নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৭

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৭
ঝিলিক মল্লিক

সেদিন চড়টা খাওয়ার পর থেকে আরবিনের সাথে আর একটা কথাও বলেনি রিদি। অবশ্য বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। রিদি সেই যে রাতে দরজা আটকালো, তারপর আর আরবিনের মুখোমুখি হয়নি খুব সহজে। আরবিন অবশ্য সেই রাতে দু’বার গিয়ে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে রিদিকে ডেকেছিল, এমনকি নরম গলায় স্যরিও বলেছিল কয়েকবার। তবু এতটুকুও মন গলেনি রিদির৷ তারপর আরবিনও হঠাৎ কেমন দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করলো। আগের থেকে আরো অনেকটা বেশি। ভাবটা এমন, যেন রিদির কোনো কর্মকাণ্ডেই কিছু যায় আসে না ওর। যা খুশি করুক গে।

অবশ্য রিদি করছেও তাই। নিজের মর্জিমতো চলছে। সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। নিয়মিত কোচিং-এ যাওয়া, ক্লাস করা আর শিহাবের সাথে চলাফেরা, ঘোরাঘুরি করা— এটুকুই। এসব রিদি আরবিনকে দেখিয়ে দেখিয়েই করছে। অর্থাৎ আরবিন যেসব করতে নিষেধ করেছে, সেগুলোই বেশি বেশি করছে আরবিনকে ক্ষিপ্ত করার জন্য।
বাসায় বাজারসদাই থাকে সবসময়। আরবিন আর রিদি যে যার মতো নিজেদের রান্নাবান্না করে নেয়। আজ-ও রিদি সকালে নিজের জন্য নাস্তা বানিয়ে বসেছে সবে। আরবিন এখনো বের হয়নি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে বের হবে হয়তো। রিদি উঁকি মেরে একনজর দেখে নিলো, বাইরে আসছে নাকি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

না, আরবিন ঘরেই আছে। রিদি নিশ্চিন্তে সোফার ওপর বসলো৷ শিহাব মেসেজ দিয়েছে। সেটারই নোটিফিকেশন এসেছে ফোনে। ফোনের লক খুলে মেসেজটা পড়লো রিদি। শিহাব লিখেছে—
“আজ আমরা মালিনীছড়া চা-বাগানে ঘুরতে যাবো। তুমি শাড়ি পরো। ফটোগ্রাফি সুন্দর হবে তাহলে।”
রিদি কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে নিল। আজ কোচিং বন্ধ। এখানে একা বোরিং সময় কাটবে। সুতরাং ঘুরতে যাওয়া যেতেই পারে। রিদি শিহাবের মেসেজের রিপ্লাইয়ে জানালো যে, ও যাবে। শিহাব মেসেজ করলো, “তাহলে এখনই রেডি হয়ে থাকো। আমরা একঘন্টার মধ্যে বের হবো।”
রিদি লিখলো,

“আচ্ছা, আমি রেডি হচ্ছি। তুমি নিতে এসো আমাকে।”
শিহাবের মেসেজ আসলো—
“আজ তো আমার ওদিকটায় যেতে একটু অসুবিধা হবে। তুমিই বরং ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া থেকে একটু এগিয়ে এদিকটায় এসো রিকশা নিয়ে। আমি তোমাকে রিসিভ করবো।”
রিদি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে রইলো। মনে অনেকগুলো প্রশ্নও আসলো। শিহাব তো ওকে সবসময় নিতে আসে। এমনকি পৌঁছেও দিয়ে যায়। অবশ্য এসব রিদি-ই ওকে করতে বলেছিল একসময়।তবে আজ শিহাবের ওকে নিতে আসতে কী অসুবিধা? রিদি ভেবে পেল না। কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। তারপরও “আচ্ছা” মেসেজটা টাইপিং করে ঘরের ভেতরে চলে গেল। আরবিন বের হবে এখনো কিছুক্ষণ পরে। রিদি ওকে দেখিয়েই বের হবে এখান থেকে। শাড়ি পরবে, সুন্দরভাবে সাজগোজ করবে। দেখুক আরবিন, তাতেই ওর মনের শান্তি।

আরবিন সবে ইউনিফর্ম পড়ে আর্মি ওয়াচটা হাতে পড়তে পড়তে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনের দৃশ্যটা চোখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে থমকে দাঁড়ালো ও। রিদি সামনে খানিকটা নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোফার কাছটায়। সোফার ওপরে মহিলাদের একটা সাইড ব্যাগ রাখা৷ তাতে কিছু জিনিসপত্র রাখছে রিদি। ওর পরনে একটা সুতোয় কাজ করা লাল রঙের শাড়ি, হাতে সোনালি বালা, কানে দুল আর কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ৷ আরবিন কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে দেখলো রিদিকে। তারপর ধীরেধীরে এগিয়ে গিয়ে ওর পেছনে দাঁড়ালো। রিদি আড়চোখে খেয়াল করেছে আরবিনকে।

আরো আগেই বরং এখান থেকে বের হতো ও। কিন্তু আরবিনের বাইরে আসার জন্যই মূলত অপেক্ষা করা। যাক, অপেক্ষাটা সার্থক হয়েছে তাহলে! এবার মনে একরাশ প্রশান্তি নিয়ে রিদি ঘুরেফিরে বেড়াবে; আর আরবিন জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে৷ কাজে মনোযোগ বসাতে পারবে না নিশ্চয়ই। মনে মনে কথাগুলো ভেবে পৈশাচিক আনন্দ হলো রিদির। উঠে ঘুরে দাঁড়াতেই আরবিনের মুখোমুখি হলো। আরবিন প্যান্টের পকেটে হাত রেখে গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। রিদিকে সরু চোখে দেখছে আপাদমস্তক। আরবিনের ওই অন্তর্নিহিত চাহনি দেখে কিছুটা বিব্রত হলো রিদি। আরবিন ওর গলার দিকে চেয়ে ছিল একদৃষ্টিতে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের গলার দিকে লক্ষ্য করতেই বিরক্ত হলো রিদি। আঁচল টেনে কাঁধ ঢেকে দিতেই আরবিন ভারী গলায় প্রশ্ন করে বসে,

“কোথায় চড়াতে যাওয়া হচ্ছে এখন?”
“যেখানে খুশি। আমার মর্জি৷ আপনাকে কৈফিয়ত দেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখছি না।”
“ভাবসাব তো ভালো ঠেকছে না তোমার। সাজটা কেমন যেন বধূ বধূ লাগছে৷ কী, এখন স্বামীর পাত্তা পাচ্ছো না বলে আরেকটা বিয়ে-শাদি করে ফেলার পরিকল্পনা করছো নাকি? করলে অবশ্য অসুবিধা নেই। সাক্ষী লাগলে আমাকে ফোন করে ডেকো। ডিউটি না-হয় একদিনের জন্য মিস দিলাম। জরিমনা হলে হবে!”
রিদির শরীর জ্বলতে লাগলো আরবিনের কথা শুনে। অবশ্য আরবিন ওকে জ্বলানোর জন্যই কথাটা বলেছে। এবার দাঁতে দাঁত চেপে রিদি বললো,
“আপনি যদি আমার কয়েক বছরের সিনিয়র এবং নামকাওয়াস্তে স্বামী না হতেন; তাহলে নির্ঘাত এখন আপনার মুখের ওপর একটা ঘু’ষি মেরে বসতাম!”
রিদির কথা শোনা মাত্র আরবিন হোহো করে হেসে উঠলো। রিদির বিরক্ত লাগলো ভীষণ। আরবিন হাসতে হাসতেই ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

“ওইটুকু একরত্তি শরীর। ওই শরীরের জোর আমার জানা আছে।”
আরবিন কথাটা বলে হঠাৎ আবার গম্ভীর হলো৷ এবার রিদির কাঁধ আলতোভাবে চেপে ধরলো দুই হাতে। তারপর ওর চোখে চোখ রেখে গম্ভীর স্বরে বললো,
“অনেক হয়েছে। এবার একটুখানি বিরাম যাও রিদি। জেদ আর ছেলেমানুষীর চক্করে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনো না। বাঁচতে পারবে না। কখনো কিছু হলে আমি কিন্তু বাঁচাতে যাবো না তোমাকে। ম্যাক্সিমাম টাইম অন ডিউটিতে থাকি!”
রিদি এবার দৃঢ়ভাবে চরম আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিলো,
“আপনাকে আমার কখনো প্রয়োজনও পরবে না।”
আরবিন ফিচেল হেসে জবাব দিলো,

“পরবে পরবে। অবশ্যই প্রয়োজন পরবে, দেখো৷ কিন্তু আমি তোমার ডাকে সাড়া দেবো না৷ তুমি নিজে আগেই সেই সিচুয়েশন ক্রিয়েট করে ফেলেছো৷ সো..”
রিদি এবার ছিটকে সরে গেল। তারপর সাইড ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবেই জোরে আরবিনকে শুনিয়ে বললো,
“শিহাবের সাথে বের হচ্ছি আজ। চা-বাগানে ঘুরতে যাবো আমরা। দারুণ ব্যাপার না? আমি ভীষণ এক্সাইটেড!”
আরবিন পেছন থেকে জোরে চিল্লিয়ে বললো,
“সাবধান যতটুকু করার, করেছি। এরপর মরতে বসলেও কিন্তু আমি বাঁচাতে যাবো না। মাইন্ড ইট।”
আরবিনের কথার কোনো তোয়াক্কা করলো না রিদি। যতটুকু জ্বালানো দরকার, সেটুকু হয়ে গেছে। এবার উচ্ছ্বসিত মনে বাইরে বেরিয়ে গেল রিদি৷ আরবিন ওর যাওয়ার পথে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধীরে ধীরে মুখ কঠোর হয়ে এলো ওর। দাঁড়িয়ে থেকে কিছু একটা ভাবলো।

আরবিন করিডোরে দাঁড়িয়েছিল। মেজর সুদীপ্ত রায়ের সাথে কথা বলছিল একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে। সুদীপ্ত রায় এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন মাস দুয়েক হবে। প্রাক্তন আইটি অফিসার মেজর বাশারের স্থানে এসেছেন তিনি। দু’জনের আলোচনার ধরন অত্যন্ত গম্ভীর। বোঝাই যাচ্ছে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে তাদের মধ্যে। আরবিন বলে উঠলো,

“মেজর, এখন বেশিদিন ওয়েট করার মতো টাইম হাতে নেই আমাদের। বাশারকে হাতেনাতে প্রমাণস্বরূপ ধরতে হবে। তাছাড়াও আমি বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। আপনি পাচ্ছেন না?”
সুদীপ্ত রায় আরবিনের কাঁধে এক হাত রেখে বলেন,
“তুমি বিচক্ষণ মানুষ। তবে এই বিষয়টাতে এখন আপাতত হস্তক্ষেপ কোরো না৷ বাশার নিজে এসে ধরা দেবে দেখো।”
“আমার মনে হচ্ছে না, সেরকম কিছু হবে। তবে জাস্ট একটা সুযোগ পেলে ওকে কমান্ডারের পায়ের সামনে এনে ফেলবো।”

“এসব আমাদের হাতে নয় আরবিন৷ সেনা অফিসারদের কাজ এটা। যদিও ব্যাপারটা আমাদের ডিপার্টমেন্ট সাথে জড়িয়ে। তবে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”
দু’জনের আলোচনা চলার মধ্যেই আরবিনের ফোন বেজে উঠলো হঠাৎ। পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করলো আরবিন। আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। সেকেন্ড দুয়েকের মতো নাম্বারটা পরিচিত কারো কিনা— তা মনে করার চেষ্টা করলো৷ নাহ, পরিচিত কারো বলে মনে হলো না। তারপর আরবিন কল রিসিভ করে জিজ্ঞাসা করলো,
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
ফোনের ওপাশ থেকে সালামের জবাব আসলো না৷ বরং একটা কর্কশ গলার স্বর শুনতেই ক্ষণিকের জন্য চমকে উঠলো আরবিন। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি বলে উঠলেন,
“কি রে আরবিন? চাকরিতে এতো মজে গেছিস যে বউয়ের খোঁজ-খবর রাখতেছিস না ইদানীং! ব্যাপার কী? প্রমোশন-ট্রমোশন পাচ্ছিস নাকি?”

“বাশার?!”
বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্নটা করে আরবিন। টেনশনে কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। বিপদের আশংকা টের পেয়ে গেছে ইতিমধ্যে। মেজর সুদীপ্ত রায় ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বাশারের নাম শুনে৷ ফোনের ওপাশের লোকটি এবার হোহো করে হেসে উঠে বললেন,
“বাহ। সিনিয়রকে দেখি এখনো ভুলিস নাই। ভালোই মনে গেঁথে রেখে দিছিস। গলার স্বর শুনে কত সুন্দর করে চিনে গেলি!”
আরবিন এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলো৷ সঙ্গে সঙ্গে করিডোর পেরিয়ে দ্রুত দৌড়াতে লাগলো ও। ফোনটা কানের সাথেই চেপে ধরে রেখেছে৷ মেজর সুদীপ্ত রায় ঘটনা বুঝলেন নিমিষেই। তিনিও আরবিনের পেছনে দ্রুত দৌড়ে গেলেন।
আরবিন সোজা কন্ট্রোল রুমে এসে থেমেছে। নিঃশব্দে কন্ট্রোল রুম অপারেটরদের একজনকে ইশারা করতেই তারা সামনে ডেস্ক কম্পিউটার স্ক্রিনে কাজ করা শুরু করে দিলো দ্রুতগতিতে, অতি দক্ষতার সাথে। ওপাশ থেকে বাশার ঠাট্টার ছলে বললো,

“নিজেকে খুব শেয়ানা মনে করিস তাই না? আমার লোকেশন ট্রাক করতে পারবি না বাপ। বাশারকে ধরার সাধ্যি এখনো কারো হয়ে ওঠেনি। আসল কথায় আসি এখন। তোর বউ আমার কাছে আছে। মানে বন্দি আছে। কী বিশ্বাস হচ্ছে না তাই-না? তোর হোয়াটসঅ্যাপে একটা ফটো যাবে, দেখে শিওর হয়ে নিস।”
আরবিনের হোয়াটসঅ্যাপে সঙ্গে সঙ্গে একটা মেসেজ আসলো একই নাম্বার থেকে। মেসেজটা বিমূঢ়, হতভম্ব হয়ে দেখলো ও৷ রিদির দুই হাত চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা। মুখে কসটেপ। ছটফট করছে ও। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভীষণ আতঙ্কে আছে। বাশার কলেই ছিল। ও বললো,
“তোর বউ তো এখন আমার কব্জায়। কী করা যায় বল তো? মে’রে ফেলবো? নাকি বাঁচিয়ে রাখবো? তা অবশ্য নির্ভর করে তোর ওপরে।”

“বাশার!”
আরবিন চেঁচিয়ে উঠতেই বাশার বললো,
“উহু! একদম চিৎকার-চেঁচামেচি নয়। বউকে বাঁচাতে চাইলে পুরোনো প্রাচীরের টিলার কাছে আয়৷ কিন্তু খালি হাতে আসিস না আবার। তোহফা চাই। বুঝলি, তোহফা।”
“কী চাস তুই?”
“ওইযে ডকুমেন্টস! যেগুলোর জন্য আমি চাকরি হতে বিতাড়িত হলাম! ওগুলো আমার চাই৷ আজকে এবং এখুনি। তোর হাতে সময় একঘন্টা। এখন ভেবে দ্যাখ, কি করবি।”
বাশার কল কেটে দিলো৷ মাত্র পাঁচ মিনিটের কথোপকথন। তারমধ্যে কন্ট্রোল রুমে আসার পরে দুই মিনিট। আরবিনের রীতিমতো ঘাম ছুটে গেছে। মস্তিষ্ক দপদপ করে জ্বলছে ওর৷ মেজর সুদীপ্ত রায় এবং বাকিরা উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে। লাউড স্পিকার ছিল। বাশারের কথা শুনেছে সবাই। আরবিন চিন্তায় মাথার চুল চেপে ধরে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলো মিনিট দুয়েক। কন্ট্রোল রুম অপারেটর আসাদকে বললো,
“লোকেশন ট্রাক করতে পেরেছো আসাদ?”

“নো স্যার। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, ওটা বাশার আজিজ। ধূর্ত লোক। লোকেশন দেখাচ্ছে ফ্রান্সের। আরো কিছুক্ষণ তাকে কলে রাখতে পারলেই কারেক্ট লোকেশন ট্র্যাক করা যেতো।”
আরবিন আশাহত হলো। যদিও লোকেশন ওকে বলেই দিয়েছে। তবু বাশারকে বিশ্বাস নেই। মেজাজ মারাত্মক বিগড়ে গেছে ওর৷ পরিস্থিতি ভয়াবহ। সামনের টেবিলে একটা ঘুষি মারলো রাগের বশে৷ সুদীপ্ত রায় আরবিনকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। ওর অবস্থা দেখে বললেন,
“আমি বুঝলাম না, বাশার প্রফেশনাল ম্যাটারের সাথে পার্সোনাল সাবজেক্ট টানলো কেন?”
“বাশারের সবচেয়ে বড় শত্রু আমি৷ ও রিভেঞ্জ নিতে চায়। তাছাড়াও ডকুমেন্টসগুলো আমার কাছেই সেইফলি।”
“কিন্তু তোমার ওয়াইফকেই কেন টার্গেট করা হলো?”
“বাশার আমার একটাই দুর্বলতা ধরে ফেলেছে মেজর৷ এই ভয়টা-ই পাচ্ছিলাম। উফফ! এতো চেষ্টা করেও আটকাতে পারলাম না।”

আরবিন দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেল কন্ট্রোল রুম থেকে। তারপর সোজা নিজের ডেস্কে। ডেস্কের ড্রয়ার থেকে এতোদিনে যেই জিনিসটা কখনো কাজে লাগানোর প্রয়োজন পড়েনি, সেটা বের করে প্যান্টের বেল্টের সাথে আঁটকে রাখলো আরবিন। এরপর ইউনিট কমান্ডারের কেবিনে। আবদুল মুহিত কেবিনেই ছিলেন। ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না তিনি৷ সামনে ল্যাপটপ স্ক্রিনে মনোযোগ ছিল তার৷ আরবিন আজ অনুমতি নিলো না। কোনো ফর্মালিটিও পালন করলো না৷ সোজা কমান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“স্যার।”
“হ্যাঁ আরবিন। বলো। কোনো দরকার?”
“আপনার কাছ থেকে একটা পারমিশন নিতে এসেছি।”
“বলো।”

“কিছুক্ষণ আগে বাশার কল করেছিল আমার নাম্বারে। আমার ওয়াইফকে তুলে নিয়ে গেছে। সিচুয়েশন আউট অফ কন্ট্রোল। ওয়াইফকে জীবিত ফেরত দেবে, বিনিময়ে ডকুমেন্টসগুলো চাইছে।”
আবদুল মুহিত হতভম্ব হলেন খবরটা শুনে। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তুমি কী ডকুমেন্টসগুলো ওকে দেওয়ার জন্য পারমিশন চাইতে এসেছো?”
“নো স্যার। এটার জন্য।”
প্যান্টের পেছন দিক থেকে জিনিসটা বের করে সামনে তুলে ধরলো আরবিন। কমান্ডার চোখ বড় বড় করে জিনিসটা দেখা মাত্র বিস্মিত কন্ঠে বললেন,

“তুমি এটা ব্যবহার করার প্ল্যানিং করছো?”
“অলরেডি করে ফেলেছি স্যার। কিছু করার নেই। আ’ম রিয়্যালি স্যরি।”
“এসব অস্ত্র অফিসারদের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য দেওয়া হয়, এটা নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি?”
“জি স্যার। আর ভুলে যাইনি বলেই আমি এটা ব্যবহার করতে চাইছি। লাইফ রিস্কের ব্যাপার স্যার। আমার ওয়াইফকে বাঁচাতে যাবো আমি। বাশার যদি আমার ওপর অ্যাটাক করার চেষ্টা করে, তাহলে আমিও রিটার্ন অ্যাটাক দেবো।”

“শান্ত হও আরবিন। ঠান্ডা মাথায় ভাবো। তাড়াহুড়োয় কিছু করতে যেও না।”
“সিচুয়েশন ডেঞ্জারাস স্যার। শান্ত থাকার কোনো অপশন নেই আমার কাছে। একঘন্টা টাইম দিয়েছে মাত্র। জাস্ট অন আওয়ার। ওখানে আমার ওয়াইফ লাইফ রিস্কের মধ্যে রয়েছে। বুঝছেন স্যার?”
“বুঝছি। কিন্তু কিছু করার নেই। আমি তোমাকে পারমিশন দিতে পারছি না এভাবে৷ তুমি এদেশের সম্পদ। এই মাতৃভূমির সোনার সন্তান। বাশার ডেঞ্জারাস লোক৷ তোমার কিছু করে ফেললে? আর তুমি ওকে পাল্টা আক্রমণ করলে এই ইফেক্ট তোমার প্রফেশনাল লাইফের ওপর পরতে পারে।”
“পড়ুক স্যার। আই ডোন্ট কেয়ার! আজ কিছু ভাবতে পারছি না৷ আপাতত সবকিছুর চেয়ে ওর জীবন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”

“ওয়েল ডান! তোমার কাছ থেকে এমন জবাব-ই আশা করেছিলাম। তোমার ওয়াইফও এদেশের-ই নাগরিক। তাকে রেসকিউ করা সেনাসদস্যদের দায়িত্ব। সুতরাং, এক্ষেত্রে রেস্ট্রিকশন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। তবে তোমাকে একা ছাড়তে পারবো না আমি। লোকেশনটা বলো। দেখি কি করা যায়।”
আরবিন লোকেশন বলেই সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল দ্রুত। এদিকে আবদুল মুহিত দ্রুত জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টের আর্মি হেড বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ইয়াদুদ মির্জাকে কল করে ইমিডিয়েট কয়েকজন সেনা সদস্যের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। বিগ্রেডিয়ার জেনারেল তাকে আশ্বস্ত করে কল কাটলেন। আরবিন একটা কালো রঙা জিপ নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো দ্রুত। ও বের হওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওকে অনুসরণ করে দু’টো মিলিটারি ভেহিকল বের হলো।

রিদি ভীষণ ক্লান্ত। বেঁচে থাকার আর কোনো আশা নেই। শিহাবকে দেখা যাচ্ছে অদূরে। এই ছেলেটাকেই নাকি বন্ধু ভেবেছিল ও! আশ্চর্য হয়ে শিহাবকে দেখতে লাগলো রিদি। শিহাবের বাবাকে চিনতে পেরেছে৷ এই লোক-ই তো সবকিছুর মূল হোতা। শিহাবের তেমন কোনো ভূমিকা নেই৷ রিদি সিলেট শহরের সবকিছু চেনে না। তাই ধারণাও করতে পারেনি, শিহাব ওকে কোথায় নিয়ে এসেছে!
এখানে আসার আগ পর্যন্তও বুঝতে পারেনি রিদি। কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখ বুঁজে মনে করতে লাগলে ও।

আরবিনকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শিহাবের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে ভেবে মনে মনে খুব খুশি ছিল রিদি। রিকশা থেকে নেমে অটোরিকশায় বসেছে ও৷ আজ ঘুরতে বের হওয়ার তেমন ইচ্ছা ছিল না রিদির। তবুও বের হওয়ার একটাই কারণ — আরবিনের অবাধ্যতা করা।
শিহাবের সাথে সুন্দর সুন্দর ফটো তুলবে। তারপর সেগুলো আরবিনকে দেখাবে। নানান পরিকল্পনা চলছিল রিদির মনে। এরমধ্যে ও খেয়ালই করেনি, কোথায় এসে থেমেছে অটোরিকশা। শিহাব নেমে রিদিকে ডাকতেই রিদি নেমে দাঁড়ালো অটোরিকশা থেকে। শিহাব ভাড়া চুকিয়ে দিতেই রিদি কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কোথায় এসেছি আমরা? এটা তো পুরোনো দুর্গের মতো। ভাঙাচোরা অবস্থা। চা-বাগান কোথায়?”
“এইতো সামনেই। আসো নিয়ে যাচ্ছি।”

শিহাব কথাটা বলে আগে এগোলো। রিদি বিস্মিত হলো৷ তবুও ওকে অনুসরণ করে এগোতে লাগলো। আজ শিহাবকে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। মানে অন্যদিনের মতো নয়৷ দুর্গ পেরোলেই চা-বাগান নাকি! এই জায়গায় একটা পশুপাখির ছায়াও নেই। নানান চিন্তাভাবনা করে সামনে এগোলো রিদি। ভাঙাচোরা দুর্গ পেরিয়ে ভেতর দিকে যেতেই একটা পুরোনো ভবন সামনে পরলো। সেটা পেরোতে যাবে, তখনই হঠাৎ কি যেন হলো। মাথায় পেছন থেকে আঘাতটা খেয়েই মাথা চেপে ধরে ঘুরে দাঁড়ালো৷ দেখলো, শিহাব একটা মোটা লাঠি হাতে শক্ত মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। রিদি ওকে কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই চোখে আঁধার দেখলো।

আর তারপর জ্ঞান ফিরেই এখন এই পরিস্থিতি। বাশার লোকটার সব কথা শুনেছে রিদি। এতোক্ষণে ঘটনা বোঝাও হয়ে গেছে ওর। শিহাবকে দেখে ঘৃণা লাগছে প্রচন্ড। রিদির নিজের মাথাটা দেয়ালে ঠুকতে মন চাইছে। নিজের ওপর রাগ উঠছে প্রচন্ড। চরম আফসোস হচ্ছে। ইশশ! আরবিন শুরু হতে বহুবার সতর্ক করেছিল ওকে। রিদি মানেনি। জেদ ধরেছে। জেদের বশে নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। শিহাব এবার এগিয়ে আসলো। রিদি ওকে দেখে ক্ষোভে জ্বলে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তোমাকে আমি বন্ধু ভেবেছিলাম!”
“কিন্তু আমি তো কখনোই ভাবিনি। কোচিং-এর শুরু থেকেই জানতাম, তুমি আমার বাবার শত্রুর ওয়াইফ।”
“তারমানে?”

“এটা পুরোটাই গেইম ছিল। তুমি তোমার হাসবেন্ডের কাজের বিদ্বেষী৷ আর আমার বাবা আমাকে দিয়ে তোমাকে কাজে লাগিয়েছে। এখন তোমার হাসবেন্ড আসবে। ডকুমেন্টস দেবে। তারপর বাকিটা দেখা যাবে।”
“আসবেন না। উনি কখনোই আসবেন না। দেশের চেয়ে আমি বড় নই উনার কাছে৷ উনি তো আমাকে ভালোবাসেন না। আমি উনার দুর্বলতাও নই। উনিই বলেছিলেন, আমি ম’রে গেলেও বাঁচাতে আসবেন না আমাকে। তোমরা সবাই মিলে বরং মে’রে ফেলো আমাকে। তাতে আমি আরো বেঁচে যাই।”
“দেখা যাক আসে কিনা। আর মাত্র ফিফটিন মিনিটস। না আসলে খাতাম!”
কথাটা বললো বাশার। সামনে এগিয়ে এসেছে৷ রিদি লোকটাকে দেখে ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নিজে তো অপরাধী, নোংরা লোক; ছেলেটাকেও সেই পথে বিকিয়েছে। ছিহ! কতটা জঘন্য!

আর মাত্র দশ মিনিট সময় বাকি। বাশার একবার সময় দেখছে ঘড়িতে, আবার সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে বাইরে। বাশার সতর্ক ছিল বেশ। ভেবেছিল, আরবিন একাই আসবে৷ আরেকজন লোক আছে বাশারের সাথে। সে পেছন দিকটায় রয়েছে। কিন্তু বাশার ভাবতেও পারেনি, ঘটনা উল্টো ঘটে যাবে!
অতর্কিত হামলায় চমকে উঠলো বাশার। কাভার করার সুযোগ বা সময় ওকে দেওয়া হলো না। হামলার চোটে ওর হাতের অস্ত্র পড়ে গেল মাটিতে। সেটা তুলে নিতে পারলো না। আরবিন পিস্তল হাতে নিয়ে খুব সতর্কভাবে ভেতরে ঢুকতে লাগলো। ওদিকে বাশারকে নিজেদের অস্ত্রের মুখে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সেনাসদস্যরা। পেছনের পথ থেকে আরেকজন স’ ন্ত্রাসী বেরিয়ে আসতেই তাকেও আটক করে নেওয়া হলো। খুবই নিপুণতার সাথে মিশন চলছিল। একটুও এদিক-ওদিক হলেই শেষ।

ভেতরে আসতেই আরবিন বিমূঢ় হয়ে গেল৷ রিদির গলায় ছু’ রি ধরে রেখেছে শিহাব। আরবিনকে দেখা মাত্র ছু’রিটা আরেকটু গভীরভাবে ধরলো। তবে শিহাবকে অস্থির দেখাচ্ছে। হাত কাঁপছে ওর। বোঝাই যাচ্ছে, ভয় পেয়েছে বেশ। এজন্য এই কাজ৷ বাঁচার শেষ প্রচেষ্টা। আরবিনকে দেখা মাত্র শিহাব রিদির গলার সাথে ছুরিটা মিশিয়ে ধরে বললো,
“পিস্তল ফেলুন। নাহলে ওর গলায় পোঁচ পরবে কিন্তু।”
আরবিন কোনোকিছু ভাবার সময় নিলো না৷ হাত থেকে পিস্তলটা ফেলে দিলো সঙ্গে সঙ্গে। তারপর শিহাব বললো,
“আমার বাবাকে ছাড়ুন।”
আরবিন কোনো কথা বললো না। পেছন দিকে তাকালো৷ দূরে বাশার আর তার সঙ্গীকে আঁটকে নিয়েছে সেনাসদস্যরা। আরবিন এবার সামনের দিকে তাকালো। শিহাব তটস্থ। শিহাবের পেছনে একনজর দেখে ইশারা করে আরবিন দুই হাত উঁচু করে সতর্কতার সাথে বললো,

“ওকে…”
আরবিন চূড়ান্ত ইশারা করতেই শিহাবের পেছন থেকে একজন আর্মি অফিসার পা টিপে এগিয়ে এসে চোখের পলকে শিহাবকে ধরে টান দিলো। শিহাব পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়ালো। রিদি তখনও বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে। জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে যেন ও। শিহাব শেষ প্রচেষ্টা করতে ছাড়লো না। আর্মি অফিসার ওর হাত ধরে টান দিতে যাবে, তখনই শিহাব হাতের ছুরিটা রিদির পিঠে বসিয়ে দিলো। রিদি ছিটকে সরে গেল। কয়েকজন অফিসার এগিয়ে এসে শিহাবকে আটক করতেই আরবিন দ্রুত এগিয়ে গেল রিদির দিকে। রিদি ওকে কাছে আসতে দেখা মাত্রই যেন প্রাণ ফিরে পেল। ছুটে এসে আরবিনের বাহুর মাঝে হাত গলিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো খুব শক্ত করে। তারপরেই হুহু করে কেঁদে ফেললো। আরবিন ওর মাথা নিজের বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

“শান্ত হও। কিচ্ছু হয়নি। আমি আছি তো।”
“মরে যেতাম। ভেবেছিলাম, আপনি আসবেন না।”
“আমার জান এদিকে চলে যাচ্ছে, আর আমি আসবো না? আশ্চর্যজনক কথাবার্তা!”
“আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন না৷ আমার মরণেও আপনার কিছু যায় আসে না। তাহলে আসলেন কেন? কেন বাঁচালেন আমাকে? ম’রে যেতে দিতেন। বেঁচে যেতাম তো এতো যন্ত্রণা, অবহেলা থেকে।”
রিদি আরবিনের বুক থেকে মুখ উঠিয়ে কিছুটা অভিমানের সুরে কান্নারত অবস্থায় কথাগুলো বললো। আরবিন কিছুক্ষণ নিরবে ওর দিকে তাকিয়ে ধরে ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললো,

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৬

“ভালোবাসার কথা তো বলতে পারবো না। তবে আমি তোমার প্রতি দুর্বল। মারাত্মক দুর্বল। আজ টের পেলাম। এর আগে কোনোদিন কারো ওপর এতোটা দুর্বল হইনি। কেন বলো তো? তুমি কী অন্যরকম সম্মোহন? সবার থেকে আলাদা? নাকি আমার ভ্রম?”

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৮