নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২
ঝিলিক মল্লিক
“দোস্ত, আমার জব কনফার্মেশন লেটার হাতে এসেছে৷ হ্যাঁ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আইটি ও সাইবার সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে।”
“কংগ্রাচুলেশনস! তারমানে তুই এখন থেকে একজন আইটি ও সাইবার অফিসার, মানে সামরিক অফিসার?”
“সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পরে হয়তো। ”
আরবিন হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক হলো বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে। ফোনের ওপাশ থেকে বন্ধু কায়েস বললো,
“তোকে কী এখন থেকে স্যালুট করতে হবে?”
আরবিন গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো,
“আমাকে নয়, জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করলেই হবে।”
“আচ্ছা, ট্রিট দিচ্ছিস কবে?”
“যেদিন তোরা চাস। পিয়ালকে এখনো জানানো হয়নি। ওকে পরে কল করবো।”
“তা তোর বিয়ে-শাদির কী খবর? আমরা বন্ধুরা তো সব বিয়ে-শাদি করে নিলাম। এক হালায় বাচ্চাও ফুটিয়ে ফেললো। আর তুই শেষ বয়সে এসেও বিয়ে না করে আবার জব জয়েন করছিস?”
আরবিন হেসে জবাব দিলো,
“জীবনে কী বিয়ে-শাদি সব? আমার স্বপ্ন ছিল এই ডিপার্টমেন্টে জব করবো। দেশের একটা বড় প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করবো৷ আলহামদুলিল্লাহ আ’ম সাকসেসফুল। আপাতত আর কী চাই?”
“তোর কোনো চাহিদা নেই?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ওয়েল, কায়েস তুই যা বলছিস বা বোঝাতে চাইছিস; তা বুঝতে আমার মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না৷ অবশ্যই চাহিদা আছে। ইভেন, প্রতিটা মানুষের-ই আছে। তবে এখনই সময় হয়নি। আমার জব পোস্টিং সিলেটে হচ্ছে। সেখান থেকে ছুটিতে কয়েক মাস পরে ফিরে তখন বিয়ে করে নেবো। আর আব্বা এখন আমাকে চক্রজালে ফেলতে চাইছেন। এক বাচ্চা মেয়ের সাথে জড়াতে চাইছেন। মেয়েটার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। আমি সেটা নষ্ট করতে চাইছি না। একারণেই মনে করতে পারিস, এই জব জয়েন করে দূরে সরে যাচ্ছি। এখানে থাকাটা আমার জন্য সমীচীন নয়।”
“কোন মেয়ে? কীসের কথা বলছিস আরবিন? তোর সাথে কোনো মেয়ের বিষয় জড়ানো! হ্যাঁ একটা মেয়েকে কলেজ লাইফে পছন্দ করতিস, দুই মাসের রিলেশন ছিল। ওসব তো ছোটোখাটো ব্যাপার। এরপর থেকে তোর নামের সাথে কোনো মেয়ের নাম কখনোই জড়াতে দেখিনি আমি। বুয়েটে পড়াশোনা, টাইগার আইটি বাংলাদেশে দুই বছরের জব; সেখান থেকে জব ছেড়ে আইটি ও সাইবার সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের জন্য এপ্লাই, ট্রেনিংসহ আরো কত কি করলি। তারপর যখন কিছুদিন আগে বাসায় এসে বসলি; তখন ভাবলাম যে, না এবার বোধহয় তোর সুমতি হলো। বিয়ে এবার একটা খেতে পারবো আমরা বন্ধুমহল। কিন্তু তুই শালা আবারও আমাদের নিরাশ করলি।”
কায়েসের কন্ঠে কিছুটা ক্ষোভ স্পষ্ট। তবে আরবিন আগের মতোই শান্ত। সেই শান্ত গলায়ই বললো,
“আমিও ভেবেছিলাম এই দুই মাসের মধ্যে বিয়েটা করে নেবো। কিন্তু আমার শ্রদ্ধেয় বাপজান আমাকে যেই আইন শোনালেন, তা মানতে আমি মোটেও রাজি নই৷ একটা মেয়ে আছে বুঝলি। যার হৃদয় জলের মতো স্বচ্ছ, পরিষ্কার। দুনিয়াবি পরিস্থিতি অনুযায়ী একটু বোকাসোকা। তবে ভীষণ মেধাবী আর সম্ভাবনাময়। ওকে দেখলেই আমার মনে হয়, এদেশের একটা রত্ন হতে পারবে। সেই রত্নকে ধ্বংস করার অধিকার আমার নেই। এখন ওর সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেললে, ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। আমার অবস্থান ও বুঝে উঠতে পারবে না। আমার নিজের লাইফের যেই অ্যাম্বিশান, সেটা পূরণ করতে গেলে ওকে এড়িয়ে যেতে হবে। আর ও একবার আমার কবলে পড়ে গেলে, আমার আচরণ মেনে নিতে পারবে না। প্রতিনিয়ত কষ্ট পাবে৷ তাছাড়াও একটা কঠিন সত্যি হচ্ছে, একটা মেয়ে যতোই মেধাবী হোক; বিয়ের পরে তার সেই মেধা থাকে না পরিস্থিতির জন্য। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। তাই আমি জেনেশুনে এই অপরাধ করতে চাই না। আব্বাকে দিয়েও করাতে চাই না। সুতরাং, যত দ্রুত সম্ভব এই অঞ্চল ছাড়তে হবে। নাহলে ব্যাপারটা আরো গুরুতর হয়ে যাবে।”
কায়েস এবার অতি উৎসুক হলো। বললো,
“মেয়েটা কে? নাম কী? কতদিন যাবত চিনিস?”
“নাম-ধাম না বলি। ওসব গোপন-ই থাকুক। মেয়েটা আমার স্নেহের। অবশ্য আমার বিপরীত। আমাকে চিনলে ও খারাপ লোক বলা শুরু করবে।”
কথাটা বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো আরবিন। থেমে আবার বললো,
“ও চুপচাপ স্বভাবের৷ তবে আজ একটা ভুল করেছে। যদিও আমি তা আমলে নিইনি বিশেষভাবে। কিন্তু ও আত্মগ্লানিতে ভুগবে খু্ব৷ কারণ, আমাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে৷ আর আমি ওকে স্নেহ করি অনেক। এখন আমাকে চোখের সামনে সবসময় দেখলে ওর এই আত্মগ্লানি বাড়তেই থাকবে। তাই আমি দূরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা তাড়াতাড়িই নিয়েছি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে এই শহর ছাড়বো।”
“তারমানে মেয়েটাকে তুই বিয়ে করবি না?”
“এককথায়— না। আমি ওকে একজন সাকসেসফুল ওমেন হিসেবে দেখতে চাই। সি ডিজার্ভ অ্যা গ্রেট অ্যাচিভমেন্ট। তাছাড়াও আমাদের সম্পর্ক অবস্থান বিবেচনায় শিক্ষক-ছাত্রীর। আজ থেকে দশ বছর পরে হলেও আমি ওর শিক্ষক। অথবা বিশ বছর। সব সম্পর্কে সবকিছু মানায় না। এটা আমার নিজেরই পছন্দের নয়।”
“শিক্ষক-ছাত্রীর মানে? আমি কি ঠিক ধরছি . .?”
কায়েসের শেষোক্ত কথাটা শোনার সাথে সাথেই ফোন কেটে দিলো আরবিন। অপরদিকে কায়েস ফোনের ওপাশ থেকে হা-হুতাশ করতে শুরু করলো।
আরবিন!
টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে বসে জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের প্রথম অধ্যায় সবে পড়া শুরু করেছিল রিদি। পেন্সিল আর হাইলাইটার দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ লাইন মার্ক করছিল। হঠাৎই হাতের পেন্সিল দিয়ে অপ্রত্যাশিত নামটা বইতে লিখে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল রিদি। আশ্চর্য হওয়ার কারণ হচ্ছে, এর আগে কস্মিনকালেও বইতে কারো নাম, এমনকি নিজের নামও ভুলবশত লেখেনি সে। সেখানে প্রথমবারের মতো এমন একজন অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির নাম লেখা কতটা সমীচীন?
মনে মনে হিসাব কষলো রিদি। কোনো সমাধান-ই পেলো না। বরং, সমীকরণটি আরো জটিল হয়ে উঠলো। অনেকক্ষণ যাবত পড়ায় মন বসছে না। ওর আম্মা তানিয়া বেগম কিছুক্ষণ আগে এসে এক কাপ কড়া লিকারের চা আর টোস্ট-বিস্কিট দিয়ে গেছেন। অন্যমনস্ক থাকায় চা সেই কখন ঠান্ডা হয়ে গেছে। বর্তমানে তেতো বিদঘুটে জিনিসটাতে বিস্কুট ভিজিয়ে গিলছে রিদি। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই ওর। অন্যসময় হলে চিল্লিয়ে বলে উঠতো,
“আম্মায়ায়ায়া, আরো এক কাপ কড়া লিকারের চা প্লিজ।”
তবে আজ কেন জানি সে অন্যরকম। কিছুই করছে না। কিছুই ভালো লাগছে না। শুধু ক্ষণে ক্ষণে বুক ধ্বক করে উঠছে। একটা সময় গিয়ে তেতো ঠান্ডা চায়ের ভেতরে টোস্টগুলো ভিজে গলে পড়লো। তবুও ওর খেয়ে ওঠা হলো না। রিদি দ্রুত একটা কালো মার্কার দিয়ে আরবিন নামটা কেটে ফেললো বইয়ের পৃষ্ঠা হতে। তারপর উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে। আজ আর পড়া হবে না ওর। মন ভালো করতে এখন উপন্যাসের বই-ই শ্রেষ্ঠ উপায়। সেই মোতাবেক, ছোট বুকশেলফটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো রিদি। বুকশেলফের তাকগুলোতে চোখ বুলালো মোটা ফ্রেমের আড়াল থেকে। এখন পরিস্থিতি অনুযায়ী, সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটাকেই উপযুক্ত মনে হলো ওর। দীপাবলিকে আরেকবার পড়া ভীষণ প্রয়োজন! যেই আত্মমর্যাদা, আত্মগ্লানিতে ভুগছে ও, তা থেকে দীপাবলিই উদ্ধার করতে পারে ওকে। সাতকাহন বইটা সবে হাতে নিয়ে বিছানায় বসেছে রিদি, তখনই বালিশের কাছে ফোনটা টুংটাং শব্দে কেঁপে উঠলো। মেসেজ এসেছে সম্ভবত হোয়াটসঅ্যাপে। ফোনটা রিদির আম্মুর৷ রিদিকে কোনো নিজস্ব ফোন দেওয়া না হলেও পড়াশোনার প্রয়োজনে এটা এখন রিদির কাছে থাকে বেশি। হোয়াটসঅ্যাপে একটা গ্রুপ আছে। গ্রুপটার নাম— “মাইন্ডস্ট্রোম।”
গ্রুপের মেইন অ্যাডমিন টগর স্যার। উনিই বহুদিন আগে এই গ্রুপটা খুলেছিলেন কোচিং-এর ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্টদের জন্য। কিছুদিন আগে আরবিন স্যারও গ্রুপে জয়েন করেন।
রিদি হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে দেখলো, সাদ্দাম মেসেজে লিখেছে—
“সকলের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, আমাদের শ্রদ্ধেয় আরবিন স্যার আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তাহার শিক্ষকতা হইতে অবসর গ্রহণ করিবেন, সুতরাং এক সপ্তাহ বাদ আমরা সকলে মিলিয়া একখানা বনভোজন আয়োজনের পরিকল্পনা করিতে চাইতেছি। আপনারা কী বলেন মাননীয় ও মাননীয়ারা?”
সাদ্দামের মেসেজে ছত্রিশটা লাভ, কেয়ার রিয়্যাক্ট পড়লো। রিপ্লাইতে সামিয়া বললো,
“যথা আজ্ঞা কবি সাদ্দামানন্দ। আপনার আদেশ শিরোধার্য।”
কাইফা রিপ্লাই করলো,
“এ সাদ্দাইম্মা, বুঝলাম তুই বাংলা সাহিত্যপ্রেমী। তাই বলে সবখানে এরকম ভাদাইম্মাগিরি ক্যান করিস?”
“কাইফা, এখানে স্যারেরা আছেন। এভাবে কথা বোলো না।”
কাইফার মেসেজের রিপ্লাইতে রিদি কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন একটা মেসেজ আসলো গ্রুপে। লামিয়া লিখেছে,
“যার নিজেরই শিক্ষকদের সাথে আচরণের ঠিক নাই, সে আবার আসে জ্ঞান ঝাড়তে। হাস্যকর।”
লামিয়ার মেসেজটা সবাই সিন করেও এড়িয়ে গেল। তবে রিদির মনে তা গেঁথে গেল একপ্রকার। দেখলো, আরবিন স্যার সব মেসেজ-ই সিন করছেন। কোনো রিপ্লাই জানাচ্ছেন না। অন্যদিন স্যার নিজেও সবার সাথে আড্ডায় যুক্ত হন। টগর স্যার, হাশিম স্যার অনলাইনে নেই। রিদির হঠাৎ খুব রাগ হলো৷ নিজের ওপর,তারপর লামিয়ার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ থেকে লিভ নিলো ও। নেওয়ার পরে আচনক কেমন শান্ত হয়ে গেল। তারপরই কোনোকিছু হয়নি— এমন একটা ভাব নিয়ে সাতকাহন বইটা পড়তে শুরু করলো।
ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। কল দিয়েছে কেউ। দ্রুত ফোন হাতে উঠালো রিদি৷ ফোনস্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আরবিন স্যারের নাম। কল রিসিভ করলো রিদি৷ সঙ্গে সঙ্গে ফোনের ওপাশ থেকে যেন ঝড় উঠতে লাগলো।
“এই মাথামোটা। বলদ একটা। এই মোটা মাথা নিয়ে তুমি মেডিকেল এক্সাম দেবে? নাকি ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নেবে? ছাগল কোথাকার! সামান্য বিষয়ে এতো ইমোশনাল হও কেন তুমি? যেখানে দেখেছো সবাই ইগনোর করেছে মেসেজটা, ইভেন আমিও এড়িয়ে গেছি। বিষয়টা গুরুত্ব দিইনি। নাহলে লামিয়া ঝাড়ি খেতো কনফার্ম। সেখানে তুমি সামান্য একটা বাচ্চা মেয়ে, এতো আতে ঘাঁ কেন লাগতে হবে তোমার? শোনো রিদি একটা কথা বলি, জীবনে যদি তুমি সবার সব কথাকে গুরুত্ব দাও, তাহলে কেউ যদি তোমাকে ম’রতে বলে; তখন কী তুমি সোজা ম’রতে চলে যাবে? এতোটা গর্দভ হইও না।
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১
পড়াশোনায় যেমন মেধা ধরে রেখেছো, তেমনই দুনিয়াবি পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করতে শেখো। জীবনের দেখেছো কী? এইটুকুতেই ক্লান্ত? এখনো লম্বা একটা জীবন পড়ে আছে তোমার জন্য। বাকিটা জীবন এভাবে ছিচকাঁদুনে স্বভাবে কাটালে কিচ্ছু করতে পারবে না। শোনো, আমি গ্রুপে অ্যাড করে দিচ্ছি। আবার লিভ নেবে না। লিভ নিলে আমি মনে করবো, তুমি আমাকে অসম্মান করতে এমনটা করছো। দ্যান, দ্য ডিসিশন ইজ ইয়োর্স।”
রিদিকে কিছু বলার সুযোগই দিলেন না আরবিন স্যার। কল কেটে দিলেন। রিদি ফোন রেখে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলো।
আবারও সেই নাম, সেই মুখ, আবারও সেই আড়ষ্টতা — এ নিয়ে কি বাঁচা যায়. . .