাকার থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান।”
জবরুল হুহু শব্দে কেঁদে ফেললেন। সারফারাজ উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো….
—”আপনার অনুপস্থিতিতে পিহুর সাথে মসজিদে খুব ছোট ভাবে আমি আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পিহুর সাথে বিবাহকার্য সম্পন্ন করেছিলাম৷
জবরুল নিজের হাত বাড়িয়ে সারফারাজের হাত ধরে বললেন…..

—“তোমার জন্য আজ আমি সঠিক শিক্ষা পেয়েছি জামাই বাবা। আমার মেয়েটা অনেক ভাগ্যবতী তাই তো ও তোমার জন্য একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছে। ওর দুঃখে ভরা জীবনের আকাশে তুমি খুশির চাঁদ হয়ে উঠেছো। আল্লাহ্‌ তোমাদের চির সুখী করুক। আর আমি প্রতিজ্ঞা করছি- যদি বেঁচে থাকি, আমার মেয়েকে আমি আর কখনও আমার তরফ থেকে কষ্ট পেতে দিবো না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ওকে শুধু ভালোবেসে যাবো আমি।”
সারফারাজ হালকা হেসে বললো…..

—”এবার আপনার কাঁধে গুরুদায়িত্ব পড়লো বলে। খুব শীঘ্রই বিশাল আয়োজন করা হবে পিহুর আর আমার বিয়ের। খান বাড়ি জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠবে। যেই দায়িত্ব ১ম বার পালন করতে পারেন নি সেই দায়িত্ব এবার নিপুনভাবে পালন করার জন্য শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করুন শ্বশুরআব্বা। এবারের বিয়ের আয়োজনে বাবার আসন খালি থাকবে না। পিহু ওর মন খেকে অনুভব করতে পারবে ওর বিয়েতে ওর সবথেকে কাছের মানুষ ওর বাবা উপস্থিত আছেন ওর সবথেকে বড় শক্তি হয়ে।”
জবরুল হালকা হেসে বললেন….
—“হ্যা জামাই বাব, আমি যাবো। আমাকে তো যেতেই হবে। আমার মেয়ের হাতটা শক্ত ভাবে ধরতে হবে আমায়। ওর কোমল হাতটা সারাজীবনের জন্য তোমার হাতে তুলে দেওয়ার গুরু দায়িত্বটা আমায় পালন করতেই হবে।”
সারফারাজ মাথা দুলালো হালকা।

শপিং শেষে সব কয়টা শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে দোকান থেকে বের হলো তেজ। ইলমা বললো….
—”ব্যগগুলো আমাকে দিন। আমার ব্যগ আপনি কেনো বহন করবেন?”
তেজ কোনো উত্তর দিলো না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সামনের দিকে হেঁটে চলেছে। ইলমার আবারও বললো…
—”এই যে শুনছেন? আমি আপনাকে বললাম তো ব্যগগুলো আমাকে দেওয়ার জন্য। আমার ব্যগ আমাকে বহন করতে দিন।”
তেজকে এবারও নিরব থাকতে দেখে ইলমা তেজের পথ আটকে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। তেজ ভ্রু কুঁচকে ইলমার দিকে তাকিয়ে বললো….

—”কি সমস্যা?”
—”ব্যগগুলো যথেষ্ট ভাড়ি। আপনি একা বহন করছেন বিষয়টা আমার কাছে ভালো লাগছে না। সবগুলো না দিলেন, ২-১টা তো দেওয়া যায়৷ আপনার হাতে ভার কম লাগবে।”
তেজ বি*র*ক্তি মাখা কন্ঠে বললো….
—”আমি একবারও বলেছি আপনাকে যে ব্যগগুলো বহন করতে আমার কষ্ট হচ্ছে? বলি নি তো! তাই চুপচাপ হাঁটুন। নয়তো আপনাকে এখানে ফেলেই আমি চলে যাবো।”
ইলমা চুপ করে গেলো। তেজের পাশে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে আর একটু পর পর আড়চোখে তেজকে দেখছে ইলমা।
সপিং মলের বাইরে এসে তেজ বললো…

—”এখানে দাঁড়ান। আমি বাইকটা নিয়ে আসছি।”
ইলমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তেজ ব্যগগুলো হাতে নিয়ে পার্কিং সাইডে গেলো নিজের বাইকটা আনতে। ইলমা তেজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো….
—”আজকাল নিজ থেকে মানুষের উপকার করতে যেতে নেই।”
পরপরই তেজ বাইকটা নিয়ে ইলমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ব্যগগুলো পিছন চাকার উপরিভাগে থাকা হ্যঙ্গারে রেখে দিয়েছে। তেজ নিজের হেলমেটটা ইলমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো….
—”হেলমেটটা ধরুন আর পরে নিন মাথায়।”
ইলমা অবাক হয়ে তেজের দিকে তাকিয়ে বললো….

—”বাইক চালাবেন আপনি আর হেলমেট আমি কেনো পড়বো?”
—”কারণ আপনি আমার কাছে আরেকজনের আমানত। তাই নিজের জীবনের থেকে আপনার জীবন বাঁচানো আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
—”আসার সময় তো হেলমেট দেন নি!”
—”তখন সকালের বিষয়টা নিয়ে একটু রাগ জমে ছিলো ভিতরে। তাই আর কি!”
—”এখন তো রাগের মাত্রা আরো বেশি হওয়ার কথা। আপনার এতোগুলো টাকা খরচা করালাম কেনাকাটার পিছনে, এতো মূল্যবান সময় নষ্ট করালাম।”

—”বেশি কথা না বলে বাইকে চেপে বসুন তো। এখানে আর কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকলে ঐযে ট্রাফিক পুলিশকে দেখতে পারছেন ডা*ন্ডা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ওখানে। আপনি তো মেয়ে জন্য বেঁচে যাবেন। কিন্তু আমার পশ্চাৎদেশ ৭দিন পর্যন্ত না বসার অবস্থায় থাকবে আর না চিৎ হয়ে শোয়ার অবস্থায় থাকবে।”
তেজের এরূপ কথায় ইলমা ঠোঁট চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ এর চেষ্টা করলো। অতঃপর আর কথা না বাড়িয়ে হেলমেটটা নিজের মাথায় পড়ে নিয়ে বাইকের পিছনে উঠে বসলো। প্রথমত ইলমা নিজের শরীরটা আড়ষ্ট করে রাখলেও তেজ বাইক স্টার্ট করার পর পরই গিয়ারের হালকা ধাক্কায় তেজের দিকে ঝুঁকে গেলো সে। স্বভাবতই ইলমার হাত এসে পড়লো তেজের কাঁধে। তেজের হৃদপিন্ডের গতি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে চলেছে। একবার শুকনো ঢোক গি*লে নিয়ে তেজ বিরবিরিয়ে বললো….

—”কন্ট্রোল তেজ, প্লিজ কন্ট্রোল।”
তেজ বাইক যথেষ্ট স্পিডে রেখেই চালাচ্ছে মেইন রোড ধরে। হেলমেট পড়ে থাকাতেও ভাড়ি বাতাসে ইলমার কোমর সমান খোলা চুলগুলো বারবার এসে তেজের মুখে – গলায় লাগছে। এহেনু অবস্থায় তেজের ভিতরে অদ্ভুত তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে যা এর আগে কখনও কোনো নারীর সংস্পর্শে যাওয়ার পর ফিল করে নি তেজ। তেজের দৃষ্টি সামনেই স্থির। কিন্তু তেজের মন যেনো ওর মস্তিষ্ককে চিৎকার করে বলছে……
‘এই মেয়ের সান্নিধ্যে যতো থাকবি, ততোই তুই ডুবে যাবি। সাবধান তেজ, সাবধান!’
ইলমা বললো…

—”বাইক ধীরে চালান, খুব জোরে চালাচ্ছেন।”
তেজ গম্ভীর গলায় বললো….
—”চুপচাপ বসে থাকুন। আমি জানি কীভাবে বাইক চালাতে হয়।”
তেজের মুখের গাম্ভীর্য ভাবের সাথে ওর বুকের মধ্যে চলমান তোলপাড় মিলছে না একটু। বাহ্যিক ও অন্তর্ভাগ একে-অপরের থেকে বিপরীত।
একটু পর ইলমা আবারও বললো….
—”সকালের ওমন আচারণের জন্য আমি দুঃখিত। আসলে আমার স্বভাবটা কিছুটা এমনই। নতুন নতুন যখন কারোর সাথে পরিচয় হয় খুব সহজে তাদের বিশ্বাস করে উঠতে পারি না। তাই ওমন আচারণ করে পরীক্ষা নেই তাদের ধৈর্যের। আর তা অন্তরের দিক থেকে কেমন সেটাও বুঝা যায়। আপনি আর নির্ঝর দু’জনেই অনেক ভালো। আপনাদের দু’জনকেই অনেক ধন্যবাদ।”
তেজ আলতো করে নিজের ঠোঁট কাঁ*ম*ড়ে ধরলো। কোনো উত্তর দিলো না। শুধু বাইকের গতি আরো একটু বাড়িয়ে দিলো। যেনো এই বাহ্যিক হাওয়া, শব্দ আর স্পিডের মাঝে নিজের ভিতর তৈরি হওয়া ঝড়টাকে তেজ লুকিয়ে রাখতে চাইছে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো বলে। তেজ ওদের বাংলো বাড়ির ভিতরে বাইক চালিয়ে ইলমাকে নিয়ে প্রবেশ করলো। বাইক থামাতেই ইলমা দ্রুত বাইক থেকে নেমে হেলমেটটা খুলে তেজের হাতে ধরিয়ে দিয়ে হ্যঙ্গার থেকে সব সপিং ব্যগ খুলে একাই বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। তেজ ইলমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো…..
—”এই মেয়ের আসলেই আমার উপর কোনো ভরসা নেই। ব্যগগুলো বারবার নিজের হাতে নেওয়ার আবদার করার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো মতলব আছে। হয়তো ভেবেছিলো আমি ব্যগগুলো তাকে না দিয়ে রাস্তায় কোথাও ফেলে আসতাম! আর এখন তো বাড়িতেই চলে এসেছি। তবুও এতো তাড়াহুড়ো করার মানে কি! আজব!”
তেজ আর না ভেবে বাইকটা পার্কিং সাইড এ রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। প্যন্টের পকেট থেকে রুমালটা বের করে কপালে ও গলায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছছে তেজ। ড্রয়িংরুমে সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে নির্ঝর। কোমরে একটা বালিশ চেপে ধরে রেখেছে। নির্ঝরের মুখশ্রী জুড়ে এখনো কষ্টের ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। তেজ নির্ঝরের পাশে বসে বি*রক্তি মাখা স্বরে বললো……

—“নির্ঝর, শোন। আর কখনও আমাকে এসব মেয়েলী কাজে ফাঁ*সা*বি না, বুঝলি? আমি শপিং-টপিং বুঝি না ভাই। এসব বহুত প্যা*রা*দায়ক। কোনো মেয়েকে সপিং করিয়ে দেওয়ার মতো মানুষ আমি না।”
নির্ঝর মুখ কুঁচকে ব্য*থা চেপে মাথা নেড়ে বললো…
—“ঠিক আছে তেজ ভাই। আর বলবো না তোমায় কিছু। তবে আজ তুমি তোমার রেকর্ড ভে*ঙে ইলমার সাথে না গেলে তো ওনার বড্ড কষ্ট হয়ে যেতো এখন।”
—”খাবার খেয়েছিস দুপুরের? আর ঔষধ?”
—”হ্যা সব নেওয়া ডান। তুমি যাও এখন ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। আমি সার্ভেন্টকে বলে দিয়েছি ইলমার খাবারটা তার রুমেই দিয়ে দিতে।”
তেজ আর কিছু না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে। ঘন্টাখানেক পর তেজ খাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে নির্ঝরের সাথে বসে টুকটাক গল্প করছিলো। সেইসময় ইলমা সেখানে এসে নম্রস্বরে বললো…..
—“নির্ঝর, আমার একটা কথা বলার ছিলো?”
নির্ঝর ইলমার দিকে তাকিয়ে বললো….

—“বলুন, ইলমা।”
ইলমা নিজের পেটের কাছে দু’হাত জড়ো করে কচলা-কচলি করছিলো। ওর চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে আছে অস্বস্তির ছাপ। তেজ আঁড় দৃষ্টিতে ইলমার কার্যকলাপ দেখছে। ইলমা ঠোঁট কাঁ*ম*ড়ে বললো….
—“আপনারা দু’জনেি প্রাপ্তবয়সী পুরুষ মানুষ। আপনাদের সঙ্গে এভাবে একই বাড়িতে থাকাটা আমার মানায় না। মানুষ এই বিষয়টাকে ভালো নজরে দেখবে না। যদি সম্ভব হয়, আমার থাকার জন্য অন্য কোনো ব্যবস্থা করে দিন। আর পাশাপাশি যদি ছোটখাটো কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন! তাহলে আমি নিজের খরচটা নিজেই চালিয়ে নিতে পারবো।”
নির্ঝর আর তেজ ইলমার এরূপ কথা শুনে একে-অপরের দিকে দেখলো এক মুহূর্তের জন্য। কিয়ৎক্ষণ পুরো পরিবেশ জুড়ে নিরবতা বিরাজ করলো। অতঃপর নির্ঝর ওর ব্য*থায় কাঁতর দৃষ্টি নিয়ে তেজের দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে বললো…..

—”তেজ ভাই, শুনছো!”
তেজ ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বি*রক্তি মাখা কন্ঠে বললো….
—“আবার আমাকে টেনে আনছিস এসবের মাঝে?”
নির্ঝর কষ্টের হাসি দিয়ে মাথা নামিয়ে ফেললো। তেজ দাঁতে দাঁত চেপে ইলমাকে উদ্দেশ্য করে বললো….

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২২ (৩)

—”আজ রাতটা থাকুন এখানেই কষ্ট করে। আগামীকাল বের হবো আপনাকে নিয়ে আবারও। আপনার নতুন কাজ ও নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে।”
ইলমা মাথা নুইয়ে রাখা অবস্থাতেই হালকা হাসলো।

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here