নিবেদিতা পর্ব ১৩

নিবেদিতা পর্ব ১৩
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

মিদহাদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইছে আর নাচছে। আজকের সকালটা সুন্দর। দিনটাও সুন্দর হওয়ার কথা। মন ফুরফুরে লাগছে নিবেদিতার ছবি দেখে। আজ অনেকদিন পর নিবেদিতা ফেসবুকে ওর নিজের একটা ছবি দিয়েছে। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটের সামনে দাঁড়ানো হাস্যজ্বোল মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে অবশ্য আরেকটা বাঙালি মেয়েও রয়েছে। তবে মিদহাদ সেদিকে নজর দেয়নি।

তার দৃষ্টি নিবেদিতার দিকে ছিল। নিবেদিতা ভালো আছে আর এতেই সে খুশি। সে সবসময় দূর থেকে এটাই চেয়েছে নিবেদিতা ভালো থাকুক, হাসি-খুশি থাকুক। ওর খুব ইচ্ছে করছিল একটাবার ফোন করতে। একটু খোঁজ-খবর নিতে। কিন্তু সাহস হলো না। পাছে নিবেদিতা আবার কী না কী ভাবে! অথবা বিরক্তও হতে পারে। নিবেদিতার ভালো সময় সে কোনোভাবেই নষ্ট করতে চায় না। এছাড়া সরাসরি কথা বলে খোঁজ না নিলেও নয়নের সঙ্গে প্রতিদিনই কথা বলে সে খোঁজ-খবর নিচ্ছে।
মিদহাদের ছোটো বোন মৌটুসি মিদহাদকে ডাকতে এসে এভাবে নাচতে দেখে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কী ব্যাপার ভাইয়া, আজ এত খুশি কেন?”
মিদহাদ দরজার দিকে তাকিয়ে মৌটুসিকে দেখে মুচকি হাসল। চুলে চিরুনি করে বোনের কাছে এসে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
“কেন রে আমার খুশি কি তোর হজম হচ্ছে না?”
মৌটুসী রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি এই কথা কখন বললাম?”
“বলতে হয় না। আমি সব বুঝি।”
“ছাই বুঝো তুমি! তোমাকে ডাকতে আসাই ভুল হয়েছে। তুমি খুব খারাপ লোক।”
“নতুন কিছু বল।”

“তোমার বউ একটা জ’ল্লা’দ হবে দেখে নিও। সকাল বিকাল নিয়ম করে তোমাকে শূ’লে চড়াবে। তোমার জীবন ভাজাভাজা করে খাবে।”
“তুই আমার আপন বোন হয়ে এমন বদদোয়া করতে পারলি?”
“পারলাম। কারণ তুমি খারাপ।”
এটা বলেই মৌটুসী মিদহাদের হাতে খামচি দিয়ে দৌঁড়ে ডাইনিংরুমে চলে গেল। পেছন পেছন মিদহাদও দৌঁড় দিল। মৌটুসী বাবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মমতা বেগম দুজনকেই ধমক দিয়ে বললেন,
“কী ব্যাপার? কী হচ্ছে এগুলো?”

মিদহাত হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে বলল,
“দেখো তোমার মেয়ে আমার হাতে চিমটি দিয়ে কী করেছে? রা’ক্ষ’সী একটা!”
“নিশ্চয়ই তুমি ওর পেছনে আগে লেগেছ।” বললেন মমতা বেগম।
মিদহাদ চেয়ার টেনে বসল। গাল ফুলিয়ে বলল,
“সবসময় শুধু মেয়ের সাপোর্টই টানলে।”
আহসান আহমেদ বললেন,
“তুমিও আর বড়ো হলে না! তারপর আপডেট দাও।”
মিদহাদ বলল,

“কীসের আপডেট আব্বু?”
“সবকিছুরই। অফিস কেমন কাটছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো।”
“বলেছিলে দেশ থেকে ঘুরে এসে বিয়ে করবে। এরপর তো অনেকদিন চলে গেল। কিছু তো জানালে না।”
মিদহাদ চুপ করে আছে। তিনি আবার বললেন,
“কী হলো? পছন্দের কেউ আছে?”

মিদহাদ হেসে বলল,
“আমাকে আর একটু সময় দাও আব্বু।”
“আরো সময়?”
“হু। বেশি না। অল্প।”
আহসান আহমেদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন,
“বেশ! দেখি সময় নিয়ে পরে তুমি কী করো।!
“থ্যাঙ্কিউ আব্বু।”
মিদহাদ নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ল অফিসে যাওয়ার জন্য। সাথে মৌটুসীও আছে। ওকে স্কুলে দিয়ে সে অফিসে যাবে। মিদহাদ ড্রাইভিং করতে করতে মৌটুসীকে বলল,

“তুই যে তখন আমাকে খামচি দিলি, এখন যদি আমিও একটা দেই তাহলে কেমন হবে?”
মৌটুসী ব্যাগ সামনে রেখে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে বলল,
“খবরদার, না ভাইয়া! আব্বুকে কিন্তু বলে দেবো।”
“আমি কি ভয় পাই আব্বুকে?”
“ভাইয়া সামনে!”

মিদহাদ সামনে তাকিয়ে সাথে সাথে ব্রেক কষল। সামনে এক মেয়ে দুহাত ওপরে তুলে গাড়ি থামানোর জন্য হাত নাড়ছিল। মিদহাদ গাড়ি থামাতেই মেয়েটা এগিয়ে এলো। মিদহাদ গাড়ির কাচ নামিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা মাথা নিচু মিদহাদ ও মৌটুসীকে দেখল। মিদহাদ জিজ্ঞেস করল,
“হু আর ইউ?”
মেয়েটা মুচকি হেসে স্পষ্ট বাংলাতে বলল,
“আমি সুবর্ণলতা।”

আকাশমুখী হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে নিবেদিতা। অনেক বেশি ক্লান্ত লাগছে শরীর। উঠে রান্নাবান্না করতে ইচ্ছে করছে না। অথচ রান্না না করলে খাওয়াও হবে না। চাইলে বাহির থেকে খাবার অর্ডার করা যাবে। কিন্তু এতে টাকা নষ্ট হবে। ডেনমার্কে আসার পর থেকে নিবেদিতা টাকা অনেক হিসাব করে খরচ করে। তার বাবার পাঠানো কষ্টের টাকা সে বিলাসিতায় নষ্ট করতে চায় না। এখনো একটা জবের ব্যবস্থা করতে পারেনি।

একটা পার্ট টাইম জবের ব্যবস্থা হয়ে গেলে তখন হয়তো একটু বাড়তি খরচ করা যাবে। বাবার ওপর প্রেশারও কমবে। অবশ্য জবের ব্যাপারে বাবার পারমিশন নেই। তার আদরের মেয়ে ভিনদেশে কষ্ট করে কাজ করবে এটা তার মানতেই কষ্ট হয়। কিন্তু নিবেদিতা তবুও করবে। নিজের জন্য হলেও। এতে করে তার সময় কাটার সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। সাবিহাকে সে বলে রেখেছে একটা কাজ জোগাড় করে দিতে। সে বলেছে দেবে। অবশ্য নিবেদিতা নিজেও জানে, একটু দেরি হলেও সে কোনো না কোনো একটা কাজ পেয়ে যাবে নিশ্চিত।

আলস্য ভেঙে ক্লান্ত শরীরটাকে প্রচণ্ড অনিচ্ছায় যেন টেনে তুলল নিবেদিতা। চুলগুলোকে হাতখোপা করে কিচেনে গেল। কী যে রান্না করবে বুঝতে পারছে না। চটজলদি কী করা যায়? ডিম? হ্যাঁ, ডিম ভুনা ও ভাত আজকের জন্য। এরচেয়ে বেশি কিছু সম্ভব না। চুলায় ডিম সেদ্ধ দিয়ে সে পেয়াজ, মরিচ বের করল কাটার যখন। তখন রুম থেকে তার ফোনটা বেজে উঠল। নিবেদিতা রুমে এসে দেখল মা হোয়াটসএপে ভিডিয়ো কল দিয়েছে। ফোন রিসিভ করে কিচেনে গেল সে। একটা স্থানে ফোন রেখে পেয়াজ কাটতে কাটতে কথা বলতে লাগল।
নাসিমা বেগম আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

“কী করো আম্মু?”
নিবেদিতা হেসে বলল,
“পেয়াজ কাটি। রান্না করব।”
“খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে না?”
নিবেদিতা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস নিল। সে জানত বাইরের দেশে সার্ভাইভ করা কঠিন। কিন্তু তাই বলে যে এতটা কঠিন সেটা ভাবেনি। কিন্তু সেসব গোপন রেখে বলল,
“কষ্ট হবে কেন?”
“এইযে একা একা সব করতে হচ্ছে।”

“না, মা। বরং আমি এসব ইনজয় করছি। কিন্তু তোমাদের ভীষণ মিস করি।”
নাসিমা বেগম সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেললেন। নিবেদিতার নিজেরও চোখ ছলছল করে উঠল। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলল,
“তুমি এত পাগলি কেন মা? একদম বাচ্চা! দিনদিন বয়স কমে বাচ্চা হয়ে যাচ্ছ।”
নাসিমা বেগম কান্নার জন্য কথা বলতে পারছেন না। বেশ অনেকক্ষণ পর তিনি স্বাভাবিক হলেন। নাক টেনে বললেন,
“কেন যে তুই এতদূরে চলে গেলি আমাদের রেখে!”

“আবার চলেও তো আসব মা। দেখতে দেখতেই সময় চলে যাবে। একটু শান্ত হও। তুমি এমন করলে কি আমি দূরে ভালো থাকতে পারব বলো?”
নাসিমা বেগম কিছু বললেন না। চোখ মুছলেন। নিবেদিতা বলল,
“রাকিব কোথায়?”
“ঘুমাচ্ছে। তোর বাবার সাথে কথা হয়েছিল?”

তরকারি কাটা শেষ করে নিবেদিতা ফোন নিয়ে রুমে এলো। জানালার পাশে বসে বলল,
“হ্যাঁ। আব্বু, ভাইয়া দুজনের সাথেই কথা হয়েছে। ভাইয়ার জন্য নাকি তোমরা মেয়ে দেখতে চাচ্ছ?”
“হ্যাঁ। কিন্তু গাধাটা বিয়ে করতে চাচ্ছে না। বয়স কি থেমে আছে? আর কবে বিয়ে করবে?”
“ভাইয়া কী বলে?”
“এখন বিয়ে করবে না। আরো পরে করবে।”

“তাহলে জোর করছ কেন? যখন ইচ্ছে হয় করবে।”
“আরে বাহ্! খুব যে ভাইয়ের সাপোর্ট নিচ্ছিস?”
নিবেদিতা হেসে ফেলল। বলল,
“ভাই বলে কথা!”
“আচ্ছা শোন, নয়নের কি কারো সাথে কোনো সম্পর্ক আছে? তুই জানিস কিছু?”
“না তো! আমাকে তো কিছু বলেনি।”
“তুই মিদহাদকে ফোন দিস তো।”
“কেন?”

“মিদহাদ জানলেও জানতে পারে। আমি তো আর মা হয়ে ছেলের প্রেমিকার কথা জানতে চাইতে পারি না। তুই বোন। তুই জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবে না।”
নিবেদিতা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। আচ্ছা মা এখন রাখি। রান্না করব। রান্না শেষে কল দেবো।”
“আচ্ছা মা। রান্না শেষ করে আগে খেয়ে নিবি। পরে কল দিস।”
“ঠিক আছে।”

নিবেদিতা কল কেটে আনমনা হয়ে বসে রইল। নয়নের বিয়ের কথা উঠতেই নির্ণয়ের বিয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তাদের বিয়ের কথাবার্তা কতদূর এখন কে জানে! মা তো এই ব্যাপারে কিছু বলেও না। এখানে আসার পর খালার সাথে চার, পাঁচবার ফোনে কথা হয়েছিল। কিন্তু নির্ণয়ের বিয়ে নিয়ে কোনো কথা হয়নি। যেচে জিজ্ঞেসও করতে পারেনি নিবেদিতা। সে উদাস হয়ে বসে থাকতে থাকতে চুলায় যে ডিম সেদ্ধ দিয়েছে এটা দিব্যি ভুলে গেছে। মনে পড়তেই দৌঁড়ে কিচেনে গেল। গিয়ে দেখে ডিম সেদ্ধ হয়ে ফেটে বেরিয়ে আছে। চুলা নিভিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিবেদিতা। মনটা যন্ত্রণায় হুহু করে ডেকে উঠল,

নিবেদিতা পর্ব ১২

“নির্ণয়!”
পরক্ষণে স্বগতোক্তি করে বলল,
“আই মিস ইউ। রিয়েলি আই মিস ইউ। এত দূরে এসেও এক সেকেন্ডের জন্যও বোধ হয় আপনাকে ভুলে থাকতে পারছি না। এ কেমন ভালোবাসা? কেমন মায়ায় বেঁধেছেন আমাকে? কেন এত কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে? কেন?”

নিবেদিতা পর্ব ১৪