নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৩৫+৩৬
আহমেদ হৃদ
কেটে গেছে আরও একটা দিন। সময়, তিন অক্ষরের এই শব্দটি কারো জন্য থেমে থাকে না। সে বহমান। নিজ গতিতে নিজের মতো সে ছুটছে। আদিকাল থেকে পশ্চিম দিগন্তে সূর্য উঠতো, আজও উঠেছে। কিন্তু সব ভোরের আলো কি মিষ্টি, স্নিগ্ধ হয়? নতুন ভোরের আলোর দেখা মিলতেই পাখিরা যেমন নেচে-কুঁদে ওঠে, ডাক ছাড়তে ছাড়তে বেড়িয়ে যায় খাবারের সন্ধ্যানে, মানুষরা কি আসলেই তা পারে? নতুন উদ্যম পায় এই আলোয়? পায়না! ব্যাতিক্রম কিছু মানুষ এবং সকাল ছাড়া তা সম্ভবপর নয়। সেই ব্যাতিক্রম মানুষগুলোও একদিন নাম লেখায় দুঃখী মানুষদের খাতায়। রোজকার নিয়ম ভঙ্গ করে তারাও এলোমেলো হয়ে যায়। জিবন; যা তাদের কাছে আনন্দের, তারাও ক্ষণে ক্ষণে ‘জীবন্মৃত’ কাকে বলে তা বুঝতে শেখে। সেই নিয়মের গন্ডি বুঝি অভ্র ও পেরোলো আজ। প্রতিটা সেকেন্ড নিয়ম করে চলা ছেলেটা অনিদ্রায় কাটিয়ে দিলো সারাটা রাত।
ভাবা যায়? ভোরের আলো এসে জানালার পর্দায় পড়েছে। আধশোয়া হয়ে সেদিকেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভ্র। নিস্পৃহ তার চাহনি। শুকনো চোখমুখ। একরাতেই চোখদু’টো মইয়ে এসেছে। তার কারন? ভালোবাসা! বুক্ষস্থলে জায়গা দেওয়া মানুষটার অতি সূক্ষ্ম অবহেলা। হ্যা, অবহেলা নয় তো কি? হাজার খানেক কল, মেসেজ উপেক্ষা তো অবহেলার মাধ্যমেই করা যায়। পরশু সে-ই যে কলটা কাটলো তানিয়া, আর সে একটা কল কিংবা মেসেজ দেয়নি। ফোন দিলেও ধরছে না। কি হলো হঠাৎ? কি করেছে অভ্র; যার শাস্তি এতো প্রখর? এতো বিষাদময়, কষ্টের? অভ্র আকাশ-কুসুম ভেবেও কূল পাচ্ছেনা!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তানিয়া কি তার মাধ্যমে কষ্ট পেয়েছে? তার ভালোবাসার কথায় সে কি আঘাত পেয়েছে? সেদিন রাতে জেবা যখন এসেছিলো, সে নিজেই বলেছে তানিয়া তাকে ভালোবাসে। এমনকি অফিসে জয়েন হওয়ার মূল কারন নাকি অভ্র। তাহলে প্রকাশ করাতে এমন পাল্টে গেলো কেন তানিয়া? সে কি তাকে ভালোবাসেনি? চায়নি? দু’চোখ পুড়ছে অভ্র’র। জ্বলছে কপালের শিরা-উপশিরা। শক্তপোক্ত অভ্র আজ কেমন থিতিয়ে গেছে! অভ্র মাথা এলিয়ে দু’চোখ বুজলো। হাসিমাখা তানিয়ার স্নিগ্ধ, ফরসা মুখখানি ভেসে ওঠে দু’চোখের পাতায়। অভ্র দ্রুত চোখ খোলে। চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। ছেলে বলেই হয়তো, নোনাজলগুলো লুকিয়ে থাকতে চাইছে আড়ালে, আরও অতলে!
বেলা আরও খানিক গড়িয়ে যায়। নিস্তেজ দেহ নিয়ে বিছানা ছাড়ে অভ্র। আজ চারপাশ কেমন বিষাদময়। কোন কিছুতে সূখ নেই। কেন? একটি মানুষের এতো শক্তি; যে সে সূখ কেড়ে নিতে পারে? অভ্র’কে দ্রুত অফিসে যেতে হবে আজও। যদি তানিয়া আসে? এক চিলতে আশার আলো নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো অভ্র। শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে দ্রুত রেডি হয়ে নিলো। মনটা কেমন খচখচ করছে। তানিয়া আসবে তো? মস্তিষ্ক যেন সাদরে গ্রহণ কথাটা। উপহাস করে জানান দিলো,
‘ঠিক ধরেছিস! আজকেও আসবে না তোর তানিয়া! দেখিস—’
চিন্তা নয়, হৃদয়ে যেন বিষাক্ত বান এসে বিধলো অভ্র’র। সেই বানে মুচড়ে ওঠে অভ্র’র বুক। দমে যায় ক্ষিণ আশা। কিন্তু, মন? সে যে ওই একজনতে আবদ্ধ! উপহাস শুনে বহ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠলো সে। তেজস্বী গলায় বললো,
‘ও আসবে! ভালোবাসে আমায়। ওর হৃদয়েও আমার জন্য প্রতিদিন ভালোবাসা ফোটে। আমার জন্য! হ্যা, শুধু আমার জন্য!’
মস্তিষ্ক বিদ্রুপ করে হাসে সেই কথায়। হাসার মতোই কথা নয় কি? যে মেয়ে ভালোবাসি বলতেই হারিয়ে গেলো; সে নাকি ভালোবাসে! তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
‘তাই বুঝি পালিয়ে গেলো তোর ভালোবাসা? ও তোকে কখনোই ভালোবাসে নি অভ্র। তুই একটা মেয়ের কাছে এতো এক্সপেকটেশন রাখিস? তোর পুরুষ ব্যাক্তিত্বে ঘৃণা হচ্ছে না আজ?’
অভ্র চেঁচিয়ে ওঠে। তিব্র প্রতিবাদ করে জানায়,
‘তুমি মিথ্যে বলছো!’
‘নিজেকে আর কত বুঝ দিবি? ভালোবাসলে তোর কলগুলো, মেসেজগুলো ইগনোর করতে পারতো?’
অভ্র মুহুর্তে থেমে যায়। ভেঙে আসে সারা শরীর। সত্যিই তো! তবে কি তানিয়া তাকে ভালোবাসে না? দু’দিনের মোহ ছিলো সব? যা এখন কেটে গেছে? কপালে তিব্র জ্বলন শুরু হয় অভ্র’র। বিক্ষুব্ধতা ধীরে ধীরে অসহনীয় হয়ে উঠছে। সারা শরীরে গ্রাস করছে এই যন্ত্রণা। কিন্তু অভ্র যে এর প্রতিষেধক দেখে না। চোখ বুজে আসে। রক্তক্ষরণে মূর্ছা যাওয়ার জোগাড় বুক পিঞ্জর! অভ্র রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। ড্রইংরুমের আনাচে-কানাচে কোথাও ইলিমাকে দেখা গেলো না আজ। অভ্র সস্তির শ্বাস ফেলে। বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে অফিসে যায়। ঢোকার আগে বুক ভরে শ্বাস টানে। এখনো অফিস শুরু হতে ঢের সময় বাকি। কিছু স্টাফ, করিম সাহেব ছাড়া অফিসে এখন কেউ নেই তা জানে অভ্র। তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে, তানিয়া এসেছে। ছুটে এসে বুকে ঝাপিয়ে পড়তে উদগ্রীব তার মন। আনচানে ঠিকমতো বসেওনি!
ফাঁকা অফিসে প্রবেশ করলো অভ্র। না, কেউ নেই। আসেনি সে। দূরের একটি ডেস্কে বসে আছে অথৈ। আজ এতো সকালে? অভ্র চোখ সরিয়ে নিলো। সারি সারি দিয়ে বসানো ডেস্ক থেকে একটি চেয়ার টেনে বসলো অভ্র। অইতো কিছু দূরে তানিয়ার ডেস্ক। কোথায় উনি? নেই! এখন আর ওই ডেস্কে কেউ বসে না। তুর্য’র সাথে হেসে হেসে কেউ কথা বলে না। অভ্র চোখ বুজলো। বিরবির করে প্রেয়সীকে ডাকলো,
‘কোথায় আপনি তানিয়া? ফিরে আসুন৷ যা ইচ্ছে করবেন। যার সাথে ইচ্ছে গল্প করবেন। আমি আর কিচ্ছু বলবো না আপনাকে। একবার ফিরে আসুন শুধু.. একবার..’
‘স্যার?’
করিম সাহেবের স্বর শুনতেই ঝটপট চোখ খুললো অভ্র। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। অভ্র উঠে দাঁড়ায়। ঝাপসা চোখ আড়াল করতে দ্রুতপদে নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। করিম সাহেব পিছু পিছু এলেন। অভ্র নিজের চেয়ারে বসে ল্যাপটপ অন করলো। করিম সাহেব সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। নিষ্প্রভ কন্ঠে বললেন,
‘আরিফ সাহরানের সেক্রেটারি অরুণ শিকদার এসেছিলেন। বললেন, ম্যাডাম তানিয়া আর আসবেন না।’
স্তব্ধ হয়ে গেলো অভ্র। সারা শরীর আসাঢ় হয়ে এলো মুহুর্তে। তানিয়া আর আসবে না? এতো ঘৃণা, যে চাকরি ছেড়ে দিলো? অভ্র অস্রুবিদ্ধ চোখদুটি সন্তোর্পণে টেবিলের ওপর নিবদ্ধ করলো। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। প্রতি নিঃশ্বাসে যেন বিষ টানছে। শুধু ছোট করে বললো,
‘ওহ্।’
‘স্যার, আপনি বললে আমরা ওনার ব্যাপারে লিগাল এ্যাকশন নিতে পারি।’
‘দরকার নেই!’
বলে উঠে দাঁড়ায় অভ্র। দ্রুত বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। করিম সাহেব বুঝেও কিছু বলার সাহস পেলেন না। তিনি জানেন, এখন অভ্র ক্লাবে যাবে। শেষবার গিয়েছিলো ভাইয়ের সাথে ভুল বোঝাবুঝির পর। বিগত বারো বছর এই চাকরিতে করিম। একসময় ইরহামের একহাত ছিলেন। ছেলেদের হাতে ব্যাবসা তুলে দেওয়ার পর, করিম সাহেবের মন উঠে গিয়েছিলো চাকরি থেকে। বিদেশ ফেরত অভ্র’র আচরণ তাকে আঘাত দিতো। কতবার ভেবেছেন এই চাকরি ছাড়বেন! কিন্তু হয়ে ওঠেনি। এতো ভালো বেতন, এই যুগে কোথায় পাবেন? বরাবরই অভ্র’র রাগ নিয়ে অসন্তোষ ছিলেন করিম। তিনি ভাবতেন, এই ছেলের দেহে বুঝি প্রাণ নেই! যে মেয়ে কপালে আছে, তার বুঝি জিবনটাই নষ্ট।
কারন ভালোবাসা আসলে কি অভ্র আদতেও বোঝে না! লাস্ট কবে নিজের ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে অভ্র, মনে নেই করিম সাহেবের। করনটা অতি তুচ্ছ! এইযে নিয়ন্ত্রণহীন রাগ, শুধু এতোটুকুই কমাতে বলেছিলো রুদ্র। অতঃপর ভুল বোঝাবুঝি! বিদেশ থেকে এসে অভ্র ছোট বড় কাউকে মান্য করতো না। নিজের কাজটাই যেন তার ধ্যান-জ্ঞান। সেখানে কোন কম্প্রোমাইজ সে করবে না। প্রথম দিন অফিসে এসেই পুরো অফিসের চিত্র ঠিক কিভাবে পাল্টে দিয়েছিলো, তা ভাবলে এখনো শিউরে ওঠেন তিনি। কিন্তু, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছিলেন অভ্র’র পরিবর্তন। কাল যখন ফুল, চকলেট ডাস্টবিনে ফেলতে দেখলেন, তখনি তিনি বুঝেছেন অভ্র দুর্বল কোন নারীর প্রতি। তবে সেই নারী যে তানিয়া, এটাই তিনি বুঝতে সময় নিয়ে ফেলেছেন। শুধু অনুভব করলেন, এই খিটখিটে, বদমেজাজি ছেলেটার জন্য তার নিজেরও কষ্ট হচ্ছে!
ছুটে রুমে ডুকতে যাচ্ছিলো আরু। কিন্তু দরজার সামনে হুট করে ব্রেক কষলো। সদ্য শাওয়ার নিয়ে বেরোনো রুদ্র’কে দেখে দরজার সামনে একপ্রকার থমকে গেল সে। শুধু একটা ট্রাউজার, তাও নাভীর নিচে থেকে পরে আয়নার সামনে নিজের চুল সেট করতে ব্যাস্ত রুদ্র। রুদ্র’র ফরসা পেশীবহুল ইস্পাত-দৃঢ়ের ন্যায় উদাম পিঠে এখনো উঁকি দিচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা পানি। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে আরুর মসৃন পাতলা গাল। দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় আরু। হাপড়ের ন্যায় ওঠা-নামা করছে আরুর বুক। হৃদপিন্ডের ছোটার গতি জোরালো ভাবে কানে বাজছে। ইশশ্! কি সুন্দর এই লোক। এতো সুন্দর হতে কে বলেছে লোকটাকে, হা? এইযে আরু এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলতে এসেছিলো, এখন যে সেটার আগামাথা কিছুই মনে করতে পারছে না; তার দায় কার? আরু ফাঁকা ডোগ গিলে। আরেকবার তাকাবে? তাকালে কি খুব বেশি লজ্জা পাবে? আরু কিঞ্চিৎ মাথা তোলে। সম্পূর্ণ না দেখেই মাথা নামিয়ে নেয়।
‘এভাবে দূর থেকে দেখার কি আছে? কাছে এসো, খুব কাছ থেকে দেখো। আমি মাইন্ড করবো না।’
কান গরম হয়ে ওঠে আরুর। দৃষ্টি আরও নামিয়ে নেয় সাথেসাথে। লোকটা ধরে ফেললো কি করে? আরু তো কোন শব্দ করেনি। তাহলে কিভাবে বুঝলো? কারো হাঁটার শব্দ শুনতে পেলো আরু। নিশ্চিত লোকটা এগিয়ে আসছে? আরু তড়িঘড়ি করে রুমে ঢোকে। দ্রুতপায়ে বিছানায় বসে এব্রোথেব্রোভাবে জবাব দেয়,
‘আ্ আমার বয়েই গেছে আপনাকে দেখতে। আমিতো..আমিতো দেখছিলাম যে রুমটা ময়লা হয়েছে কি-না!’
‘ওহ্ রিয়েলি?’
আরু শুকনো ডোগ গিলে মাথা নাড়ে। রুদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসে। কিছুটা এগিয়ে এসে বলে,
‘আমি যে আয়নায় স্পষ্ট দেখলাম তুমি আমাকেই দেখছিলে!’
লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়ে মাথা নামিয়ে নেয় আরু। কি উত্তর দেবে, ভেবে পেলো না। লোকটার মাথাভর্তি এতো বুদ্ধি! রুদ্র একপা একপা করে এগিয়ে আসে। আরু বুঝতে পেরে চকিতে মাথা তুলে তাকায়। হৃদপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে আবারো। এভাবে এগিয়ে কেন আসছে রুদ্র? কাছে এসে হাটু মুড়িয়ে বসলো রুদ্র। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো আরুর দিকে। আরু স্ব-হস্তে বিছানার চাঁদর খামচে নেয়। ওই চোখে যেন স্পস্টভাবে ‘মরণ’ লেখা! আরেকটু কাছে আসে রুদ্র। ফিচেল গলায় বলে,
‘বিয়ের তিনদিন আমাদের। এখনো এতো লজ্জা?’
আড়ষ্টতা জাপটে ধরলো এবারে। সে-ই তো! বিয়ের তিনদিন পরেও করো এতো লজ্জা থাকে, থাকার কথা? কিন্তু আরু লজ্জা পাচ্ছে। অর্ধনগ্ন বলিষ্ঠ রুদ্র’র সামনে থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। বুকের ভেতর অসহনীয় কম্পন হচ্ছে আরুর।
‘এখন যদি তোমার ওই কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দেই, কি করবে তখন? মরে-টরে যাবে না তো?’
কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে আরুর। লজ্জায় মইয়ে আসে সারা শরীর। আরু লজ্জা লুকাতে উঠে দাঁড়ায়। ছুট দিতে নিলেই রুদ্র পিছ থেকে একটানে বুকে মিশিয়ে নেয় আরুকে। উষ্ণ বুকে পিঠ ঠেকতেই কেঁপে ওঠে আরু। শরীর ভার ছেড়ে দেয়। রুদ্র শক্ত করে জড়িয়ে নেয় বুকের সাথে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় আরু। রুদ্র আরুর খোলা চুলে মুখ গুঁজে। বুকভরে শ্বাস টানে। কি সুন্দর এক সুভাস! রুদ্র’কে এই ঘ্রাণ মাতাল করে তোলে। অন্যজগতে নিয়ে যায়। যদি পারতো, সারাক্ষণ এই চুলে মুখ গুঁজে থাকতো রুদ্র।
‘আ্ আপনি না অফিসে যাবেন? দ্ দেরি হচ্ছে..’
‘দুপুর দুইটায় কে অফিসে যায়?’
‘ছাড়ুন, কেউ চলে আসবে।’
রুদ্র আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়। গলা শুকিয়ে আসে আরুর। গুটিয়ে যায় কিছুটা। রুদ্র ধীরে ধীরে ঘারের দিকে এগোয়। খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ কাঁধে লাগতেই শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে আরুর। ঘারে গাঢ় চুম্বন করে রুদ্র। ঠোঁটের বিচরণ চালায় আরুর গলা জুড়ে। নেশালো কন্ঠে অস্পষ্ট সুরে বলে,
‘কাউকে পরোয়া করেনা রুদ্র।’
‘ছ্ ছাড়ুন।’
আবারো আটকানো কন্ঠে বললো আরু। রুদ্র একটানে নিজের দিকে ঘোরায় আরুকে। রুদ্র’র উষ্ণ ছোঁয়ায় প্রতি অঙ্গে শিহরণ তখন। আরু চোখ খোলে। রুদ্র নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আরু ডোগ গিললো। কিছু বলার আগেই ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিলো রুদ্র। আপোশে চোখদ্বয় মুদে নেয় আরু। রুদ্র দু’হাত আরুর কোমরে রাখে। হেঁচকা টানে কিছুটা উঁচু করে আরও মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে। খানিক বাদেই ছেড়ে দেয় ঠোঁটজোড়া। আরু তখনো ঘোরে। চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। রুদ্র কপালে কপাল ঠেকিয়ে শ্বাস ফেলে। বুজে আসা কন্ঠে বলে,
‘ভালোবাসি।’
আরু সময় নিয়ে চোখ খুললো। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে। অস্পষ্ট কন্ঠে সে-ও বললো,
‘আমিও!’
রুদ্র ছেড়ে দেয়। রুদ্র ছাড়তেই আরু পিছিয়ে যায় কয়েক কদম। বড়বড় শ্বাস টানে। এতোক্ষণ যেন শ্বাস আঁটকে ছিলো। তাকায় রুদ্র’র দিকে। এখনো রুদ্র’র দৃষ্টি আরুর দিকে। বিরবির করে বলে আরু,
‘নির্লজ্জ!’
রুদ্র বুঝি বুঝতে পেলো কথাটা। বাঁকা হেঁসে বললো,
‘বউয়ের কাছে সবাই নির্লজ্জ।’
আরু অন্যদিকে ফেরে। কি কথার ছিড়ি! আরু আলমারির দিকে এগোয়। আলমারি খুলতেই চোখে পড়ে সেই চকলেট কালারের শার্ট’টা। মনে পরে সেই রাতের কথা। যেদিন লুকিয়ে তাদের বাড়িতে এসেছিলো রুদ্র। সেদিন এই শার্টটাই পড়েছিলো। ঠিক যেন আস্ত চকলেট মনে হয়েছিলো রুদ্র’কে আরুর। আরু আবারো লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। শার্ট’টা বের করে এগিয়ে গিয়ে রুদ্র’র হাতে দেয়। রুদ্র শার্ট হাতে নিলো। ঠোঁট টেনে হেঁসে গায়ে জড়িয়ে নিলো রুদ্র। ঠিক তখনি ইলিমার হাঁক-ডাক শোনা গেলো। মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো রুদ্র’র। কুঁচকে এলো কপালের চামড়া। না, হাঁক নয়; তিনি কাঁদছেন। রুদ্র একপলক আরুর দিকে তাকালো। আরুও হতভম্ব চোখে তাকেই দেখছে। রুদ্র ছুটে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। তার রুমের ঠিক বিপরীত পার্শে জেবা, ইরফান আর ইলিমা দাঁড়িয়ে। রুদ্র দ্রুত সেখানে গেলো। অভ্র’র রুমের দরজা বন্ধ। সেখানেই অনবরত ডেকে চলেছেন ইরফান। ইলিমা পাশেই কাঁদছে। রুদ্র’কে দেখে কান্নার গতি বাড়লো ইলিমার। তিনি ছুটে এগিয়ে এলেন কাঁদতে কাঁদতে। জড়ানো গলায় বললেন,
‘অভ্র..অভ্র..’
‘অভ্র? কি হয়েছে অভ্র’র? তুমি কাঁদছো কেন?’
ইলিমা বাধ ভাঙা নদীর মতো কেঁদে উঠলেন। গলা যেন ধরে আসছে তার। এতো ভালো ছেলের উপর কার নজর পড়লো কে জানে! আগে তো কখনো এমন করেনি। আজ তবে কি হলো অভ্র’র? রুদ্র উত্তর না পেয়ে ইলিমাকে পেছোনে ফেলে এগিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো ইরহামকে,
‘কি হয়েছে অভ্র’র? আম্মু কাঁদছে কেন এভাবে?’
অসহায় চোখে তাকালেন ইরহাম। সেই দৃষ্টিতে স্পষ্ট অনুতপ্তের ছাপ। এসবের জন্য যেন তার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। বরাবরই তার দুই ছেলে বেশ বিচক্ষণ। আজ তবে কি হলো অভ্র’র?
রুদ্র এবার বিরক্ত হলো। বিরক্ত গলায় বলে উঠলো,
‘বলছো না কেন? কি হয়েছে?’
‘অভ্র সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলো। এসেছে খানিক আগে। দরজা খুলছে না। কোন সারা শব্দ নেই।’
ছোটখাটো বাজ পড়লো রুদ্র’র মাথায়। ইলিমা বিলোপ জপতে জপতে এগিয়ে এলেন। ভাঙা গলায় বললেন,
‘কাল সারাদিন কিচ্ছুটি খায়নি ছেলেটা। রাতেও কিছু খাওয়াতে পারিনি। সকালে না খেয়েই বেড়িয়ে গিয়েছিলো। আর এসেছে থেকে দরজা বন্ধ। কি হয়েছে বলতো ছেলেটার? এমন তো নয় আমাদের অভ্র!’
অন্ধকার ঘর। জানালার ছোট ছোট ফাঁক গলে সূর্যের আলোক রশ্মি পড়েছে রুমে। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে, মেঝেতে এলোমেলো ভঙ্গিতে বসে অভ্র। দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। মাথাটা ঝিমঝিম করছে অভ্র’র। চোখদু’টি বুজে আসছে। অভ্র বুজে নিলো আঁখিদ্বয়। সব কষ্ট থেকে বুঝি নিস্তার মিলেছে কিয়ৎক্ষনের জন্য! বাইরের কোলাহল হালকা কানে আসছে। তা শুনে ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হয় অভ্র’র। চোখ খোলার চেষ্টা করে অভ্র। দু’চোখ ঝাপসা। চারপাশের অন্ধকার যেন ধেয়ে আসছে তারদিকে। মুড়িয়ে নিচ্ছে আরও। অভ্র মাথা ঝাঁকালো। একটু পরিষ্কার হয় সব। আবারো ঝাপসা হয়ে আসে চারপাশ।
অভ্র কাঁপা কাঁপা হাত তুলে পাশের টেবিল থেকে পানি নিতে চায়। একটু হাত উঠিয়েই ক্লান্ত হাত থুবড়ে পড়ে মেঝেতে। শক্তি নেই এতোটুকুও। হাসি গাঢ় হয় অভ্র’র। আবারো ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দেয় টেবিলের দিকে। এবারে সফল হয় অভ্র। কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাস ধরে। গ্লাস থরথর করে কাঁপছে হাতের সাথে পাল্লা দিয়ে। অভ্র গায়ের সমস্ত জোর খাটিয়ে মাথায় ঢালে গ্লাসের পানিটুকু। মেঝেতে পিঁজরাপোলের আসামীর মতো পড়ো আছে সিগারেটের প্যাকেট। সেখান থেকে সাত নাম্বর সিগারেট হাতে নিলো অভ্র। লাইটার দিয়ে তা ধরালো কোনমতে। মুখে গুঁজে দু’হাত মেঝেতে ছড়িয়ে দিলো অভ্র।
পানি মাথায় দেয়ায় নেশা কাটছে। হাতে বল পায় অভ্র। দূরেই আফিমের কতগুলো প্যাকেট পড়ে। অভ্র তাকিয়ে আছে সেদিকে। বুক পিঞ্জর জ্বলে যাচ্ছে। মুখের সিগারেট’টা হাতে নিলো অভ্র। সেই জলন্ত সিগারেট আলতো করে মুঠো কটে নিলো। চোখ বুজলো। তীব্র যন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠে অভ্র’র ভেতর। গলা জ্বলছে। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। দু’চোখের কর্নিশ বেয়ে তপ্ত নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। সিগারেটের আগুনে জ্বলছে, মরিচের মতো পুড়ছে অভ্র’র হাত। অথচ অভ্র নির্বিকার। এতটুকু ব্যাথা অনুভব করছে না সে। বুকের ভেতরের ব্যাথার কাছে যে এই ব্যাথা নিতান্তই তুচ্ছ অভ্র’র কাছে। আর কত কষ্ট বাকি? মৃত্যু কত দূরে এখনো? পাঁজরে পাঁজরে তীব্র যন্ত্রণার স্রোত! সেই হৃদয় পোড়ানো যন্ত্রণা নিয়ে বিরবির করে বলে ওঠে অভ্র,
‘তানিয়া, ফিরে আসুন!’
বিকট একখানা শব্দ কানে আসতেই চোখ মেলে তাকালো অভ্র। দরজা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করছে রুদ্র, ইরহাম, ইলিমা। তবে কি দরজা ভেঙে দিলো? অভ্র আবারো ঠোঁট টেনে হাসে। আবারো চোখ বোজে।
রুদ্র এসেই ঘরের আলো জ্বালায়। মেঝেতে অভ্র’কে এভাবে বসে থাকতে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলেন ইলিমা। রুদ্র হতবিহ্বল! কিছু দূরে পড়ে থাকা আফিমের প্যাকেটগুলোর দিকে চোখে পড়ে রুদ্র’র। অভ্র নেশা করেছে? যে ছেলে নিজের প্রতিটা পদক্ষেপ মেপে মেপে নেয়, সে এই কাজ করতে পারলো? অভ্র থমকানো পায়ে এগিয়ে আসে। ইলিমা ততক্ষণে আহাজারি জুড়েছেন। রুদ্র অভ্র’র সামনে এসে বসলো। চোখ বুজে দেয়ালে মাথা এলিয়ে অভ্র। চোখে জল। ঠোঁটে হাসি। রুদ্র ক্ষিণ গলায় ডাকে,’অভ্র!’
অভ্র তড়িৎ গতিতে চোখ মেলে। লাল টকটকে অভ্র’র চোখ। চোখ খুলেই বিচলিত হয়ে এদিক-ওদিক তাকায় অভ্র। সামনে রুদ্র’কে বসে থাকতে দেখে মুখের হাসি মিলিয়ে যায় তৎক্ষনাৎ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজে। না! নেই সেই কাঙ্খিত বস্তু। আকস্মিক রুদ্র’র বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অভ্র। বাচ্চাদের মতো হু হু করে কেঁদে ওঠে অভ্র। রুদ্র স্তব্ধ হয়ে যায়। আরও জড়িয়ে নেয় অভ্র রুদ্র’কে। ক্রন্দনরত কন্ঠে আওড়ায়,
‘ভাই! ও আমায় ভালোবাসেনি ভাই। আমায় ছেড়ে চলে গেছে। চলে গেছে ভাই আমার থেকে। ভালোবাসেনি আমায় ও..
বিছানায় শোয়ানো হয়েছে অভ্র’কে। মাথার পাশেই বসে আছে রুদ্র। রুদ্র’র একহাত এখনো শক্ত করে ধরে অভ্র। যেন ছাড়লেই হারিয়ে যাবে তার ভাই। ডাক্তার ডাকা হয়েছে। অভ্র’র পার্লস্ চেক করছেন তিনি। ইলিমা চোখের পানি মুছলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালেন ইরহামের দিকে। চোখ দিয়ে যেন প্রশ্ন করলেন,’ছেলেটা সুস্থ হবে তো?’ ইরহাম বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে অভয় দিলেন ইলিমাকে। ইলিমা সস্তি পায় একটু। তবুও চোখের পানি থামেনা। অভ্র’র বিবর্ণ মুখ দেখলেই বুক কেঁপে উঠছে। বেশ তো চলছিলো তাদের জিবন। নিয়ম করে ছেলেটা অফিসে যাচ্ছিলো, ফিরছিলো! কার এমন কুনজর পড়লো হঠাৎ? বড় ছেলের বিয়ে দেওয়ার পর ইলিমা ভেবেছিলেন এবার ছোট ছেলেটার জন্য মেয়ে দেখবেন।
এ বিষয়ে কালও কথা হয়েছিলো ইরহামের সাথে। জেবাও তাড়া দিচ্ছিলো। কিন্তু, হঠাৎ করে কি সব হয়ে গেলো! সব কেমন পাল্টে গেলো একদিনে। যে ছেলে মেয়ের নাম শুনলেই কয়েক হাত দূরে পালায়, সে না-কি কারো প্রেমে পড়েছে! আর তার থেকেও বড় কথা, অভ্র’র মতো ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করেছে মেয়েটা। এটা সত্যিই সম্ভব? কোন দিক দিয়ে কম তাদের অভ্র? ইলিমার মাথা ধরে আসছে এসব ভাবতে ভাবতে। তিনি যদি একবার ওই মেয়েকে সামনে পায়, কষে ক’টা চড় বসিয়ে দেবেন বলে মনস্থির করলেন।
ডাক্তার সবির চেকআপ শেষে উঠে দাঁড়ালেন। এ বাড়ির বহুদিনের পরিচিত তিনি। ইরহামের বন্ধু-ও বলা যায়। ইরহাম এগিয়ে আসে। সাহসা জিজ্ঞেস করে,’কি বুঝলে সবির? বেশি খারাপ কিছু নয় তো?’
সবির উদ্দিন মাথা নাড়লেন। যার অর্থ তেমন গুরুতর কিছু নয়। সজল কন্ঠে বললেন,’চিন্তার কিছু নেই। প্রথমবার নেশা করায় একটু বেশি ইফেক্ট করেছিলো। সমস্যা নেই তেমন। অনেক কম নিয়েছিলো অভ্র। এখন একটু খেয়াল প্রয়োজন শুধু।’
সবির উদ্দিনের কথা শেষ হতেই ইলিমা ক্রোধে ফেটে পড়লেন। আজ যেন তিনি নিজের মধ্যে নেই। সব দোষ ওই মেয়েটার। তিনি সহ্য করতে পারছেন না ছেলের এই দুরবস্থা! একপর্যায়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,’কে ওই মেয়ে, রুদ্র? কোথাকার রানি সে? আমার ছেলের এই অবস্থা করে, কাকে বিয়ে..’
‘আহ্!’
তিব্র বিরক্তি নিয়ে থামিয়ে দিলেন ইরহাম। ইলিমা হুট করে আবারো শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ইরহাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ইলিমা আদতেও এমন ঠুঙ্ক ব্যাক্তিত্বের মানুষ নয়। ছেলের এই অবস্থা দেখে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। সংবরনের চেষ্টা চালিয়েও ব্যার্থ হচ্ছেন। ইরহাম দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। সবিরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘চলো সবির, এগিয়ে দিয়ে আসি।’
সবির মাথা নাড়ে। যাওয়ার আগে বলে যায়,’রুমে এতো চেঁচামেচি অভ্র’র জন্য ভালো নয়।’
বলে বেরিয়ে গেলেন মধ্যবয়স্ক সবির। পিছুপিছু বেরোলেন ইরহাম। ইলিমা এগিয়ে গেলেন রুদ্র’র কাছে। এখানে থাকতে বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে গেলেন তিনিও। রুদ্র অভ্র’র মাথা বুলিয়ে দিতে থাকে। কত দিন বাদে অভ্র’কে সে স্পর্শ করলো, কথা বললো; মনে নেই তার। অথচ যখন কথা বললো, তখন কি অবস্থা ছেলেটার! রুদ্র পরম যত্নে মাথা বুলিয়ে দেয়।
ঘুমের ঘোরে ঠোঁট কাঁপছে অভ্র’র। যেন কিছু বলছে বা ডাকছে কাউকে। রুদ্র এগিয়ে বসলো একটু। তবুও বুঝতে পারলো না সেই কথা। ডাকলো,
‘অভ্র, কিছু বলছিস? কিছু দরকার?’
অভ্র চোখ খোলে। ভাইয়ের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। জড়ানো গলায় আওড়ায়,
‘ভাই আমি ওনাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবো? আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।’
ভাইয়ের কাতর কন্ঠ বুকে এসে লাগে রুদ্র’র। জিজ্ঞেস করে নরম কন্ঠে,
‘কে ওই মেয়ে? তুই একবার বল শুধু, দেখিস আমি তুলে নিয়ে আসব ওকে। তুই শুধু নামটা বল একবার!’
অভ্র সাথেসাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। আলগা হয়ে আসে শক্ত হাতের বাঁধন। জোর করে? একটা মানুষের জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায়? সারাজীবন কেউ তার অপছন্দের মানুষের সাথে কাটিয়ে দেবে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও? চোখের কর্নিশ বেয়ে তপ্ত নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। অভ্র সন্তোর্পণে তা মুছে নেয় সাথেসাথে। তানিয়াকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। যেন কত বছর দেখে না মেয়েটাকে!
‘অভ্র?’
‘জোর করে কারো ভালোবাসা পাওয়া যায়, ভাই?’
প্রতিত্তোরে কি বলবে ভেবে পেলো রুদ্র। কিন্তু তার যে জানতেই হবে, কে সেই মেয়ে! যার জন্য এমন শিশুদের মতো কাঁদছে অভ্র? বুকে কষ্টের পাহার তুলেছে যার কারণে। রুদ্র সামলালো নিজেকে। উঁচু গলায় বলে উঠলো,
‘তুই শুধু বল মেয়েটা কে। আমি দেখছি তারপর।’
‘তানিয়া।’
বিদ্ধগ্ধ কন্ঠ অভ্র’র। রুদ্র সহসা এই নামের কাউকে মনে করতে পারলো না। বললো,
‘তানিয়া, কে সে?’
গলা বুজে আসে অভ্র’র। যেন দলা পাকিয়ে আসছে। সমস্ত যন্ত্রণারা ঝট পাকাচ্ছে। সমস্ত যন্ত্রণা উপেক্ষা ক্ষিণ গলায় জবাব দিলো অভ্র,
‘আমাদের অফিসের এমপ্লয়ি তানিয়া!’
ড্রইংরুমে পায়চারি করছে জেবা। চোখেমুখে ভয়। বারবার ডোগ গিলছে। বুকের ভেতর দামামা বাজছে জেবার। যেন ভয়ংকর কিছু হতে চলেছে। হ্যা, চলেছেই তো! রাফিদ আসছে। একাই আসছে। তবুও কেন যেন জেবার মনে হচ্ছে অনেক বড়ো কিছু ঘটবে আজ। বাড়ির পরিস্থিতি কতটা অনুকূলে এখন, জেবা হাজারবার বলেও বোঝাতে পারেনি রাফিদকে। জেবাও চেয়েছিলো এমন কিছু হোক। তা না হলে সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে পাবে না! কিন্তু ভাইয়ের এই সময় নিশ্চয়ই নয়। তারউপর ফোন বন্ধ করে রেখেছে রাফিদ। সে আজ আসবেই! হাত-পা ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে জেবার।
উপর থেকে নেমে এলেন ইরহাম, ইলিমা, সবির। ইলিমা মেয়েকে এমন আনচান করতে দেখে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলেন। কাঁদে হাত রেখে আস্বস্ত করে বললেন,
‘চিন্তা করিস না মা!’
জেবা কাঁদো কাঁদো চোখে তাকায়। ইলিমা মুহুর্তে বুঝতে পারলেন অন্য কিছু হয়েছে। তিনি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে। ইরহামের যাওয়া দেখে নিলেন; প্রায় সদর দরজার কাছাকাছি চলে গিয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন জেবাকে,
‘কিছু হয়েছে?’
জেবা কিছু বললো না। তবে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মুখ। রাফিদ আগেও এসেছে এ বাড়িতে। প্রায় সকলের পরিচিত। কিন্ত আজ মনটা কু গাইছে জেবার। মনে হচ্ছে আজ জিবনের তরে হারিয়ে ফেলবে রাফিদকে সে, নয়তো পূর্ণতা পাবে তাদের ভালোবাসা। জেবা অন্যদিকে ফিরলো। ইলিমা এবার স্ব-হস্তে মেয়েকে নিজের দিকে ফেরালেন। তেজস্বী কন্ঠে বললেন,
‘কিছু হলে বল জেবা। কাল থেকে দেখছি কেমন মনমরা হয়ে আছিস।’
‘মা..’
জেবা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। এই সময়ে কি এসব বলা ঠিক? ইলিমা শক্ত কন্ঠে বললেন,
‘বল!’
জেবা বলতে শুরু করলো। একেএকে পুরো ঘটনা বলে বললো মা’কে। ইলিমাকে চিন্তিত দেখালো সব শুনে। জেবা ইতস্তত করতে করতে ফের বললো,
‘রাফিদ আজকে আসছে।’
ইলিমা চমকালেন, তবে প্রকাশ করলেন। শুধু বললেন,
‘চিন্তা করিস না।’
সদর দরজা খুলতেই বাইরে একটি ছেলেকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ইরহাম। সাদা শার্ট, নেবি ব্লু জিন্সের সাথে ইন করে উল্টোদিক হয়ে দাঁড়িয়ে। তিনি গম্ভীর কন্ঠে ডাকলেন,
‘এ্যাই ছেলে!’
রাফিদের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো। ভীত নয়নে পিছু ফিরে তাকালো। এতক্ষণ কিভাবে ঢুকবে, সেটাই ভেবে পাচ্ছিলো না। তাইতো প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, সাহস জমাচ্ছিলো বুকে। তার আগেই শশুর মশাই হাজির! জানলো কিভাবে সে দাঁড়িয়ে? সিসি ক্যাম লাগানো আছে নাকি? রাফিদ আশেপাশে চোখ বোলায়। না, নেইতো!
‘রাফিদ, আশেপাশে কি দেখছো?’
আগেরবারের থেকে এই কন্ঠ আরও বেশি গম্ভীর শোনালো। তাকে দেখে গম্ভীর্যতা বাড়লো নাকি? রাফিদ অবাক চিত্তে তাকায়। তার নাম মনে আছে এখনো? রাফিদ শুকনো ডোগ গিললো। অস্বস্তি হচ্ছে তার। কোনমতে বললো,
‘আসসলামু আলাইকুম, আঙ্কেল।’
‘ওয়ালাইকুম আসলাম। এভাবে দাড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে এসো।’
রাফিদ মাথা নেড়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ইরহাম সবিরকে বিদায় দিয়ে দরজা আঁটকে দিলেন। এরপর ভেতরে গেলেন। জেবা কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে আসছে। ইলিমা বসতে বললেন রাফিদ’কে। রাফিদ বসলো। তার যে ভয় করছে না, তা নয়। কিন্তু ভয় করলে চলবে না। তাকে আজ বলতেই হবে। অন্যদিন ইরহাম থাকেন না এসবে। তবে আজ তিনি ঠিক রাফিদের সামনে বসলেন পায়ের উপর পা তুলে। এতে রাফিদের অস্বস্তি আরও বাড়লো। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা চালায় রাফিদ। রাফিদ সংকোচ ঘুচিয়ে কথা শুরে করে,
‘কেমন আছেন, আঙ্কেল?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ কন্ঠে গম্ভীর্যতা বজায় তার।
এরই মাঝে ইলিমা ট্রে-হাতে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন ভালো-মন্দ রাফিদ’কে। রাফিদও বলতে লাগলো এটা-সেটা। ইলিমা নিজেও বসলেন ইরহামের পাশে। রাফিদের অস্বস্তি তিব্র হলো এবার। আগে যতবার এসেছে, এমন পরিস্থিতিতে সে পড়েনি। জেবা তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। মধ্যাকথা কেউ এভাবে তাকে ঘিরে বসেনি। শ্বাস টানলো রাফিদ। ইলিমা তার মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেন। রাফিদ বললো, তারা ভালো আছে। রাফিদ হাত কচলাতে লাগলো। কিভাবে শুরু করবে, ভেবে পাচ্ছে না সে। ইলিমা রাফিদকে আনচান করতে দেখে নিজেই বললেন,
‘কিছু বলবে রাফিদ?’
রাফিদ জেবার দিকে তাকায়। রাফিদ তাকাতেই, চোখ নামিয়ে নেয় জেবা। ওদিকে তাকিয়েই বলতে শুরু করলো রাফিদ,
‘আমি জেবাকে ভালোবাসি আন্টি-আঙ্কেল। জেবাও আমায় ভালোবাসে। কিছুদিন বাদে আমার সিঙ্গাপুরে চলে যেতে হবে। আমি, মানে আমরা চাইছি বিয়ে করতে। জেবা আমার সাথে ওখানেই থাকবে।’
এক নিঃশ্বাসে বললো রাফিদ। মাথা নামিয়ে নিলো সে। মেয়ের বাবার কাছে, তাও তাদের বাড়িতে গিয়ে ভালোবাসার কথা বলাটা চারটি খানি কথা নয়। রাফিদ নিশ্চিত এবার একটা হৈ চৈ পড়বে। রাফিদ সে অনুযায়ী সংযত করলো নিজেকে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। রাফিদ মাথা তুলে আগের মতোই স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকতে দেখলো সামনের দু’জনকে। যেন কিছুই ঘটেনি। ইরহাম এবারে মুখ খুললেন। তবে গম্ভীর কন্ঠে নয়। নরম সুরে বললেন,
‘একা এসে মেয়ের হাত চাইছো? যাও, আগে পরিবার নিয়ে এসো।’
রাফিদ থমকালো। চোখ তুলে জেবার দিকে তাকালো। জেবাও কিছুটা সেভাবেই তাকিয়ে তার দিকে।
অতি কষ্টে চোখ মেলে তাকালো তানিয়া। আঁধারে নিমজ্জিত চারপাশ। ঘুটঘুটে এই অন্ধকারে নিজের অবস্থান বুঝতে সময় লাগলো তানিয়ার। মনে করতে পারলো না সে এখন কোথায়। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক সচল হলো। অন্ধকার হওয়ার কারণ বুঝলো তানিয়া। কাল খুব বেলা করে জানালা আঁটকে দিয়েছিলো। সময় তখন কত, সেটাও তানিয়া জানে না। কিছুদিন আগেই দেয়াল ঘরিটার ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছে। জানালার সাথে পুরো রুমের লাইট ও বন্ধ করে দিয়েছিলো। তারপর থেকে দিন রাতের হিসেব নেই তানিয়ার কাছে। সে জানে না এখন ক’টা বাজে। রাত হয়ে গিয়েছে কি খুব? জানালা গলে একটুকরো আলো রুমের আসার কোন স্কোপ নেই। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে উঠে বসে তানিয়া। পাঁজরে পাঁজরে কি ব্যাথা!
বিছানার ঠিক কোনপাশে সে এখন, এটাও বুঝে উঠতে পারলো না তানিয়া। ঘারে, কোমরে অসহ্য ব্যাথায় চিঁড়ে আসছে। শরীরে এতটুকু বল পেলো না তানিয়া। অন্ধকারে নিজের হাত-ও দেখতে পারছে না ঠিকমতো। তানিয়া উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। ব্যাথায় বিষাক্ত সূচের মতো ফুটে গোটা গায়ে। শ্বাস ঘন হয়। তবুও হাল ছাড়ে না তানিয়া। উঠে দাঁড়ায়। নিজের অবস্থান বুঝতে চারপাশে চোখ বোলায়। না! চারপাশে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। তানিয়া পা বাড়ায় সামনে। কয়েকপা এগোতেই কিছু একটার সাথে লেগে ধপ করে পড়ে তানিয়া। কপালে আঘাত লাগে। গুঙিয়ে ওঠে তানিয়া৷ ভেঙে আসে সারা শরীর। বিন্দুমাত্র শক্তি নেই গায়ে। থাকবে কিভাবে? দুইদিন একরাত অনাহারে সে। পেটে কিচ্ছু পড়েনি।
সারা শরীর আসাঢ় হয়ে আসছে। ঘনঘন শ্বাস ফেলে তানিয়া। কোনমতে উঠে বসে। আজ যে বেরোতে হবে তাকে! যে করেই হোক, সে পালাবে এখান থেকে। তানিয়া এতোদিন শুনে এসেছে, বাবারা নিঃস্বার্থ হয়। তানিয়াও এতোদিন এটাই মানতো। আরিফ যে এতোকিছু করছেন, এগুলো কার জন্য? তার’ই তো জন্য! এটাই ভাবতো তানিয়া। কিন্তু তার ভাবনাকে ভূল প্রমান করলো আরিফ। আজ ওই মানুষটা মাত্রই শুধু ঘৃণা তানিয়ার মনে! হ্যা, শুধুই ঘৃণা! কারো নিজের বাবা এমন করতে পারে? হ্যা, পারে! এইতো তার সুনির্দিষ্ট প্রমান! আরিফ নিজের মেয়ের বিয়েতেও স্বার্থ খুঁজছে। ভাবা যায়? পার্টনারের আশায় বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। ভাবতেই ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে আসে তানিয়ার।
তানিয়া ওঠার চেষ্টা করে। মাথা ঘুরে ওঠে তৎক্ষনাৎ। আবারো মাটিতে পড়ার আগেই কিছু একটা ধরে সামলে নেয় নিজেকে। ধরা জিনিসটা হাতড়ে হাতড়ে দেয়ালের কাছে যায়। দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে এগোতে থাকে। কোনদিকে এগোচ্ছে সে? জানেনা! তবুও এগোতে থাকে তানিয়া। একসময় মোড় আসে। ঘুরতেই দরজা পায় তানিয়া। সস্থির শ্বাস ছাড়ে। কপাল বেয়ে তপ্ত তরল কিছু ঝড়ে পড়ছে। বুঝতে বাকি নেই, রক্ত ঝড়ছে!
তানিয়া দরজা খুললো। সাথেসাথে আলোর ঝটা চোখে এসে লাগে। চোখমুখ খিঁচে নেয় তানিয়া। আজ দুইদিন পর সে নিজ রুম থেকে বেরোলো। সেদিন আরিফ চলে যাওয়ার পর তানিয়া আর বেরোয়নি রুম থেকে৷ কতবার এসেছে আরিফ তাকে ডাকতে! তানিয়া বেরোয়নি। অন্য কারো বাবা হলে হয়তো দরজা ভাঙতো। কিন্তু আরিফ এমন কিছুই করেনি। প্রতিবার সারা পেয়ে চলে গেছে।
তানিয়া ভালোমতোই জানে, আরিফ নিজ কথা মতো ঠিক বিয়ে দিয়ে দেবে অন্য কারো সাথে। কিন্তু তানিয়া যে তা মানতে পারবে না! অভ্র, এই নামটা যে তার প্রতি নিঃশ্বাসে। আচ্ছা, অভ্র তাকে খুঁজতে আসেনি একবারও? দুইদিন অফিসে যায়নি; তা-ও একবারও খোঁজ নেয়নি? তানিয়া নিজেকে শাসায়। তার অভ্র এমন নয়। সে নিশ্চয়ই খোঁজ নিয়েছে। তবে তাকে মুক্ত করে নিয়ে যায়নি কেন এখনো? ছলছল করে ওঠে তানিয়ার চোখদ্বয়। অবসন্ন দেহে পা বাড়ায় সামনে। চারপাশ থেকে আজানের মধুর শব্দ কানে আসছে। তবে কি এখন সন্ধ্যা? তানিয়া ধীর পায়ে এগোতে থাকে। চোখ বুজে আসছে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। সারাবাড়ি স্তব্ধ! কোন সাড়াশব্দ নেই। হয়তো নেই কেউ বাড়িতে। তানিয়া হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির সামনে যায়। উপর থেকে পরখ করে নেয় চারপাশ। কোথাও কেউ নেই। সিঁড়ির হাতল শক্ত করে ধরে তানিয়া। পা বাড়ায় নিচের দিকে। খুবই আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলো তানিয়া। ড্রইংরুমের অর্ধেকংশ অন্ধকার। ওখানে আলো জ্বালানো হয়নি কেন? তানিয়া পাত্তা দিলো না। এটাই সুবর্ণ সুযোগ! তাকে পালাতে হবে। তানিয়া এগোতে যাবে, তখনি ভেসে আসে কোন অপরিচিত পুরুষের ভরাট কন্ঠস্বর,
‘টানা আঠাস ঘন্টা আমি তোমার জন্য অপেক্ষায়, আর তুমি কি-না পালিয়ে যাচ্ছো, তানিয়া?’
কলিজা ছলকে ওঠে তানিয়ার। তড়িৎ গতিতে পিছু ফিরে তাকায়। কন্ঠস্বর অনুযায়ী খোঁজার চেষ্টা অপরিচিত ব্যাক্তিকে। অন্ধকারে দু’জন পুরুষের অবময় দেখা যাচ্ছে। চেয়ার পেতে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে দু’জনে। সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো তানিয়ার। মরুভূমির মতো শুকিয়ে এলো কন্ঠনালি। পুরুষ অবময় আলোয় আসে। চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে আরিফ এবং এক যুবক। তানিয়া পিছিয়ে যায় এককদম। থরথর করে কাঁপতে থাকে পা। যুবক নিজের ব্লেজারের খোলা বোতামটা লাগাতে ব্যাস্ত হয়ে উঠলো। সেভাবেই বললো,
‘যেদিন তোমায় প্রথম এ বাড়িতে দেখেছিলাম। সেদিন’ই আমার ভালো লেগেছিলো তোমায়। আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানো? আমি তারপর থেকেই তোমায় অনুভব করি সবখানে। এন্ড ফাইনালি আমাদের বিয়েটা হচ্ছে। তোমায় ঘর থেকে বের করে আনেনি কেন জানো? কজ, আমিই নিষেধ করেছিলাম। কারন আমি জানি তুমি অনেক ম্যাচিউর। কোন উল্টাপাল্টা কাজ তুমি বোকার মতো করবে না।’
ঘৃণায় মুখ বিকৃত হয়ে আসে তানিয়ার। তানিয়া অন্যদিকে ফিরলো। ক্লান্ত দেহে ঠিক মনে করতে পারলো না আর কবে এসেছিলো। অভ্র’র কথা মনে পড়তেই, চোখ ফেটে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। কোথায় এখন অভ্র? সে আসছে না কেন তাকে বাঁচাতে? এটাই কি তার নিয়তি? একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের হয়ে যাওয়া? কারো পদধ্বনি কানে আসতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শিতল স্রোত বয়ে গেলো তানিয়ার। মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকালো তানিয়া। যুবক এগিয়ে আসছে। মুখে বিকৃত হাসি। কলিজা শুকিয়ে এলো তানিয়ার।
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৩৩+৩৪
কয়েকপা পিছিয়ে যায় তানিয়া। পেছোনের টেবিলে আঁটকে যায় সে। যুবক তখনও এগিয়ে আসছে। মস্তিষ্ক বিকল হয়ে পড়লো তানিয়ার। ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো চারপাশ। দেহ ছেড়ে দিলো নিজের ভর। পড়তে নিলেই, কেউ শক্ত বাহুর বাঁধনে আঁকড়ে ধরলো তাকে। ঘৃণায় রি রি করে ওঠে তানিয়ার শরীর। বুজে আসা চোখদুটি কোনমতে খুললো তানিয়া। দু’চোখের পাতায় ভেসে ওঠে অভ্র’র মুখখানি। সে জানে, এ শুধুই তার কল্পনামাত্র!
