নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৩১+৩২
আহমেদ হৃদ
‘আমার দেয়া উপহারটা কি ফেলে দিয়েছো?’
মেসেজটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তানিয়া। কে এই লোক? আর কিসের উপহার? এই অচেনা লোকটাই কি সেই অপ্রিয় ব্যাক্তি? যে কালকে গাউন গিফট্ করেছিলো? নাম্বার কই পেলো লোকটা? তানিয়া একপলক আরুদের দিকে তাকালো। সবাই হলুদ মাখাতে ব্যাস্ত। আপাতত কারো নজর এদিকে নেই। তানিয়া ছাঁদের এককোনে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটাকে হাতে পাওয়া গেছে! কিছুতেই সবটা না জেনে ছাড়া যাবে না। তানিয়া জিজ্ঞেস করলো,
‘কে আপনি? কি নাম আপনার?’
মেসেজটা পাঠিয়েই তানিয়া আবারো দূরে তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ আসছে কি-না। ওপাড়ের লোকটা বুঝি ভীষন ব্যাস্ত। মেসেজ এলো সয়েসয়ে,
‘অপ্রিয় কেউ। বলেই তো দিয়েছি।’
মেসেজ দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো তানিয়ার। সে-ই অপ্রিয়! নাম নেই নাকি? কপালে সূতিক্ষ্ণ তিনটি ভাজ ফেলে টাইপ করলো তানিয়া,
‘আপনি কি বলবেন না ব্লক করে দেবো?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘দিতে পারেন। তবে, মন থেকে পারবেন না। আমি জানি আপনি গাউনটা গুছিয়ে রেখে দিয়েছেন।’
ভরকে গেলো তানিয়া। তাজ্জব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেসেজটার দিকে। লোকটা জানলো কিভাবে গুছিয়ে রাখা হয়েছে ওটা? তানিয়ার রাগ হলো নিজের প্রতি। কেন যে কালকেই ফেলে দিলোনা! লিখলো,
‘আপনি কিন্তু বারাবাড়ি করছেন। আপনি জানেন আমি কে?’
এবারো খানিক দেরিতে রিপ্লাই এলো,
‘আমার অন্দরমহলে যার ছবি প্রতি মূহুর্তে অঙ্কিত হয় জল রঙে, কাঠ পেন্সিলে, মোম রঙের ছটায়! প্রুশিয়ান নীল রঙের বিস্তর ক্যানভাসে যাকে আনমনে এঁকে বসি নানাভাবে, অভিন্যতার সাথে নতুনতা মিশিয়ে, তুমি তো সে-ই! তুমি এমন একজন, যার ছবি চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে দু’চোখের দৃশ্যপটে, প্রিয়।’
বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো তানিয়া। এ-সব কি বলছে লোকটা? এই অপ্রিয় ব্যক্তি কি তানিয়ার প্রেমে পড়েছে? তাই এমন কবি-কবি ভঙ্গিতে মেসেজ দিচ্ছে? সর্বনাশ! তানিয়ার প্রেমে পড়ার অধিকার শুধু অভ্র’র। অভ্র তানিয়ার প্রেমে পড়বে, হাবুডুবু খাবে, জোয়ারে ভেসে বেড়াবে। এই লোকের উদ্ভব কেন হবে? কেন কেউ তানিয়ার প্রেমে পড়বে? তানিয়ার রাগ হলো। নিজের বিন্দুমাত্র সৌন্দর্য নিয়ে ক্ষোভ হলো। যে সৌন্দর্য অভ্র’র চোখে পড়ে না, তা অন্য কারো চোখে কেন পড়বে? রাগে জ্বলে উঠলো তানিয়ার সর্বাঙ্গ। রিপ্লাই দিলো,
‘আমি বিবাহিত। কিছুদিন বাদেই দুই ছেলের মা হবো। আমায় আর ডিস্টার্ব করবেন না।’
‘ওহ্, রিয়েলি? জামাইটা কে?’
তানিয়া বাঁকা হাসে। জামাই এর নাম ভাবতেই অদ্ভুতভাবে অভ্র’র মুখটা ভেসে ওঠে তানিয়ার সামনে। তানিয়া লজ্জা মিশ্রিত হাসি হাসলো। লিখলো,’শুনলে আবার হার্ট এট্যাক করবেন না তো? আমি ভালো মানুষ বিধায় ভালোভাবে বলছি, আর ডিস্টার্ব না করতে। আমার জামাই আমার প্রতি ভীষন সেনসেটিভ! শুনলে কিন্তু আপনার একটা হাড়-ও আস্ত থাকবে না। সেটা আশা করি ভালো হবে না।’
‘আমায় হার্টের রোগী করে, এ্যাটাকের ভয় দেখাও? সে তো নিত্যদিনের রোগ।’
‘আপনার কি মনে হচ্ছে আমি ফাজলামো করছি?’
‘অবশ্যই। নাহলে বলুন দেখি নাম।’
‘শুনুন তাহলে, আমার জামাই হলো বিশিষ্ঠ বিজনেসম্যান ইরহাম আজাদ এর ছোট ছেলে অভ্র। চিনেছেন নিশ্চয়ই?’
তানিয়া ক্রুর হেসে পাঠিয়ে দিলো মেসেজটা। এবার? দে মেসেজ! দেখি কত সাহস! তানিয়া দু’মিনিট অপেক্ষা করলো রিপ্লাই আসার; কিন্তু এলো না। ভাবলো হয়তো দেরিতে হলেও কিছু লিখবে, কিন্তু না! আর মেসেজ এলো না। লোকটা কি ভয় পেলো? ফিচেল হাসলো তানিয়া। ব্যাস,এতটুকুই দম? এই দম নিয়ে এসেছে তানিয়াকে পটাতে! তানিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ঝামেলা বিদায় হলো তবে।
অন্ধকারে নিমজ্জিত পুরো রুম। কয়েকজন মানুষের ঘনঘন শ্বাসের শব্দ কানে আসছে। সবাই কি ঘুমিয়ে পড়লো? আরু সচকিত হয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টানে। উঠে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই, আকম্মিক বুকের ওপর দাবাং মার্কা একটা হাত হুমড়ি দিয়ে পড়লো। আরু বুঝলো, ঘুমোয়নি এখনো তারা। মুহুর্তে নিজের ভালোলাগা জলে বিসর্জন দিতে হলো আরুকে। আর কখন ঘুমাবে মেয়েগুলো? নাকি জেগে জেগেই কাটিয়ে দেবে পুরো রাত? বিয়ের এক রাত আগে বউয়ের ঘুম আসেনা লাজুকতায়, অদ্ভুত-কিম্ভুত সব অনুভূতি’তে। অথচ বেহায়া আরু বরের সাথে কথা বলার জন্য ছটফটাচ্ছে। তার মিষ্টি মধুর কন্ঠ শুনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আরুর ছোট্ট কোমল হৃদয়। আচ্ছা,বরের সাথে কথা না বললে ভালো লাগে কারো? থাকা সম্ভব? এইযে, আজ বাদে কালকে আরুর বিয়ে। বিয়ের আগের এই রাতটুকু, এমন রোমাঞ্চকর অনুভূতিগুলো কি বারবার আসবে? গল্প জমবে এমন? আসবে না, জমবেও না! আজ সারাদিন কথা হয়নি রুদ্র’র সাথে। এরা যা শুরু করেছে, এখনো হবেনা নিশ্চিত!
আরুর দু’পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তানিয়া, সোনিয়া। বিছানায় ঘুমাচ্ছে অতুশি, ইরু, তোফা আর শ্রাবনী। ওরা চারজন হয়তো সপ্নের দেশে পাড়ি জমিয়েছে এতক্ষণে। কিন্তু এরা? আরুরা তিন বান্ধুবী মিলে শুয়েছে মেঝেতে। আরুর উপরে রাখা হাতটার মালিক সোনিয়া। সারাঘর অন্ধকার হলেও তিনজনের একটারও চোখ বন্ধ নয়। অন্ধকারে চোখ রেখে ভাবনায় বিভোর তিনজনে। সোনিয়ার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। রাত কতো হলো কে জানে! অথচ কেউই কোন কথা বলছে না। কথা কেন বলে না মেয়েগুলো? জেগেই তো আছে! সোনিয়া আগ বাড়িয়ে বরাবরের মতো এবারো কথা বলতে পারল না। অন্ধকারে তানিয়াকে দেখতে চেষ্টা করলো; না! দেখা গেলো না। শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। আরুর ওপর রাখা হাতটা বাড়িয়ে আলতো করে তানিয়াকে খোঁচা দিলো একটা। সাথেসাথে বিরক্তমাখা কন্ঠ ভেসে এলো তানিয়ার,
‘সোনু! এমন করছিস কেন তুই?’
সোনিয়া উত্তর দিলো না। খানিক মন খারাপ হলো তার। আহ্লাদে আরুর সাথে ঘেঁষে গেলো কিছুটা। আরুও বিরক্ত গলায় বলে উঠলো,’আহ্, গরম লাগছে বইন।’
সোনিয়ার মন খারাপের মাত্রা তিব্র হলো। সাথেসাথে আরুকে ছেড়ে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে ফুরে শুয়ে পড়লো। আরু বুঝেও কিছু বললো না। মেয়েটা বড় হবে কবে? পাশ থেকে তানিয়া ডেকে উঠলো,
‘আরু!’
‘হু?’ জবাব দিলো আরু।
‘কাল আব্বু আমার সাথে টানা দু’মিনিট কথা বলেছে।’
পাশ থেকে আগ্রহ নিয়ে ফিরলো সোনিয়া। আবারো আগের মতো আরুর ওপর হাত রাখলো; যেন কিছুই হয়নি। অতি উৎকন্ঠার সহিত জিজ্ঞেস করলো,’কি বলিস? টানা দুই মিনিট? কি বললো?’
‘জিজ্ঞেস করলো আমি ফ্রী আছি কবে।’
‘কি বললি তুই?’ বললো আরু।
‘বললাম, আগামি তিনদিন আমি ভীষন ব্যাস্ত। তাইতো কালকেও বাড়ি যাইনি। আমার কেন জানি খটকা লাগছে।’
সোনিয়া রসিকতার সুরে বলে,
‘দেখ, তোর বিসনেসম্যান বাপ তোর বিয়ের কথা ভাবছে নাকি।’
তানিয়া তড়িৎ গতিতে উঠে বসে। এই কথাটা তার মাথাতেও এসেছে আজকে। এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে কি হবে? আর আরিফ সেরহানের মতো মানুষ নিশ্চয়ই তানিয়ার কথা শুনবে না! ভাববে না তার মনের মানুষটাকে নিয়ে গড়া কতশত সপ্নের কথা। ভাবতেই গলা শুকিয়ে এলো তানিয়ার। এই ভয়টাই কি কালকে তানিয়াকে যেতে দেয়নি বাড়িতে? তাহলে আরও কয়েকদিন এখানেই থাকবে সে। ডিসিশন ফাইনাল! পাশ ফিরে ক্রুর চোখে তাকালো তানিয়া। কটমটে গলায় বললো,
‘বেদ্দপ! ভূলেও এমন কথা বলবি না আর।’
‘অতো ভয় কেন পাচ্ছিস? এমন যদি হয়, আমরা তো আছিই। আর অভ্র ভাইয়াও তো আছেন।’
তানিয়া সোনিয়ার কথায় আড়ালে মুখ ভেঙায়। এই লোক আছে; হ্যা, শুধু আছেই! না আছে সাতে আর না আছে পাঁচে। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে ওঠে তানিয়া,
‘ঘোড়ার ডিম। ওই লোকের এসবে কিছু এসে যায় নাকি? আমি মরলেও ওনার কিছু যায় আসে না।’
আরু হতাশার শ্বাস ছাড়ে। বলে,’আর কবে নিজের মনের কথা বলবি তুই?’
‘আমি একটা মেয়ে মানুষ হয়ে আগে যাবো বলতে? উনি বোঝেন না কিছু? জানিস, ট্যুরে গিয়ে আমি ওনাকে আই লাভ ইউ বলেছিলাম। হোক সেটা নেশার ঝোঁকে! এইটুকুনের জন্য উনি দু’দিন আমার সাথে কথা বলেননি।’
আঁতকে উঠে বসলো আরু, সোনিয়া। অন্ধকারে দেখতে চেষ্টা করলো তানিয়াকে। সোনিয়া অবাক গলায় বললো,’তুই বলেছিলিস?’
‘হু, নেশার ঘোরে।’
আরু আগের মতোই শুয়ে পড়লো আবারো। সোনিয়া জিজ্ঞেস করলো,
‘তারপর?’
তানিয়া উত্তর দিলো না। আরুর পাশে আবারো গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। তারপর? তারপর,মানুষের প্রেম শুরু হয়, বিয়ে হয়! কিন্তু আনরোমান্টিক লোক একটা, কথা বলাই বন্ধ করে দিলো! মনটা খচখচ করছে খুব তানিয়ার। আজকে তানিয়া বাসায় ফেরেনি বলে আরিফ সেহরান গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। তানিয়া তবুও ফেরেনি। আকম্মিক অন্য রকম এই মানুষটার আচরণ তানিয়ার ভয়ের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে! বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে।
দুপুর দুইটা। সূর্য হেলে পড়তেই হৈ হুল্লোড় পড়ে গেলো আহমেদ ভিলায়। ঘরের কোনা কোনায় ছেঁয়ে মানুষজনে। বাড়ির সামনে সাজানো বিরাট প্যান্ডেলেও পা রাখার জো নেই। ছাঁদে দাঁড়িয়ে দূর থেকে সব দেখছে আরু। রেলিং-এ মরিচ বাতি লাগানো হয়েছে। এখন থেকেই তারা বিভিন্ন আলো ছড়াচ্ছে। মাথার চুলগুলো ভেজা। শেষ হলুদ দিয়ে সদ্য গোসল করে এসে সেখানে দাঁড়িয়েছে আরু। চুল বেয়ে পানি ঝড়ছে। আরুর সেদিকে খেয়াল নেই। আনমনা হয়ে ভাবনায় বিভোর সে। পাশে এসে যে কখন মহুয়া বেগম দাঁড়িয়েছে, খেয়াল নেই মেয়েটার। মহুয়া কয়েক মিনিট তাকিয়েই রইলেন। কি এতো ভাবছে আরু? স্ব-যত্নে মেয়ের ভেজা চুলে হাত রাখলেন মহুয়া। আরুর সম্বিত ফিরলো। পাশে তাকিয়ে মা’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠোঁট টেনে হাসলো। সেই হাসি নিষ্প্রাণ। জিজ্ঞেস করলো আরু,
‘কখন এসেছো?’
মহুয়া নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিলেন,
‘আরও আগে। কি ভাবছিস এতো?’
‘ক্ কই কি? এমনিই..’
মহুয়া হাসলেন। আজকে মেয়ে চলে যাবে ভাবলেই মুচড়ে উঠছে ওনার ভেতর। আহমেদ সাহেব খানিক আগেই কোথাও চলে গেলো। মহুয়া নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে। চোখ-মুখ শুকনো মেয়েটার। গালে লেগে থাকা হাসিটুকু আজ নেই। যতোই লম্প-ঝম্প করুক, সে-ও তো মেয়ে। পরিবারকে ছেড়ে অন্য বাড়িতে গিয়ে থাকা কি মুখের কথা? তিনি এ বিষয়ে কথা বললেন না। কথা বললেই আরু কেঁদে দেবে। তিনি চান না এখন মেয়েকে কাঁদাতে। উম, উনি পারবেন না সহ্য করতে আরুর কান্না। তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন,
‘তোকে তানিয়া, শ্রাবনী খুঁজছে। পার্লার থেকে চলে এসেছে হাফপ্যান্ট পড়া মেয়েগুলো। আরও দেরি করলে কিন্তু তোকে না নিয়েই রুদ্র’রা চলে যাবে।’
আরু হুট করে জড়িয়ে ধরে মহুয়া বেগমকে। কপালে, গালে গাঢ় চুম্বন দেয়। কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, এরপর ছুটে চলে যায় সেখান থেকে। আরুর চলে যাওয়ার পাণে তাকিয়ে, আরক্ত হাসলেন মহুয়া। চোখের কোনে জমা পানিটুকু আলগোছে মুছে নিলেন।
আরু নিচে নেমে এলো। বাড়িটা আজ আর বাড়ি নেই, শিশুপার্ক হয়ে গেছে। আরু নিজের রুমে গিয়ে দেখলো, তোফা আর তানিয়া সাজছে। ওদের সাজাচ্ছে দু’টো মেয়ে। পার্লার থেকে এসেছে ওরা। আরুকে দেখেই তানিয়া এগিয়ে আসে। ওর সাজ প্রায় শেষ। গাঢ় লাল রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে তানিয়া। ঠোঁটে লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করা লাল লিপস্টিক। সিল্কের ওড়না গলায় জড়িয়ে তানিয়া এসেই কাঁধে হাত রেখে রাগত স্বরে আওড়ায়,’কোথায় গিয়েছিলি? কিছুক্ষণ পরেই বরপক্ষ চলে আসবে। তোকে সাজাতেও তো হবে, না-কি?’
উত্তরে আরু মাথা নাড়ে। বলে,’আজ তোকে অসাধারণ লাগছে। আজ দেখিস, অভ্র ভাইয়া নিশ্চিত ক্রাশ খেয়ে যাবে।’
তানিয়া লজ্জা পেলো আরুর কথায়। লজ্জা ঢাকতে আরুকে টেনে এনে আয়নার সামনে বসালো তানিয়া। মেয়ে দুটো’কে বললো আরুকে সাজাতে। ওরা সাজাতে শুরু করে আরুকে। একপর্যায়ে ঘর ভরে যায় পাড়া-প্রতিবেশী, আত্নীয়-স্বজনে। সবাই লজ্জা দিতে থাকে আরুকে। আরুর গালে দেয়া প্রসাধনী উপেক্ষা করে রক্তিমা হয় ভরাট দুটি গাল। লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয় আরু। এতো লজহীন কথা বলে কেন এরা? আরু যে সর্বশরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠছে কথাগুলোয়, ওরা বুঝছে না?
দেখতে দেখতে সাজ সম্পূর্ণ হয় আরুর। তানিয়া সবাইকে ঠেলে আরুর পাশে এসে বসে। সবাইকে নিষেধ করে এমন কথা বলতে। তক্ষুনি আর্বিভাব সোনিয়ার। হাঁপাচ্ছে সে। যেন ছুটে এসেছে। একটানে বলে ওঠে,
‘বরপক্ষ চলে এসেছে।’
বাইরে থেকে হৈচৈ এর আওয়াজ তীক্ষ্ণ ভাবে কানে আসে তখনি। রুমে থাকা সবাই একে একে বেড়িয়ে গেলো চিল্লাতে চিল্লাতে। সবার মুখে একই কথা,’বর এসেছে, বর এসেছে।’
লজ্জায় আরুর কান গরম হয়ে ওঠে ওই কথায়। হাতের মেহেদির দিকে চোখ পড়ে আরুর। সেখানে ইংরেজিতে ‘রুদ্র’ লেখা। আরু আবারো লজ্জা পেলো। বুকের ভেতর শুরু হলো নাম না জানা ঝড়ের তান্ডব। ধিপধিপ শব্দ করে বাজতে লাগলো হৃদপিণ্ড। আরু ড্রেসিং-এর কোনাটা শক্ত করে ধরলো। বুকটা কাঁপছে!
সোনিয়া এগিয়ে আসে। তাড়া দিয়ে তানিয়াকে বলে,’ওই, খাড়ায় আছোস ক্যান? চল গেট ধরবো।’
তানিয়া মাথা নাড়ে। দাড়িয়ে নিজেকে একবার আয়নাতে দেখে নেয়। ভেবেছিলো লিপস্টিক’টা ছড়িয়ে যাবে। দেয়ার অবিজ্ঞতা নেই কি-না! কিন্তু মোটামুটি ঠিকিই আছে। চুলগুলো একসাইডে করে আরুকে অভয় দিয়ে বেড়িয়ে এলো তানিয়া, সোনিয়া। নিচে নেমে রান্নাঘর থেকে বানানো সরবত, মিষ্টি’র ট্রে-টা নিয়ে বেড়িয়ে এলো বাইরে। ভীর ঠেলে গেট-এর সামনে এসে দাঁড়াতেই বরপক্ষ এর মধ্যে অভ্র’কে নতুন সাজে দেখে থমকে গেলো তানিয়া। হার্টবিট মিস হলো কয়েকবার। সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো অভ্র’র দিকে। অভ্র আজ পাঞ্জাবী পড়েছে। নীল পাঞ্জাবী, উপরে কোর্ট, হাতে চকচকে সোনালি রঙা ব্রান্ডের ঘরি পড়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে অভ্র। মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে তার দিকেই অকপটে অভ্র’র শীতল দৃষ্টি স্থির। তারদিকেই তাকিয়ে! সাথেসাথে চোখ সরিয়ে নিলো তানিয়া। ফাঁকা ডোগ গিলে মাথা নামিয়ে নিলো। এতো সেজেগুজে এসেছে কেন লোকটা? তাকে মারতে? এভাবে দেখলে যে তানিয়ার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে, লোকটা বোঝে না? মুখ তুলে তাকাতে পারবে তো, আবার?
তানিয়া আকম্মিক থেমে যাওয়ায় সোনিয়া বিরক্ত হয়ে হাত টেনে ধরলো তানিয়ার। টেনে নিয়ে এসে দাড় করালো সামনে। লাল ফিতে বাঁধিয়ে গন্ডি করা। ছোট্ট টেবিল সামনে। টেবিলে ট্রে-টা রেখে সোনিয়া প্রস্তুতি নিলো ঝগড়া করার। প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে রুদ্র’কে খুঁজলো। কিন্তু সে নেই। আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠলো সোনিয়া,
‘দুলাভাই কই আমাদের? লুকায় রাখছেন নাকি?’
ইলিমা ছেলেকে নিয়ে একটু পেছনে দাড়িয়ে। জেবা আর জুঁই এগিয়ে এলো। যদিও ইলিমা এসবে জড়াতে নিষেধ করেছেন। তবুও, কথা কাটাকাটি না হলে কি ভালো লাগে নাকি? ইরহাম এগিয়ে আসতে চাইলে, থামিয়ে দিলো অভ্র। এগিয়ে এলো কিছুটা। অভ্র’র দৃষ্টি তানিয়াতে। যেন চোখের সামনে কোন পরি নেমে এসেছে। এতো সুন্দর কেন এই মেয়ে? হুট করেই মনে পড়লো, তানিয়া লিপস্টিক দিয়েছে ঠোঁটে। লিপস্টিক কেন দিয়েছে মেয়েটা? হাত মুষ্টিমেয় করে নিজেকে সামলায় অভ্র। গলা পরিষ্কার করে সোনিয়ার দিকে তাকায়। বলে,
‘এভাবে আটকানোর কারন?’
‘বিয়াই মশাই, কিছু বোঝেন না? টাকা দিন, আর ভেতরে ডুকুন। সিম্পল!’
‘তো? কত দিতে হবে?’
পাশ থেকে জুঁই বিরক্ত চোখে তাকায় ভাইয়ের দিকে।ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,’ভাইয়া কি বলছো? এতো জলদি এমাউন্টের কথা আনছো কেন?’
অভ্র পাত্তা দিলো না। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সোনিয়ার দিকে। সোনিয়া ভ্যাবলার মতো একবার তানিয়াকে, আরেকবার অভ্র’কে দেখছে। এমাউন্ট কত বলবে এটা তো ঠিক করা হয়নি। পাশ থেকে তেড়ে আসে শ্রাবনী। বলে,
‘বিষ হাজারের আগে এই গেট খুলছে না।’
মাথা উঁচু-নিচু করে সায় দিলো সোনিয়া। সঠিক সময় এসে মোক্ষম কথা বলায় শ্রাবনীর কাঁধে আলতো চাপর দিয়ে বাহবা দিলো। অভ্র ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায়। পাশ থেকে তেতে বলে ওঠে জুঁই,
‘বললেই হলো নাকি? পাঁচশ’তে ডিল ফাইনাল। নাকি পাঁচশ এক, দুই, তিন কাউন্ট করবো?’
‘আরে, এতো কিপ্টে! মোটে পাঁচশ? লজ্জাটা বোধহয় আমরাই পাচ্ছি এবারে।’
এভাবেই কথা কাটাকাটি চললো আরও কিছুক্ষণ। এরমধ্যে তানিয়া একবারও মাথা তোলেনি। অভ্র হাত উঁচিয়ে থামালো সবাইকে। তানিয়ার দিকে হাত উঠিয়ে স্ব-শব্দে বলে উঠলো,
‘ওইযে আপনাদের পাশে দাড়ানো মেয়েটা, ও ঠিক যত বলবে, ততোই দেয়া হবে।’
সবাই অবাক চোখে তাকালো তানিয়ার দিকে। কেন্দ্রবিন্দু তানিয়া অস্থির চিত্তে মাথা তোলে। অভ্র’র তাক করা হাত এখনো তার দিকে স্থির। চোখাচোখি হতেই মাথা নামিয়ে নিলো তানিয়া। গলা শুকিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা বিরাজ করলো। সবার চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ। সোনিয়া এগিয়ে আসে। তানিয়ার কানে ফিসফিস করে বলে,
‘দোস্থ, বল ত্রিশ হাজার। বলে দে!’
তানিয়া মাথা তুলে সোনিয়ার দিকে তাকায়। শুকনো ডোগ গিলে মাথা নামিয়ে নেয় আবারো। অভ্র তাড়া দিয়ে ওঠে,
‘উনি না বললে যেমন ঝগড়া চলছে, তেমনি চলবে। টাকার কথা ভুলে যান।’
সোনিয়া মৃদু ধাক্কা দিতেই তানিয়া হকচকিয়ে উঠলো। কানে এসে একই কথা বললো আবারো সোনিয়া। তানিয়া মাথা তুলে তাকায়। যেই বলতে যাবে, ওমনি স্মিত হাসে অভ্র। তানিয়া ভরকায়। আচমকা বলে ওঠে,
‘পাঁচ হাজার।’
সাথেসাথে কোমরে চিমটি কাটলো সোনিয়া। অতিষ্ঠ চোখে তাকিয়ে কটমটে গলায় বললো,’কি বললো গাঁধি? শ্রেফ পাঁচ হাজার?’
তানিয়া জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। হাত-পা কাঁপছে তার। লেহেঙ্গার দুইহাতে আঁকড়ে একপ্রকার ছুটে পালিয়ে গেলো ভীর ঠেলে তানিয়া। ওপাড়ে ততক্ষণে করতালির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে। অভ্র পকেট থেকে পাঁচটা নোট বাড়িয়ে দিলো। সেগুলো চোখমুখ কুঁচকে হাতে নিলো সোনিয়া। এরপর কেটে দিলো লাল ফিতে। অভ্র মিষ্টির দিকে ইসারা করতেই বিরক্ত ভঙ্গিতে মিষ্টি খাইয়ে দিলো। অভ্র তৃপ্তি নিয়ে হাসে। টেবিল সরিয়ে সবাইকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসেন আহমেদ সাহেব। ভেতরে এসেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে তানিয়াকে খুঁজতে লাগলো অভ্র। কই গেলো মেয়েটা? এতো মানুষের মাঝে কোথায় গেলো? ছাঁদে, হ্যা ছাঁদে যায়নি তো? অভ্র আমতা-আমতা করে সরে এলো সবার মাঝ থেকে। একেবারে উঠে চলে গেলো ছাঁদে। ছাঁদের দরজা ভেজানো। অভ্র ছাঁদে উঠে পূর্ব দিকে তাকালো। নেই তানিয়া। পশ্চিম দিকে তাকাতেই তানিয়াকে ছাঁদের এককোনায় দেখতে পেলো। অভ্র এগিয়ে যায়। পেছন থেকে শিতল গলায় বলে ওঠে,
‘কোন সাহসে লিপস্টিক দিয়েছেন আপনি?’
‘কোন সাহসে লিপস্টিক দিয়েছেন আপনি?’
পরিচিত একটি শীতল কন্ঠ কানে আসতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো তানিয়ার। চমকে পিছু ফিরে তাকালো সে। কন্ঠ অনুযায়ী পরোখ করে নিলো কাঙ্খিত মানুষটিকে। তার থেকে কয়েকহাত দূরে অভ্র দাঁড়িয়ে। বিয়ে বাড়ির চারপাশে লাগানো মরিচ বাতির আলোয় অভ্র’র অস্পষ্ট কঠোর দু’টি চোখ, তানিয়ার চক্ষুগোচর হয় না। পাঞ্জাবী পরোহিত অভ্র’কে অসম্ভব সূদর্শন লাগলেও, তানিয়া এ মুহুর্তে মুগ্ধ হতে পারলো না। একচোখে তাকিয়ে থাকতে পারলো না অভ্র’র পাণে। বিরবির করে তার সৌন্দর্যের গুনগান, হঠাৎ-ই গলায় আঁটকে রইলো। আবছা আলোয় তীক্ষ্ণ, রাগান্বিত চোখজোড়া ভয়ের দানা সৃষ্টি করলো তানিয়ার মনে। গলা অত্যান্ত নিবীরতার সহিত জানান দিলো, এক ফোটা পানি প্রয়োজন তার। মাথা নামিয়ে নিলো তানিয়া। লোকটা এখানে কি করছে? কিভাবে জানলো তানিয়া এখানে? কেন এসেছে? আর ওই চোখের রাগ, সেটাই বা কেন? কি আবার ভুল করলো তানিয়া? অভ্র এগিয়ে আসে। ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায় তানিয়ার। ভয়ে আরও নত হয় তানিয়া। শ্বাসকষ্ট বাড়ে। অভ্র একচোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ফের বলে ওঠে একই কন্ঠে,
‘কি হলো? আন্সার মি মিস তানিয়া! কেন ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছেন? কাকে দেখাতে?’
শেষের কথাটুকু ধমকে বলে উঠলো অভ্র। অধিকারবোধ নিয়ে বলা শেষ প্রশ্নে কেঁপে ওঠে তানিয়া। শক্ত করে ওড়না খিঁচে নেয়। লিপস্টিক! দিয়েছে তো কি হয়েছে? সবাই তো দিয়েছে। এতে এতো রাগার কি আছে? আর, রাগবেই বা কেন অভ্র? তানিয়া ঠোঁটে লিপস্টিক দিলো কি না দিলো, তাতে অভ্র’র কি? তানিয়া উত্তরে টুঁ-শব্দটিও করতে পারলো না। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না তার। তানিয়ার নিশ্চুপতা রাগের কারন হয়ে দাঁড়ালো। চেয়াল শক্ত করে, ক্রোধে তানিয়ার দু’বাহু ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো অভ্র,
‘আপনি কি না শোনার ভান ধরছেন?’
হৃদপিণ্ডে’র লাফিয়ে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা দমে গেলো মুহুর্তে। অভ্র’র এতোটা কাছে এসে, তিরতির করে কাঁপতে লাগলো দু’চোখের পাতা। তানিয়া মাথা তুলে তাকায়। রাগে অগ্নিশর্মা অভ্র’র শক্ত চোখমুখ শ্বাস থামিয়ে দেয় তানিয়ার। ক্ষনিক সময় এভাবেই কাটলো। আকস্মিক যেভাবে তানিয়াকে ধরেছিলো অভ্র, ঠিক সেভাবেই ছেড়ে দিলো আবারো। অন্যদিকে ফিরে শ্বাস টানলো কয়েকবার। যেটার ভয় পেয়েছিলো সে, ঠিক তাই ঘটলো। নিজেকে দমিয়ে, কিছুটা নরম গলায় বললো অভ্র,
‘আ্ আ’ম সরি। লিপস্টিক’টা মুছে ফেলুন। নয়তো সর্বনাশ খুব নিকটে আপনার।’
অভ্র ছাড়তেই, তানিয়া জোরে জোরে শ্বাস টানে। শেষ কথাটার মানে বুঝতে না পেরে, চাতক চাহনি নিয়ে তাকায় অভ্র’র পাণে। ‘লিপস্টিক’টা মুছে ফেলুন’ কথাটা প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বাজছে তানিয়ার। আশ্চর্য! মুছে কেন ফেলবে? আরু তো বললো, অনেক সুন্দর লাগছে। তাহলে? সুন্দর কি লাগছে না? না-কি ছড়িয়ে গেলো আবারো? ছড়িয়ে যাওয়ার তো কথা নয়, আর না অসুন্দর লাগছে। অস্বস্তিবোধ ঝেঁড়ে বলে ওঠে তানিয়া,
‘মুছবো না লিপস্টিক! খারাপ তো লাগছে না। আর কি যেন বললেন? সর্বনাশ না-কি? হোক সেটা! আপনার তাতে কি?’
অভ্র একহাত কপালে স্লাইড করে রাগটুকু সংবরণের যথার্থ চেষ্টা চালাতে লাগলো। কিন্তু চাইলেই কি কমে? না, কমছে না! বরং তানিয়ার বিপরীতমুখী কথাবার্তায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মেয়েটাকে কিভাবে বোঝাবে অভ্র, ওই ঠোঁটের প্রতি কতটা আকর্শন অনুভব করে সে। দখল করে নিতে মন চায়। সেদিন বারে যখন তানিয়া লিপস্টিক দিয়ে গিয়েছিলো, কতটা কষ্টেই না নিজেকে দমিয়েছে অভ্র! এই দোটানা ঠিক কতটা কষ্টকর, মেয়েটা বোঝে না? না-কি না বোঝার ভান ধরে? এই সর্বনাশ হলে পারবে তো নিজেকে সামলাতে মেয়েটা? পারবে অভ্র’কে মানতে? পারবে না! কষ্ট পাবে, অভ্র’কে ঘৃনা করবে নিশ্চয়ই! তার থেকে উত্তম নয় কি সব সমস্যার মূলে যে, তাকে সরিয়ে দেওয়া? নির্বোধ মেয়েটা বুঝলে তো!
তানিয়া একচোখে পরোখ করে নিলো কিয়ৎক্ষন। অভ্র’র কি মাথা ব্যাথা করছে? ওমন করছে কেন? তানিয়ার সুবিধার মনে হচ্ছে না পরিবেশ। চটপট কেটে পড়াই উত্তম। তানিয়া যাওয়া জন্য উদ্যত হতেই অভ্র সামনে এসে দাঁড়ায়। তানিয়া ভরকায়। পিছিয়ে যায় খানিকটা। অভ্র তো অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো, বুঝলো কি করে তানিয়া চলে যাচ্ছে? অভ্র’র দৃষ্টি অন্যদিকে। তাকালেই যেন সর্বনাশটা করে ফেলবে, এমন ভাব। ইতস্তত করতে করতে বললো অভ্র,
‘লিপস্টিক’টা এখান থেকে গিয়েই মুছে ফেলবেন। নয়তো ফল কিন্তু খারাপ হবে মিস তানিয়া।’
কপালে ভাজ পড়ে তানিয়ার। একই কথা বারবার কেন বলছে লোকটা? তেজি গলায় বললো,
‘এটা আপনার অফিস নয় যে, আপনার এসব অসহ্যকর আবদার শুনতে হবে আমায়। আমার ঠোঁট, আমার লিপস্টিক! আমি যা খুশি করবো। গালে দেবো, কপালে দেব, নাকে দেব। পারলে ভ্রু’তেও দেব। আপনার কি? সব জায়গায় বস গিরি ফলাতে আসবেন না।’
তানিয়ার কথা শেষ গরম চোখে তাকায়। অভ্র কিছুটা ঝুঁকে যায় তানিয়া মুখের কাছে। তানিয়া সাথেসাথে পিছিয়ে নেয়। অভ্র তা দেখে বাঁকা হাসে। শিতল গলায় বলে,
‘ওহ্ রিয়েলি?’
তানিয়া শুকনো ডোগ গিললো। কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলো,
‘হ্ হ্যা।’
অভ্র সরে আসে। ঘার বাঁকিয়ে তাকায় তানিয়ার দিকে। তানিয়া চমকায়, সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রয়। অভ্র ফিচেল গলায় বলে ওঠে,
‘আপনি কি ভূলে যাচ্ছেন যে, আপনার ছুটির আবেদন এখনো এপ্রুভড্ হয়নি? ছুটি ছাড়া এভাবে দিন কাটাচ্ছেন, আবার বড় বড় কথাও বলছেন? জানেন তো আমি কি করতে পারি?’
থতমত খেয়ে গেলো তানিয়া। এদিক-ওদিক চোরা চোখে চাওয়া-চাওয়ি করে বোকা বোকা হাসলো। যেখানে চোরের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়; কথাটা আবারো প্রমান হলো। ঠিক গুনেগুনে ছুটি না নেওয়ার ব্যাপারটা মনে রেখেছে। এতো কিছু মনে রাখার কি আছে? অভ্র হাসিটুকু গাঢ় করে ফের বললো,
‘নেবো কোন এ্যাকশন? পরে আবার বান্ধবীর বিয়েতে থাকাই না প্রশ্ন হয়ে ওঠে।’
তানিয়া নিজেকে সামলায়। এভাবে নরম থাকা যাবে না। আরুর বিয়েতে থাকতে পারবে না, এতে বড় কথা! এতো বড় হেলা! অভ্র কি সূক্ষ্মভাবে ব্লাকমেল করেছে? নাকি অগোচরে অপমান করছে? রাগ হলো তানিয়ার। ভরাট গলায় বলে উঠলো,
‘নিন এ্যাকশন! কি আর করবেন? বরখাস্ত করে দেবেন তো? দিন! আমিও এটাই চাই।’
ঠোঁটের হাসিটুকু মুহুর্তে মিলিয়ে যায় অভ্র’র। আগের ন্যায় শক্ত হয় চেয়াল। অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তেড়ে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায় তানিয়ার। তানিয়া পিছিয়ে যেতে নিলেই, একহাতে শক্ত করে কাছে টেনে নেয় অভ্র। দাঁতে দাঁত পিশে কিছুটা ঝুঁকে বলে ওঠে,
‘ফের এই কথা মুখে আনলে, জান-জীবন শেষ করে ফেলবো মিস তানিয়া!’
বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তানিয়া। ট্রেনের ন্যায় ছুটছে তানিয়ার হৃদপিণ্ড। অস্বাভাবিক বুক কাঁপছে। কোন মতে বললো তানিয়া,
‘আমি চাকরি ছাড়লে আপনার কি?’
অভ্র মৃদু হাসে। সে হাসিতে প্রকাশ পায় তাচ্ছিল্য। শক্ত গলায় বলে ওঠে,’সেটা খুব শীগ্রই জানতে পারবেন।’
বলেই ছেড়ে দিলো অভ্র। তানিয়া এখনো বিস্ময়ের মায়াজালে। শীগ্রই কি জানানোর কথা বলছে অভ্র? আজ বড্ড রহস্য লাগছে অভ্র’র আচরণ, তাকানোর ভঙ্গি। এভাবে তো তাকায় না লোকটা! আজ কি হলো অভ্র’র? এতো অধিকার কেন অভ্র’র প্রতিটা কথায়? তানিয়া দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অভ্র কিছুটা শান্ত গলায় বলে,
‘নিচে গিয়েই মুছে ফেলবেন লিপস্টিক। ফের যদি কোন দিন ওটা ঠোঁটে দেখি, বুঝে নেবেন সেদিন আপনার সর্বনাশ লেখা আছে ভাগ্যে। সেই সর্বনাশ, কলঙ্কের জন্য আমায় দায়ী করতে পারবেন না।’
স্তব্ধ হয়ে গেলো তানিয়া। দৃষ্টি তুলে তাকানোর সাহস হলো না আর। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। তানিয়া হাঁটা ধরে চলে যাওয়ার জন্য। কলঙ্ক, সর্বনাশের কথা কেন বললো অভ্র? কি এর মানে? থ্রেট দিলো কি? হ্যা! থ্রেট-ই তো! হুট করে দরজার সামনে গিয়ে থামলো তানিয়া। পিছু ফিরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
‘মুছবো না লিপস্টিক। যা করার করে নিন।’
কথাটুকু কোনমতে শেষ করেই ছুঁট দিলো তানিয়া। অভ্র’র রিয়েকশন কেমন এখন? নিশ্চয়ই অনেক রেগে গেছে? যাক! তাতে তানিয়ার কি? তখন এমন জোরে হাতটা ধরেছিলো, এখনো টনটন করছে ব্যাথায়। অপমান করছে, ব্লাকমেল করছে আবার থ্রেট দিয়ে তানিয়ার সাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে? এই সাজ তো অভ্র’র জন্যই করেছিলো তানিয়া। ভালোয় ভালোয় বললে তানিয়া ভূলেও এই লিপস্টিক রাখতো না। কিন্তু এখন এটা লড়াইয়ের পর্যায়ে চলে গেছে। এতো সহজে মুছে ফেলবে? কোনদিন না! তানিয়া বিরবির করতে করতে নিচে নেমে এলো। বিয়ের মূল স্থানে গিয়ে দাঁড়ালো তানিয়া। আরুকে নিয়ে আসা হয়েছে মঞ্চে। একমুখ ঘোমটা দিয়ে পাশে বসে আছে রুদ্র’র। আর পাঁচটা বরের মতো রুদ্র’র মুখে রুমাল নেই। না আছে হাসির ছাপ। দুই ভাই এমন গোমড়ামুখো কেন? তানিয়ার বুঝে আসে না!
কাজি খুৎবা পড়াতে শুরু করেছে। আশেপাশের এতো মানুষের সামনে বউ রুপে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে আরুর। এতোক্ষণ লাগে কেন? বিয়ে মানেই আরুর যদ্দূর ধারনা সে আর রুদ্র শুধু ‘কবুল’ বলে দেবে, ব্যাস। শেষ বিয়ে। কিন্তু এখন দেখছে ব্যাপারটা অন্য। আরুর ভীষন করে মন চাইছে, পাশে বসে থাকা রুদ্র’র দিকে তাকাতে। কেমন লাগছে লোকটাকে? নিশ্চয়ই বর বর লাগছে। ওমা, আরুকে যেম বউ বউ লাগছে; রুদ্র’কেও তো বর বর লাগবে, তাইনা? আরু নিজের বোকা বোকা ভাবনাগুলোর উপর বিরক্ত হলো। আরুর যেন তর সইছে না রুদ্র’কে দেখতে। সমস্যা হচ্ছে ঘোমটা’টায়। এমন ঘোমটা কি এ জুগের মেয়ে বউরা দেয়? আশ্চর্য! আরু তো বলেছিলো রুদ্র’কে, ম্যাচিং করে শেরোয়ানি পড়তে। লোকটা কি পড়েছে? আচ্ছা, তার পাশে বসা ছেলেটা রুদ্র তো? ধূত্তেরি, এগুলো কি ভাবছে সে? অবশ্যই রুদ্র। তার সুদর্শন হ্যান্ডসাম জামাই। আরুর বিরক্ত ঠেকছে। স্লো-মতে নিজের ঘোমটা নামিয়ে দিলো আরু। কোনরুপ কথাবার্তা ছাড়াই মাথা উঁচিয়ে রুদ্র’র দিকে তাকালো।
হঠাৎ কনের এমনধারা আচরণে মজলিসের সবাই হো হো করে হেঁসে উঠলো। আরুর তবুও এতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সোনিয়া পাশ থেকে ছুটে এসে আরুর পাশে বসে। মেয়েটা মান-মর্যাদা কিচ্ছু রাখলো না আর! সোনিয়া তড়িঘড়ি করে আরুর মাথায় ঘোমটা দিয়ে বলে উঠলো,
‘বরের মুখ কি চুরি হয়ে যাচ্ছে? আরেকটু সবুর কর, শুধু মুখ নয়; সব দেখতে পারবি।’
সোনিয়া কথাটা চাপা গলায় বললেও পাশে বসা রুদ্র শুনতে পেলো বুঝি। খুক খুক করে কেশে উঠলো রুদ্র। কি অসভ্য মেয়ে! মেয়েরা এমন ডেঞ্জারাস হয়, আজ প্রথম দেখলো রুদ্র। এতোটুকু লজ্জা নেই নাকি? রুদ্র রুমালটা না এনে আক্ষেপ করলো খুব। লজ্জায় মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার। সোনিয়া বুঝতে পেরে জিভ কাটলো। দ্রুত সরে গেলো ওখান থেকে।
ঘোমটার আড়ালে থাকা আরু লজ্জায় সাত রঙে রঙিন হতে লাগলো সোনিয়ার কথায়।
অভ্র ফিটফাট হয়ে এসে দাঁড়ালো। ঠিক তানিয়ার সামনাসামনি। তানিয়া একবার তাকালো, এরপর আবারো অন্যদিকে মনোযোগ দিলো। অভ্র তানিয়ার ঠোঁটে এখনো লিপস্টিক দেখে হাসলো। সময় আসুক, বোঝাবে তখন!
কাজি রুদ্র’কে কবুল বলতে বললেন। রুদ্র ধীর গতিতে তিনবার কবুল বললো। আরু ঠোঁট বাঁকায়। এতো ধীরে বলার কি আছে? আরুর পালা আসুক, আরু দেখিয়ে দেবে! কাজি আরুকে বলতে বললেন এবারে। আরু পটপট করে বলে উঠলো,
‘কবুল, কবুল, কবুল।’
সবাই হেঁসে ওঠে। স্ব-শব্দে শুকরিয়া আদায় করে,’আলহামদুলিল্লাহ।’
এবার পালা বিদায়ের। বিদায়, তিন অক্ষরের এই শব্দটি মানতে নাজেহাল অবস্থা মহুয়া বেগমের। একমাত্র মেয়ে আজ চলে যাবে, ভাবলেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে মহুয়ার। কেঁদে একাকার করছেন তিনি। আহমেদ সাহেব পাশে দাঁড়িয়ে বরংবার নিষেধ করছেন না কাঁদতে। মেয়ে মানুষের এই এক দোষ! কান্না শুরু করলে থামানো মুশকিল। আরু এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকলেও, মায়ের কান্নায় ডুকরে কেঁদে উঠলো। ছুটে এসে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো মা’কে। আহমেদ পাশ থেকে স্ব-যত্নে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। শান্তনা দিয়ে বললেন,
‘কাঁদছিস কেন মা? কোথায় কতদূর? মন খারাপ হলেই চলে আসবি।’
আরু মাথা তোলে। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। আহমেদ সাহেব মেয়ের কপালে চুমু দিলেন। ইলিমা, ইরহাম এগিয়ে আসে। সহাস্যে বলে উঠলেন ইরহাম,
‘আমরা কথা দিচ্ছি, আপনার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখবো।’
আহমেদ মাথা নাড়েন। মহুয়া নিজেকে সামলে নেন। মেয়েকে কিছু উপদেশ দেন ভাঙা গলায়। আরু হু হু করে কেঁদে ওঠে। সোনিয়া আরুর পাশে এসে দাঁড়ায়। আরু সোনিয়াকে দেখে চোখের পানি মুছলো। জিজ্ঞেস করলো,’তানিয়া?’
‘জানি না। দেখিনি তো। দাঁড়া খুঁজে নিয়ে আসি।’
সোনিয়া বাড়িমুখো হাঁটতে লাগলো। এইসময়ে কই গেলো মেয়েটা? সোনিয়া বাড়ির ভেতরে ডুকতে গিয়ে, খট করে কিছু পড়ার শব্দ পেলো। অগ্রাহ্য করে ভেতরে যেই পা রাখবে, আবারো শব্দটি কর্নকুহরে হানা দিলো সোনিয়ার। কান খাঁড়া করে শব্দের উৎস শুনলো সোনিয়া। দক্ষিণ থেকে শব্দটা আসছে। কিন্তু ওই দিকে তো কেউ নেই। বাড়ির পেছোনে কেউ যাবেই বা কেন? সোনিয়া একপা একপা করে ওদিকে এগোতে থাকে। সম্পূর্ণ আধারে ঢাকা এপাশটা। এমন ঝমঝমে পরিবেশ দেখে দক্ষিণে ফেরার আগেই ছুট দিলো সোনিয়া।
পায়ের শব্দ বিপরীত দিকে যাচ্ছে, বুকে হাত দিয়ে দম ফেললো তানিয়া। বুকের ভেতর দামামা বাজছিলো এতক্ষণ। যদি চলে আসতো? কি হতো তখন? তাদের এভাবে দেখে ফেললে, কি ভাবতো সবাই? তানিয়া বিরক্ত হয়ে তাকালো অভ্র’র পাণে। অভ্র সুঠাম হাত দিয়ে তানিয়াকে আঁটকে রেখেছে। পিঠ দেয়ালে ঠেকানো তানিয়ার। অস্পষ্ট আলোয় অভ্র’র মুখ দেখা যাচ্ছে না। এভাবে বাড়ির পেছোনে কেন টেনে আনলো অভ্র? তানিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২৯+৩০
‘ছাড়ুন। হয়তো আমাদের খুঁজছে। কেন এখানে এনেছেন আমায়?’
‘শাস্তি দিতে।’
শীতল কন্ঠ অভ্র’র। তানিয়া ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। বলে,
‘শাস্তি! কিসের শাস্তি? কি করেছি আমি?’
‘লিপস্টিক দিয়েছেন, আমার নিষেধ করা সত্ত্বেও।’
‘তাই বলে..’
কথা শেষ হওয়ার আগেই তানিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট বসালো অভ্র। আঁতকে ওঠে তানিয়া। হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। হাপড়ের মতো ওঠানামা করতে থাকে বক্ষস্থল। এভাবেই যায় একমিট..দুইমিনিট..
