নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২৭+২৮
আহমেদ হৃদ
সময় বহমান। কেটে গেছে দুটো দিন। তানিয়া তির্যক রোদের মাঝে রিকশায় বসে। হুডি তুললে শ্বাস যেন আঁটকে আসছে। দিনদিন গরমের তীব্রতা তরতর করে বাড়ছে। অফিসের সামনে রিকশা থামতেই, তানিয়া নেমে পড়লো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। রুমাল দিয়ে তা সন্তর্পণে মুছে নিলো তানিয়া। ভারা মিটিয়ে অফিস মুখো হাঁটতে লাগলো। অফিসে প্রবেশ করতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তানিয়া। এই জায়গায় থাকলে মনটা বিতৃষ্ণায় মেতে ওঠে আজকাল তানিয়ার। অফিসে মন টেকে না। তার কারন কি অভ্র? হ্যা!
পাল্টে যাওয়া অভ্র’ই বুঝি তার কারন। যে অভ্র’র গম্ভীর্য, চুপচাপ স্বভাবের উপর তানিয়া ফিদা ছিলো, আজ সেই গম্ভীর্যের প্রতি তিব্র ক্ষোভ তানিয়ার। এই চুপচাপ স্বাভাবের জন্যই অভ্র’র প্রতি তানিয়ার একসময় অনুভূতির জন্ম নিয়েছিলো। চুপচাপ, শান্ত তানিয়া অশান্ত হয়ে উঠেছিলো এই লোকটার প্রেমে। যে মেয়ে প্রেমের নাম শুনলেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়, সে নিজে গিয়ে বন্ধুদের বললো এই লোকটার কথা। আরও ভালো লাগা জন্মালো সেই দিন, যেদিন সোনিয়া অভ্র’র গাড়ির কাঁচ ভেঙেছিলো। সবটা সাবলীল ভাবেই নিয়েছিলো অভ্র। তবে অফিস জয়েনের পর পরিবর্তন একটু লক্ষ্য করেছিলো তানিয়া। কি ঝগড়ুটে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সব মানুষই বুঝি এমন। তারা সামনে যা প্রকাশ করে, ভেতরে একেবারেই ভিন্ন। তবুও অভ্র’র প্রতি তানিয়ার ভালোলাগা কমেনি এক চুল। বরং-চ তা বেড়েছে দ্বিগুনভাবে। নিরবতার থেকে এই চঞ্চলতাই কি আরও ভালোলাগার করন? হয়তো! তবে, এখন সেগুলো অতীতমাত্র! এখন আর অভ্র ঝগড়া করে না, বলে না কফি নিয়ে আসতে, বলে না গোছানো কেবিনটা আবারো গুছিয়ে দিতে। আগের থেকেও চুপচাপ, গম্ভীর অভ্র। ভাবতেই ভেতরটা মুচড়ে ওঠে তানিয়ার। কোন কালেই অভ্র’র এই বারাবাড়ি রকমের কাজগুলো পছন্দ ছিলো না তানিয়ার। তাহলে আজ কেন এতো মনে পড়ছে দিনগুলো? কেন তানিয়া চায় অভ্র তাকে আবার ডাকুক; বলুক কফি করে আনতে। কথায় কথায় রাগ দেখাক! কই সেই দিন? নেই!
মাত্র দু’দিনেই সব পাল্টে গেছে। অভ্র আর আগের মতো তানিয়া অফিসে এলেই কেবিনে ডাকে না, বলে না কফি নিয়ে আসতে। আরে, এগুলো তো দূরের ব্যাপার! অভ্র তো কথাই বলে না তানিয়ার সাথে। দেখা হয় কি? হয়! এই দু’দিনে দু’বার দেখা হয়েছে মাত্র! যেই অভ্র’র কেবিনে সারাদিন পড়ে থাকতো তানিয়া, সেই অভ্র’র দেখা মেলা যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার সমান। এতো ব্যাথা কেন হয় বুকে? একপাক্ষিক ভালোবাসা কতটা কষ্টের লোকটা বোঝে না? এই ভালোবাসা যে ক্ষণে ক্ষণে শেষ করে দিচ্ছে তানিয়াকে। এই দু’দিনের পরিবর্তনে সহস্রবার অগোচরে লুকিয়েছে চোখে আসা পানিটুকু! আবারো তপ্তশ্বাস ফেললো তানিয়া। সব দোষ তার নিজের। তানিয়ার ভাবনায় ভূল ছিলো। তানিয়ার প্রতি যে লোকটার অনুভূতি জন্মেছে এই ভাবনা সম্পূর্ণ মিথ্যে, নিজের মনগড়া! বারে গিয়ে কেন গিয়েছিলো লোকটাকে নিজের অনুভূতি জানাতে? এতো ঘৃণা তানিয়ার প্রতি অভ্র’র? নেশার ঘোরে ‘আই লাভ ইউ’ বলেছে বলে এতো বড় শাস্তি পাওনা তার?
তানিয়া নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। এই ডেস্ক, কম্পিউটারই এখন সব। এখানে এসে বসলে আগের মতো করিম সাহেব যান্ত্রিক গলায় বলে না,’ম্যাডাম, আপনাকে স্যার ডাকছে।’ আর কত দিন বাকি এক মাস পূর্ণ হওয়ার? ওইতো কয়েকটা দিন বাকি। তারপর তানিয়া থাকবে না এই অফিসে। কেন থাকবে? কার জন্য? ভেতর থেকে আর উত্তর আসে না এখন। যার জন্য তানিয়া প্রতিটা মুহুর্তে বিরহের আগুনে জ্বলে, সে তো বেশ ভালোই আছে। তাকে কি ভালো থাকতে দেয়া উচিত নয়? উচিত! এটা তার প্রাপ্য।
‘আপনি কি ডিপ্রেসড্, তানিয়া?’
পরিচিত একটি গলায় ভাবনার সুতো কাটলো তানিয়ার। হকচকিয়ে পাশে তাকালো। ভ্রু যুগল কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে তুর্য। ভাবনায় মশগুল থাকায় খেয়াল করেনি তুর্যকে। নিজেকে সামলে নিলো তানিয়া। কৃত্রিম হাঁসি হেঁসে জবাব দিলো,
‘কই, না তো।’
‘আপনাকে আপসেট দেখাচ্ছে। ট্যুর থেকে আসার পর আপনি কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন। সবসময় কি যেন ভাবেন। আ’ম সিওর আপনি এখনো কিছু ভাবছিলেন। কোন সমস্যা না থাকলে বলতে পারেন। ইফ ইউ ওয়ান্ট আই ক্যান হেল্প ইউ।’
‘না না, তেমন কিছু নয়।’
জোরপূর্বক হেঁসে বললো তানিয়া। কিন্তু সে নিজেও জানে তার মাঝের পরিবর্তনটুকু। তুর্য’র মনেহয় বিশ্বাস হয়নি তানিয়ার কথা। আগের মতোই তাকিয়ে আছে তানিয়ার দিকে। তানিয়া চোখ সরিয়ে শ্বাস টানলো। আজ সে অভ্র’র কেবিনে যাবে। তানিয়া কাঁধে থাকা ব্যাগটাও ডেস্কে রাখলো না। অভ্র’র কেবিনের দিকে রওনা হলো সেভাবেই। যাই হয়ে যাক আজ তানিয়া সরি বলবে লোকটাকে। বলবেই! কালকে কেবিনের সামনে গিয়েও বলতে পারেনি তানিয়া। জড়তা, সংকোচে ঢুকতে পারেনি কেবিনে। কিন্তু আজ আর নয়। তানিয়া কেবিনের সামনে গিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। সমস্ত সংকোচ ঘুচিয়ে পার্মিশন চাইলো,
‘মে আই কামিং, স্যার?’
চোখ বুজে নিলো তানিয়া। ভেতরটা টিপটিপ করছে তার। আগে তো এমন হয়নি! আজ কেন এই রোগের উপশম? অভ্র এখনো কেন ‘কামিং’ বলছে না? তানিয়া কি অনুমতি পাবে না? আজ যেন বড্ড দেরি করছে অভ্র। দেরি করছে নাকি তানিয়ার উত্তেজনার জন্য এমন মনে হচ্ছে? তানিয়ার ভাবনার মাঝেই ভেসে এলো কাঙ্খিত গম্ভীর কন্ঠ,
‘কামিং।’
তানিয়া দরজা ঠেলে ধীর পায়ে ঢুকলো কেবিনে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল ভেতরে। অভ্র গম্ভীরমুখে ল্যাপটপ ঘাটছে। এখনো তাকায়নি তানিয়ার দিকে। তানিয়ার বুক অস্বাভাবিক কাঁপছে। বড্ড জ্বালা হলো তো! মাথা নামিয়ে নিলো তানিয়া।
অভ্র আড়চোখে একবার তাকিয়ে আগাগোড়া পরখ করে নিলো। এভাবে সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন এই মেয়ে? চোখ সরিয়ে আবারো ল্যাপটপের দিকে তাকালো অভ্র। গম্ভীর গলায় বললো,
‘এভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন যে? কিছু বলার থাকলে বলুন। নাহলে দরজা খোলা আছে।’
শুকনো ডোগ গিললো তানিয়া। গলা জড়িয়ে আসছে। মাথা নামিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
‘সরি।’
পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো অভ্র। মাথা নিচু করে হাত কচলাচ্ছে তানিয়া। আকস্মিক সরি বলার কারন কি? অভ্র বুঝতে পারলো না। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘ফর হোয়াই?’
তানিয়া মাথা নামিয়ে রেখেই উত্তর দিলো,’ওইযে সেদিন বারে আপনার সাথে..অসভ্যতা..ক্ করেছি না? সেটার জন্য।’
‘কোন দিন?’
মাথা তুলে তাকালো তানিয়া। তার দিকেই তাকিয়ে অভ্র। লোকটা কি বুঝছে না? নাকি না বোঝার ভান করছে তাকে রাগানোর জন্য? এমনিতেই বুকে কতো অভিমান তানিয়ার। নিজেকে সামলে নিলো তানিয়া। অন্যদিকে ফিরে শক্ত গলায় বললো,
‘সেদিন আপনাকে যা বলেছি তার জন্য সত্যিই আমি দুঃখীত।’
‘ওহ্।’
আবারো ল্যাপটপে মুখ গুজলো অভ্র। ওহ্? ব্যাস এতটুকুই? তানিয়া রাগত চোখে তাকিয়ে রইলো অভ্র’র দিকে। লোকটা ইচ্ছে করেই এমন করে। তানিয়া বেশ বুঝতে পারছে। তানিয়া ভাবলো চলে যাবে এখান থেকে। সেধে এসেছিলো সরি বলতে; এখন বোঝো ঠেলা! তানিয়া পিছু ঘুরতেই কাঁধের ব্যাগে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। মেজাজ আরও খিঁচে গেলো তানিয়ার। ভুলে বসলো সে অভ্র’র কেবিনে আছে। সেখানেই ফোন বের করলো তানিয়া। দেখলো আরু ফোন করেছে। রিসিভ করে উগ্র গলায় বলে উঠলো,
‘হ্যা, বল। কে মরেছে?’
ওপাশে আরু হকচাকিয়ে উঠলো। শান্ত মেয়েটার মেজাজ এতো হাই কেন হঠাৎ? কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদুরে গলায় বললো,
‘তুই এখন কই জান?’
বিরক্ত হলো তানিয়া। কাঠকাঠ গলায় বললো,
‘তোর দেবরের সাথে আলাদা টাইম স্পেইন করছিলাম দোস্থ। কেন, কোন সমস্যা?’
পাশ থেকে খুক করে কেশে উঠলো অভ্র। পাশে থাকা গ্লাস থেকে ডগডগ করে পানিটুকু খেয়ে নিলো। বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো তানিয়ার দিকে। কি সাংঘাতিক মেয়েছেলে!
তানিয়ার সম্বিত ফিরলো। এই রে! লোকটা শুনে ফেললো নাকি? তানিয়া ধীর গতিতে মাথা ঘুরিয়ে আঁড়চোখে তাকালো অভ্র’র দিকে। এখনো কাশি থামেনি অভ্র’র। নিশ্চয়ই বুঝেছে তানিয়ার কথা। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো তানিয়ার মুখ। চোখমুখ খিঁচে তানিয়া ছুট দিলো কেবিন থেকে। বেড়িয়ে এসে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানলো কয়েকবার। নিশ্চয়ই বুঝে গেছে! সব দোষ আরুর। এই মেয়েটার এন্ট্রি সবসময়ই বিপদ বয়ে আনে তানিয়ার জন্য। তানিয়া কমন রুমে গেলো। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
‘তুই আমায় আজকেই মেরে ফেলতি।’
‘ওমা, কি আবার করলাম আমি?’
‘কিছুনা। বল কি জন্য ফোন দিয়েছিস।’
গলা আরেকটু মলিন করলো আরু। টেনে বললো,’জান, আজকে একটু আসতে পারবি?’
‘আরু আমি অফিসে। চারটার আগে সম্ভব নয়।’
‘চারটা? না না, এক্ষনি!’
তাড়া দিয়ে বললো আরু। তানিয়া বিরক্ত হলো। এক্ষনি বললেই কি এক্ষনি যেতে দেবে নাকি অভ্র? এমনিতেই একটু আগের ঘটনা মনে পড়লে কান গরম হয়ে যাচ্ছে তানিয়ার। এখন অভ্র’র সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তানিয়ার নেই। তানিয়া ছোট করে জবাব দিলো,
‘পসিবল না।’
আরু অনুনয় করে উঠলো,’প্লিজ জান প্লিজ! এমন করিস না। তুই তো জানিস আমার চয়েজ কত বাজে। রুদ্র’র মা মানে আমার শাশুড়ী মা সপিং এর জন্য ডেকেছেন। দেখা যাবে বস্তাপচা জিনিস কিনে নিলাম। তখন কি মান-সম্মান কিছু থাকবে? আয় না তুই। প্লিইইইইজ!’
‘যদি ছুটি না দেয়?’
‘দেবে দেবে। একটা বাহানা বলে বেড়িয়ে আয়। আমি লকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
কি করে নিজের পরিস্থিতি বোঝাবে তানিয়া এই মেয়েকে! সে যে একটু আগে ঝড় উঠিয়ে দিয়ে এসেছে। এখন ওই ঝড়ের মুখোমুখি হওয়া তানিয়ার পক্ষে ভীষন লজ্জাজনক!
‘সোনিয়াকে নিয়ে যা।’
তানিয়ার কথায় আরুর বিদ্রুপ হাঁসি শোনা গেলো ওপাশ থেকে। বললো,’সোনিয়া? ও আর আমি তো একই।’
‘দেখছি দাঁড়া।’
‘হুম।’ বলে কেটে দিলো আরু ফোন। দেখছি তো বললো; কিন্তু সে কিভাবে বলবে অভ্র’কে? আচ্ছা, তানিয়া তো কথার মাঝে কার দেবর সেটা বলেনি। তাহলে এতো লজ্জা পাওয়ার তো কোন মানে নেই! তানিয়া নিজেকে সামলে নিলো। আবারো হাঁটা ধরলো অভ্র’র কেবিনের দিকে। অনুমতি চেয়ে ভেতরে ডুকলো। অভ্র কারো সাথে কথা বলছে। মুখে বেজায় বিরক্ত তার। কোথাও যেতে না করছে বারবার। শেষমেশ রাজি হয়ে ফোন কোটে দিলো অভ্র। ফোনের দিকে তাকিয়েই বিরক্ত গলায় তানিয়াকে বললো,
‘আবার কি হলো আপনার?’
থতমত খেয়ে গেলো তানিয়া। নিজেকে বুঝ দিয়ে গড়া মনোবল যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো অভ্র’র একটি বাক্যে। তানিয়া এদিক-ওদিক চাওয়াচাওয়ি চাইলো। আমতা-আমতা করে বললো,
‘আসলে..আসলে ছুটি লাগবে আজকে, স্যার।’
শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো অভ্র। হঠাৎ ছুটি কেন চাইছে? আজকে আবার ডেট-ফেটে যাওয়ার প্লান নেই তো? অভ্র চোখ সরিয়ে নিলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললো,
‘এইতো দু’দিন হলো ঘুরে আসার। আবার ছুটি কেন?’
এবার কি বলবে তানিয়া? কিছু একটা ভাবতেই এক চিলতে হাসি ফুটলো তানিয়ার মুখে। মুহুর্তে আবার তা কাঁদো কাঁদো করে নিলো। অত্যন্ত দুঃখী হওয়ার ভান ধরে ভেজা গলায় বললো,’স্যার আমার বান্ধবী সোনিয়া হাসপাতালে। ওর প্রচন্ড পা ব্যাথা করছে। আমার যাওয়াটা খুবই জরুরি।’
‘পা ব্যাথা?’ ভ্রু কুঁচকে তাকালো অভ্র। তিক্ষ্ণ নজরে পরখ করলো তানিয়াকে। তানিয়া আবারো থতমত খেলো। বললো তো বললো পায়ে ব্যাথা বললো? এটা কোন রোগ?
‘পা..হাত, পেট, গলা সব ব্যাথা। স্যার ছুটিটা খুব দরকার। ওর পরিবার বললো, আমায় না দেখলে মরেও যেতে পারে। যাই স্যার?’ বললো তানিয়া।
অভ্র কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে ভাবলো। এরপর অনুমতি দিলো। তানিয়া এতক্ষণে শ্বাস ফেললো। মিথ্যে বলাটা তানিয়ার কাছে অনেক কষ্টের একটা ব্যাপার। তানিয়া বেড়িয়ে এলো অফিস থেকে। হাতের ছোট ঘরিটায় চোখ বোলালো তানিয়া। প্রায় দশটা বাজে। বেশ খানিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর রিকশা পেলো। চালক’কে আরুর বলা মলের সামনে নিয়ে যেতে বললো তানিয়া। রিকশা চলতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর তাদের পাশ ঘেঁষেই পরিচিত একটি সাদা ধবধবে গাড়ি গেলো। চিনতে অসুবিধা হলো না তানিয়ার। অভ্র’র গাড়ি! অভ্র এখন আবার কই যাচ্ছে?
রিকশা থামলো বিশাল মলের সামনে। তানিয়া রিকশা ছেড়ে মলের ভেতরে ডুকলো। এই এতো বড় মলে কোথায় খুঁজবে আরুকে সে? তানিয়া ফোন বের করলো। আরুকে কল দিতেই রিসিভ করলো আরু। উদগ্রীব আরুর স্বর,
‘কই তুই? এদিকে অবস্থা কাহেল আমার।’
‘এসেছি। কোন ফ্লোরে আছিস?’
তানিয়া চারপাশে একবার চোখ বোলায়। মানুষ গিজগিক করছে। এরা কি কেনাকাটা করতে আসে না ঘুরতে আসে? তানিয়ার বোধগম্য হয় না। দূরে কয়েকটা মেয়ে ছবি তোলাতুলিতে ব্যাস্ত। তানিয়া চোখ সরালো। আরুকে চুপ দেখে আবারো জিজ্ঞেস করে উঠলো,
‘কি রে? বল!’
‘দোস্ত ভুলে গেছিলাম কয় তালায় আছি। দেখে নিয়েছি। চার তালায় চলে আয়।’
ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো তানিয়ার। আরুর মাঝেমাঝে এমন কথা বলবে যে যতই রাগ, বিরক্তি থাকুক; সব ফিকে পড়বে ওই কথায়। স্মিত হেসে চারতলায় রওনা হলো তানিয়া। চারতলায় মেয়েদের জিনিসপত্রে ভরপুর। তানিয়া খুঁজতে লাগলো আরুকে। শাড়ির দোকানের সামনে পেয়েও গেলো। একটু দূরেই রুদ্র, তার মা এবং দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে। তানিয়া ঝটপট এগিয়ে যায়। কিন্তু মাঝরাস্তায় পা থেমে গেলো তানিয়ার। বুকের গতি ট্রেনের গতির সমান হয়ে উঠলো মুহুর্তে। এই সবার মাঝেই যে একটু দূরে অভ্র দাঁড়িয়ে, তানিয়া খেয়াল করেনি। শুধু কি তাই? তানিয়ার দিকেই অভ্র’র তীক্ষ্ণ নজর। চেয়াল শক্ত। সুঠাম হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ। যেন রাগ দমাতে চাইছে অভ্র। তানিয়া ডোগ গিললো। ভয়ে আসাঢ় হয়ে আসলো শরীর। আজ নির্ঘাত তানিয়া মারা পড়বে। খুন করে ফেলবে লোকটা তানিয়াকে। তানিয়া ভাবলো আর এক মুহুর্ত এখানে দাঁড়াবে না। নাহলে এই বয়সে ওপরওয়ালার কাছে পৌঁছে যেতে হবো। তানিয়া উল্টো ফিরে হাঁটা ধরতেই আরু পিছু ডেকে উঠলো,
‘তানিয়া!’
তানিয়া থামে। কামিজের এককোনা শক্ত করে খিঁচে নেয়। চোখমুখ খেঁচা। তারমানে তখন অভ্র এখানে আসতে বারবার না করছিলো ফোনে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে পিছু ফিরলো তানিয়া। আরু এদিকেই আসছে। আরুর দিকে তাকিয়ে বোকা হাসলো তানিয়া। আরু কপাল কুঁচকে বললো,
‘কই যাচ্ছিলি? আয় এদিকে..’
তানিয়া মাথা নাড়ে। আঁড়চোখে একবার অভ্র’কে দেখে। বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপছে। ভয়ার্ত তানিয়া মেঝের দিকে তাকিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়। আরু ততক্ষণে চলে গেছে অনেকটা দূরে। একা ফেলে গেলো কেন এই মেয়ে? পথ যেন শেষ হয় না। হুট করে সামনে বুট পড়া একটি পা দেখে থেমে গেলো তানিয়া। হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো এবার। অভ্র! ভয়ে তানিয়ার পা কাঁপছে। মাথা আরেকটু নামিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অভ্র আরেকটু কাছে আসে। ঝুকে পড়লো কিছুটা। ক্রোধান্বিত অভ্র চেয়াল শক্ত দাঁতে দাঁত পিষে বলে ওঠে,
‘হাউ ডেয়ার ইউ, মিস তানিয়া! আপনার সাহস দিনদিন আমায় অবাক করে তুলছে। ইরফান হোসেন অভ্র’কে মিথ্যে বলতে আপনার বাঁধলো না? কুণ্ঠাবোধ হলো না? তবে জেনে রাখুন, শাস্তি খুবই নিকটে আপনার। কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি আপনার জন্য অপেক্ষা করছে!’
চেঞ্জিং রুম থেকে বেড়িয়ে হেঁটে আসছিলো আরু। পাশ থেকে কেউ একজন খপ করে আরুর হাত ধরতেই, আরু ভড়কে গেলো। ভয় পেয়ে তাকানো মাত্রই আগন্তুক ব্যক্তিটি রীতিমতো টেনে ভেতরে নিলো আরুকে। প্রচন্ড আতঙ্কে কলিজা ছলকে উঠল আরুর। হৃদপিণ্ড বিকল হয়ে বিট থামাল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলো আরুর শ্বাস। ভয়ে মুদে নিলো নিজের আঁখিজোড়া আরু। তাকে আড়াল করে নিলো অজানা ব্যাক্তিটি। সুঠাম হাতে শক্ত করে আরুকে ধরে আগুন্তক।
আরুর গলা শুকিয়ে এলো। এতো মানুষের মাঝে কে এভাবে টেনে আনলো? আরু পিঠপিঠ করে চোখ মেলে তাকায়। আবছা অন্ধকার চারপাশে। মলের ঝলমলে আলো আড়াল করেছে এক বিরাট তাক। তার পেছোনেই এখন দাঁড়িয়ে আরু। আবছা অন্ধকারে সামনে তাকাতেই ভেসে উঠলো রুদ্র’র মুখ। বাঁকা হাসি নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে রুদ্র। আরু রুদ্র’কে দেখে সস্থির শ্বাস ফেললো। একহাত বুকে রেখে শ্বাস টানলো কয়েকবার। আজ নির্ঘাত আরুর ছোট্ট প্রানপাখিটা উড়ে যেত। এই লোকের কারনেই হয়তো আরুকে একদিন পরপারে পাড়ি জমাতে হবে। কি অসভ্য লোক! এভাবে কেউ ভয় দেখায়? আরু চোখ পাকিয়ে তাকালো রুদ্র’র দিকে। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসিটুকু বজায় এখনো। আরুর ভয়ার্ত মুখশ্রীর দিকে অনিমেষে তাকিয়ে রুদ্র। সত্যিই বেশ উপভোগ করে এই চেহারা সে। ভয়ে আড়ষ্ট আরুর জুবুথুবু মুখ, তিরতির করে কাঁপা ঠোঁট যেন ভীষণ মজা দেয় রুদ্র’কে।
চেয়াল শক্ত করে চাপা গলায় বলে উঠলো আরু,
‘আপনি এ রকম করেন কেন সবসময়? জানেন, আমি কত ভয় পাই! কলিজা ছলাৎ করে ওঠে।’
‘তাই?’
রুদ্র’র নিরুদ্বেগ কন্ঠ। রাগের মাত্রা বাড়লো আরুর। কঠিন গলায় বললো,
‘আপনি একটা ইয়ে! অসম্ভব ইয়ে!’
‘ইয়ে?’ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো রুদ্র।
‘হ্যা।’ বলেই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো আরু। কিন্তু আবারো আরুর হাত টান পড়লো। কথায় কথায় পালাতে চায় কেন এই মেয়ে? আরে,পালিয়ে যাবে কোথায়? সে কি রুদ্র’র মতো হেথায় সেথায় সর্বত্রই তাকে দেখে না? নিজের দিকে ফেরালো আরুকে রুদ্র। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
‘কোথায় যাচ্ছি মানে? এটা একটা মল, রুদ্রবাবু। যখন-তখন যে কেউ চলে আসতে পারে। ছাড়ুন! কেউ দেখে ফেলবে।’
‘রুদ্রবাবু’ শুনে ফিক করে হেঁসে উঠলো রুদ্র। অস্বস্তিতে পড়ে আরু। মুখ থেকে যে ‘রুদ্রবাবু’ বেড়িয়ে আসবে কল্পনাও করেনি সে। এখন নিশ্চয়ই এটা নিয়েও পঁচাবে লোকটা!
‘এই বাবু যদি না ছাড়ে, তাহলে?’
রাশভারি গলায় বললো রুদ্র। আরু অন্যদিকে তাকায়। এই বাবুটার তো পাশেই থাকতে চায় আরু। কেন ছাড়বে? হু? আরু যেন ঘোরে পড়েছে। রুদ্র গলা খেঁকিয়ে উঠতেই সম্বিত ফিরলো আরুর। এগুলো কি ভাবছিলো ভেবে নিজেকে কটাক্ষ করলো। সবাই খুঁজছে হয়তো! আরু প্রস্তুতি নিলো কিছু কঠিন কথা শোনাবে,
‘আপনি কিন্তু অনেক বেশি..’
কথা শেষ হওয়ার আগেই মুখে হাত চেপে ধরলো রুদ্র। আরু থেমে যায়। রুদ্র’র এহেম আচরণে হতভম্ব নয়নে তাকায়। ভ্রু জোড়া বেঁকে গেলো আরুর। আবারো রাগে ফুসে উঠলো আগের ন্যায়। রুদ্র আরেকটু কাছে আসে। আরু নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মুচড়ে ওঠে। ছাড়ে না কেন লোকটা? কেউ এসে পড়লে কি হবে? ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপছে আরুর। আরু অনেকক্ষন যাবৎ ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলো না নিজেকে। এমন ষাঁড়ের মতো ছেলেকে কি চাইলেই সরানো যায়? কি খায় কে জানে!
রুদ্র ক্ষীণ হাঁসলো। জুঁই আর রুদ্র’র মা তো আরুকে চোখের আড়াল হতে দিচ্ছিলো না একদম। কি করবে রুদ্র? চোখের সামনে বউ ঘুরে বেড়ালে কি নিজেকে সামাল দেয়া সম্ভব? এক্কেবারেই সম্ভব নয়! অন্য কারো কথা রুদ্র জানে না, কিন্তু সে নিজে পারে না। চেয়েও পারে না! তাইতো এতো প্রতিক্ষার পর কাঙ্খিত জিনিসটা হাতে পাওয়ার তৃপ্তি মুখজুড়ে রুদ্র’র। রুদ্র আর আরুর মাঝে কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব। সেটুকুও রাখতে চাইলো না রুদ্র। কিন্তু এখন রুদ্র’র হাত-পা বাঁধা। বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিলো আরুকে রুদ্র। বিয়েটা হোক একবার, সারাক্ষন বুক পিঞ্জরায় সাজিয়ে রেখে দেবে দেবে মেয়েটাকে।
রুদ্র ছাড়তেই আরু চেয়াল শক্ত তাকালো রুদ্র’র দিকে। আরুকে কিছু বলতে না দিয়েই রুদ্র এক চোখ টিপে বলে উঠলো,
‘আমার বউ।’
থেমে যায় আরু। সারা শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যায়। স্তব্ধ, সিক্ততা ফোটে আরুর দৃষ্টিতে। মুখে ফুটে ওঠা রাগ কর্পূরের মতো উবে গেলো আরুর। মাথা নামিয়ে নিলো সাথেসাথে। লোকটার কি লজ্জা বলতে কিছু নেই? কথায় কথায় ‘আমার বউ’ ‘আমার বউ’ করে কেন লোকটা? এই বুউকেই যে মারতে বসে হুটহাট চমকে দিয়ে; তার বেলা?
রুদ্র মুচকি হাঁসে আরুর অবস্থা দেখে। কি এমন আছে এই কথাটায়? এতো লজ্জা পায় কেন এই মেয়ে? এইযে, আরুর দুই গাল লাল টকটকে হয়ে গেছে এই একটি কথায়, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি? এমনিই?
রুদ্র আরুর দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে মাথাটা আরও নামিয়ে নিলো আরু। রুদ্র আরুর হাত ধরে নিলো শক্ত করে। এই দিকটা বেশ ফাঁকা। তাইতো সুযোগ পেতেই আরুকে টেনে নিয়েছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আরুকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে? হোক! তাতে রুদ্র’র কিছু যায় আসে না। রুদ্র আরুর হাত ধরে বেড়িয়ে এলো। অন্যদিকে হাঁটা ধরতেই আরু থেমে যায়। মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে,
‘এদিকে তো নেই ওরা।’
রুদ্র প্রতিত্তোর করেনা। নিজের মতোই হাঁটতে থাকে।নিয়ে যায় পূর্ব পার্শে। মেয়েদের কসমেটিকস্ এর একটি দোকানে নিয়ে গেলো আরুকে রুদ্র। সেদিনের পর থেকে আরু যেন সাজগোজ-ই বন্ধ করে দিয়েছে। কানে ছোট ছোট ছোট দুটো দুল। ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে প্রসাধনি; কোনটাই নেই। ফরসা হাতটা একদম ফাঁকা। মেয়েদের হাতে চুড়ি পড়লে কত সুন্দর লাগে,মেয়েটা জানে না? হাতে চুড়ি কেন পড়ে না? ফরসা হাতখানায় টিয়া রঙা কাঁচের চুড়িতে দারুন লাগবে নিশ্চয়ই? রুদ্র দোকান’দারকে চুরি দেখাতে বললো। একে একে অনেকগুলো চুড়ি নামালো দোকানদার। হাতের মাপ নিয়ে জ্বলজ্বল করা লাল আর সবুজ রঙের দুই থোকা চুড়ি নিয়ে নিলো রুদ্র। আরু সচারাচর চুড়ি পড়ে না। কিন্তু আজ না করতে পারলো না আরু। একটা লিপস্টিক ও নিলো রুদ্র। কি রঙের তা দেখতে পেলো না আরু। একে একে অনেক কিছু কিনে কয়েকটা ব্যাগ বানিয়ে ফেললো রুদ্র। আরু তখনো নিশ্চুপ। এরপর ওখান থেকে চলে এলো দু’জনে। হাঁটার এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলো রুদ্র,
‘পছন্দ হয়েছে জিনিসগুলো? আজ প্রথম এসব কিনলাম।’
আরু মাথা নাড়ে। যার অর্থ পছন্দ হয়েছে তার। দু’জনে বাকিটা পথ আর কোন কথা বললো না। গেলো আগের জায়গাটায়। আরু ভেবেছিলো এতক্ষণে তাদের খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, সবাই শান্ত, স্বাভাবিক ভাবে বসে এটা-সেটা দেখছে। তাদের উপস্থিতিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত বা হেলদোল নেই কারো। এরা কি কেউ খেয়াল করেনি? তাহলে তো ভালোই হলো! আরু যেতেই ইলিমা আরুকে কাছে ডাকলেন। আরু জুঁইয়ের পাশ ঘেঁষে যেতেই জুঁই ফিচেল গলায় বলে উঠলো,
‘তা কি কি কিনে দিলো ভাইয়া?’
আরু লজ্জা পেলো। তারমানে সবাই জানে? তাহলে কেউ কিছু বলছে না কেন? আরু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসলো ইলিমার পাশে। ইলিমা সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আরু, শাড়ি নেবে না লেহেঙ্গা?’
আরুর মনে পড়লো রুদ্র একদিন শাড়ির কথা বলেছিলো। রুদ্র’র কি শাড়ি ভীষণ পছন্দ? মনে প্রশ্ন জাগে আরুর। তা নাহলে সেদিন অত রাগ কেন করেছিলো? আরু হেঁসে বললো, শাড়ি নেবে। অনেকগুলো শাড়ি তাদের সামনে বিছিয়ে দেখাতে লাগলেন দু’টো লোক। তানিয়া পাশে চুপচাপ বসে। কোনমতে হাত উঁচিয়ে সিলেক্ট করে দিলো একটি গোলাপি রঙের শাড়ি। আরু আঁড়চোখে একবার রুদ্র’র দিকে তাকায়। মাথা নাড়ে রুদ্র। আরু ওটাই নিলো।
সবাই কেনাকাটায় ব্যাস্ত। সেই ফাঁকে একটু আড়ালে এসে দাঁড়ালো তানিয়া। হাতঘড়িতে তখন সাড়ে চারটা বাজে। এতক্ষণ লাগে সপিং করতে? অবশ্য বিয়ের সপিং বলে কথা, হয়তো আরো লাগবে, লাগতে পারে। কিন্তু তানিয়া ইচ্ছে করছে এখনি চলে যেতে। তার কারন ওই অভ্র। অভ্র’র দিকে যতবার তানিয়ার চোখ পড়েছে, ততবার চোখাচোখি হয়েছে। আর অভ্র কি সুস্থ-সুন্দর চোখে তাকানোর মতো ছেলে? ওই চোখে নিজের মরন দেখে তানিয়া। অদ্ভুত রাগ দখল করে থাকে সবসময়। তারউপর মরার উপর খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে অভ্র’র থ্রেট! কি শাস্তি দেবে অভ্র? গোটা অফিস পরিষ্কার করাবে? নাকি তার থেকেও বেশি কিছু? সেই চিন্তা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তানিয়াকে। চেয়েও চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। এসেছে থেকে একদন্ড সস্থির শ্বাস ফেলতে পারেনি। তাইতো সুযোগ বুঝে সরে এসেছে ওখান থেকে। এদিকে রুদ্র বারবার বলছে,’শালি সাহেবা, যা ইচ্ছা নিন। দুলাভাইয়ের থেকে লজ্জা কিসের?’ আরুও সেম। আরুর শাশুড়ী তার থেকেও বেশি। তানিয়া যে মুখ ফুটে টু শব্দও করতে পারছিলো না অভ্র’র সামনে। শেষমেশ কোনমতে বলেছিলো,
‘আরেকদিন শালি হিসেবে চেয়ে নেব দুলাভাই।’
ব্যাস! এতোটুকুই গলা থেকে বেড়িয়েছে। কিন্তু এই কথা কেউ শুনলো না তার। জোর করতে লাগলো সবাই। অবশেষে বাধ্য হয়েই একটা থ্রি-পিস নিলো তানিয়া। তার পরেও কেউ ছাড়ে না। এই কারনগুলোর জন্যই তানিয়া চলে এসেছে। তানিয়া ভাবলো, যতক্ষন না ওদের সপিং শেষ হবে, ততক্ষণ আর সামনেই যাবে না তানিয়া। আড়ালে-আবডালে থাকবে। তানিয়া এদিক-ওদিক হাঁটতে লাগলো। হুট করে দূরে একটি গাউন চোখে পড়লো তানিয়ার। প্লাস্টিকের পুতুলে ঝুলিয়ে রাখা গাউনের রঙ ফুল হোয়াইট! তানিয়া মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলো গাউনটা। এরপর এগিয়ে যায়।
সাদা পাথরে অসাধারণ ডিজাইনে গড়া গাউন। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নিয়ে গড়া গাউনটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তানিয়া। কই, আগে তো এসব ভালো লাগেনি তানিয়ার। আজকাল কি তানিয়া পাল্টে যাচ্ছে? তানিয়া শুভ্র গাউনটা ছুঁয়ে দেখে। সামনে ক্ষুদ্র গর্তযুক্ত জাল দেয়া। পুতুলের হাতে সাদা গ্লাভস। ঠিক ভিনদেশী টাইপের। নিচটা পুথি দিয়ে সাজানো। তানিয়ার ভীষণ পছন্দ হলো গাউনটা। কৌতুহল নিয়ে প্রাইস দেখতেই পিলে চমকে উঠলো তানিয়ার। ছাব্বিশ হাজার টাকা! এই গাউনের এতো দাম? টাকা কি গাছে ফলে নাকি? অন্যদিন হলে তানিয়া নিয়ে নিত। কিন্তু আজ তো সে টাকা কিংবা কার্ড কোনটাই আনেনি।
তানিয়া তড়িৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়ালো। রুদ্র বলছে বটে, কিন্তু তাই বলে ছাব্বিশ হাজার টাকার একটা গাউন নিয়ে নেবে? না, না! তখন হয়তো বলবে,’মেয়েটা নির্লজ্জ! নিতে বলেছে বলে বেহায়ার রাক্ষুসে আবদার করে বসেছে।’ তানিয়া জিভ কাটলো। এটা থেকে দূরে যাওয়াই উত্তম। তানিয়া চলে এলো ওখান থেকে। কেন যেন আবারো তাকাতে মন চাইছে। তানিয়া আবারো তাকালো গাউনটার দিকে। চোখ সরিয়ে নিলো ফের। মনকে বুজ দিলো, ওটা মাছ ধরা জাল। ওমন জাল ছাব্বিশ হাজার টাকায় শুধু পাগলরাই কিনবে। সময় হলে আরেকদিন আসা যাবে। তখন নয় নিয়ে নেবে। তানিয়া দ্রুত ত্যাগ করলো সেই স্থান। গাউনটা বুঝি এখনো পিছু ডাকছে তার।
প্রায় সন্ধ্যা। ধরনিতে আধার নেমে এসেছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে এলো সবাই। সপিং-এর পর সবাই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলো। প্রায় সবার হাতেই সপিং ব্যাগ।
সারাদিন পর পেটে কিছু পড়লো তানিয়ার। এতক্ষণে মাথার চিন্তাগুলো কমেছে একটু। তানিয়া ভাবলো সবাইকে বলে এবার বিদায় নেবে। ইতিমধ্যে তার বাবা ফোন করেছে কয়েকবার। তানিয়া এগিয়ে গেলো ইলিমা আজাদের সামনে। ডেকে উঠলো,
‘আন্টি।’
ইলিমা তাকালেন তানিয়ার দিকে। তানিয়া নতজানু গলায় ফের বললো,’আজ তাহলে আসি। আব্বু ফোন করছে বারবার।’
ইলিমা হাসলেন। মেয়েটা খুব বেশিই শান্ত ইলিমার মনে হয়েছে। আর কি ভদ্র! এমন সন্ধ্যায় মেয়েটা একা যাবে? ইলিমা অভ্র’র দিকে তাকালেন। অভ্র দূরত্ব রেখে দাড়িয়ে। বললেন,’অভ্র যা তো মেয়েটাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।’
তানিয়া চমকালো। সে কি একা যেতে পারে না? নাকি তার হাত পা নেই? তানিয়া চোখ তুলে তাকালো অভ্র’র দিকে। আপাদমস্তক নিরুদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়ে অভ্র। অভ্র’র নিশ্চুপতায় কলিজা শুকিয়ে এলো তানিয়ার। সেধে কেউ বাঘের গুহায় যায় নাকি? তানিয়া না করে উঠলো,
‘আরে আন্টি, কোন দরকার নেই। এখান থেকে আমাদের বাসা খুবই অল্প পথ। আমি চলে যেতে পারবো।’
বাঁধ সাধলো আরু। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
‘কাছে মানে? এই পথ তো উল্টো তোদের বাড়ি থেকে। তারথেকে বরং অভ্র ভাইয়া গিয়ে পৌছে দিয়ে আসুক।’
তানিয়া ইতস্তত করতে লাগলো। অভ্র এখন চুপচাপ আছে ঠিকিই, কিন্তু পরে? যদি চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেয়? বা মোরের কুকুরগুলোর সামনে? তখন কি হবে? তানিয়া এত জলদি মরতে চায় না। কিন্তু করারই বা কি আছে? যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়! কথাটা আবারো প্রমানিত হলো।
‘আরু ঠিকিই বলেছে। অভ্র, তুমি গিয়ে পৌছে দিয়ে এসো তানিয়াকে,কেমন?’ তানিয়ার দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন ইলিমা। তানিয়া কোনমতে ঠোঁট প্রসারিত করে হাঁসলো। কিন্তু মনের ভেতরে ভয়টুকু তখনো বজায়। তানিয়া বোঝে না, যেখানে মা, ভাই, বোনেরা এতো ভালো; সেখানে এই অভ্র? যাচ্ছেতাই!
একে একে সবাই রুদ্র’র সাদা-কালো গাড়িটায় গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে চলেও গেলো। কিন্তু তানিয়া একইভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে। না নড়ছে, আর না কথা বলছে। অভ্র স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো তানিয়ার সামনে। গম্ভীর গলায় বললো,
‘এভাবে দাঁড়িয়েই থাকবেন? এমনিতে আমি কাউকে আমার গাড়িতে এলাও করি না। কিন্তু মা যেহেতু বললো, তাই না হয় আজ একটু স্যাক্রিফাইস করলাম! তাই বলে আপনার নাটক দেখার সময় আমার হাতে নেই মিস তানিয়া।’
রাগে জ্বলে উঠলো তানিয়া। মাথা নিচু রেখেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ন্ত্রনের বৃথা চেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ। নাটক? তানিয়াকে দেখে কোন এঙ্গেলে অভিনেত্রী মনে হচ্ছে? তানিয়া তেতে বলে উঠতে চাইলো,’আমারো ইচ্ছে নেই ওই গাড়িতে উঠতে। কে চাইছে আপনার গাড়িতে উঠতে? এমন ধারা ভাব যেন আমি পাগল হয়ে গেছি ওই গাড়িতল উঠতে। তখন আন্টি বলেছিলো, এখন তো আর নেই। তাহলে চলে গেলেই তো পারেন। কে বলেছে স্যাক্রিফাইস করতে? এহ্! এসেছে দেমাগ দেখাতে। ওই দেমাগ ধুয়ে পানি খান!’
কিন্তু তানিয়া মুখ ফুটে একটা কথাও বলতে পারলো না। দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করে নিলো।
অভ্র গিয়ে উঠে বসলো গাড়িতে। চোখে সানগ্লাস দিয়ে বিরক্ত মুখে বাইরে তাকাতেই তানিয়া একপা একপা করে এগিয়ে এলো। পেছনের বসতে নিলেই অভ্র ধারালো গলায় বলে উঠলো,
‘পেছোনে বসছেন যে? আমি কি আপনার ড্রাইভার যে আপনাকে পেছনে নিয়ে ঘুরবো?’
তানিয়া এবারেও দন্তে আঘাত করে সহ্য করে নিলো। এসে সামনে বসলো তানিয়া। অভ্র গাড়ি স্টার্ট দিলো। পুরোটা রাস্তা তেমন কোন কথা বললো না। শুধু মাঝেমাঝে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছিলো তানিয়া। খানিক বাদেই তানিয়াদের বাড়ি সামনে এসে থামলো গাড়িটা। তানিয়া দ্রুত নেমে পড়লো। থ্যাংক ইউ কি বলবে? জিবনেও না! কত কথাই না শোনালো তাকে। এরপর আবার থ্যাংক ইউ? তানিয়া হাঁটা ধরতেই অভ্র চেয়াল শক্ত করে বললো,
‘অকৃতজ্ঞ!’
তানিয়া শুনেও না শোনার ভান ধরলো। গটগট করে হেঁটে বাড়ির ভিতরে ডুকলো। সদর দরজা খোলা! তারমানে তার বাবা নিশ্চয়ই বাড়িতে? আজ গর্দান যাবে তানিয়ার। তানিয়া দরজা লাগিয়ে দিলো। ভেতরে ডুকতেই ড্রইংরুমে আরিফ সেহরান’কে বসে থাকতে দেখে কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলো তানিয়া। আরিফ গম্ভীর হয়ে বসে। তানিয়স কিছু বলবে, তার আগেই বেজে উঠলো কলিং বেল। তানিয়া যেন একটু চমকালো। আরিফ দরজা খোলার জন্য ইসারা করতেই তানিয়া দরজা খুলতে গেলো। একজন মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে। হাতে একটি বাক্স। তানিয়া জিজ্ঞেস করলো,
‘জ্বি,কাকে চাই?’
মধ্যবয়স্ক লোকটি সামনের দাঁতগুলো বের করে হাঁসলেন। বললেন,
‘ম্যাডাম তানিয়া কি বাড়িতে আছেন?’
‘হ্যা, আমিই তানিয়া। বলুন কি দরকার।’
তানিয়ার কথা শুনে মুখের হাঁসি দীর্ঘ হলো লোকটার। হাতের বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘আপনার পার্সেল।’
কপাল কুঁচকে গেলো তানিয়ার। পার্সেল, তাও তানিয়ার নামে? তানিয়া তো অনলাইনে কেনাকাটা করে না। তাহলে পার্সেল আসবে কোত্থেকে? তানিয়া অনিমেষে বললো,
‘আপনার হয়তো ভূল হচ্ছে। এটা আমার পার্সেল নয়।’
লোকটি কপাল কুঁচকালো। জিজ্ঞেস করলো,’আপনি তানিয়া ইরহাম এন্টারপ্রাইজে জব করেন,তাইনা?’
তানিয়া ভরকালো। এই লোকে এসব জানলো কিভাবে? একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে নিলো তানিয়া। আরিফ সেরহান আগের মতোই বসে আছেন। শোনেনি তাহলে! তানিয়া দ্রুত নিয়ে নিলো বাক্সটা। বললো,’পেমেন্ট বাকি আছে?’
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২৫+২৬
লোকটি মাথা নাড়িয়ে বিদায় নিলেন। তানিয়া চিন্তার সাগরে ডুব দিলো। তানিয়া অর্ডার করেনি, আবার পেমেন্ট ও হয়ে গেছে! কে পাঠালো এই পার্সেল? তানিয়া ঈগল চোখে তাকালো বাক্সটার দিকে। সেখানে কালো মার্কারে ছোট করে লেখা,’আপনার অপ্রিয় কেউ।’
