নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৯

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৯
ঝিলিক মল্লিক

আরবিন ক্যান্টনমেন্ট থেকে কোয়ার্টারে ফিরেছে মাত্র। ফ্ল্যাটের একটা চাবি সবসময় ওর কাছেই থাকে। সেটা ব্যবহার করে ভেতরে প্রবেশ করলো আরবিন। ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো, ড্রয়িংরুমে আলো নেভানো। রিদির ঘরের দরজা খোলা। আলো জ্বলছে ওঘরে। আরবিন শরীরের ওপরে চাপানো শার্টটা খুলে সোফার ওপর রেখে রিদির ঘরের দিকে গেল।
রিদি লাগেজে নিজের সব জামাকাপড়, জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বিমূঢ় হয়ে সরু দৃষ্টিতে ওর কাজকর্ম দেখলো আরবিন। রিদি ঘাড় ঘুরিয়ে একনজর দেখলো আরবিনকে। তারপর ওড়না ভাঁজ করতে করতে বললো,

“আপনার জন্য রান্না করে রেখেছি। প্রয়োজন পরলে গরম করে নেবেন। নাহলে আমাকে বলবেন, গরম করে দেবো। ঝাল ঠিকঠাকমতোই দিয়েছি। ও নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।”
আরবিন এবার এগিয়ে গেলো রিদির কাছে। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকি মে’রে প্রশ্ন করলো,
“কী করছো তুমি?”
“চোখ দিয়ে দেখতেই তো পাচ্ছেন।”
“কী হয়েছে?”
“কী হবে?”
“লাগেজ প্যাক করছো কেন?”
“বাপের বাড়িতে যাবো। আব্বুকে কল দেবো সবকিছু গুছানোর পরে। বলবো, আগামীকালের মধ্যেই আমাকে নিতে আসতে।”
“প্রতিদিন একটু-আধটু বিনোদন না দিলে তোমার চলে না?”
“না, চলে না।”
“তো কতদিনের জন্য যাচ্ছো?”
“জানি না।”
“আচ্ছা যাও।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরবিনকে এতো সহজে মেনে নিতে দেখে বেশ অবাকই হলো রিদি। কিছু বললো না যে! মনে মনে একটু কৌতূহল জাগলো ওর৷ তবে ভুল ভাঙলো মিনিট দুয়েক পরেই। আরবিন রিদিকে যাওয়ার জন্য পারমিশন দিয়ে ওর ঘরে দাঁড়িয়েই সেলফোনটা বের করলো পকেট থেকে। তারপর নাম্বার ডায়াল করে নিজের আব্বাকে কল দিলো। ইকবাল জম্মাদার কল রিসিভ করতেই আরবিন বলে উঠলো,
“হ্যালো, কেমন আছেন আব্বা?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি বাজান। তোমরা দু’জন কেমন আছো?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আম্মা কেমন আছে?”
“তোমার আম্মাও আছেন ভালো। একটু জ্বর-ঠান্ডা লেগেছে — এই আরকি।”
“এমন ওয়েদারে এসব হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তা আম্মাকে নিয়ে তো সিলেট আসতে পারেন। ওয়েদারও চেঞ্জ করা হবে আর কিছুদিন বেড়ানো হয়ে যাবে নাহয়।”

“প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কিন্তু আমি এতো বড় কোচিং ফেলে রেখে আসি কীভাবে বলো তো?”
“তাহলে আম্মাকেই পাঠিয়ে দেন। মূলত একথা বলতেই ফোন দিয়েছিলাম। আমি ম্যাক্সিমাম টাইম ক্যান্টনমেন্টে থাকি। আপনাদের বৌমা কোচিং টাইম বাদে অবসরে প্রায় সারাদিন- ই কোয়ার্টারে একা বিরক্তিকর সময় কাটায়। আম্মা আসলে ওর-ও বরং ভালো লাগবে একটু। সঙ্গ পাবে, সময়টাও সুন্দর কাটবে। আসলে ও-ই আমাকে বলছিল, আম্মাকে যেন আসতে বলি।”
“আচ্ছা। আমি তাহলে অতি দ্রুতই এ সপ্তাহের মধ্যে তোমার আম্মাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”
“এ সপ্তাহের মধ্যে নয় আব্বা। আপনি দেখুন, কোনোভাবে আগামীকাল-ই আম্মাকে পাঠানো যায় কিনা।”
“তাহলে কাল ভোরের বাসেই উঠবো আমরা। তোমার আম্মাকে সিলেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আমি আবার ফিরে যাবো।”

আরবিন আর ইকবাল জম্মাদারের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ কথা হলো। রিদি শুধু হতভম্ব হয়ে দেখতে লাগলো আরবিনকে। কি জটিল চাল চেলেছে ওকে এখানে আটকে রাখতে। এতো বুদ্ধি নিয়ে এই লোক রাতে ঘুমায় কিভাবে! ভাবলেই আশ্চর্য হয়ে যায় রিদি। তবে পরমুহূর্তেই রাগ উঠলো ওর। আরবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে জোর গলায় বললো,
“আপনি যা খুশি করুন গে। আমি থাকছি না এখানে। আপনি আমার কথা কখনো ভাবেন না। আপনার সাথে থাকার প্রশ্ন-ই আসছে না এখন। আব্বুকে কল দিয়ে আর সময় নষ্ট করবো না। আমি এখনই লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। বাস স্টেশনে যেয়ে তারপর ঢাকার বাস ধরবো।”
আরবিন কিছুক্ষণ অদ্ভুতভাবে রিদির দিকে চেয়ে থেকে গম্ভীর স্বরে বলে,
“আঙুল নামিয়ে কথা বলো।”

রিদি আঙুল নামালো না। বরং একইভাবে উঁচিয়ে রাখলো। আরবিনের মুখের দিকে আরো এগিয়ে নিলো। আরবিন এবার হাত উঠিয়ে ওর আঙুল চেপে ধরে মুচড়ে ধরলো শক্তভাবে। রিদি ব্যাথায় কুকিয়ে উঠতেই ছেড়ে দিয়ে বললো,
“কথাবার্তা না শুনলে এমনই করবো এখন থেকে। তোমার মতো ঘাউড়ার সাথে এসব করা জায়েজ আছে।”
রিদির আঙুল ছাড়তেই ও এবার আরবিনের পরনের জলপাই রঙের টি-শার্টের গলার কাছটায় চেপে ধরলো শক্ত করে। তারপর বললো,
“আপনি আমাকে নিয়ে ভাবেন কখনো?”
“ভাবার টাইম পাই?”

“তাহলে আমি চলে গেলে কী সমস্যা? আমি থাকলেও যা, না থাকলেও তাই৷ নূন্যতম কিছু চেঞ্জ হবে বলে আমার মনে হয় না। তাহলে এতো তোড়জোড় কেন আমাকে আটকে রাখার?”
রিদি আরবিনের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রশ্নটা করার পরে। আজ জবাব নিয়েই ছাড়বে ও। আরবিন একটা শব্দও বের করলো না মুখ দিয়ে। ঠোঁট কামড়ে রিদির দিকে তাকিয়ে রইলো৷ হাত উঠিয়ে ওর এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে কানের পাশে গুঁজে দিলো। রিদি এবার কলার ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো,
“কী হলো? জবাব দিচ্ছেন না কেন?”
“কলার থেকে হাত সরাও। এটা লাস্ট ওয়ার্নিং। পরের বার ভুলক্রমেও কলারে হাত রাখলে তুলে একটা আছাড় মারবো।”

“আমাকে তুলে আছাড় মারতে পারবেন?”
“পানিভর্তি মাঝারি সাইজের ড্রাম উঠিয়ে কাঁধে তুলে নিতে পারলে তোমাকে তুলে আছাড় মারা কোনো ব্যাপার না। তোমাকে না কতবার বলেছি? এভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলবে না আমার সাথে। একদম পছন্দ না। জুনিয়র অফিসাররা আগ বাড়িয়ে কথা বলতেও ভয় পায় আমার সাথে৷”
“আমি আপনার জুনিয়র অফিসার না। আপনাকে আমি ভয় পাই না।”
“তাই নাকি?”
“হুঁ।”
“সেদিনের চড়টার কথা ভুলে গেলে?”

সেদিনের চড়ের কথা মনে পড়তেই আঁতকে উঠলো রিদি। উহহ! কি ভয়াবহ ছিল থাপ্পড়টা! দু’দিন টনটনে ব্যাথা ছিল গালে। ব্যাথায় গাল নাড়াতে, খাবার খেতে, এমনকি কথা বলতেও মহা ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল রিদিকে। চড়ের কথা মনে পড়তেই হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল ও। আরবিন এবার ওকে টেনে বিছানায় বসিয়ে বললো,
“সারাদিন এতো আজগুবি চিন্তাভাবনা করো কীভাবে? পড়াশোনা নেই তোমার?”
“আছে।”
“তো যাও। লাগেজ যা গুছিয়েছো, ওগুলো আর বইপত্র নিয়ে আমার ঘরে গিয়ে পড়তে বসো। এঘরে এমনিতেও কাল থেকে থাকতে পারবে না। আম্মা আসলে ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে কিছুদিনের জন্য। তারপর আম্মা চলে যাওয়ার পর নাহয় আবার এঘরে শিফট করবে।”

“কেন? আপনার ঘরে আমি গেস্টের মতো যেয়ে থাকতে পারবো না। গেলে একবারে যাবো, নাহয় কখনোই না।”
“অ্যাডমিশনের আগ পর্যন্ত একঘরে একসাথে থাকা যাবে না। উল্টোপাল্টা কিছু হয়ে গেলে প্রবলেম। এখন সাময়িক সময়ের জন্য থাকতে হবে তা-ও শুধুমাত্র পরিস্থিতির বিবেচনায়। বুঝতে পেরেছো?”
“হুঁ।”
রিদি আর কথা বাড়ালো না। লাগেজ যা প্যাক করেছিল, সে-সব নিয়ে আরবিনের ঘরে চলে গেল। শাশুড়ি আসবে বলে ওর আর বাপের বাড়িতে যাওয়া হলো না।

মেয়েটির নাম তানহা৷
ভারী মিষ্টি দেখতে। বিয়ে হয়েছে ছয়মাস হলো৷ স্বামী দেশের বাইরে গেছে কিছুদিনের জন্য। তানহা আরবিনের ফুপাতো বোন। শাশুড়ির সাথে নিজের প্রায় সমবয়সী একজন মেয়েকে দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি রিদি। অবশ্য সামনাসামনি তা প্রকাশও করে ফেললো।
আরবিন সব ফর্মালিটি পূরণ করে তাদেরকে কোয়ার্টারে নিয়ে এসেছে। সাধারণ অফিসারদের কোয়ার্টারে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা বেড়াতে আসতে হলেও তার ওপর কিছু শর্ত বা নিয়ম ধরাবাঁধা থাকে। এজন্য আরবিন ওর আম্মা আর ফুপাতো বোনের পরিচয়সহ প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সেনা প্রশাসনে রেজিস্টার করিয়ে এখানে থাকার সময়সীমা জানানোর পরে ভেতরে প্রবেশ করানোর অনুমতি পেয়েছে।

আফসানা বেগম ছেলেকে পাশে বসিয়ে ওর মুখে হাত দিয়ে দেখছিলেন। বেশ আফসোস করে তিনি বললেন,
“মুখটা শুকিয়ে গেছে কেন আব্বা? খাওয়া-দাওয়া হয় না ঠিকমতো। বৌমা, রান্না করো না?”
রিদির দিকে তাকিয়ে শেষোক্ত প্রশ্নটা করলেন আফসানা বেগম। রিদি মাথা নত করে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। আরবিন ওকে আড়চোখে দেখলো একবার। বাস স্টেশনে ওর আম্মাকে নিতে যাওয়ার সময়ে রিদিকে বলে গিয়েছিল, পারলে ইমিডিয়েট একটা শাড়ি পড়ে বউ সেজে থাকতে। যেন দেখলেই বোঝা যায়, কিছুটা সংসারী ভাব এসেছে। দু’জনে চুটিয়ে সংসার করছে— এমন মনে হবে।
রিদি করেছেও তাই। একটা খয়েরী রঙা সুতির শাড়ি, ব্লাউজ আর এখানে আসার পর এই প্রথমবারের মতো স্বর্ণের ডালের মতো সাইজের ছোটো নাকফুলটা পড়ে ঘোমটা দিয়ে পুরো বউ সেজে আছে রিদি। ভাবটা এমন— যেন বাসায় থাকাকালীন সবসময়ই এমন থাকে। আসার পর শাশুড়িকে বেশ তোয়াজও করা হয়েছে ওর। নিজে গিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে এসেছে। বিকালের নাস্তা দিয়েছে। এমনকি রাতের রান্না চড়ানোর জন্যও তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে।
রিদিকে চুপ থাকতে দেখে আফসানা বেগম এবার আরবিনের দিকে তাকালেন। আফসানা বেগম সোফায় বসে আছেন। আরবিন তার সামনে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে মায়ের দুই হাত ধরে। আরবিন এবার কিছুটা চাপা গলায় বললো,

“আসলে ও তেমন রান্না পারেনা আম্মা। টুকটাক পারে৷ আমরা মিলেমিশে রান্না করি আরকি।”
“না। তা বললে হবে কী করে? জানি, ওর পড়াশোনার চাপ থাকে। কিন্তু কয়েকদিন পরে কোল জুড়ে একটা ন্যাদা আসলে তখন তো সংসারী হতে হবে। ন্যাদার জন্য তো রান্নাবান্না জানা জরুরি। নাহলে ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েকে কী রান্না করে খাওয়াবে? আর তুমি থাকো বেশিরভাগ সময় কাজে। তুমি কী ঘরের কাজ দেখতে পারবে? এসব তোমাকে সাজে? ওকে বরং আমি সব নিজ হাতে ধরিয়ে শিখিয়ে দিয়ে যাবো।”
রিদির বুক ধড়ফড় করে ওঠে। রান্নাবান্না শিখতে হবে। বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করতে হবে! এতোদূর তো ভেবে দেখেনি। সংসার কতো বিশাল, আবার ঝামেলার। ভাবলেই মন আঁতকে ওঠে।
আফসানা বেগম উঠলেন এবেলায়। তানহার হাতে লাগেজ আর ব্যাগগুলো। আফসানা বেগম ওকে দেখিয়ে দিয়ে রিদিকে বললেন,

“বড় ভালো মেয়ে বুঝলে মা। স্বামী কাজের জন্য কিছুদিন হলো দেশের বাইরে গেছে। ফিরবে সপ্তাহখানেক পরে। বেচারি একা থাকে বাসায় সারাদিন পড়ে। তাই ভাবলাম, আমার সাথে বরং একটু বেড়াতে নিয়ে আসি।”
রিদি এবার হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“ভালো কাজ করেছেন আম্মা। চলুন, আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিই।”
রিদি আফসানা বেগম আর তানহাকে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময়ে আফসানা বেগম বললেন,
”রাতের খাবারের কী ব্যবস্থা করেছো?”
“মাংস কেটে রেখেছি। সবজি আছে। এখনই রান্না চড়াবো।”
“আজ আর তোমাকে হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে না৷ আমি এসেছি, ক’দিন এবার একটু রোষো বাপু। ছেলেটাকে আর তোমাকে ভালোমন্দ কিছু রান্না করে খাইয়ে যাই। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বরং রান্নাটা ভালোমতোন শিখে নেবে।”

তানহা এবার অনার্স প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছে। রিদির থেকে এক বছরের সিনিয়র। তবে দু’জনের খাতির জমেছে বেশ। রিদি এমনিতেও বরাবরই মিশুকে স্বভাবের। তারওপর তানহা মেয়েটি খুবই ভালো। ওর সাথে গল্প-আড্ডা জমেও খুব। মনখোলা রিদি কথার ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথাই বলে ফেলেছে অজান্তেই। নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি প্রথমে। তবে পরে তানহার সহযোগিতায় সহজ হলো ওর সাথে।
ওদিকে আফসানা বেগম রান্নাঘরে রাতের রান্না চড়িয়েছেন। রিদি আর তানহাকে ঘরে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, আজ একা হাতে রান্না করবেন৷ কাজে যেন অসুবিধা না হয়। নিরিবিলিতে কাজ করতে বেশি পছন্দ করেন তিনি।
তাই রিদি আর তানহা দুই মগ কফি নিয়ে বসেছে ব্যালকনির বেতের চেয়ারে৷ সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। তানহা এবার কথার মাঝে বিজ্ঞদের মতো বলে উঠলো,

“বুঝলাম।”
“কী বুঝলে?”
রিদি কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে। তানহা এবার কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বললো,
“তোমাদের সম্পর্কটা আর দশটা স্বাভাবিক সম্পর্কের মতো এখনো হয়ে ওঠেনি। যদিও এতে তোমাদের দু’জনেরই দোষ আছে বলেই আমি মনে করি৷ তবে তুমি চাইলে নিজের দোষটা শুধরে নিয়ে একটু চতুরভাবে এগোতে পারো। এতে যদি সংসারটা স্বাভাবিক হয়।”

“কীভাবে গো? একটু বলো না আমাকে। উনাকে আঁচলে বেঁধে রাখার কোনো উপায় জানা আছে তোমার কাছে?”
“উপায় তো জানা আছে অবশ্যই। আমার উনির সাথেও আমার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল। প্রথম প্রথম অতো ভাব ছিল না। আস্তে-ধীরে ভাব হলো৷ আর এখন তো উনি আমাকে ছাড়া কিছু চেনেনই না। আমি বলতেই অজ্ঞান।”
“কিন্তু আরবিন তো আর সবার মতো নয়। খুব পাষাণ। আমাকে নিয়ে ভাবার সময় উনার হয় না।”
“আরে আরবিন ভাইয়া বরাবরই এমন। পুরুষ মানুষের ভাব একটু-আধটু ওরকম হয় বুঝলে। সিধে করতে জানতে হয়। আমার উনিও তো একসময় খুব ভাববাজ ছিল। এখন আমার সামনে কোনোরকম ভাব দেখানো তো দূর, টুঁশব্দ করতেও দশবার ভাবনা-চিন্তা করে।”
“কীভাবে বশ করেছো? আমাকে একটু টিপস দেবে প্লিজ?”
“অবশ্যই দেবো। কেন দেবো না? তোমাকে আমার খুব ভালো মেয়ে মনে হয়। বেশ মনে ধরেছে। আমি চাই, তোমার আর আমার ভাইয়ের একটা সুন্দর সংসার হোক। শোনো, স্বামীকে মুঠোয় রাখতে হলে প্রথমত কী করতে হয় জানো?”

“কী?”
রিদি চাপা স্বরে কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে। আশেপাশে তাকায় সতর্ক দৃষ্টিতে। পাছে না আবার ওর শাশুড়ি এসব কথাবার্তা শুনে ফেলে। তখন আরেক কেচ্ছা। তানহা এবার ফিসফিস করে বলে,
“তোমাকে দেখি, সাজো খুব কম। এরকম থাকলে তো চলবে না। জানো, আমি বাইরে বা অন্য মানুষের সামনে সাধারণভাবে থাকি। কিন্তু ঘরে থাকাকালীন স্বামীর সামনে সবসময় সাজগোজ করে ঘুরঘুর করি। এতে তার মন অন্যদিকে সে হোক কাজ কিংবা অন্যকিছু; ছোটাছুটি করার সুযোগ-ই পায় না। আমার আঁচল ধরে বসে থাকে। আদর-আহ্লাদ করে। ভালোবাসে। আর স্বামীর সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হয়। মিষ্টি কথায় তো বরফও গলে পানি হয়ে যায়।”

“তোমার এসব ট্রিকস কাজে লেগেছে?”
“লাগবে না আবার? ব্যাটামানুষ বউয়ের অমন রূপ দেখে দূরে থাকতে পারে? আর ভালোবাসা তো আস্তে আস্তে তৈরি হয়-ই। তবে দূরে গিয়ে ভালোবাসার অনুভূতি টের পাওয়ানোটা বকওয়াজ। কয়েকবার আমার গুরুত্ব নেই ভেবে রাগ করে বাপের বাড়ি গিয়ে বসেছিলাম। ওমা! ব্যাটা দেখি সপ্তাহখানেক পার হলেও মনে করে না। তারপর শাশুড়ি গিয়ে নিয়ে আসলো। আসার পরে আবার বলে, ‘তোমাকে খুব মিস করছিলাম।’ কেমন বোঝো!”
“তাহলে তুমি বলছো, আমার এই ট্রিকসগুলো কাজে লাগিয়ে দেখা উচিত?”
“অবশ্যই! আজ থেকেই শুরু করে দাও বরং। আমি থাকাকালীন ট্রিকসগুলো কাজে লাগালে বরং বেশি ভালো হয়৷ কোনোটা বিফলে গেলে, নতুন করে আবার কিছু ভাববো নাহয়। তবে যত যা-ই হয়ে যাক, তোমাদের মধ্যে সুন্দর একটা বন্ডিং তৈরি করে দিয়ে তবেই নড়ছি আমি।”

“আজকের ট্রিকস কী?”
“ভাইয়া বের হলো না? কোথায় গেছে?”
“উপশহরের ওদিকে গেল মনে হয়।”
“আসতে কতক্ষণ?”
“রাত হবে অনেক। মেসেজ করে জানালো। ততক্ষণে সবাই রাতের খাবার খেয়েদেয়ে ঘুম।”
“উপযুক্ত সময়। শোনো, আজ আমরা তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরবো। দরকার হয় মামিকে আমি হ্যান্ডেল করবো। তুমি ওসব নিয়ে মোটেও চিন্তা করবে না৷ তুমি বরং আজ সুন্দর দেখে একটা শাড়ি পরবে। নেটের শাড়ি আছে তোমার?”

“হ্যাঁ একটা আছে। বিয়েতে গিফট পেয়েছিলাম। কখনো পরা হয়নি।”
“কী কালার?”
“কালো।”
“পারফেক্ট! হাতা কাটা ব্লাউজ আছে?”
“ওমা। ছি ছি! ওসব আমি পড়ি না।”
“তাও অসুবিধা নেই। শর্ট হাতার একটা ব্লাউজ পরলেই হবে। তা আছে তো?”
“হ্যাঁ আছে।”

“তোমার সাজটা আমি বলে দিই শোনো। ওই নেটের শাড়ি পরবে। শর্ট ব্লাউজ পরবে। সাজ বলতে মেকআপ না। চোখে গাঢ় করে কাজল দেবে। ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী লিপস্টিক। আজ যদি ভাইয়া তোমার আঁচল ধরে না বসেছে, তাহলে আমার নাম চেঞ্জ করে কাকতাড়ুয়া রেখে দিও। বুঝেছো?”

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৮

“বুঝেছি। আমি ভাবছি, উনার রিয়্যাকশন কেমন হবে। কল্পনা করতে পারছি না।”
রিদি আর তানহা— দুটিতে মিলে আরো অনেকটা সময় পুরো সন্ধ্যা জুড়ে নানান পরিকল্পনা করলো। কীভাবে আরবিনকে রিদি বাগে আনতে পারে। রিদি ভাবছে, আজ না জানি কি হবে!

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩০