নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২১

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২১
ঝিলিক মল্লিক

ঘড়ির কাটায় রাত আটটা বেজেছে সবে। রিদি তাড়াহুড়ো করছে ভীষণ। ওদিকে রান্নাঘরে ওর আম্মা রান্নার কাজে ব্যস্ত। সোহরাব হোসেন এসে বাজার দিয়ে আবার বেরিয়েছেন দই-মিষ্টি আনতে। হালিমা খাতুনকে কল করে আসতে বলেছেন তানিয়া বেগম। মেয়ে আজ-ই শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবে, হালিমা খাতুন না থাকলে হয় না। তাই হালিমা খাতুন ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রওয়ানা দিয়েছেন।

রিদি একাই শাড়ি পরেছে। সবসময় ওর আম্মা পরিপাটিভাবে পরিয়ে দিলেও ও নিজে একেবারে খারাপ পারে না। রিদি ওর আব্বাকে বলে দিয়েছে, যেন আসার সময়ে একটা বেলি ফুলের গাজরা আনেন তিনি।
রিদি শাড়ির কুঁচি ধরে অতি সাবধানে হেঁটে রান্নাঘরে গিয়ে ওর মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তানিয়া বেগম তরকারি চড়াতে ব্যস্ত। রিদি “আম্মা” বলে ডাক দিতেই ফিরে তাকালেন তানিয়া বেগম। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। কিছু বলতে যাবেন, তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। রিদি আর দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। ওর আব্বা এসেছে। রিদি এদিক-ওদিক চেয়ে অনুসন্ধান করে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“গাজরা এনেছো আব্বু?”
সোহরাব হোসেন পেছনে রাখা হাতটা সামনে এনে একটা প্যাকেট রিদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“এই নাও আম্মা। তোমার গাজরা।”
রিদি প্যাকেট খুলে গাজরাটা দেখলো৷ একদম ওর মনের মতো। এবার পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর আব্বার হাতে গাজরাটা দিয়ে বললো,
“আব্বু, খোঁপায় পরিয়ে দাও তো গাজরাটা।”
সোহরাব হোসেন এসব কাজে দক্ষ নন। তবে মেয়ের আবদার রাখতে অদক্ষ হাতেই ধীরেসুস্থে গাজরাটা পরিয়ে দিলেন তিনি। রিদির চোখেমুখে দারুণ উচ্ছ্বাসতা। ও ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি আয়নায় দেখে আসছি আব্বু।”
কথাটা বলেই ঘরের দিকে ছুট লাগালো রিদি।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরে ফিরে কয়েকবার দেখলো রিদি। না! সবদিক থেকে পারফেক্ট। যা বলা হয়েছে, তার পুরোপুরি উল্টোটা করতে পেরেছে। মনে মনে নিজের বিজয় উপলব্ধি করে ভীষণ আনন্দিত হলো রিদি।
তখনই আবারও কলিংবেল বেজে উঠলো। রিদি ভাবলো, ওর আব্বু গিয়ে সদর দরজা খুলে দেবেন। কিন্তু পরপর আরো কয়েকবার কলিংবেল টানা বাজতে থাকায় রিদি ঘর থেকে বেরিয়ে নিজে গেল দরজা খুলতে।

সদর দরজা খুলতেই সামনে আরবিনের পরিবারের সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্রতাসূচক হালকা হাসলো ও। তারপর-ই শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে বললো। আরবিনের আব্বা-আম্মা ভেতরে চলে আসতেই আরবিনকে দেখা গেল এবার। আরবিন দরজার সামনে সাদা একটা শার্ট আর ডিপ এ্যাশ রঙা ডেনিম ফেব্রিক্সর প্যান্ট পরিহিত দুই হাত পকেটে রেখে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্রেইটলি। রিদি আরবিনকে দেখে ঠোঁট চেপে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরে ধীরে আরবিনের চোখের দিকে তাকাতেই বুক ধ্বক করে উঠলো ওর। হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো। আরবিনের চোখ-নাক লাল হয়ে গেছে। রেগে গেলেই বুঝি এমন হয়! এর আগে আরবিনকে কখনো এতোটা রেখে যেতে দেখেনি রিদি। হ্যাঁ, রাগ সে স্বচক্ষে বহুবার দেখেছে। বলা যায়, আরবিন তার রাগ শুধুমাত্র রিদিকেই হয়তো দেখিয়েছে। এর বাইরে প্রফেশনাল লাইফে দেখালেও দেখাতে পারে। তবে সে বিষয়ে খুব বেশি জানা নেই রিদির। আরবিন দাঁতে দাঁত চেপে রিদির দিকে কিছুটা এগোলো। শাড়ির আঁচল গলিয়ে ওর হাতের কব্জি চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,

“জর্জেট শাড়ি পড়েছো কেন তুমি? আর জামদানী ব্লাউজ.. তুমি! এই মুহূর্তে তোমাকে থাপড়াতে পারলে খুব শান্তি পেতাম। এখুনি ঘরে গিয়ে এই শাড়ি, ব্লাউজ চেঞ্জ করে সুতির শাড়ি আর ব্লাউজ পরবে।”
রিদি তৎক্ষণাৎ মুখের ওপর জবাব দিলো,
“পারবো না! আমার শরীর, যা কিছু পরবো; আমার মর্জি। আপনি বলার কে?”
“বেয়াদব! তুলে একটা আছাড় মারবো। সবজায়গায় ঘাড়ত্যাড়ামি না করলে চলে না, তাই-না? একবার জাস্ট বাড়িতে চলো, তোমার সব ত্যাড়ামি আর তেজ ছুটিয়ে দেবো।”

রিদি পাল্টা মুখ ভেংচি দিলো। ভাবখানা এমন — ভয় পাই নাকি! আরবিন আরো শক্ত করে রিদির হাতের কব্জি চেপে ধরেছে। রিদির চরম অস্বস্তি হচ্ছে। রাগও উঠছে। আশেপাশে কেউ নেই। সদর দরজার পরে সরু বারান্দা পেরোলে তারপর-ই ড্রয়িংরুম৷ আরবিন এবার আশেপাশে দেখে কিছুটা ঝুঁকলো। রিদির ঠোঁটে গাঢ় ডার্ক খয়েরী লিপস্টিক। নিচু হয়ে রিদির ঠোঁটের সামনে মুখ এগোলো আরবিন। কিছু একটা করতে যেয়েও করলো না। পকেট হতে টিস্যু বের করে কাছাকাছি এগিয়ে রিদির ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে দিলো ধীরে ধীরে। রিদি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো আরবিনের দিকে। আরবিন একদম ওর কাছাকাছি। দু’জনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে একাকার। রিদি চরম আড়ষ্টতায় নুইয়ে গেছে। নিজের রাগ-জেদের কথাও ভুলে গেছে আপাতত।
আরবিন মুখ উঠিয়ে ওকে দেখলো একনজর। সরু চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর ওর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

“রিল্যাক্স। আমি-ই তো। এখন কিছু বলবো না৷ তোমাকে পরে দেখে নেব।”
রিদিকে পেছনে ফেলে রেখে আরবিন বসার ঘরের দিকে হাঁটা দিলো। মনে একরাশ রাগ-ক্ষোভ আর জেদ পুষে রেখে রিদি ওর পেছন পেছন গেল। নিজের ঘরে যেতে হবে। আবারও অকাজটা করতে হবে। মাথার ভেতরে শয়তানি বুদ্ধি ঘুরঘুর করছে। কে যেন কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলছে,
“তুই আরবিনের কথা শুনবি না রিদি। লিপস্টিক মুছে দিয়েছে না? এবার আরো গাঢ় করে লিপস্টিক দিবি। শাড়ি, ব্লাউজ তো কোনোমতেই চেঞ্জ করবি না!”
রিদি করলোও তাই। বসার ঘরে সবাইকে একঝলক দেখে একফাঁকে নিজের ঘরে চলে গেল ও। ওর কাকিমণি এসেছে মাত্র। রিদির ঘরেই বসেছিলেন তিনি। রিদিকে ঘরে ফিরতে দেখে হালিমা খাতুন বললেন,
“কি রে মা? তোর জামাকাপড় সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিস? জরুরি কাগজপত্রগুলো? পরে তো দরকার হবে।”
“হ্যাঁ কাকিমণি। মোটামুটি সবকিছুই গুছিয়ে নিয়েছি। তা-ও একবার তুমি দেখো তো, সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা?”
হালিমা খাতুনের সামনে বিরাট বিরাট লাগেজগুলো টেনে নিয়ে আসলো রিদি। হালিমা খাতুন লাগেজদুটো খুলে ভালোভাবে চেক করে নিলেন, সবকিছু ঠিক আছে কিনা। তারপর রিদির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“শাড়ি নিসনি একটাও?”
“শাড়ি নিয়ে কী করবো?”
“ওমা ও কি কথা! তুই কী এক-দুইদিনের জন্য যাচ্ছিস নাকি? সারাজীবনের জন্যই তো চলে যাচ্ছিস। দরকারি জিনিসপত্র নিবি না সব? শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর থেকে তো শাড়ি-ই পরতে হবে বেশিরভাগ সময়।”
কাকিমণির কথা শুনে এবার ধ্যান ভাঙলো রিদির। আসলেই তো! ও এতোক্ষণে একবারও ভেবে দেখেনি যে, ও বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাচ্ছে একেবারে। এরপর এখানে আসলেও আসতে হবে অতিথি হয়ে, থাকতে হবেও সেভাবেই। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি-ই হয়ে ওঠে মেয়েদের চিরস্থায়ী বাড়ি। যদিও এই সংজ্ঞায় রিদি বিশ্বাসী নয় মোটেও। তবে বাস্তবতা মেনে না নিয়েও কোনো উপায় নেই।
রিদি এবার ফ্লোরে বসলো হালিমা খাতুনের পাশে। তার কাঁধে দুই হাত রেখে বললো,

“এসব বাদ দাও তো কাকিমণি৷ দেখি এদিকে ফেরো তুমি। মুখ শুকনা লাগে কেন তোমার? খাওয়া-দাওয়া করো না ঠিকমতো? নাকি চিন্তা করো সারাদিন-রাত?”
“আমার কী আর চিন্তার শেষ আছে রে মা? তিতাসের পড়াশোনার ঝক্কি। জামিয়া বড় হচ্ছে। ওর বিয়ে-শাদি দিতে হবে। কত চিন্তাভাবনা! তোর কাকাই থাকলে তো আমাকে এতো দুশ্চিন্তা করতে হতো না। বাপহীন ছেলেমেয়েদের মানুষ করা খুব কঠিন। সবাই বোঝে না।”

হালিমা খাতুন হালকা হাসার চেষ্টা করে কথাগুলো বললেও তার সামান্য দীর্ঘশ্বাস-ই যেন কতকিছু বলে দিতে চায় অকপটে। রিদি নিষ্পলক চাহনিতে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে ওর কাকিমণিকে। মানুষটা এমনিতেও ছোটোখাটো, তারওপর দুশ্চিন্তা আর পরিশ্রম করে করে শরীরে অজস্র রোগ বাঁধিয়েছে। রোগা হয়ে গেছে ভীষণ। রিদি এবার ওর কাকিমণির গালে এক হাত রেখে বললো,
“তোমাকে একটা অনুরোধ করি?”
হালিমা খাতুন বিচক্ষণ মানুষ। তিনি যেন বুঝতে পারলেন, রিদি কি বলতে পারে। তাই কিছুটা রাশভারী আওয়াজে বললেন,

“রাখার মতো হলে কর।”
রিদিও নাছোড়বান্দা। সহসা জবাব দিলো,
“রাখারা মতোই। তুমি এবার একটা বিয়ে করেই নাও না কাকিমণি। জামিয়া আর তিতাসের জন্য হলেও। তাছাড়া তোমার বয়সও তো কম। এজন্য বল..”
“এধরনের কথা আর কখনো বলবি না রিদি। তাহলে কিন্তু আমাকে এখানে আসাও বন্ধ করতে হবে।”
হালিমা খাতুন রিদিকে থামিয়ে দিয়ে শক্ত গলায় কথাটা বলতেই রিদি সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেল। নতমুখে বসে রইলো। হালিমা খাতুন এবার শক্ত থেকে নরম হলেন। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিষন্ন সুরে বললেন,
“আমি তো তোর কাকার নামেই বাঁচতে চাই রে মা। তোরা সবাই কেন বুঝিস না বল তো? তোরা আমার ভালো চাইতে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বলিস। কিন্তু আমার ভালো যে আসলে কিসে হবে, কিসে যে আমি ভালো থাকবো; তা তোরা কেউ বুঝতে পারিস না। ওই মানুষটাকে আমি খুব ভালোবাসতাম রে।”
“আমি জানি কাকিমণি৷ তুমি কাকাইকে খুব ভালোবাসতে৷ তুমি তো স্বার্থপর হতে পারোনি৷ কিন্তু কাকাই পেরেছিল। কাকাই তোমার ভালোবাসার উর্ধ্বে দেশের প্রতি ভালোবাসাটাকে আগে রেখেছিল। এজন্য আজ তোমাদের এই অবস্থা। আমার সহ্য হয় না কাকিমণি। বিশ্বাস করো, তোমার কান্না আমি সহ্য করতে পারি না। কেন এমন হলো বলো তো?”

হালিমা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো রিদি। আর কত সহ্য করা যায়! এতটুকু একজন মানুষ এই অল্প বয়সে আর কত সহ্য করবে! হালিমা খাতুন অনেক অল্প বয়সেই স্বামীহারা হয়েছেন। সেই থেকে দুই সন্তান নিয়ে তার কি ভয়াবহ সংগ্রাম৷ রিদি নিজ চোখে প্রতিটা মুহূর্তে দেখেছে সবটা, উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই ওর এতো বিতৃষ্ণা এই পেশার প্রতি।
হালিমা খাতুন এবার চোখ মুছে উঠে রিদিকে ঠেলে বললেন,
“চল, ড্রয়িংরুমে যাবি৷ তার আগে সাজ ঠিক করে নে।”
রিদি ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ালো। সাজ আহামরি কিছুই না৷ তবে পরিপাটি ভাবটা আর আগের মতো নেই।
রিদি আবারও সব ঠিক করে নিলো। এবার আরো গাঢ়ভাবে ডার্ক খয়েরী লিপস্টিক ঠোঁটে দিলো৷ চোখে গাঢ় করে কাজল। শাড়ি, ব্লাউজ পরিবর্তন করলো না।

শোবার ঘরে থেকে বসার ঘরে এসে রিদি দেখলো, সবাই গল্প করছে। রিদিকে দেখতেই আফসানা খাতুন টেনে নিয়ে পাশে বসালেন। আরবিন তিতাসের সাথে তিতাসের পড়াশোনার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল। তিতাসও খুবই বুদ্ধিমান এবং ভালো স্টুডেন্ট। স্বপ্ন — বুয়েটিয়ান হবে৷ যেহেতু আরবিন বুয়েটের স্টুডেন্ট ছিল, তাই তিতাসকে নানান দিকনির্দেশনা এবং পরামর্শ দিচ্ছিল ও। তিতাস এবার এসএসসি দেবে। এরপর কোথায় পড়াশোনা করবে, কোন কোচিং-এ ভর্তি হবে; সেসব বিষয়েই আরবিন ওকে পরামর্শ দিচ্ছিল। ও খেয়ালও করেনি, রিদি এসে বসেছে সামনের সোফায়। ওর কন্ঠ শুনেই ঘুরে তাকালো। রিদিও আরবিনের দিকে তাকালো। হঠাৎ দু’জনের চোখাচোখি হতেই রিদি আড়ষ্ট হলো। আরবিন দাঁতে দাঁত পিষে দেখতে লাগলো। চোখ যেন মুখের কথা বলে দিতে চায় অনেক সময়। আরবিনের ওই উত্তপ্ত চাহনিও এই মুহূর্তে অনেক কিছু বলে দিচ্ছে যেন। পারলে এখুনি রিদিকে গিলে খেয়ে ফেলতো আরবিন— এমন চাহনি ওর। রিদি হতচকিত হয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেললো। পণ করলো, এখানে থাকা অবধি আর একবারও আরবিনের দিকে তাকাবে না।
নিজের প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী স্থির রইলো রিদি। এমনকি রাতের খাওয়ার জন্য ডাইনিং-এ বসেও একবারের জন্যও আরবিনের দিকে তাকালো না। এতে যে বিপরীত পাশের মানুষটা রাগে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তা দেখার সুযোগ রিদির হলো না বৈকি!

রিদি এখন লাগেজটা শেষবারের মতো চেক করে নিচ্ছে। তানিয়া বেগম তাড়াহুড়োয় ছিলেন বেশ। মাত্র মেয়ের ঘরে আসলেন তিনি। বাইরে সবাই তাড়া দিচ্ছে। রাত অনেক হয়েছে। দূরত্ব যানবাহনে মিনিট পঁচিশের পথ হলেও মাইক্রোবাস ভাড়া করা হয়েছে। ড্রাইভার অপেক্ষা করছে নিচে৷
তানিয়া বেগম এসে কোনো কথা বললেন না। কিছুক্ষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলেন রিদিকে। তবে মেয়ের মা হয়েও যথেষ্ট শক্ত রয়েছেন তিনি। চোখে এক ফোঁটাও নোনাপানি নেই। তা দেখে রিদির আরো বেশি অভিমান হলো। একে তো এতো তাড়াহুড়োয় হঠাৎ করে নিজের আপনালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছে ও, তাতে আবার কারো তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই! রিদি এবার কেঁদে ফেললো শব্দ করে। তানিয়া বেগমকে বললো,
“তুমি কাঁদছো না কেন আম্মা? আমি একেবারে চলে যাচ্ছি তো!”

তানিয়া বেগমের হৃদপিণ্ড যেন এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেল রিদির এই কথায়। ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নিলেন। মেয়ের থুঁতনি ধরে মুখ উঠিয়ে বললেন,
“আরে আম্মাজান কাঁদবো কেন? তুমি কী চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছো নাকি? আবার তো দেখা হবে আমাদের সাথে তাইনা?”
তানিয়া বেগম নিজেও জানেন, কথাটা মোটেও সত্যি নয়। আরবিনের সাথে ক্যান্টনমেন্টে চলে গেলে আরবিনের যখন ছুটি হবে, তখনই আসার সুযোগ পাবে রিদি। সবটা কেমন যেন তাড়াহুড়োয় হয়ে গেল! বাস্তবিক দিকটা ভাবলেই বুক ফেটে যাচ্ছে তানিয়া বেগমের। যথেষ্ট শান্ত থেকে রিদিকে বসার ঘর পর্যন্ত নিয়ে আসলেন। সবাই যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল সেখানে। বসার ঘরে আসার আগে হালিমা খাতুনকে শক্ত করে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলো রিদি। হালিমা খাতুন ওর পরিস্থিতি বুঝলেন। তাই অস্থিরতা না দেখিয়ে রিদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিছুক্ষণ।

সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু সোহরাব হোসেন যখন মেয়েকে এগিয়ে দিতে সামনে আসলেন, তখন রিদি নিজেকে মোটেও সামলাতে পারলো না। ধৈর্যের সর্বোচ্চ বাঁধ ভেঙে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। সোহরাব হোসেনের ভেতরটা খাখা করছে। ছোট ছোট আঙুলগুলোকে আঙুলে পেঁচিয়ে যাকে হাঁটতে শিখিয়েছেন, যার প্রতিটা আবদার, অভিমান – অভিযোগ ; সবটাই ছিল তাকে ঘিরে, সেই ছোট্ট মেয়েটাও আজ বড় হয়ে গেছে। সে নাকি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে! মেয়েটাকে আর তেমন দেখা হবে না। ভাবলেই সোহরাব হোসেনের পৌরুষিক কঠিন হৃদয়ের সত্তা ভেতর হতে ভেঙে চৌচির হয়ে যেতে চায়। তবুও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। নিজে গিয়ে মেয়েকে মাইক্রোতে উঠিয়ে দিয়ে আসলেন। লাগেজ তুলে দিলেন টিকিতে।
তারপর সেই মাইক্রোবাসটি রওয়ানা হলো রিদির বিবাহিত জীবন অতিক্রম করার প্রথম ধাপের দিকে।

মাইক্রোবাসের সামনের সিটে বসেছিল আরবিনের আব্বা-আম্মা। আরবিন আর রিদি পেছনের সিটে৷ রিদি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রায় আধশোয়া হয়ে আছে সিটের ওপর। আরবিন ফোন স্ক্রল করতে ব্যস্ত ছিল। রিদিকে আড়চোখে দেখছিল মাঝেমধ্যে। মেজাজ যে আরবিনের মোটেও ভালোর পর্যায়ে নেই, তার স্পষ্ট প্রমাণ ওর নিশ্চুপতা আর নিরবতা। মাঝেমধ্যে কিছু নিরবতা কথার আঘাতের চাইতেও মারাত্মক ভয়ংকর।
রাস্তায় জ্যাম বেঁধেছিল। মাইক্রোবাস এসে আরবিনদের চারতলা বিল্ডিংয়ের সামনে থামলো প্রায় আধাঘন্টা পরে। আরবিন মাইক্রো থেকে নেমে আগেই উঠে চলে গেল ভেতরে। রিদির দিকে ফিরেও তাকালো না। রিদি দিকদিশা না পেয়ে মাইক্রোর ভেতরেই বসে রইলো অসহায়ের মতো। শেষমেশ ওকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করলেন আরবিনের আব্বা-আম্মা। তারা ড্রাইভারকে লাগেজটা চারতলার ফ্ল্যাটে দিয়ে যেতে বলে রিদিকে নিয়ে চলে গেলেন ভেতরে।
রিদির আশংকা হচ্ছে। আরবিনের হঠাৎ কি হলো! এমন চুপ করে থাকার মতো মানুষ তো নয়। যেন ঝড়ের আগের পূর্বাভাস।

আরবিনদের চারতলা ফ্ল্যাটের ভেতরটা এই প্রথম দেখছে রিদি। এর আগে কখনো আসা হয়নি এখানে। ওর শ্বশুর ভেতরের ঘরের দিকে গেছেন। শাশুড়ি এখানে ড্রয়িংরুমে ওকে বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে গেছেন শরবত আনতে। রিদি বসলো না সেখানে। উঠে গিয়ে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আফসানা বেগমকে ডাক দিয়ে বললো,
“আম্মু, এখন আপনার শরবত বানাতে হবে না। আমার পেটে কিছু পরার মতো জায়গা নেই। আপনি বরং ঘরে গিয়ে রেস্ট নেন।”
আফসানা বেগম এগিয়ে এসে অনুরোধ করে বললেন,
“এক গ্লাস শরবত তো মাত্র।”
রিদিও পাল্টা অনুরোধ করে বললো,
“না আম্মু। এখন সত্যিই খেতে পারবো না।”

আফসানা বেগম মেনে নিলেন রিদির অনুরোধ। ওর হাত ধরে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“চলো তোমাকে আমার আব্বার ঘরে দিয়ে আসি। লাগেজ সব ওঘরে রাখা হয়েছে। জামাকাপড় বের করে আলমারিতে রেখো।”
রিদি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। কিন্তু এদিকে ওর মনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দিন। তারওপর আরবিনের এমন আচরণ। ঘরে গেলে আবার কি হয় কে জানে!
দুরুদুরু বুক আর মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা চেপে আরবিনের ঘরে প্রবেশ করলো রিদি৷ আফসানা বেগম আর ভেতরে গেলেন না। বাইরে থেকে বললেন,
“সকালে দ্রুত উঠতে হবে না৷ ক্লান্ত আছো, চিন্তামুক্তভাবে ঘুম দাও।”

আফসানা বেগম যেতেই রিদি পেছনে ঘুরে ঘরটা দেখতে লাগলো। এই ঘরের দুই পাশের দেয়ালে আরবিনের ইউনিফর্ম পরিহিত দু’টো ফটো ফ্রেমে বাঁধাই করে টাঙানো। গোছানো, সুন্দর পরিপাটি একটা ঘর। চোখের শান্তির জন্য এটুকুই যথেষ্ট। রিদির এসব দেখতে দেখতে হঠাৎ খেয়াল হলো, আরবিন নেই ঘরে৷ বাথরুমের দরজা খোলা। তারমানে সেখানেও নেই৷ তাহলে ব্যালকনিতেই হবে। রিদি ব্যালকনির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো, আরবিন দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। এক হাতের দুই আঙুলের ভাঁজে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে তাতে টানও দিচ্ছে কয়েকবার করে৷ ভালোভাবে কান খাঁড়া করতেই রিদি শুনতে পেলো আরবিনের রাশভারী কন্ঠস্বর—

“ফারিয়া, তোমাকে আমি হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়ে রেখেছি। ইমেইলটা ইমিডিয়েট রিসেন্ট করো আমাকে।”
রিদি চমকে উঠলো যেন। হতভম্ব হলো। দুই পা পিছিয়েও গেল। আরবিন না ঘুরেও ওর উপস্থিতি টের পেলো বোধহয়। এবার পেছনে ফিরে তাকাতেই হতচকিত রিদিকে দেখলো ও। আরবিনের চোখে-মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। একদম সহজ-স্বাভাবিক। ঠোঁট হতে সিগারেট নামিয়ে হাতের আঙুলের সাথে চেপে ধরে রিদির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো ও। রিদি আরবিনকে এগোতে দেখে জানালার পর্দা খামচে ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আরবিন এক হাত সমান দূরত্ব রেখে রিদির চোখে চোখ রাখলো। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে রিদির দিকে তাকিয়ে আছে ও। রিদি এবার অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করলো,

“কার সাথে কথা বলছিলেন?”
“হু আর ইউ? তুমি কৈফিয়ত চাওয়ার কে?”
আরবিনের কঠোর আওয়াজে চমকে উঠলো রিদি। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরবিনের উত্তপ্ত চাহনির দিকে। তারপর ধীরে ধীরে জবাব দিলো,
“আপনার স্ত্রী।”
আরবিন চোয়াল শক্ত করে বললো,
“তুমি নিজে মন থেকে মানো? আগে সেটা বলো।”
রিদি নির্লিপ্ত চাহনিতে আরবিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো জবাব দেয় না। ধীরেধীরে মুখ নত করে ফেলে। তা দেখে আরবিনের আরো বেশি রাগ ওঠে। আর এক পা এগোতেই সম্পূর্ণ দূরত্বটুকু ঘুচে যায়। আরবিন সিগারেটটা ফেলে দেয় খোলা জানালা দিয়ে। রিদির গাল দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলে,
“আমি যা বলি সবসময় তার উল্টোটা করো, পারলে আমাকে এড়িয়ে চলো, আমার অবাধ্য হও সবসময়, আমাদের সম্পর্কের কোনো মূল্যায়ন করো না; তাহলে তুমি আমার কেমন স্ত্রী হলে?”
রিদি কোনো জবাব দেয় না। চুপ করে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। আরবিন জবাবের আশায় ওর দিকে কিছুক্ষণ নিরবে চেয়ে থেকে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“ওখানে মুরব্বিরা ছিল। এজন্য জর্জেট শাড়ি চেঞ্জ করতে বলেছিলাম। আমার পছন্দ নয় এটা। গাঢ় ডার্ক লিপস্টিকও না। এমনিতেই ঠিক আছো। তবু কেন তুমি শোনোনি আমার কথা? হোয়াই?”
আরবিনের কথার প্রতিত্তোর করলো না রিদি। নির্লিপ্ততা যেন ঘিরে ধরেছে ওকে৷ আরবিন এবার চেঁচিয়ে বলে,
“কথা বলছো না কেন? বোবা তুমি? তর্ক করার সময় তো খুব পারো ফটর ফটর করতে। এখন কী হয়েছে?!”
রিদি হালকা কেঁপে ওঠে আরবিনের চেঁচামেচিতে৷ ভীতু চোখে তাকায় এবার আরবিনের দিকে। আরবিন একদৃষ্টিতে ওর গালের দুইপাশে একইভাবে হাত রেখে তাকিয়ে থাকে।

পরপরই মুখ এগিয়ে নেয় আরো। সর্বনাশা ঘটনা আবারও ঘটার আকস্মিকতায় রিদি স্থির থাকতে পারে না। হতচকিত চাহনিতে তাকালো আরবিনের দিকে। আরবিন নিজের কাজ করতে ব্যস্ত৷ মাত্র সিগারেট ছোঁয়ানো ওষ্ঠদ্বয়ের পেষনে হৃদয়ে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে রিদির। মনে হচ্ছে, টেনে ধরে কেউ ওকে সিগারেটের ধোঁয়া খাওয়াচ্ছে। আরবিনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চেয়েও পারলো না। আরবিনের কাছে নয়, বরং নিজের কাছে পরাজিত হলো ও। রিদি হিসাব করছে, “টাচ করবে না, টাচ করবে না”— বলেও আরবিন এযাবতকাল পর্যন্ত কতবার ওর কাছে এসেছে আর কতবার ওকে ছুঁয়েছে!

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২০

হিসাব করলে সংখ্যাটা অনেক-ই দাঁড়ায়! এই লোকের মতিগতির অবশ্য ঠিক নেই। আরবিন এবার রিদির ঠোঁট ছাড়ে। তবে গাল যেভাবে দুই হাতে চেপে ধরে রেখেছিল; সেভাবেই ধরে রাখে। আরবিন এবার রিদির চোখে চোখ মিলিয়ে বললো,
“এই মেয়ে, তুমি কী আমাকে ধ্বংস করার জন্য আমার জীবনে এসেছো? বলো!”

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২২