নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি গল্পের লিংক || ঝিলিক মল্লিক

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১
ঝিলিক মল্লিক

“আরবিন স্যার, আমি আপনাকে ভালোবাসি! চলুন, আমরা পালিয়ে যাই বহুদূরে।”
বইয়ের ভেতর থেকে চিরকুটটা বের করে বেশ জোরে জোরে পড়লো আরবিন আল তৈমুর স্যার। কোচিং-এর স্টুডেন্টরা বড় বড় চোখ করে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো আরবিন স্যারের দিকে৷ আশরাফ তো উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলো। সাইদ বিপদের আশংকা বুঝতে পেরে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো বেঞ্চ থেকে। যথেষ্ট নম্রভদ্রভাবে বললো,
“স্যার, আমার ইমিডিয়েট একটু এক-এ যাওয়া দরকার। খুব জরুরি স্যার।”
“যা।”

আরবিন স্যার হাতের ইশারায় যেতে বললো সাইদকে। সাইদ দ্রুত ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আরবিন স্যার ছেলেদের বেঞ্চের দিকে ফিরে বললেন,
“আমার হাতে যেই ইংলিশ সাপ্লিমেন্টটা এসেছে, এটা কার? সে উঠে দাঁড়াবে এক মিনিটের মধ্যে। নাহলে আজ ক্লাসের সবকটাকে বের করে মেইন রোডের সামনে নিয়ে কান ধরিয়ে রাখবো। বুঝিস কিন্তু সবগুলো।”
দুই সারিতে ছয়টা করে মোট বারোটা বেঞ্চ। ছেলেদের বেঞ্চে আজ নয়জন উপস্থিত। মেয়েদের বেঞ্চে দশজন। ছেলেরা একে-অপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলে স্যারের দিকে তাকালো। জামাল বলে উঠলো,
“স্যার এইটা শিওর মেয়েদের কাজ। আমরা নিরীহ, নির্দোষ। ফাজিল তো মোটেও নই।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেয়েরা এবার একে-অপরের দিকে তাকিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হলো। তবে একেবারে সামনের বেঞ্চে নিরবতা দেখা গেল। আরবিন স্যার সন্দিহান চোখে সামনের বেঞ্চে লক্ষ্য করলেন। কেয়া আর মারিসা একে অন্যের দিকে কোণা চোখে তাকাতে লাগলো। আবার স্যারের দিকে। রিদি বসেছিল মাঝখানে। মাথায় শিফন কাপড়ের হিজাব ওড়না পেঁচানো। গলার কাছে সেফটিপিন আটকানো। চোখে মোটা সাদা ফ্রেমের প্লাস পাওয়ারের চশমা। এতোক্ষণ মারাত্মক চুপচাপ ছিল। আরবিন স্যারের গুমোট আর প্রতিক্রিয়াহীন মুখশ্রী আর ক্লাসমেটদের আতঙ্ক দেখছিল। দুপাশে মুখ ঘুরিয়ে দেখলো, কেয়া আর মারিসা চুপচাপ বসে আছে। এবার দ্রুতগতিতে উঠে দাঁড়ালো ও। মুখ নুইয়ে মাথা নত করে ফেললো।

“স্যার অতি আবেগের বশে আমি লিখেছি এই চিরকুট। আমার ভুল হয়েছে। মাফ করে দেবেন। আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কোচিং-এ আর পড়তে না দিলে-ও কিছু মনে করবো না।”
চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলো রিদি। আরবিন স্যার কিছুক্ষণ প্রতিক্রিয়াহীনভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে। পরপরই বললেন,
“আজ আর ক্লাস হবে না। সবাই আসতে পারো।”
রিদি চমকে উঠলো। কাঁপা কাঁপা চোখে স্যারকে দেখে নিলো একবার। ওর মোটা গ্লাসের ওপাশে থাকা বিস্ময়সূচক দৃষ্টি আরবিন স্যারের নজরে পড়লো না। আরবিন হাতের মার্কারটা কেবিনেটে রেখে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেলেন ক্লাসরুম থেকে। তিনি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একে একে সব স্টুডেন্টরা বেরোলো ক্লাস থেকে। যেতে যেতে ওরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে রিদির দিকে তাকাতে লাগলো। এই কোচিং-এ এবং কলেজের ক্লাসের মধ্যে রিদির একমাত্র প্রতিযোগী হলো লামিয়া। ও তো যাওয়ার সময় ব্যাঙ্গ করে বলেই ফেললো,

“টপার, নম্র-ভদ্র স্টুডেন্টরাও দেখি আজকাল স্যারের সাথে ফাজলামি করে। নাকি কাহিনী সত্যি কে জানে।”
লামিয়া একপ্রকার খোঁচা মেরে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। সবাই যাওয়ার সাথে সাথেই রিদি বেঞ্চে ধপ করে বসে কাঁদতে শুরু করলো মুখ চেপে। বাচ্চাদের মতো হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে ও কেয়া আর মারিসাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“এতোটা অসম্মান! আমার জন্মের পর থেকে এই আঠারো বছরে আব্বু-আম্মু কখনো এমন অপমানিত হতে দেননি আমাকে। আজ তোদের জন্য আমাকে তা-ই হতে হলো। এই কোচিং-এ পড়ার আর কোনো মুখ থাকবে না আমার। যেখানে আমার আত্মসম্মানে বাঁধে, সেখানে আমি আর দ্বিতীয়বার কখনো যেতে পারি না। কখনো না! স্যার মুখে না বললেও স্যারের নিরবতা এতটুকু বুঝিয়ে দিয়েছে, আমার এখানে আসাটা আর সমীচীন নয়। তোদের জন্য এমন বাজে একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। তোরা আর কখনো কথা বলবি না আমার সাথে।”
“তুই কতটা নির্বোধ আর সোজাসাপ্টা রিদি! আমরা তো মজা করে চিরকুটটা ওখানে রেখেছিলাম সাপ্লিমেন্টে। ওতে কারো নামও লেখা ছিল না। স্যার ধরতেও পারতো না। তুই কেন মুখ খুললি?”

“তোদের ধরে ফেললে কী হতো? তোরা তো স্বীকার করতিস না। পরে আরো বিশ্রী কান্ড হতো। তারচেয়ে বরং আমি নিজের ওপর দোষ চাপিয়ে নিয়েছে — এতেই ঘটনা শেষ। তখন তোদের এতো করে নিষেধ করেছিলাম, এধরনের ফালতু কাজ করিস না। এসব বাজে ফাজলামির পর্যায়ে পড়ে৷ কিন্তু তবুও তোরা শুনলি না। তোদের সাথে আর কোনো কথা নেই আমার৷ যা তোরা। আর কখনো কথা বলবি না আমার সাথে!”
কেয়া আর মারিসা অনেকক্ষণ যাবত রিদিকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু রিদি তার সিদ্ধান্তে অটল। একচুল পরিমাণও নড়লো না নিজ জায়গা থেকে। শেষমেষ হতাশ হয়ে আর করুণ দশা নিয়ে বেরিয়ে যেতে হলো কেয়া আর মারিসাকে। যাওয়ার সময়ে রিদির কাছে মাফও চেয়ে গেল। রিদি ওদের দিকে ঘুরেও তাকালো না। ওরা বেরিয়ে যেতেই বিরবির করে ঠোঁট উল্টে বললো,

“আজকের পর থেকে আর কারো জন্য কখনো যেচে নিজের ঘাড়ে চাপাবো না। কারো সাথে কোনোরকম আপোষ করবো না। আব্বু ঠিকই বলে, বন্ধুদের জন্য কিছু করতে যেয়ে নিজেকে বিপদে ফেলার মতো বোকামি আর দ্বিতীয়টি নেই। সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ!”

রিদি চশমার কোণ থেকে আঙুল গলিয়ে চোখের পানি মুখে আস্তে-ধীরে বেরিয়ে গেল ক্লাসরুম থেকে। বিশাল বড় কোচিং সেন্টার। লাস্ট লার্নাস কোচিং-সেন্টারটা একটা চারতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় বড় ফ্লাটে স্থাপন করা হয়েছে। মূল শহরের মধ্যে অত্যন্ত আধুনিক এবং জনপ্রিয় একটি কোচিং সেন্টার। ইংরেজি শেখানোর জন্য বিখ্যাত। এখান থেকে পড়ে বেশিরভাগ স্টুডেন্টরা ভালো রেজাল্ট করে, অ্যাডমিশন কোচিং করে ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন দিয়ে বড় বড় নামকরা ভার্সিটিতে চান্সও পেয়ে যায়। কোচিংটার স্বত্বাধিকারী হলেন, ইকবাল জম্মাদার। আরবিন স্যারের আব্বা। তিনি যখন রিদিদের কলেজে দীর্ঘ পনেরো বছর আগে চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন, তখনই এই কোচিং সেন্টারটি নিজের বাড়ির বিল্ডিংয়ে দোতলায় স্থাপন করেন। আজ অবধি একইভাবে, একই অবস্থানে সুনাম ধরে রয়েছে এই কোচিং সেন্টারটি। একসময় ইকবাল জম্মাদার নিজে ক্লাস নিতেন। তবে এখন তার বয়স হয়েছে— একারণে কিছু বছর আগে হতেই তিনি ভার্সিটি পড়ুয়া দক্ষ ছাত্রদের দ্বারা এবং সম্প্রতি নিজের ছেলে আরবিনকে দিয়ে ক্লাস নেওয়াচ্ছেন। সকলেই ভীষণ দক্ষ। এখানে নবম শ্রেণি হতে শুরু করে অ্যাডমিশনের স্টুডেন্ট — এমনকি ভার্সিটি পড়ুয়ারাও ক্লাস করে।

“রিদি আম্মা।”
রিদি তখন অফিস রুমের সামনে হতে মুখ নুইয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। অফিস রুমের ভেতর থেকে ইকবাল জম্মাদারের ডাক শুনে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতরে চোখ পড়তেই দেখলো আরবিন স্যার কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন নির্লিপ্তভঙ্গিতে। কোচিং-এ আসেন একদম ফিটফাট হয়ে। শার্ট, প্যান্ট আর জেল লাগানো পরিপাটি সাজে। এখন অবশ্য তা নেই। চুলগুলো এলোমেলো, একটা টি-শার্ট গায়ে জড়ানো।৷ হাতে ঘড়ি নিখোঁজ। নিতান্তই সাধারণ এক ঘরোয়া উনত্রিশোর্ধ্ব পুরুষ মনে হচ্ছে।
রিদি ইকবাল জম্মাদারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“জি আংকেল, ডাকছিলেন?”
“ভেতরে এসো। ”

রিদি ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো। ইকবাল জম্মাদার কিছু বলার আগেই আরবিন স্যার বললেন,
“আব্বা আপনাকে কি যেন বলছিলাম? রিদি একটা অপরাধ করেছে আজ৷ জটিল অপরাধ। কি অপরাধ তা আর না বলি। কথা হচ্ছে, এই অপরাধের শাস্তি কি দেওয়া যায়, তা এই সাতসকালে আমার মাথায় আসছে না বিশ্বাস করুন। এখন আপনি ওকে বলে দেন, যেন এধরনের কাজ আর কখনো না করে।”
ইকবাল জম্মাদার একবার আরবিনকে দেখে রিদির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মেয়েটা কি অপরাধ করেছে, তা তো আমি জানি না৷ তবে যদি স্টুডেন্ট হয়ে মাস্টারের সাথে কোনো বেয়াদবি করে থাকে তবে তার জন্য অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে।”

“জি আব্বা। একপ্রকার বেয়াদবিই করেছে ও। তবে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে। বিষয়টা আপনাকে জানানোর কারণ হচ্ছে, ওর আব্বু বিশেষভাবে আপনার হস্তক্ষেপে ওকে দিয়ে গেছেন। যেন ওর পড়াশোনার মনোযোগ এবং কোচিং-এ থাকাকালীন দায়িত্বটুকু আপনার কাঁধে বর্তায়। সুতরাং, আপনি ওকে জানিয়ে দিন যে, এই ধরনের অপরাধ যেন ও আর কখনো না করে; কিংবা কোচিং ছাড়ার কথাও চিন্তাভাবনা না করে। চিন্তা করতে হবে না৷ ও আনকম্ফোর্টেবল ফিল করলে আমি আর কাল থেকে ওদের ব্যাচের ক্লাস নেবো না।”
ইকবাল জম্মাদার ছেলের কথা শুনে রিদির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“শোনো আম্মা, তোমার আব্বু তোমাকে আমার দায়িত্বে দিয়ে গেছেন এখানে। তোমার কোনো ভুল-ত্রুটি হলে তা ধরিয়ে দেওয়া-ও আমার দায়িত্ব। নয় কী? তুমি ভালো স্টুডেন্ট। সম্ভাবনাময়ী। তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ প্রায় দ্বারপ্রান্তে। এসময়ে এমন কিছু করো না, যাতে তুমি নিজের লক্ষ্যের দিকে পৌঁছাতে বাঁধা পাও। এজন্য যা কিছু হয়েছে, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়াশোনায় মন দাও। তোমরাই একদিন হবে লাল-সবুজের বাংলাদেশ।”

রিদি নম্রভাবে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো ইকবাল জম্মাদারের কথায়। একবার চশমার ওপাশের দৃষ্টি হতে দেখে নিল আরবিন স্যারকে। কি ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর! লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে বলতে মন চইছে,
“স্যার আমি কিছু করিনি। আমি তো এমন মেয়ে নই। আপনি চেনেন আমাকে। কতটা স্নেহ করতেন! আব্বু-আম্মু তো আমাকে শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি করার শিক্ষা দেননি। শুধুমাত্র ঝোঁকের বশে করা একটা বোকামির কারণে বিনা দোষে দোষী হয়ে গেলাম।”

রিদির ভীষণ কান্না পেল। গলা চিড়ে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলো। বহুকষ্টে, মারাত্মক প্রচেষ্টায় কোনোমতে আটকে নিলো ও। কপাল ভালো, ইকবাল জম্মাদার তখন রিদিকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। রিদি দরজার কাছাকাছি যেতেই আরবিন স্যার ওর দিকে এগিয়ে আসলেন। রিদি দাঁড়িয়ে গেল৷ আরবিন স্যার রিদির মাথায় হাত রেখে বললেন,
“শোনো রিদি, ভুল করে কখনো লজ্জা পাবেনা। বরং নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেবে। প্রতিটা ভুল থেকে তুমি জীবনে কিছু না কিছু শিখতে পারবে।”
আরবিন স্যারের মাথায় হাত রাখা যেন একটা স্নেহের স্পর্শ। তার বলার প্রতিটি কথার অক্ষরের ভাঁজে যেন ছিল স্নেহময়তা। রিদির অনুশোচনার চোটে হঠাৎ কান্না পেল ভীষণ। ঠোঁট চেপে ধরলো ও।

“আসি স্যার। আল্লাহ হাফেজ।”
বলে রিদি দৌড়ে বেরিয়ে গেল অফিস রুম থেকে। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামতে লাগলো ও৷ চোখের কোণা থেকে গড়িয়ে পরা অশ্রুজল সপাটে মুছতে মুছতে বিরবির করে নিজেকে বললো,
“এ আমি কোন পাপে জড়িয়ে পরলাম! এই পাপের যে ক্ষমা নেই। স্যার নিশ্চয়ই আমার ব্যাপারে মনে নেতিবাচক মনোভাব রাখবেন। যা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। এই অনুশোচনা বোধ আমার এ জীবনে কাটবে না। আমি আর এই কোচিং এ আসবো না। কখনোই না।”

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২