নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১৬

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১৬
ঝিলিক মল্লিক

চোখের সামনে ফোন স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে “আরবিন আল তৈমুর”— আইডিটাতে ট্যাগ করে ফারিয়া জাহান নামক একটা আইডি থেকে ফটো আপলোড করা হয়েছে। ফটোতে দেখা যাচ্ছে একটা ক্যাফেতে সামরিক পোশাক পরিহিত কয়েকজন নারী ও পুরুষ অফিসারের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন আরবিন৷ মুখে চওড়া হাসি। যেন খুশিতে বরফের মতো গলে পরছে।

রিদি উত্তপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে আছে সামনে বসে থাকা সাইফার দিকে। সাইফা ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে। রিদি যে ভীষণ রেগে গেছে, তা বলার অবকাশ রাখে না। সাইফা ওকে আরো কিছুটা ক্ষ্যাপাতে বললো,
“চা খা। চা খেয়ে মাথা ঠান্ডা কর।”
রিদি খেঁকিয়ে উঠে বললো,
“আর মাথা ঠান্ডা! তোকে এইসব আমি দেখাতে বলেছি? ওই লোকের আইডির নাম তোকে বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।”
সাইফা আস্তে করে জবাব দেয়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কিছু কিছু ভুল জীবনের জন্য ভালো। এই যেমন দেখ, তুই তো দুলাভাইকে ব্লক দিয়ে রেখেছিস। এখন আমি যদি আইডির খোঁজ পেয়ে গোয়েন্দাগিরি করে ভেতরে ঢুকে না দেখতাম, তাহলে তো জানতেই পারতিস না এসব। ওই মেয়েটার আইডির নাম খেয়াল করেছিস? ফারিয়া জাহান। ও তোর স্বামীর ডিপার্টমেন্টে লেফটেন্যান্ট পদে আছে। ওই মেয়েটাই তো দুলাভাইকে ট্যাগ দিয়ে ফটো পোস্ট দিলো গতকাল। আইডি পাবলিক করা ছিল বলে আমি দেখতে পেরেছি। তোকে রাতেই জানাতাম। কিন্তু তোর যদি চিন্তায় ঘুম না হতো রাতে, এজন্য জানাইনি।”
“অযৌক্তিক কথাবার্তা বলিস কেন? এসব আউল-ফাউল মানুষ কাহিনী করে বেড়াবে, আর রাতের ঘুম হারাম হবে আমার? হাস্যকর কথাবার্তা!”

রিদি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো শেষের কথাটা বলে। সাইফা এবার সতর্ক গলায় বললো,
“দেখেছিস, আমার কথা কী ভুল ছিল? এই ডিফেন্সের ব্যাটা মানুষরা বউ ছাড়া থাকলে এমনিতেই খারাপ চরিত্রের হয়ে যায়। মানে এরা যে কত খারাপ! আমার খালামণি ভুগছে এখন।”
“সাইফা, উনার সাথে আমার কোনোদিন কোনোরকম সম্পর্ক গড়েই ওঠেনি। এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ পরিণতি অনিশ্চিত। আমি নিজেও এ ব্যাপারে কনফিউজড। হুটহাট কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কিন্তু উনি সরাসরি বলে দিয়েছেন, আমাকে ডিভোর্স দেবেন। তাহলে তাই-ই হোক। আমিও বিনা সংকোচে মেনে নেবো।”
“কিন্তু তোদের ঝামেলার মূল কারণটা আমার খুব লেইম লাগে রে রিদি।”

“লেইম তোর কাছে। আমার কাছে এটা ছোটোখাটো ব্যাপার নয়। বিয়ের প্রথম দিনে উনি একটা কথা আমাকে ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমার চাইতে উনার কাছে দেশ বড়। এই দেশ কী দিয়েছে উনাকে? এই দেশের গুরুত্ব সর্বোচ্চ হওয়ার জন্য কোনো কারণ দেখা আমাকে! উনি আমার গুরুত্বটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। একটা মানুষকে কাছ থেকে না দেখলে চেনা যায় না, জানাও যায় না। বিয়ের আগে উনাকে আমি যতটুকু দেখেছি, দূর থেকে। শ্রদ্ধার নজরে দেখেছি। উনার সম্পর্কে খুবই কম জেনেছি। সেখানে উনার মনোভাবের কথা জানা আমার জন্য কী খুব সহজ ছিল? তারপর বিয়ের পরবর্তী সময়ে যখন আমি স্ত্রীর অধিকার এবং সম্পর্কের গুরুত্ব নিয়ে এগিয়ে গেলাম, তখন উনি ইগো দেখিয়ে দূরে সরে গেলেন। আর আমার সাথে কি করেছিলেন, তা তো না-ই বলি!”
“কী করেছে রে? কিছু হয়েছে তোদের মধ্যে?”

সাইফা রিদির সামনাসামনি এক হাতের মতো দূরত্ব রেখে বসেছিল। এবার ও দ্রুত এগিয়ে এসে রিদির হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে প্রশ্নটা করলো। রিদি উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
“সর তো। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর পার্সোনাল ম্যাটার৷ তোর শুনতে হবে না। ভালো আছিস, ভালো থাক।”
“তারমানে সত্যিই তোদের মধ্যে কিছু হয়েছিল! তাহলে তুই এই সম্পর্ক শেষ করবি কীভাবে রিদি? যেখানে তোর…”
“চুপ! চুপ কর। আর কিছু বলিস না। আমি এসব প্যারা এখন মোটেও নিতে চাচ্ছি না সাইফা। এক্সামটা ভালোভাবে দিই। আর বেশিদিন সময় নেই হাতে। রেজাল্ট ভালো না হলে আমার মেডিকেল, পাবলিক ভার্সিটি কিছুতেই চান্স হবে না।”

সাইফা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললো,
“তোর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নিস রিদি। তোর জন্য আমার বড্ড চিন্তা হয়। আমার খালামণির মতো দুর্ভাগা কপাল তোর না হোক—এই দোয়া করি।”
“ছাগল লাগে তোর আমাকে? ওই লোক বেশি ত্যাড়ামি করলে ডিরেক্ট নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে দেবো। তখন চাকরিও যাবে, বউও যাবে আর সব ভাবও ফটে যাবে।”
সাইফা তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো রিদির কথা শুনে৷ অবাক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
“তাই বলে দুলাভাইয়ের নামে নারী নির্যাতনের মামলা দিবি তুই? ক্যান রে? দুলাভাই তোকে কিছু করেছে? তোরা তো একসাথে থাকলিই না কখনো।”

“কী করেছে সেটা আমি বানিয়ে নেবো। এই দেখ, উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে মে’রেছিল। তারপর কেটে গেছে। আরো তো কত কিছু আছে। এটা জাস্ট একটা স্যাম্পল। ঠিক আছে না?”
কথাটা বলে ফ্রকের হাতা উঠিয়ে কনুইতে একটা কাটা দাগ দেখালো। সাইফা হতভম্ব হয়ে বললো,
“কিন্তু এইটা তো সেদিন হোঁচট খেয়ে পড়ে টিনে কেটে…”
“ওইযে বললাম না? বানিয়ে নেবো? ওই লোক শেয়ানা হলে আমি সের শেয়ানা। আমাকে মচকাতে পারবে, ভাঙতে না। ব্যাটা মানুষকে এভাবেই শিক্ষা দিতে হয়। আর যদি স্বামী হয় ডিফেন্সের, তাহলে মনে করবি এদেরকে উচিত শিক্ষা দিতে আরো বেশি সুবিধা আছে।”

“আচ্ছা শোন, মন খারাপ করিস না।”
“কে মন খারাপ করছে? বিন্দাস আছি আমি।”
“তাহলে চল, ঘুরে আসি একটু।”
“না, এখন বেরোতে ইচ্ছা করছে না।”
“আরে চল না। কয়েকদিন পর তো এমনিই বেরোনো হবে না। পরীক্ষার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বো৷ আজকে বরং পশ্চিমপাড়ার ওদিক থেকে আজিজ চাচার ফুচকা খেয়ে আসবো। অটোতেই তো যাবো৷ বেশি সময় লাগবে না। আধা ঘণ্টায় ঘুরেফিরে চলে আসতে পারবো।”
রিদি এবার রাজি হয়ে বললো,
“আচ্ছা, আমি আম্মাকে বলে আসি তাহলে।”
রিদি রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ফিরলো মিনিট তিনেকের মধ্যে। ঘরে এসে বললো,
“আম্মা যেতে দিতে রাজি হয়েছে। আমি রেডি হই তাহলে।”

আজ লেফটেন্যান্ট আরবিন কয়েকজন জুনিয়র সেনা অফিসারদের আইটি ও সাইবার সিকিউরিটির ওপর ট্রেনিং দিচ্ছে। যেহেতু আরবিনের অভিজ্ঞতা বেশি, তাই বেশিরভাগ সময়ই এই কাজের দায়িত্ব ইউনিট কমান্ডার ওকেই দেন।
আরবিন নতুন জুনিয়র সেনা অফিসারদের ট্রেনিংয়ের প্রথম দিনেই বুঝালো, যুদ্ধক্ষেত্র এখন আর শুধু মাটিতে সীমাবদ্ধ নেই; এটি ছড়িয়ে পড়েছে ভার্চুয়াল জগতেও।
আরো বিস্তারিতভাবে বুঝাতে আরবিন বললো,
“তোমরা এখন দেশের ডিজিটাল ঢাল। এই যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের অস্ত্র হবে কোড এবং শত্রু হবে অদৃশ্য।”
বেসিক ক্লাসের পর ট্রেনিং শুরু হলো সাইবার অ্যাটাকের ধরন চেনা দিয়ে। প্রথম ক্লাসে তারা শিখলো ফিশিং অ্যাটাক, ম্যালওয়্যার এবং ডেটা ব্রিচের কৌশল। আরবিন বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলো, কীভাবে একটি ছোট্ট ভুল পুরো একটা সিস্টেম ভেঙে দিতে পারে।
মূলত, এই জগতে শত্রুরা খুবই কৌশলী। তবে একটি শক্ত কোডই একটি শক্তিশালী দেশ। আর এটাই নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র
ক্লাসের এক ফাঁকে অফিসার তাহসিন জিজ্ঞাসা করলো,

“স্যার, আমরা যদি কখনো সাইবার অ্যাটাকের সম্মুখীন হই; তখন কী করবো?”
আরবিন হালকা হেসে বললো,
“প্রথমত, আতঙ্কিত হবে না। দ্বিতীয়ত, আগের দিন যেসব প্রটোকল শিখেছ, সেগুলো অনুসরণ করবে। তৃতীয়ত, শত্রুর কোড ভেঙে তাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করবে।”
আরবিন আরো কিছুক্ষণ ট্রেনিং ক্লাস করিয়ে তারপর ক্লাস শেষ করে দিলো। ক্লাসরুম থেকে বের হওয়া মাত্রই আরবিনের ফোন ক্রিংক্রিং শব্দে কেঁপে উঠলো। সুক্ষ্মভাবে ফোনটা খাকি প্যান্টের পকেট থেকে বের করে ফোন স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখলো। আরবিনের আম্মা কল দিয়েছেন। আজও ডিউটি টাইমে আম্মার কল। আরবিন বুঝলো, নিশ্চয়ই কোনো জরুরি বিষয় হবে। তাই সঙ্গে সঙ্গেই কল রিসিভ করলো ও। কল রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে যেন ঝড় বয়ে গেল। অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি, আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আরবিন ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছে না ওর আম্মার কথা। কি যেন বলছেন তিনি। আরবিন এবার হালকা কেশে গলা ঝেড়ে বললো,

“হ্যালো আম্মা? কি বলছেন? কিছু শোনা যাচ্ছে না।”
এবার আফসানা বেগম একপাশে সরে গিয়ে জোরে জোরে চেঁচিয়ে বললেন,
“হ্যালো আব্বা। রিদি.. রিদি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে! ওকে ইমিডিয়েট হসপিটালে আনা হয়েছে। আমি খবর পেয়ে মাত্র হসপিটালের সামনে এসে নেমেছি। ভেতরে যেয়ে তোমাকে জানাবো। কল রাখছি এখন। অবস্থা গুরুতর হয়তো।”
আফসানা বেগম রীতিমতো হাঁপাচ্ছিলেন। নিঃশ্বাস আঁটকে আঁটকে আসছিল তার। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। যেন ভীষণ তাড়াহুড়োয় আর শঙ্কিত হয়ে আছেন। তার কথার ধারেই তা স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছিল। মায়ের কল কেটে দেওয়ার পরেও আরবিন কিছুক্ষণ ফোনটা কানে চেপে ধরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। যেন বোবা হয়ে গেছে ও। বুকে দুরুদুরু কম্পন হতে লাগলো। হৃৎস্পন্দন মুহুর্তের মধ্যে মাত্রা ছাড়িয়ে বেড়ে গেল। আরবিন আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না সেখানে। মাথা কাজ করছে না ওর। উদ্দেশ্যহীনভাবে দ্রুত হাঁটা দিলো ক্যান্টনমেন্টের দিকে।
আরবিন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যভাবে হেঁটে চলেছে। মূল অফিসের সামনে এসে দাঁড়াতেই সহকর্মী জাহিনের সাথে দেখা হলো। আরবিনকে উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পরিপাটি ভাব হারিয়েছে৷ চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাতের মুঠো শক্ত করে অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ও৷ জাহিন আরবিনের এমন অবস্থা দেখে হতচকিত হলো। রীতিমতো ভয়ও হলো। স্যার কি আবার কারো ওপর ক্ষেপলেন নাকি! নিশ্চয়ই কেউ কোনো কাজে উল্টোপাল্টা ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। জাহিন মনে করার চেষ্টা করলো, ও কিছু করেছে কিনা। যখন নিজের কোনো ভুল বা দোষ মনে পড়লো না; তখন জাহিন নিশ্চিন্ত হয়ে ভদ্রভাবে আরবিনকে প্রশ্ন করলো,

“স্যার? কিছু কী হয়েছে?”
আরবিন এবার সরাসরি জাহিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“আবদুল মুহিত স্যার কী ইউনিট হেডকোয়ার্টারে আছেন জাহিন?”
“ইয়েস স্যার। তিনি আছেন। আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো বেরোবেন। দেখলাম, ড্রাইভারকে কল করে গাড়ি বের করার কথা বলছিলেন।”
“ওকে!”
আরবিন কথা বাড়ালো না। এখন ওর হাতে খুব বেশি সময় নেই। কারো সাথে সৌজন্যতা দেখানোও জরুরি নয় এই মুহূর্তে। আরবিন সোজা কমান্ডার আবদুল মুহিদ স্যারের অফিসের দিকে হাঁটা ধরলো৷ এর আগে এই মানুষটাকে কখনো এতোটা উদভ্রান্ত লাগেনি।

ইউনিট কমান্ডার আবদুল মুহিত স্যারের অফিস রুমে তার সামনে দুই হাত পেছনে মুড়ে স্ট্রেইটলি দাঁড়িয়ে আছে আরবিন। প্রফেশনাল লাইফে দেড় যুগ পার করে ফেলা আবদুল মুহিত রিমলেস চিকন গ্লাসের চশমাটা ঠিক করে আরবিনের দিকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে চেয়ে আছেন। আরবিন সরাসরি আবারও বললো,
“স্যার, আমার ইমিডিয়েট আজ-ই, এখুনি ছুটি প্রয়োজন। এখন ছুটিটা কীভাবে পাবো, সেটা আপনি দেখবেন।”
কমান্ডার আবদুল মুহিত চশমাটা হালকা নামিয়ে আরবিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“লিখিত আবেদনপত্র কোথায়?”
আরবিন এবার থমকালো। এই সময়েও রুলস এন্ড রেগুলেশনস! ও ধাতস্থ হয়ে জবাব দিলো,
“স্যার সিচুয়েশন আউট অফ কন্ট্রোল। হাতে একটুও টাইম নেই। ইমিডিয়েট আমাকে ঢাকায় ফিরতে হবে। আমার ওয়াইফ অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।”
“ওহ নো! কীভাবে?”

“আই ডোন্ট নো স্যার। আমি জাস্ট জেনেছি, ও অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। সিরিয়াস কন্ডিশন!”
“কিন্তু বাবা, তোমাকে তো রিসেন্টলি একটা অপারেশন পরিচালনাকারী টিমের আইটি এন্ড সাইবার সাপোর্টের জন্য ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেটার কি হবে?”
“কলিগ নয়তো কোনো ডেপুটি অফিসারকে আমার অ্যাবসেন্সে ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্ব দিতে পারেন স্যার। বাট আমার এখন কোনোকিছু ভাবার সময় নেই। দু’দিনের ছুটি চাইছি। বেশিদিন তো নয়।”
“কিন্তু এভাবে হুটহাট ছুটির অ্যাপ্লিকেশন অ্যাপ্রুভ করাটা আমার জন্য তো খুব টাফ ব্যাপার আরবিন। মনে রেখো, আমার ওপরেও অথোরিটি আছে। আমিই শেষ নই। আর এসব সেন্সিটিভ ইস্যু। খুব বেশিদিন হয়নি তুমি জব জয়েন করেছো। তাছাড়াও তোমার ওপর একটা আইটি টিমের ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্ব রয়েছে। অর্থাৎ, তোমার ডিউটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

আরবিন এবার টেবিলে হাত রাখলো৷ কণ্ঠস্বর কিছুটা খাদে এনে আবদুল মুহিতকে বললো,
“স্যরি স্যার, বাট প্রফেশন এন্ড ডিউটির বাইরে গিয়ে একটা কথা বলতেই হচ্ছে, আপনার কী ঘরে বউ নেই?”
আবদুল মুহিত মুচকি হাসলেন এমন পরিস্থিতিতেও। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে আরবিনের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“তোমাকে বাজিয়ে দেখতে ভালো লাগে। এমনি এমনি কী আর ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্ব তোমার ওপর ছেড়ে দিয়েছি এতো অল্প ক’দিনের মধ্যে?”
আরবিন কিছুটা রাগও হলো। এমন পরিস্থিতিতেও স্যারের বাজিয়ে দেখতে হবে! যদিও প্রফেশনের বাইরে গিয়ে ইউনিট কমান্ডার আবদুল মুহিত স্যারের সাথে ওর বেশ ভালো একটা সম্পর্ক। প্রায়-ই তারা একসাথে বসে চা-কফির আড্ডা দেয়। সমসাময়িক নানান বিষয়ে আলাপ-আলোচনাও হয় তাদের মধ্যে। মূলত আরবিনের দৃঢ় অবস্থান-ই কমান্ডারকে ওর প্রতি মুগ্ধ হতে বাধ্য করেছে।
আবদুল মুহিত এখন বের হবেন। যাওয়ার আগে তিনি আরবিনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললেন,

“তবে লেফটেন্যান্ট আরবিন, তিন মাসের এই মোটামুটি দীর্ঘ সময়টাতে আমি কিন্তু তোমাকে আজ পর্যন্ত কখনো এতোটা উদভ্রান্ত আর উদগ্রীব দেখিনি। একটু সামলে হ্যাঁ? কারণ, তুমি যেই প্রফেশনে আছো, সেখানে কাছের মানুষদের প্রতি টান তো দূর; নিজের জীবনের মায়া ছেড়ে সামনে এগোতে হবে। বুঝেছো?”
আরবিন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“ইয়েস স্যার!”

আরবিন দাঁড়িয়ে আছে ইবনে সিনা হাসপাতালের দোতলার একটা কেবিন রুমের সামনে। সারারাত বাস জার্নি করে এসে ভোরে পৌঁছেছে ও। ক্লান্তির ছাপ চোখে-মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো। পরনে খাকি প্যান্ট আর জলপাই রঙের একটা টি-শার্ট। বাঁহাতে বরাবরের মতোই আর্মি ওয়াচটা অবস্থান করছে। আরবিন ঠোঁটে ঠোঁট চেপে উদভ্রান্তের ন্যায় তাকিয়ে আছে। আশেপাশে আর কাউকে দেখছে না। সিলেট থেকে রওয়ানা হয়েছিল রাতের দিকেই। সেসময় ওর আম্মার সাথে মাত্র দুই মিনিটের জন্য একবার কথা হয়েছিল। তখন আফসানা বেগম তাড়াহুড়োয় জানিয়েছিলেন, তিনি হসপিটালেই আছেন। সবাই উপস্থিত আছে এখানে। তারা ইবনে সিনা হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার একটা কেবিন ভাড়া করেছেন।

আরো কিছু বলার আগেই ফোন কেটে যায়। তবে আরবিনের ফোনে চার্জ না থাকায় ও আর যোগাযোগ করার সুযোগ পায়নি। জার্নিটা সম্পূর্ণ রাতের এবং আরামদায়ক হলেও সারারাত আরবিনের ঘুম হয়নি। এখানে এসে রিসিপশনে ইনফরমেশন দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই তারা রিদিকে যেই কেবিনে রাখা হয়েছে, সেই কেবিন নাম্বার জানিয়ে দেয়। তবে কেবিন রুমের সামনে এসে কাউকেই চোখে পরছে না আরবিনের৷ অস্বস্তি আর অস্থিরতার দরুণ নিঃশ্বাস আটকে আসছে ওর। তখনই দোতলার ডান দিকের বারান্দা হতে সোহরাব হোসেন আর তিতাসকে আসতে দেখা গেল। আরবিনকে দেখে চরম আশ্চর্য হয়েছেন সোহরাব হোসেন আর তিতাস। সোহরাব হোসেন এগিয়ে আসতেই আরবিন বললো,

“আসসালামু আলাইকুম আব্বু।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি এখানে যে বাজান? কখন আসলে?”
“বিকালে খবর পেয়ে রাতেই রওয়ানা দিয়েছিলাম। মাত্র এসে পৌঁছালাম। সবাই কোথায়?”
“সবাই মানে তোমার আম্মা, শাশুড়ী আর মহিলাদের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমার আব্বা ছিলেন অনেকক্ষণ। তিনি একটু বাইরে বেরিয়েছেন। কিন্তু তুমি যে আসবে, তা তো আশা করিনি।”
“কেন আব্বু? আমার কী আসা উচিত হয়নি?”
“না ঠিক তা নয়। তবে অবস্থা তো আহামরি গুরুতর কিছু না।”
“মানে? আম্মা যে ফোনে বললো, গুরুতর অবস্থা!”
“তোমার আম্মা বলেছেন?”
আশ্চর্য হয়ে প্রশ্নটা করলেন সোহরাব হোসেন। আরবিন জবাব দিলো,

“জি। আম্মা-ই তো গতাকাল বিকালে ফোন করে এমনভাবে বললেন, যাতে আমার আসতেই হলো৷”
“ওহহ বুঝেছি। আসলে ভুল মানুষের না। পরিস্থিতির৷ সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। নাহলে তোমাকে এতোদূর কষ্ট করে আসতে হতো না এসময়ে। না আসলেও চলতো।”
শ্বশুরের কথা শুনে আরবিন কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
“মানে?”
সোহরাব হোসেন জবাব দিলেন,

“মানেটা বুঝতে পারবে। মেয়ে আমার কেবিনের ভেতরে আছে। ঘুমাচ্ছে এখন। হাই ডোজের মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। ভেতরে যাও। ওকে দেখো, বুঝতে পারবে।”
আরবিন আর কোনো কথা বললো না। সামনের কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। চোখের সামনে কেবিনের বেডে আলতোভাবে চোখ বুঁজে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে অজানা কারণে এতোক্ষণের বুকের মাঝে জ্বলতে থাকা জ্বলন্ত লাভা যেন নিমিষেই নিভে গেল। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে গেল আরবিন। একপাশে একটা চেয়ার রাখা ছিল। চেয়ারটা আস্তে করে টেনে নিয়ে রিদির সামনে বসলো। রিদির পায়ে, মাথায় আর ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা। রিদির শরীরের দিকে তাকিয়ে ভালোভাবে খেয়াল করে যা বোঝার বুঝে নিলো আরবিন৷ জ্বলতে থাকা হৃদয়ে প্রশান্তি নেমে আসলো যেন।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ও৷ ব্যান্ডেজ করা ওই হাতটা কোমলভাবে নিজের শক্তপোক্ত হাতের মুঠোয় টেনে নিলো আরবিন। চোখ-মুখ আবারও লাল, উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ওর। স্থির চাহনিতে রিদির ফ্যাকাশে মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো নির্লিপ্তভাবে। ধীরেধীরে এগিয়ে গেল আরবিন। গতকাল বিকাল থেকে আজ সারারাত খায়নি কিছুই। এমনকি এক গ্লাস পানিও না। রিদির মুখের কাছে মুখ এগিয়ে নিলো আরবিন। শুষ্ক ওই কোমল ঠোঁটজোড়াতেই এতক্ষণ নজর ছিল ওর।

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১৫

এবার নিজের সিগারেটে পোড় খাওয়া ওষ্ঠদ্বয় তাতে মিশিয়ে দিলো আরবিন। ঠোঁটের আলিঙ্গন আরেকটু গাঢ় হলো৷ ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁটের স্পর্শ দৃঢ় হতে লাগলো মুহূর্ত বাড়ার সাথে সাথে। দীর্ঘ সময় পরে আরবিন ওই ঠোঁটজোড়া ছেড়ে পুনরায় চেয়ারে স্থির হয়ে বসলো। এবার নাক, চোখ-মুখের সাথে ঠোঁটও লাল বর্ণ ধারণ করেছে ওর। রিদির শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে দিয়ে যেন পরম শান্তি পেয়েছে আরবিন৷ ওই ভেজা ঠোঁটের দিকে চেয়েই ফিসফিসিয়ে ও বলে উঠলো,
“এই মেয়ে নির্ঘাত আমাকে মে’রে ফেলবে একদিন!”

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ১৭