না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৪ (৫)

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৪ (৫)
মাইশা জান্নাত নূরা

সারফারাজ সোফায় বসে ফাইলের পাতা উল্টে-পাল্টে তাতে নজর বুলাচ্ছিলো। ওর চোখের নিচে হালকা কালচে দাগ ফুটে আছে যা ক্লান্তির জানান দিচ্ছে স্পষ্টতই। ভ্রু যুগল কিন্ঞ্চিত কুঁচকে রেখেছে কাজের প্রতি অটল মনোযোগ রাখতে। সারফারাজের পাশেই পেটের কাছে দু’হাত একত্রে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে ওর পি.এ আহাদ৷ ভাজকৃত হাতেই আহাদ ধরে রেখেছে একটা কলম ও একটা ছোট আকারের ডায়েরি। সারফারাজ ১টা ফাইল আহাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো…

—“এই কাজের জন্য মিটিং এর তারিখটা আগামী সোমবার ঠিক করে দিও।”
আহাদ ‘আচ্ছা স্যার’ বলে ফাইলটা নিলো ও তাতে নজর বুলালো। সারফারাজ আরেকটা ফাইল খুলে তাতে নজর বুলাচ্ছিলো সেই সময় দরজার কাছে এসে থামলো পিহু আর নীরা।
নীরা আস্তে করে ইশারায় পিহুকে বললো….
—“তুমি যাও ভেতরে, আমি বাইরে আছি।”
পিহু নিঃশব্দে মাথা নেড়ে এগিয়ে এসে রুমে ঢুকতেই ওকে দেখামাত্র আহাদ হেসে বললো….
—“আসসালামু আলাইকুম, চাচী আম্মা! কেমন আছেন?”
পিহু কিছুটা আঁ*তকে উঠলো আহাদের কন্ঠে হঠাৎ ‘চাচী আম্মা’ সম্বোধনটা শুনে। পরপরই নিজেকে সামলে নিয়ে জোরপূর্বক হেসে পিহু বললো….

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“ওয়ালাইকুম আসসালাম, আব্বা। আমি আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
আহাদ ওর ৩২ পাটি দাঁত বের করে হেসে প্রতিত্তুর করলো। সারফারাজ একবার আহাদের দিকে তাকিয়ে আবার পিহুর দিকে তাকালো। পরপরই নজর সরিয়ে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। পিহুর গলা হালকা শুকিয়ে এসেছে ইতোমধ্যেই। তবুও সাহস সঞ্চয় করে পিহু বললো…
—“আপনি কি একটু সময় দিতে পারবেন? কথা ছিলো সামান্য।”
সারফারাজ কলমটা নামিয়ে বললো…
—“কেনো, কিছু দরকার?”
—“হ্যাঁ, একটু দরকার ছিলো।”
তখুনি আহাদ নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে বললো….
—“স্যার! আমার ওয়াইফ কল করছে। একটু কথা বলে আসি!”
সারফারাজ ঠাণ্ডা স্বরে বললো….
—“ফোন সাইলেন্টে ছিলো, বুঝলে কিভাবে কল এসেছে?”
আহাদ হেসে বললো…
—“ভাইব্রেটে রেখেছিলাম, স্যার।”
সারফারাজ মাথা নেড়ে বললো….
—“ঠিক আছে, যাও।”

আহাদ বেরিয়ে আসতেই দরজার আড়ালে নীরাকে দেখামাত্র আঁ*ত*কে উঠলো। নীরা দ্রুত ইশারায় আহাদকে চুপ থাকতে বললো। আহাদ নিজের বুকে অল্প থু*থু ছিটিয়ে নিচু গলায় বিড়বিড় করে বললো…
—“আল্লাহ বাঁচাও, এ ঘরে প্রত্যেক দেওয়ালের আড়ালে আড়ালে কোনো না কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকেই।”
অতঃপর সেখান থেকে সরে গিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে ফোন থেকে ফেসবুক এপপ এ ঢুকে স্ক্রল করতে করতে বিরবিরিয়ে বললো….
—”স্যারের সাথে থাকতে থাকতে আমারও মাথায় উপস্থিত বুদ্ধি হয়েছে। পরিস্থিতির বিপাকে না পরে সেখান থেকে সহজে বেড়িয়ে আসার জন্য কি করা দরকার সেসব বুঝে উঠতে শিখেছি অনেকটাই। এইতো একটু আগে বউ কল করে নি তবুও কলের বাহানা দিয়ে বেড়িয়ে এলাম!”
রুমে ভেতরে সারফারাজ ফাইলগুলো বন্ধ করে পিহুর হাত ধরে টেনে ওকে নিজের পাশে বসালো। পিহুর উপর শান্ত দৃষ্টি স্থির করে বললো…..

—“বলো বউ, কি বলতে চাও তুমি?”
পিহু চোখ নামিয়ে রেখেছে। আঙুলের ডগায় নিজের ওড়নার একটু অংশ পেঁচিয়ে ফেলেছে। অতঃপর বললো….
—“আমি একটু অনাথ আশ্রমে যেতে চাই।”
সারফারাজ অবাক হলো না। শান্ত কন্ঠেই বললো…
—“হঠাৎ অনাথ আশ্রম?”
—“সামনে শীতকাল আসছে। ওখানে থাকা বাচ্চাদের শীতের কাপড় দরকার। তাই এই শীতটা যেনো কিছুসংখ্যক বাচ্চারা কম কষ্ট পেয়ে কাটাতে পারে এমন চিন্তা করেই ওদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করবো ভেবেছিলাম। বলতে পারেন এটা আমার অনেক আগের ইচ্ছা। তখন তো সামর্থ্য ছিলো না তাই পূরণ করতে পারি নি। এখন আপনার বদৌলতে করতে পারবো জন্য বললাম।”
সারফারাজ কিছুক্ষণ পিহুর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বললো…

—“ঠিক আছে, যাও। তবে বাড়ির গাড়ি আর ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে যেও।”
পিহু মাথা নেড়ে বললো….
—“ঠিক আছে।”
বাহিরে দাঁড়িয়ে নীরা সারফারাজ ও পিহুর সব কথপোকথন ক্লিয়ারলিই শুনতে পেরেছে। নীরা দু’হাত তুলে খুব ধীরে ‘ইয়েস, পারমিশন পেয়ে গিয়েছে ভাবীপু’ বলে উঠলো। অতঃপর নিজের রুমের উদ্দেশ্যে যাবে বলে পা বাড়াতেই আহাদকে ভ্রু কুঁচকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীরা ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো ‘কি?’ আহাদ প্রতিত্তুরে মাথা নাড়িয়েই ‘কিছু না’ বুঝিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।

ঘড়ির কাঁটা যেনো আজ ইলমার বিপক্ষে লড়ছে।
চোখ খুলতেই জানালার পর্দাকে ফাঁকি দিয়ে ঘরের ভিতরে চলে আসা দুষ্টু সূর্যের আলোর দল ইলমার চোখে এসে বা*রি খেলো যেনো। দেওয়ালে টাঙানো ছোট্ট ঘড়িটার দিকে তাকাতেই সময় তখন ‘১০টা বাজতে মাত্র ১০ মিনিট বাকি’ দেখে ইলমা ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে বললো…..
—“হায় আল্লাহ! আজ তো আমার কাজের প্রথম দিন ছিলো। আর আজই এতো লেইট করলাম!”
চোখ মুছতে মুছতেই বিছানা ছেড়ে দৌড়ে বাথরুমে চলে গেলো ইলমা। ফ্রেশ হয়ে এসে তাড়াহুড়োয় চুলটাও ঠিক মতো আঁচড়ানো হলো না ইলমার। সাদা রঙের একটা থ্রি-পিসটা গায়ে জড়িয়ে সাথে গাড় সবুজ রংয়ের হিজাব পড়ে আয়নায় নিজেকে এক ঝলক দেখে র‍্যকের উপর থেকে তালা-চাবি নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলো ইলমা। পাশের রুমের মেয়েটার ঘরের দিকে তাকাতেই তার দরজায় বড় আকারের একটা তালা ঝুলতে দেখে ইলমা মনে মনে ভাবলো….

— “উনি নিজের সময় মেপে আগেই কাজে চলে গিয়েছেন।”
বাসা থেকে কফি শপের দূরত্ব বেশি না। গুনে গুনে কয়েক কদম হেঁটেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলো ইলমা। শপের কাঁচের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এক অন্যরকম ঘ্রাণে যেনো ইলমার পুরো শরীরটা মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেলো। সারি বদ্ধ ভাবে একে-অপরের প্রাইভেসি ঠিক থাকবে এমন করে বসানো কয়েকটা টেবিল দখল করে বসে আছে সাত-আটজন তরুণ বয়সের ছেলে-মেয়ে। তারা কফির স্বাদ গ্রহন করতে করতে একে-অপরের সাথে গল্পতে মশগুল হয়ে আছে।

হাতের ডানপাশে রিসেপশনে চোখ পড়তেই ইলমা দেখলো সেখানে একজন অপরিচিত পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। পুরুষটি শ্যামলা বর্ণের। চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট, মোটামুটি লম্বা। তার বয়স আনুমানিক ত্রিশের কোঠায় হবে। পরণে একটা কালো রঙের এপ্রোন রয়েছে। মুখশ্রী জুড়ে একটুও হাসি নেই। গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে রেজিস্টার খাতায় কিছু লিখছেন।
ইলমা সাহস সঞ্চয় করে পুরুষটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো….
— “আমি আজ নতুন জয়েন করেছি এখানে। আমাকে বলা হয়েছিলো আজ থেকেই কাজ শুরু করতে। তাই আমাকে আমার কাজটা বুঝিয়ে দেও…!”
লোকটা ইলমার কথা শেষ হতে না দিয়েই নিজ কণ্ঠে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বললেন….

—“ভেতরে দরজার আড়ালে হ্যাঙ্গারে এপ্রোন রাখা আছে। সেটা পরে নিয়ে সেখানেই সিন-এ রাখা মগগুলো পরিষ্কার করে এখানে আনবেন।”
ইলমা এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে রইলো লোকটার মুখশ্রী পানে। মনে মনে ভাবলো….
—“পোশাক-আশাকে কফি শপে কর্মরত লোক মনে হলেও কথার ধরণ ও এটিটিউড এ মনে হচ্ছে কোনো মিলিটারি ক্যম্পের ট্রেনার!”
অতঃপর ইলমা ভিতর সাইডে এসে এপ্রোনটা পড়তে পড়তে বিরবিরিয়ে বললো….

—“একটু ভালোভাবে বললেই তো হয়! এমন খা*টা*শ কোম্পানির ম্যনেজারের মতো মুখ করে থাকার মানে কি?”
এই বলে ইলমা সিন-এর সামনে এসে একে একে সবগুলো মগ যত্নের সহিত পরিষ্কার করতে শুরু করলো। দশটারও বেশি মগ হবে। সব মগ ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে রিসেপশনের কাছে এলে লোকটা আবারও বললেন…
—“ওই টেবিলের উপর রাখুন। পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মগগুলোর অতিরিক্ত সব পানি মুছে ফেলুন।”
ইলমা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে কাজ শুরু করলো। এদিকে একে একে চারটা টেবিল ফাঁকা হয়ে গেলো। কাস্টোমাররা চলে যাচ্ছেন। তখনই লোকটা আবারও নির্দেশ দিলেন ইলমাকে….
—“টেবিলগুলো পরিষ্কার করে ব্যবহৃত সব মগগুলো সিন-এ নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে আবারও এখানে এনে অতিরিক্ত পানি মুছে ফেলবেন।”
ইলমা নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো…

—”মনে হচ্ছে আজ সারাদিন এই লোকটার আদেশ অনুযায়ীই চলতে হবে আমায়!”
অতঃপর ইলমা নিজ কাজে লেগে পড়লো। একবার কাস্টোমারদের কফি পরিবেশন করছে, আবার কেউ চলে গেলে টেবিল পরিষ্কার করছে, কখনো বিলের রশিদ দিচ্ছে। ঘুরে ঘুরে সব কাজ একাকেই সামলাতে হচ্ছে ইলমার।
আর ঐ লোকটা কেবল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অবিরাম ভাবে একের পর এক কফি বানিয়ে চলছে এবং একটু পর পর রেজিষ্টারে কিছু লিখছে।

একটা স্কাই ব্লু কালার লং সিম্পেল কাজ করা গাউন এর সাথে সাদা রংয়ের হিজাব পড়েছে পিহু। কোনোপ্রকার মেক-আপ এর ছিটেফোঁটাও নেই মুখে। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে লিপবাম দিয়ে নিজের সাজ সম্পন্ন করেছে পিহু। হাতে একটা ছোট আকারের পার্টস ব্যগ নিয়েছে। যেখানে নিজের ফোন সহ সারফারাজের দেওয়া এতিম বাচ্চাদের শীতবস্ত্র কেনার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে নগদ টাকা ও কার্ড রাখা রয়েছে। কার্ড কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেই নিয়মটাও সহজ ভাবে সারফারাজ পিহুকে বুঝিয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে নীরা হাঁটুর একটু নিচ পর্যন্ত গিয়েছে এমন একটা অফ হোয়াইট কালারের টপস এর সাথে অলিভ গ্রিন কালারের প্লাজু পড়েছে। প্লাজুর সাথে ম্যচ করে একটা ওড়না গলার সাথে পেঁচিয়ে বুকের উপর ফেলে রেখেছে। কাঁধ সমান স্ট্রেইট করা চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে রেখেছে। মুখে হালকা মেক-আপ করেছে আর ঠোঁটে নুড কালার লিপস্টিক দিয়েছে। বাম হাতে একটা ব্রেসলেট সাথে ২ ইন্ঞ্চি খানেক উঁচু হিল পড়েছে নীরা।
একসাথে বাড়ির বাহিরে এসে আগের থেকেই দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়িটার পিছন সিটে উঠে বসলো পিহু ও নীরা দু’জনেই। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো। বাড়ি থেকে সবথেকে কাছে যে অনাথ আশ্রমটা হয় সেখানেই যাবে বলে ঠিক করলো পিহু। কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই অনাথ আশ্রমে এসে সেখানের পরিচালকের সাথে কথা বললো পিহু ও নীরা দু’জনেই।

অতঃপর আশ্রমটা একটু ঘুরে ঘুরে দেখলো ওরা। কতোজন বাচ্চা সেখানে থাকছে বর্তমানে, এছাড়াও শীতের কাপড়ের পাশাপাশি আরো কি কি জিনিসপত্র ওদের প্রয়োজন তা নোট করে নিয়ে আশ্রম থেকে বেড়িয়ে সোজা মার্কেটে চলে এলো ওরা। সব কেনাকাটা সেরে আবারও আশ্রমে এসে বাচ্চাগুলোর মাঝে পোশাক, খাবার ও তাদের প্রয়োজনীয় কিনে আনা জিনিসপত্র গুলো বিতরণ করে দিলো পিহু ও নীরা একত্রে।
আরো কিছুক্ষণ ওদের সাথে সময় কাটিয়ে পিহু ও নীরা পুনরায় গাড়িতে উঠে বসলো। নীরা ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বললো…..

—”এবার আমাদের বাংলো বাড়ি নিয়ে চলুন চাচা।”
ড্রাইভার নীরার কথানুযায়ী গাড়ি স্টার্ট করে সেইপথেই রওনা হলো। পিহু বললো….
—”ঐ অসহায় বাচ্চাগুলোর দিকে আগে যখন তাকাতাম বড্ড মায়া কাজ করতো। কিন্তু তখন আমার সামর্থ্য ছিলো না ওদের জন্য কিছু করার। আজ তোমার ভাইয়ের জন্য ওদের কিছু উপকার করতে পেরে মনের ভিতর কি ভিষণ তৃপ্তি কাজ করছে তা তোমাকে ভাষায় বলে বোঝাতে পারবো না নীরা।”
নীরা হাসিমুখে বললো…

—”সত্যি বলতে এটা আমারও অসহায় বাচ্চাগুলোর জন্য করা ১ম কোনো কাজ ছিলো। আমার তো সামর্থ্যের ছিলোই শুরু থেকে। তবুও কখনই এই বিষয়গুলো নিয়ে এতো মাথা ঘামাতাম না আমি। রাস্তাঘাটে চলাচলের সময়, জ্যমের মাঝে কখনও গাড়ি আটকে পড়লে আশে-পাশে যে বাচ্চাগুলো এসে সাহায্য চাইতো তাদের ডাক মাঝে মাঝে কানে তুলতাম আবার প্রায় সময়ই এড়িয়ে যেতাম। আজ ওদের জন্য তোমার ইচ্ছে শক্তির বদৌলতে কিছু করতে পেরে আমারও মনেপ্রাণে অন্যরকম শান্তি কাজ করছে ভাবীপু। কথা দিচ্ছি এখন থেকে প্রায়ই এমন অনাথ আশ্রম গুলোতে যাবো আমি। আর নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ওদের সাহায্য-সহযোগিতা করবো ইনশাআল্লাহ।”
নীরার কথা শুনে পিহুর ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ওদের কথপোকথনের মাঝেই গাড়িটা বাংলোর মেইন গেইট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। পিহু কিছুটা সংকোচ নিয়ে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—”চাচা, আপনার কাছে একটা ছোট্ট আবদার করার ছিলো আমার।”
ড্রাইভার পিহুর এমন কথা শুনে হেসে নম্রস্বরে বললেন….
—”ছি ছি বড় ম্যম সাহেব এসব কি কইতাছেন আপনে! আপনে আমার মালকিন। আপনে আমার কাছে আবদার করবেন কেন! আপনে আমারে হুকুম করবেন আর আমি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করমু।”
পিহু বললো….
—”আপনি আমার বাবার বয়সী, চাচা। আপনাকে আমি সেই নজরেই দেখছি। এখানে মালিক-দাসের সম্পর্ক টানবেন না। আপনার কাছে তাই আমার আবদার করাটাও শোভা পায়।”
ড্রাইভার হেসে মাথা নাড়লেন কেবল৷ পিহু আবারও বললো….
—”এমপি সাহেব যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে আমরা অনাথ আশ্রম ও মার্কেট ব্যতিত আরো কোথাও গিয়েছিলাম কিনা আপনি দয়াকরে আমাদের বাংলো বাড়িতে আসার কথাটা তার নিকট বলবেন না। এতে আমাদের সবার বড্ড উপকার হবে।”
ড্রাইভার বললেন….

—”আপনে নিশ্চিন্ত থাকেন মা। আমি সাহেবরে কিচ্ছু বলমু না এইখানে আসা নিয়া। সাহেব আমার কলিজা কা*ই*টাও সত্যটা বের করতে পারবো না।”
পিহু আর নীরা ড্রাইভারের কথায় অনেকটাই স্বস্তি বোধ করলো। অতঃপর ওরা একত্রে গাড়ি থেকে নেমে বাংলো বাড়ির ভিতরে আসার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো।

ঘরোয়া খাবার খাওয়ার বিন্দুমাত্র রুচি লাগছে না তেজের। তবুও খুব জোর করে সামান্য ভাত খেয়েছিলো তেজ। হুট করেই নেশা জাতীয় সব দ্রব্য সেবন করা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিবে বলে করা প্রতিজ্ঞাটাও এখনও বড্ড পু*ড়া*চ্ছে ওকে। জ্বর এখন নেই বললেই চলে। স্বর্দির সমস্যা আছে হালকা। হাঁচি পড়া বন্ধ হয়েছে। গলার ভিতর হালকা খুসখুস ভাবটা নতুনভাবে তৈরি হয়েছে। সকালেই ওদের পারিবারিক ডাক্তার এসে তেজকে চেক-আপ করে ঔষধ লেখে দিয়ে গিয়েছিলেন। মূলত সকালে ও দুপুরে সেই ঔষধ গুলো খেয়েই এখন শারিরীক সমস্যাগুলো অনেকটাই তেজের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে পেটের উপর সোফা সেটের একটা বালিশ চেপে ধরে আছে তেজ। পরণে একটা গাড় নীল রংয়ের টি-শার্ট ও ধূসর রংয়ের ট্রাউজার রয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে কপালের উপর বিস্তার করছে। সবেমাত্র শাওয়ার নিয়ে নির্ঝর ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর পরণে রয়েছে একটা অফ হোয়াইট টি-শার্ট ও গ্রে কালার ট্রাউজার৷ একহাতে তোয়ালে ধরে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে তেজের পাশে বসে ওর দিকে তাকিয়ে নির্ঝর বললো…..

—”তেজ ভাই, তুমি তো ঘরোয়া খাবার কিছুই খাচ্ছো না সেভাবে। বাহির থেকে কিছু আনাবো কি?”
তেজ বললো….
—”আনানো সম্ভব না।”
নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে বললো….
—”সম্ভব না মানে?”
—”সারফারাজ ভাই আমাদের দু’জনেরই কার্ড ব্লক করে দিয়েছেন। ঐ কার্ড ব্যবহার করে আমরা আর কোনকিছুই কিনতে পারবো না।”
তেজের কথায় নির্ঝরের চোখের আকৃতি স্বাভাবিক এর থেকে বড় হয়ে গেলো অনেকটাই। তেজ আবারও বললো…..
—”হাতে ও ভাতে দুই দিক দিয়েই মা*রা*র কাজ সম্পন্ন করলো ভাইয়া। এবার ভু*ল না শুধরে নেওয়া পর্যন্ত মিনিমাম টাকাও হাতে পাবো না রে আমরা নিজ্ঝরিয়া।”
তেজের কথা শেষ হতে না হতেই পিহু আর নীরা একত্রে বাংলো বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। তেজ আর নির্ঝরের নজর মূল দরজার দিকে গেলো। পিহু পুরোপুরি ভাবেই অপরিচিত একজন নির্ঝর ও তেজের জন্য। আর নীরাকে তো পুরোপুরি ২বছর পর দেখছে ওরা সামনা-সামনি। নির্ঝর আর তেজ দু’জনেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অবাক ভাব ওদের দু’জনের মুখশ্রী জুড়েই ফুটে আছে। নির্ঝর বললো….

—”নীরা!”
নীরা আর পিহু ওদের দু’জনের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। নীরার মুখ পুরো হা হয়ে গিয়েছে তেজকে এই রূপে দেখে। কারণ নীরাও তেজের ইনোসেন্ট, সাদাসিধা, আনস্মার্ট লুকটাই দেখে এসেছে বহুকাল ধরে। তেজ বললো…..
—”নীরা! তুই কবে দেশে আসলি?”
নীরা ঢোক গি*লে নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিয়ে বললো….
—”তুমি কি তেজ ভাই? আমাদের তেজ ভাই? আসলেই তুমিই কি তেজওয়ার খান তেজ?”
তেজ কিছুটা মুখ কুঁ*চ*কে নিয়ে বললো….
—”নাটক কমায় কর। বহুত প্যরায় আছি এই রূপ নিয়ে।”
নীরা বললো….

—”কে বলেছিলো এই প্যরা নিতে তোমায়? শুরু থেকেই যদি নিজেকে এই রূপেই রাখতে ঘরে ও বাহিরে সমান ভাবে তাহলে তো আজ আর এই দিনটা দেখতে হতো না তোমায়।”
তেজ কপট রাগ নিয়ে বললো….
—”২ বছর ধরে কারোর সাথে কোনো যোগাযোগ রাখিস নি। আজ ২বছর পর দেশে ফিরে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস? কে চাইছে তোর এই জ্ঞান?”
তেজের কথায় নীরার মুখ ফ্যকাসে হয়ে এলো। নির্ঝর বললো…
—”তেজ ভাই, শান্ত হও তুমি। এখন এভাবে রাগারাগি করার সময় নয়৷ আর নীরা তোর সাথে উনি কে?”
পিহু শান্ত কন্ঠে বললো….

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৪ (৩)

—”আমি আপনাদের বড় ভাই সারফারাজ ইউসুফ খানের বিয়ে করা বউ প্রহেলিকা পিহু।”
পিহুর এরূপ কথা শুনে তেজ আর নির্ঝর একসাথে উচ্চস্বরে বললো….
—“কি বললেন আপনি? বড় ভাইয়া বিয়ে করেছেন?”

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here