নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১৭+১৮
আহমেদ হৃদ
সারারাত অদ্ভুতরকম আনচান করে কাটলো আরুর। সাথে মিশ্র অস্থিরতা। ভয়-ও ছিলো। আহমেদ সাহেব কি আদেও রাজি হবে? যেতে দেবে রুদ্র’দের বাড়ি? আরু নিজেকে ধাতস্থ করলো বোঝালো, দেবে দেবে! বি পজিটিভ! আরু আয়নার সামনে গিয়ে বসলো। ঘরির কাটায় সাতটা বাজে। আরু যেদিন চায়, খুব ভোরে উঠতে পারে। আর যেদিন চায় না, বেলা গড়াক! উচ্ছন্নে যাক সবকিছু। আগে ঘুম আরুর জন্য ইমপর্টেন্ট। এতো সকালে আরুর বাবা ওঠেন না। তাইতো সময় কাটাতে বসলো আরু। আয়নাতে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। নাকটা কেমন দিনদিন বোঁচা হয়ে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য! রুদ্র একদিন এই বোঁচা নাক নিয়ে খোঁটা দেবে নিশ্চিত। বলবে,’একেই উড়নচণ্ডী, তার উপর নাকের উপর দিয়ে যেন ট্রাক গেছে। কি বিশ্রী!’
ভাবলেই আরুর শরীর রি রি করছে। কতো’ই না লজ্জা পাবে তখন আরু! আরু নাকটা টানে ধরে রাখলো কয়েক মিনিট। কিন্তু কোন কাজ হলো না। আবারো বেঁকে রইলো। আরু এবার দেখলো চোখদুটো। ইশশ্! কি বাজে! মনে হচ্ছে চোখের নিচে পাতিলের তলার কালি লেপ্টে দিয়ে গেছে কেউ। আরু বিরক্ত হয়ে উঠে দাড়ালো। এই পেত্নীর মতো মেয়েটাকে রুদ্র’র নিশ্চয়ই ভালো লাগে না। তবে কি নাটক করে? ওমন সুন্দর মানুষটার সাথে কি মানাবে এই আরুকে? মনে হবে, গোলাপের পাশে গাঁধা ফুটে আছে।
আরু চিন্তায় পড়লো। আজকাল আরুর চিন্তার কোন শেষ নেই৷ এতো চিন্তা করলে যে চুলটাও পেকে যাবে, তা নিয়েও আকাশ-পাতাল চিন্তা হয় আরুর। চুল পাকলে তখন রুদ্র কি আরুকে ভালোবাসবে? সেদিন রাতের মতো আগলে রাখবে চুলগুলো? রাখবে না! বরং কটাক্ষ করে বলবে,’উড়ি উড়ি করতে করতেই বুড়ি হয়ে গেলে।’
তখন আরু কি জবাব দেবে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরু মাথাভর্তি চিন্তা নিয়ে ঘরে থাকতে পারছে না। আরু বেরোলো ঘর থেকে। দোতলা’টা তিনবার চক্কর দিয়ে দেখলো কেউ উঠেছে নাকি। এরপর নিচে নেমে এলো। আরু মাকে খুঁজলো। পেলো না কোথাও। এরপর গুটিগুটি পায়ে আহমেদ সাহেবের রুমের দিকে গেলো। ঘরের দরজা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে আরু উঁকি দিলো ভেতরে। ধীর গতিতে দরজা খুলে ডুকলো আরু। মহুয়া বেগম রুমে নেই। কোথায় গেলো সকাল সকাল? আহমেদ সাহেব ঘুমোচ্ছেন। আরু হতাশ শ্বাস ফেললো। পা টিপেটিপে আবারো আয়নার সামনে গেলো। এই আয়নাতে একটু ভালো লাগছে নিজেকে আরুর। আরু চুলগুলো কানে গুজে নিয়ে হাঁসলো। একা একা কি সব বিরবির করলো কতক্ষণ। এরপর নিজের প্রতিবিম্বে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে বেরোতে নিলেই, আহমেদ সাহেব ডেকে উঠলেন,
‘আরু।’
ঘুম জড়িত কন্ঠ আহমেদ সাহেবের। আরু থামে গেলো। পিছু ফিরে মাথা নিচু করে নিলো। আহমেদ সাহেব উঠে বসলেন। ডাকলেন,
‘এদিকে এসো।’
আরু এগোলো না। সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আহমেদ সাহেব গরম শ্বাস ফেললেন। বললেন,
‘কিছু বলবে?’
আরু মাথা নাড়লো। মানে সে বলবে।
‘কি বলবে বলো।’
মুহুর্তে দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে এলো আরুর। কন্ঠ হয়ে উঠলো ভারী। আরুর ভয় হচ্ছে। আরুতো জানে, তাকে যেতে দেবে না। আরু হাত কঁচলাতে লাগলো। ক্ষিন গলাশ বললো,’উনি ডেকেছিলেন।’
‘উনি কে?’
আরুর এবার ভয়ের সাথে যুক্ত হলো লজ্জা। জবাব দিলো ছোট করে,’রুদ্র।’
‘কি বললো?’
‘ওনার মা ডেকেছেন।’
‘হুম,তো?’
আরু চোখ তুলে তাকালো। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো আরু। নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। শুকনো ডোগ গিয়ে নতজানু কন্ঠে বললো,’যাব?’
আহমেদ সাহেব বিছানা ছাড়লেন। আরুর বুক এবার কাঁপছে। উনি এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন আরুর সামনে। মাথায় হাত রেখে নরম কন্ঠে বললেন,’সন্ধ্যার আগে চলে আসবে।’
আরু চমকালো, স্তব্ধ নয়নে চোখ তুলে তাকালো। আহমেদ সাহেবের চোখে আজ কঠোরতা নেই। সবসময় থাকা কপোট রাগ নেই। রয়েছে আরুর জন্য তিব্র স্নেহ, মায়া। আরু জপটে ধরলো তার বাবাকে। চোখের কর্নিশে জমলো একফোঁটা নোনাজল। আরু তা মুছে নিলো। ছেড়ে দিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
‘ধন্যবাদ আব্বু।’
আরু আর একমুহূর্ত দাড়ালো না। খুশিতে দম আঁটকে আসছে আরুর। অনেকদিন পর আরু নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে। স্নেহ পেয়েছে। আরুর চোখ আবারো ভিজে উঠলো। আরু চোখ মুছতে মুছতে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। রুমে প্রবেশ করলেন মহুয়া। তেড়ে এসে বললেন,
‘কি বললে মেয়েটাকে তুমি?’
‘কই কি বললাম?’ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আহমেদ সাহেব।
‘আমি স্পষ্ট দেখলাম ও কাঁদছে। ক’দিন বাদেই মেয়েটা চলে যাবে। এখনো তোমার রাগ?’
আহমেদ সাহেব হাঁসলেন। আরুর কান্না দেখে যে কেউ-ই বলতো আহমেদ সাহেব বকেছেন। অবশ্য এটা তো ঠিকি-ই, আরুকে আদরের থেকে রাগটাই তিনি বেশি দেখিয়েছেন সবসময়। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এইতো একটু আগেও ঘুমের রাজ্যে আরু এসে জানালো, ‘আব্বু আব্বু, দেখো আমি সাংবাদিক হিসেবে কত বড় চ্যানেলে চাকরি পেয়েছি। তুমি বলতে না, আমি কিছু হতে পারবো না! জার্নালিস্ট হয়ে দেখালাম তো?’
আরুর সেই মুখে স্মিত হাসি লেপ্টে। খুশিতে জল জমেছে চোখের কোনায়। আহমেদ তখন ঠোঁট ছুঁইয়েছিলেন আরুর কপালে। আহ্, কি সুন্দর স্বপ্ন!
‘তুমি হাঁসছো?’
মহুয়া বেগমের কথায় ভাবনার সুতো কাটলো। তিনি স্বাভাবিকভাবেই বাথরুমে চলে গেলেন। মহুয়া হতভম্ব! অন্যদিন তো তেড়ে আসে, কথা শোনায়। আজ তবে কি হলো?
আটটা বাজতেই আরু রেডি হতে বসলো। আজ সে হালকার উপর লাইট করে ব্রাইট হয়ে রুদ্র’র সামনে গিয়ে দাড়াবে। এইযে বোঁচা নাকটা, এটা চোখেই পড়তে দেবে না। শুধু হা হয়ে তাকিয়ে থাকবে লোকটা আরুর দিকে। আরু সাদা-কালো রঙের আঁকিবুঁকি করা একটা কূর্তি পড়ে নিলো। পিঠ অব্ধি ঘন কালো কেশগুলো ছেড়ে দিয়ে মুখে পাউডার লাগালো। আজ আরু কোনরকম মেকাপ করবে না। রুদ্র যে প্রসাধনী পছন্দ করে না, আরু বুঝে গেছে এ ক’দিনে। চোখে খুবই হালকা কাজল দিলো আরু। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিলো। তখনি বেজে উঠলো আরুর ফোন। আরু ছুটে গিয়ে রিসিভ করলো ফোন। এরপর বেলকনিতে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো, রুদ্র এসেছে! ওইতো দেখা যাচ্ছে সাদা গাড়িটা। আরু ফোনে ‘আসছি’ বলে কেটে দিলো। ভেতরে এসে গলায় শুভ্র রঙা ওড়নাটা পেঁচিয়ে, পছন্দের পুতুল ওয়ালা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলো আরু। ব্যাগ থেকে কালো সানগ্লাসটা বের করে চোখে দিলো আরু। স্টাইল করে হেঁটে গাড়ির দরজা খুলে বসলো রুদ্র’র ঠিক পাশে। চোখের সামনে এসে পড়া বেবি হেয়ারগুলো ফু দিয়ে সড়িয়ে আড়চোখে রুদ্র’কে দেখে নিলো। এরপর সামনে তাকিয়ে রয়েসয়ে বললো,
‘চলুন।’
‘কি হয়েছে তোমার?’
ভ্রু কুঁচকে এলো আরুর। তার আবার কি হলো? আরু তাকালো রুদ্র’র দিকে। রুদ্র কালো টি-শার্ট পড়েছে। পেশিবহুল বলিষ্ঠ দেহে সেঁটে আছে গেঞ্জিটা। চুলগুলো গুছিয়া রাখা হয়েছে স্ব-যত্নে। আরু জিজ্ঞেস করলো,
‘কই কি হয়েছে?’
‘এমন করছো কেন?’
‘কেমন করলাম আবার?’
রুদ্র তপ্তশ্বাস ফেললো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ড্রাইভিং এ মনোনিবেশ করলো। আরু ও বাইরে চোখ রাখলো। বেশ খানিকটা পথ নিরবে গেলো দু’জনে। নিরবতা ভেঙে কথা শুরু করলো রুদ্র। বললো,
‘যেখানে যাও এই পুতুলওয়ালা ব্যাগটা নিয়ে যাও কেন?’
রুদ্র কথার পরপরই আরু তড়িঘড়ি করে ব্যাগটা আগলে নিলো। যেন কেড়ে নেবে রুদ্র। চোখদুটো ছোটছোট করে তাকালো রুদ্র’র দিকে। বললো,’আপনার সমস্যা?’
‘হ্যা।’
‘কি সমস্যা?’
‘ওগুলো ছোট বাচ্চাদের ব্যাগ। এমনিতেই তুমি বাচ্চা। তারউপর বাচ্চা হওয়ার একটা স্টেপ-ও তুমি মিস করো না।’
আরু কোন কথা বললো না। এই লোকটার সাথে আর কোন কথাও বলবে না ঠিক করে বাইরে তাকালো। গাড়ি চলতে লাগলো হাইওয়ে ধরে দ্রুত গতিতে। মিনিট ত্রিশের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেলো। গাড়ি থামলো সেই আলিশান বাড়িটার মেইন গেট ভেদ করে ভেতরে। আরু নামলো। চশমাটা স্লো-মতে ব্যাগে রেখে দিলো। রুদ্র গাড়ি পার্ক করতে গেলো। আরু চারপাশ দেখতে লাগলো মুগ্ধ হয়ে। কত কত ফুলগাছ চারিদিকে। সবথেকে বেশি রক্তজবার গাছ। রুদ্র পাশে এসে দাঁড়ালো। বললো,
‘কি দেখছো?’
‘কিছুনা।’
‘ভেতরে চলো।’
রুদ্র এগোতে লাগলো৷ পিছুপিছু যেতে লাগলো আরু। কলিং বেল চাপে একঝলক আরুকে দেখলো রুদ্র। এদিক-সেদিন তাকিয়ে দেখছে আরু। এই মেয়েটা এতো সুন্দর কেন? দেখলেই মনে নিষিদ্ধ অনুভূতি জাগে রুদ্র’র। বুকে ধিপধিপ শব্দ হয়। মেয়েটা বোঝে? অবুঝ শিশু!
দরজা খুললেন ইলিমা। তিনি দরজা খুলে আরুকে দেখেই হৈ চৈ বাঁধিয়ে ফেললেন তিনি। টেনে নিয়ে এসে বসালেন আরুকে ড্রইংরুমে। একে একে সবার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন ইলিমা। তার মুখ জুড়ে কোমল হাসির বিচরণ। একে একে বাড়ির প্রতিটা কোনা থেকে সবাই আসতে লাগলো। হুট করে এমন হওয়ায়, আরু ঘামড়ে গেলো। জড়সড় হয়ে বসে রইলো। জেবা আর জুঁই এসে বসলো আরুর পাশে। ইলিমা গেলেন ঠান্ডা পানি আনতে। রুদ্র আরুর সামনের সোফায় বসলো ক্লান্ত ভঙ্গিতে। ইরহাম আজাদ’কে কোথাও দেখা গেলো না। ইলিমা পানি এনে আরুর হাতে দিলেন। পাশে বসে কোমল কন্ঠে বললেন,
‘ধীরে ধীরে খাও।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই; আরু ডগডগ করে গোটা পানির গ্লাস শেষ করে রাখলো টেবিলে। ইলিমা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখলেন। এরপর নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কেমন আছো মা?’
আরু থতমত খেয়ে উত্তর দিলো,’ভালো। আপনারা সবাই?’
জবাব দিলো জেবা। বললো,’আমরা তো ভালোই, তোমায় দেখে আরও ভালো হয়ে গেলাম।’
আরু লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। কি ভালো এই বাড়ির মানুষগুলো! এতো ভালোবাসা রাখবে কই আরু? ইলিমা উঠে দাড়ালেন। এখনো রান্না বাকি। তখুনি নিচে নামলো অভ্র। সুট,বুট,টাই আর হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ছুটছে অফিসে। ইলিমা অভ্র’কে দেখেই থামলেন। বললেন,
‘অভ্র শোন।’
অভ্র থামলো। জিজ্ঞেস করলো,’কিছু বলবে?’
‘আজ অফিসে না গেলে হয় না?’
অভ্র ভ্রুকুটি করে তাকালো। বুঝতে বাকি নেই, কেন তাকে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। অভ্র একপলক আরুর দিকে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বললো,’অনেক কাজ বাকি। আসছি..’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো অভ্র। ইলিমা হতাশ হয়ে গেলেন রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ নিরবতা কাটলেও, এরপর আসর জমিয়ে ফেললো জুঁই, জেবা। জেবার হাতে ফোন। মাঝেমাঝে সিরিয়াস হয়ে মেসেজ টাইপ করছে সে। টুকটাক কথা হতে হতে আরু নিজের সমস্ত দ্বিধা ভেঙে মন খুলে গল্প করতে লাগলো। কথার মাঝে হুট করে জুঁই প্রশ্ন করলো,
‘আচ্ছা ভাবি, বিয়েতে তুমি লেহেঙ্গা পড়বে নাকি শাড়ি পড়বে?’
আরু চোখ তুলে তাকালো রুদ্র’র দিকে। রুদ্র’র দৃষ্টি ও আরুর দিকে স্থির। কি উত্তর দেবে আরু? কি বলবে? উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো আরু। রুদ্র মুখ নাড়িয়ে ইসারা করছে কিছু বলতে। আরু বুঝছে না ঠিক। জুঁই একবার আরুকে, আরেকবার রুদ্রকে দেখছে। রুদ্র মুখ নাড়িয়ে বলছে,’শাআআআড়ি!’
আরু বুঝলো এবারে। জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে তার ভাইয়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আরু গলা পরিষ্কার করলো। বললো,
‘আমার ইচ্ছে লেহেঙ্গা পড়ার। আর এটাই পড়বো।’
শব্দ করে হেঁসে উঠলো জুঁই। রুদ্র’র দিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, সে কতটা অসহায়। রুদ্র লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে হজম করলো আরুর সূক্ষ্ম অপমান। একবার শুধু একলা পাক, বুঝিয়ে দেবে রুদ্র’র ইচ্ছাকে রিফিউজ করার ফল। আরু বোধহয় ভুলে গেছে, তার অবস্থানরত জায়গাটা রুদ্র’র নিজের এলাকা। রুদ্র থাকবে এবার তক্কে তক্কে, পেলেই..!!
রুদ্র উঠে উপরে চলে গেলো। রুদ্র’র যাওয়ার পাণে তাকিয়ে মুখ টিপে হাঁসলো আরু। এই লোকটাকে রাগাতে আরুর কি-যে ভালো লাগে! মনে প্রশান্তি আসে।আরু দোয়া করলো; এই আত্মিক শান্তি প্রতিদিন আসুক, রোজরোজ আসুক। রুদ্র আড়াল হতেই আরু হাঁসি থামিয়ে তাকালো জেবার দিকে। বসে বসে ফোন ঘাটছে জেবা। জুঁই’য়ের মুখেও হাসি। নিশ্চিত মেয়েটা বুঝেছে! বুঝবেই তো! এভাবে মুখ নাড়িয়ে না বলে অধিকার দেখিয়েও তো বলতে পারতো এইভাবে,’আরু শাড়ি পড়বে। শাড়ি না পড়লে কি বউ বউ লাগবে?’
আরু নাক কোঁচকালো। এসব ভাবার ধৃষ্টতা কিভাবে হয় আরুর? লোকটা যে আনরোমান্টিক, তা কিভাবে ভুলে বসে সে?
‘ভাবী, চলো ঘুরিয়ে আনি তোমায় পুরো বাড়িটা।’
জুঁইয়ের কন্ঠ গদগদ। ভাবনার সুতো কাটলো আরুর। উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলে উঠলো চোখদুটো। আরুর আসার কারনের অনেকাংশ তো এটাই। কাঙ্খিত মানুষটার বাসস্থল দেখা! রুদ্র নিশ্চয়ই এখন রুমে। কেমন হবে অগোছালো লোকটার রুম? সাজানো? নাকি অগোছালো? আরুর যেন শ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম। আরু মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো জুঁইয়ের কথায়। জুঁই আরুর হাত ধরে নিয়ে গেলো উপরে। নিচের থেকে উপরটা আরো গোছানো, পরিপাটি। চারিদিকে বিশিষ্ঠ মানুষদের ফ্রেমে বন্দি ছবি ঝোলানো। ইরহাম আজাদের ও ছবি চারপাশে। এই মানুষটাকে একদিন টিভিতে দেখেছিলো আরু। কিসের জন্য যেন সম্মাননা পেয়েছিলো। আরু ঠিক মনে করতে পারলো না। কাঁচের রেলিং ঘেষে সারিসারি দিয়ে বাতাবাহারি’র গাছের টবগুলোয় চোখ আঁটকে গেলো আরুর। আরু অবাক নয়নে দেখতে লাগলো চারপাশ। জুঁই আরুকে একটা ঘরে নিয়ে গেলো। টেডিবিয়ার দিয়ে ভর্তি চারপাশ। আরু এতো টেডি দেখে অবাক হলো। বিমুঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘তোমার কি কোন ছোট ভাই বা বোন আছে জুঁই?’
জুঁই হেঁসে ফেললো আরুর কথায়। শুধু আরু কেন, যে কেউ আসলেই এই কথা বলবে, বলতে বাধ্য! জুঁই ছোট করে জবাব দিলো,’না তো।’
‘এই রুমটা কার তাহলে?’
‘জেবা’র। এখানেই থাকে তোমার আদরের ননদ।’
আরু স্তব্ধ! ডোগ গিললো কয়েকবার। এতো টেডি তো ছোটরাও রাখে না। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘সত্যিই? এতো টেডিবিয়ার কে দিয়েছে?’
আরুর প্রশ্নে জুঁই এগিয়ে এলো। সাবধানের সহিত ধীর গলায় বললো,’এগুলো জেবা আপাকে দিয়েছে রাফিদ ভাইয়া। আপার বয়ফ্রেন্ড। কাউকে বলো না।’
বলে মুখ টিপে হাঁসলো জুঁই। তন্দা মেরে থাকা আরুকে বাইরে নিয়ে এলো টেনে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বোঝাতে লাগলো কোনটা কার রুম। এত রুমের মাঝে রুদ্র’র রুম কোনটা? জুঁই সবার রুম বলছে, রুদ্র’র রুম বলছে না কেন? আরু কান খাড়া করে রইলো। জুঁই কখন বলবে, এটা রুদ্র ভাইয়ার রুম; এটা বাক্যটি শোনার জন্য মুখিয়ে রইলো। জুঁই একে একে অভ্র, নিজের রুমের বিবরণ দিতে দিতে এগোচ্ছে। আরু পিছুপিছু হাঁটছে। হুট করে একটি অন্ধকার রুর থেকে টান পড়লো আরুর হাতে। একটানে আরুকে ভেতরে নিয়ে গেলো কেউ। আরুর গোটা শরীর কেঁপে উঠলো আকস্মিক আক্রমণে। বুকের ভেতর ছিলকে উঠলো ভয়ে। আগুন্তকঃ আরুকে টেনে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিলো। চিৎকার দেয়ার আগেই সুঠাম হাতে চেপে নিলো আরুর মুখ। ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে এলো আরুর কাছে। সারা শরীর অবস হয়ে এলো আরুর। আরু চাপা মুখে ‘উমম উমম’ করছে। ভেতরটা ধরফর করছে। ঘারে কারো তপ্তশ্বাস পড়তেই আঁতকে উঠলো আরু। বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। আরু নিজেকে ছাড়ানোর জন্য যত চেষ্টা করছে, আরও কাছে টেনে নিচ্ছে আগুন্তক আরুকে। আরু হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে নিলেই, হাত দেয়ালের সাথে চেপে নিয়ে, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো আগুন্তক,
‘এভাবে নড়াচড়া করো না।’
শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা থেমে গেলো আরুর। শিরদাঁড়া বেয়ে শিতল কিছু ছুটে গেলো। এই কন্ঠ আরু চেনে। রুদ্র’র সে-ই নেশালো কন্ঠ! আরু একহাতে ওড়না খিঁচে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হৃদপিণ্ড ছুটছে ট্রেনের গতিতে। দুটি মানুষের হৃৎস্পন্দনের শব্দ কানে বাজছে প্রখরভাবে। সেই শব্দে আরুর শ্বাস আঁটকে আসছে, চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। আরু আন্ধকারে আচ্ছন্ন রুমটায় চোখ বোলায়। অবময় অব্ধি অস্পষ্ট! আরু শুকনো ঠোগ গিললো। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ক্ কি করছেন? ছা্ ছাড়ুন।’
‘কিছুতো করিনি এখনো। তবে করবো।’
‘তবে করবো’ বাক্যটি তিরের মতো বুকে এসে বিধলো আরুর। কি করতে চাইছে লোকটা? মতবলটা’ই বা কি? এভাবে ধরে আরুকে মা-রার প্লান করেনি তো? মা’রছে’ই তো! নিশ্বাস আঁটকে, নিয়ন্ত্রণহারা করছে আরুকে। লোকটা কি বোঝে না, সে কাছে আসলে আরুর মরার গতি হয়? পায়ের নখ অব্ধি কাঁপে? ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়! বোঝেনা?
‘ক্ কি করবেন?’ আটকানো কন্ঠ আরুর।
‘করে দেখাবো?’
‘ন্ না। একদম না।’
‘আমায় ভয় পাও না একদম, তাইনা?’
আরু ডোগ গিললো। কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিলো,’পাই।’
‘যদি ভয় পেতে, এই মুখে লেহেঙ্গা শব্দটি আনতে না।’
আরু চোখ বুজলো। কি উত্তর দেবে সে? রুদ্র’র গরম শ্বাস আরুর মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়ছে। এই শ্বাস হানা দিচ্ছে বুকের অন্তস্তলে। শুধু বুঝতে পারছে, রুদ্র কাছে, খুব নিকটে তার! আরু চোখ খুলে রুদ্র’কে বুঝবার চেষ্টা করলো। পারলো না! অন্ধকারের গহীনে তারা তলিয়ে। আরু জিভ দিয়ে তার কম্পনরত ঠোঁট’টা ভিজিয়ে নিলো।
রুদ্র যেন স্পষ্ট দেখছে আরুর মুখ। বরংবার চোখ পড়ছে ওই তিরতির করে কাঁপা ঠোঁটটায়। নিষিদ্ধ বিষাদ অনুভব যেন রুদ্র’কে বড্ড টানছে, আঁকড়ে ধরছে। দখল করে নিতে মন চাইছে ওই ঠোঁট। মিশে থাকতে চাইছে আরুর সাথে। রুদ্র চোখ বুজলো। একহাতে নাকের নিচে স্লাইড করে নিজেকে সামলানোর ব্যার্থ চেষ্টা চালালো। অতপর যখন নিজেকে আটকাতে ব্যার্থ হলো রুদ্র, ধীর গতিতে এগিয়ে নিলো মুখ।
রুদ্র’র গরম ঠোঁটের মৃদু স্পর্শ পেতে চকিতে তাকালো আরু। বন্ধ হয়ে গেলো শ্বাস। আরু খিঁচে বন্ধ করে নিলো নিজের চোখ। সর্বশক্তিতে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিলো রুদ্রকে। ঘোরে থাকা রুদ্র ছিঁটকে গেলো কয়েকহাত দূরে। আরু আর একদন্ড সেখানে দাড়ালো না; আগেপিছে না তাকিয়ে ছুটে পালালো। একদৌড়ে নিচে এলো আরু। তার বুক এখনো হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। শরীর কাঁপছে। আরু পাশে থাকা সোফার হাতল শক্ত করে ধরলো। চোখ বুজে শ্বাস টানলো। আরু যেন এখনো ঘোরে। এটা কি ছিলো? কেন ছিলো? ওটা কি আসলেই নিরামিষ লোকটা ছিলো? আরু শ্বাস ফেলে বসলো সোফাতে। আরুর হাত কাঁপছে এখনো। গলা শুকিয়ে কাঠ!
‘তুমি এখানে কখন এলে ভাবী?’
জুঁইয়ের কথায় আরু নিজেকে স্বাভাবিক করলো। জুঁইয়ের চিন্তা চিন্তা মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাড়ালো। জোড়ালো শ্বাস টেনে ধীর গলায় বললো,
‘ভালো লাগছিলো না। তাই নিচে চলে এসেছি।’
জুঁই এগিয়ে এলো। চিন্তিত কন্ঠে বললো,’আর আমি তোমায় খুজছিলাম। কেমন লাগছে এখন?’
‘বেটার।’
তখুনি আগমন ঘটলো ইলিমার। উনি এগিয়ে এসে বললেন,’কি করছিস তোরা এখানে? আরু, এসো কিছু খেয়ে নাও।’
আরু না করতে চাইলো। ইলিমা আরুর উত্তরের অপেক্ষায় থাকলেন না। টেনে নিয়ে এলেন ডাইনিং এ। ‘কিছু’ খেয়ে নাও বলে টেবিলে এনে, ‘কিছু’ এর জায়গায় টেবিল ভর্তি খাবার দেখে চমকে উঠলো আরু। টেবিলের এ’মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত খাবারে ভর্তি। আরু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে। এতো আয়োজন করার কারন কি আরু? আরুর একপলক ইলিমার দিকে, আরেক পলক জুঁইয়ের দিকে তাকাচ্ছে।
আরুকে এদিক-ওদিক চাওয়া-চাওয়ি করতে দেখে ইলিমা এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন,’কোন সমস্যা মা?’
আরু মাথা দোলালো। যার মানে কোন সমস্যা তার নেই। ইলিমা আরুকে নির্বিগ্নে বসালেন। এই এতো আয়োজন তো করা আরুর জন্যই। অতিথির যেন কোন সমস্যা না হয়, তাইতো পদে পদে সাজানো হয়েছে ইরহাম বাড়ির টেবিল। বিরিয়ানির বোল’টা এগিয়ে দিলেন আরুর সামনে ইলিমা। আরুর মনে হচ্ছে, এনিই বোধহয় একমাত্র শাশুড়ী, যে কি-না বাড়ির বউকে পাত বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। তা-ও কতশত পদে! আরুর সামনেই দাড়িয়ে আছে জুঁই। আরু কি একাই খাবে? না-কি একবার জিজ্ঞেস করবে? এ নিয়েও সংকোচে ভুগছে আরু। সংকোচ ঘুচিয়ে আরু বলেই উঠলো,
‘আপনারা খাবেন না?’
উত্তর দিলেন ইলিমা,’আগে মেহমান খাবে, অতঃপর আমরা।’
আরু মাথা নামিয়ে নিলো। খুবই সন্তোর্পণে তুলে নিলো একচামুচ বিরিয়ানি। সেগুলোই খেতে লাগলো। ইলিমা তন্দা মেরে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। রুদ্র সকালে বলে গিয়েছিলো, আরু পেটুক। খেতে নাকি বড্ড ভালোবাসে। কিন্তু এই মেয়ে সেখানে একচামুচ নিয়েই খ্যান্ত হবে, ইলিমা কল্পনাও করেনি। ইলিমা নিজের ভাবনা ঝেড়ে ফেললেন। উদগ্রীব হয়ে বললেন,
‘তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?’
আরু তাকালো। থতমত খেয়ে উত্তর দিলো,
‘ক্ কই না তো!’
‘তাহলে মুরগির খাবার মতো খাচ্ছো যে? এই জন্যই এতো চিকন। দাঁড়াও, আমি তুলে দেই..’
ইলিমা এগিয়ে আসতেই, আরু থামিয়ে দিলো। মানা করে বললো,’না না আন্টি, আর নয়। খেয়ে আসায় পেট ভরা আছে।’
‘খেয়ে এসেছো কেন? আচ্ছা, শুধু রেজালাটা…’
এবারেও ইলিমার হাত ধরে থামিয়ে দিলো আরু। কোনমতে খাওয়া শেষ করে উঠে দাড়ালো। এখন রুদ্র’র সামনে না পড়ে বাড়ি পালাতে পারলেই আরু বাঁচে!
অস্বাভাবিকভাবে অভ্র, তানিয়া, তুর্য আজ একই সময়ে মেইন গেট-এ উপস্থিত। তানিয়া রিকশা থেকে অভ্র’র গাড়ি দেখে নেমে একবার উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো অভ্র’কে। না, দেখা গেলো না! অভ্র গাড়ি মেইন গেট পেড়িয়ে ভেতরে নিয়ে গেলো পার্ক করতে। তুর্য তানিয়সকে দেখে বাইকের গতি কমিয়ে দাঁড়ালো। ডাকলো তানিয়াকে,
‘এইযে..শুনুন।’
তানিয়া থামে। তুর্য রিস্টার্ট দিয়ে এগিয়ে আসে।
অভ্র গাড়ি পার্ক করে আড়চোখে একবার দেখলো ওদের, এরপর চলে গেলো ভেতরে। তুর্য বাইক স্টান্ড করে দূর থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন আছেন?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ভালো। কাল আর কোন সমস্যা হয়েছিলো?’
তানিয়া হাঁটতে লাগলো। সাথে তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে তুর্য। তানিয়া বললো,
‘তেমন না। শুধু আব্বু একটু বকাঝকা করেছিলো, এই আরকি।’
তুর্য ক্ষিন হাসলো। আর কোন কথা বললো না। নির্বাক হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো দু’জনে। তুর্য গিয়ে নিজের ডেস্কে বসলো। তানিয়া জানে, এই ডেস্ক’টা নামে মাত্র তানিয়ার। এখানে বসে দু’দন্ড দম ফেলারও অধিকার তার নেই। বসলেই তো কিছুক্ষণের মধ্যে এসে হাজির হবে করিম সাহেব। সে-ই কলের পুতুলের মতো বলবে,’আপনাকে অভ্র স্যার ডাকছেন।’ ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ভেতর থেকে তানিয়ার। এখন তাকে যেতে হবে অভ্র’র কেবিনে। কালকের কথা মনে হতেই দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ নিবারণ করলো তানিয়া। ওভাবে ছেড়ে না দিলেও পারতো অভ্র। কি এমন বলেছিলো সে? আর ছেলেটা কে, সেটাও তো শোনা হলোনা!
তানিয়া অভ্র’র কেবিনের দিকে যেতে নিলেই পিছু ডাকলো তুর্য। ডেস্ক থেকেই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ওদিকে কোথায় যান?’
তানিয়া পিছু ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হতাশ কন্ঠে বললো,’পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট নিশ্চয়ই এখানে বসে থাকবে না?’
তুর্য’র ভ্রু আরও বেঁকে গেলো। অবাক চিত্তে বললো,
‘আপনি অভ্র স্যারের এসিস্ট্যান্ট?’
তানিয়া মাথা দোলালো। চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালো তুর্য। এগিয়ে এসে বললো,’আপনি এসিস্ট্যান্ট হয়ে যে কাল কফি নিয়ে গেলেন, ওটা..’
তুর্যকে থামিয়ে দিলো তানিয়া। তানিয়ার কন্ঠে লজ্জা,’আমি তার ওর্নারে কাজ করি, উনি যা বলবেন তা করতে বাধ্য আমি।’
‘কিন্তু..’
‘থাকনা এসব কথা। আসছি..’ বলে তানিয়া ঘুরে দাড়ালো। অভ্র যে তার প্রতি অন্যায় করছে, তানিয়া তা জানে। জেনেও সে থাকতে চায়। সবথেকে বড় কথা, করার-ই বা কি আছে? তানিয়া বুকভরে শ্বাস টানলো। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো কেবিনের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস বললো,
‘মে আই কামিং স্যার?’
ভেতর থেকে উত্তর এলো নিরস কন্ঠে,’আসুন।’
তানিয়া প্রবেশ করলো। ভেতরে ডুকতেই দেখলো নিত্যদিনের মতো আজ-ও ল্যাপটপে মুখ গোঁজা অভ্র’র। তার কপালে সূক্ষ্ম তিনটি ভাজ। কপালের রগগুলো ভেসে উঠেছে। অভ্র কি রেগে আছে? সকাল সকাল তেঁতো মানুষটাকে আরও তেঁতো কে বানালো?
তানিয়া চারপাশে চোখ রাখলো। কি করবে সে? কোন কাজ তো নেই। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? তানিয়া জিজ্ঞেস করলো,
‘স্যার, কি করবো আমি?’
অভ্র উত্তর দিলো না। তার তিক্ন রক্তিম দুটি আঁখি ল্যাপটপে স্থির। মনে হচ্ছে চাপা রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে অভ্র। তানিয়া আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আসলে, করার সাহস হলো না। পাশেই তো কতগুলো চেয়ার। তানিয়া কি বসবে? এভাবে দাঁড়িয়ে-ই বা কতক্ষন থাকা যায়? তানিয়া চারপাশ দেখতে দেখতে বসে পড়লো চেয়ারে।
তানিয়া বসতেই কঠোর দু’টি চোখ মেলে তাকালো অভ্র। তার চেয়াল খেঁচা। সাথেসাথে উঠে দাড়ালো তানিয়া। অভ্র তাকালেই যেন অন্তরার্ত্মা কেঁপে ওঠে তানিয়ার। ভয়ে বুক কাঁপে। তানিয়া জড়সড় হয়ে দাড়ালো। ভেসে এলো অভ্র’র গম্ভীর স্বর,
‘কফি নিয়ে আসুন।’
তানিয়া বিরক্ত চাহনিতে তাকালো। এবারে মন চাইছে,কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিতে। লোকটা কি তাকে চাকর পেয়েছে? কাল দিয়েছে বলে আজকেও? একজন এসিস্ট্যান্টে’র তো এসব কাজ নয়! কালকে অথৈ আর করিম সাহেবকে কফি বানাতে নিষেধ করার কারন এখন হারে হারে টের পাচ্ছে তানিয়া। তানিয়া গরম চোখে তাকালো অভ্র’র পাণে। শক্ত গলায় বললো,
‘পারবো না।’
ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো অভ্র। তার চোখের শিরা লাল। শিতল স্বরে বললো অভ্র,’রিপিট করুন আরেকবার।’
অভ্র’র শিতল কন্ঠে গলা শুকিয়ে এলো তানিয়ার, ভয় পেলো; তবে প্রকাশ করলো না। নিজেকে ধাতস্থ করে আবারো বললো,
‘শোনেননি? পারবো না মানে পারবো না!’
অভ্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। অভ্র চেয়ার ছাড়তেই, এক’পা পিছিয়ে গেলো তানিয়া। অভ্র হাত মুঠো করে তিক্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তানিয়ার দিকে। চেয়াল শক্ত করে ভারি গলায় বললো,
‘পারবেন না?’
ভয়ে কেঁপে উঠলো তানিয়া। ভীত গলায় বললো,
‘পারবো। আনছি..’
তানিয়ার এখন রাগে-দুঃখে কান্না পাচ্ছে। পুরো অফিস তাকে দেখবে, সে কফি নিয়ে আসছে৷ সেখানে কালকে অভ্র’র বলা ‘আয়া’ শব্দটি কি আসলেই অযৌক্তিক? না! বরং ঠিক, ঠিক এবং ঠিক। তানিয়া ক্রন্দনরত চেহারা নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য ফিরতেই অভ্র পিছু ডাকলো। বললো,
‘কেবিনের পাশের রুমেই ব্যাবস্থা আছে।’
তানিয়া বুঝলো না। অভ্র’র দিকে তাকাতেই অভ্র চোখ দিয়ে ইসারা করে দেখিয়ে দিলো দরজা। দক্ষিণ দিকে আরেকটি করিডরের দিকে চোখ পড়লো তানিয়ার। মানে এই রুম থেকেই যাওয়া যাবে পাশের রুমে। তানিয়া গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো। গিয়ে দেখলো আসলেই সমস্ত ব্যাবস্থা করা আছে। তানিয়া কফি বানিয়ে নিয়ে এসে রাখলো টেবিলে। ছোট করে বললো,’নিন।’
অভ্র কফির মগ তুলে চুমুক বসালো। যতটা অকর্মা ভেবেছিলো, ততটা নয় মেয়েটা। বেশ ভালোই কফি বানায়। হুট করে তুর্য’র কথা মনে পড়লো অভ্র’র। তাকালো তানিয়ার দিকে। গম্ভীর গলায় বললো,
‘রুমটা পরিষ্কার করুন।’
মুহুর্তে চোখের কোনে পানি জমলো তানিয়ার। কি এমন পাকা ধানে মই দিয়েছে যে এভাবে খাটাচ্ছে অভ্র তাকে? তানিয়া এবার আগের মতো ভুল করলো না। বলা তো যায় না, গরম কফিটা আবার ছুঁড়ে মারলো। তানিয়া চারিদিকে চোখ বোলালো। সবতো গোছানোই আছে। ঝকঝকে-তকতকে! এতে আবার কি করার আছে? তানিয়া অভ্র’র পাণে চাইলো। জিজ্ঞেস করলো,
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১৫+১৬
‘সব তো গোছানোই আছে স্যার। আর কি গোছাবো।’
অভ্র তাকিয়েই রইলো তানিয়ার দিকে। কফির মগটা স্ব-যত্নে রেখে টেবিলের ফাইলগুলো সুতো টানলো। পাতাগুলো অগোছালো ভাবে ছিটিয়ে দিলো পুরো রুমজুড়ে। আক্রোশ নিয়ে বললো,
‘এবার তো হয়েছে অগোছালো। নিন, পরিষ্কার করুন।’
