নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৪
ঝিলিক মল্লিক
“স্যার, আমার গত দু’দিন যাবত পড়াশোনায় মন বসছে না।”
“কারণটা কী?”
“জানি না।”
“সমস্যার কথা না বললে আমি বুঝবো কীভাবে রিদি? কি হয়েছে মনা? আমাকে বলতে পারো।”
“আমি সত্যিই নিজেও জানি না স্যার। তবে বুঝতে পারছি, আমার পড়াশোনা থেকে মনোযোগ সরে যাচ্ছে। আমি এই সমস্যা থেকে বের হতে চাই।”
টংয়ের বেঞ্চিতে চায়ের কাপটা রেখে চিন্তিত মুখে রিদির দিকে তাকালেন আরবিন স্যার। কপট ভেবে বললেন,
“তুমি কী অন্যকিছু নিয়ে ভাবছো ইদানীং? মানে পড়াশোনার বাইরে কিছু?”
“না স্যার।”
রিদি আরবিন স্যারের চোখে চোখ রেখে সরাসরি জবাব দিলো। ওর বলার ভাষায় কোনো অস্পষ্টতা নেই, তাড়াহুড়ো নেই, আর না আছে বাড়াবাড়ি। কিন্তু আরবিনের মুখের ভাবগতিক দেখেই বোঝা যাচ্ছে, জবাবটা তার পছন্দ হয়নি। হঠাৎই গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
“কোচিং-এ যাও।”
রিদি হতভম্ব হয়ে ছোট ছোট চোখে তাকালো আরবিনের দিকে। হঠাৎ কি হলো! বলা নেই, কওয়া নেই, শান্ত একজন মানুষ অশান্ত হয়ে উঠলো কেন? রিদি তখনও উঠে দাঁড়ায়নি। দ্বিতীয়বার আরবিন স্যার প্রায় ধমকের সুরেই বললেন,
“যাচ্ছো না কেন?!”
রিদি উঠে দাঁড়ালো দ্রুত। কাঁধে ব্যাগ ঠিক করে চাঁদর জড়িয়ে ধরে উল্টোপথে হাঁটা দিলো। ওর যাওয়ার দিকে আরবিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন৷ বিরবির করে বললেন,
“অ্যাপোক্যালিপস! সর্বনাশের আর কিছু বাকি নেই। হাউ রিডিকিউলাস!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আব্বা, আমার পক্ষে এই শহরে থাকা আর সম্ভব নয়। আপনি আমাকে জোরাজোরি করবেন না দয়া করে। আমি নির্ধারিত সময়ের আগেই এখান থেকে যেতে চাইছি।”
ইকবাল জম্মাদার একটা বইয়ে চোখ রেখেছিলেন সবে। ছেলের কথা শুনে বই থেকে চোখ উঠালেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“কারণ?”
“কারণটা আপনাকে বলতে পারছি না আব্বা। স্যরি। সব কথা আপনাকে বলা যায় না।”
ইকবাল জম্মাদার এবার উঠে দাঁড়ালেন। আরবিনের সামনা-সামনি এসে বললেন,
“তুমি কী চাও? আমাকে বলো তো।”
“আই ওয়ান্ট টু ডু সামথিং ফর মাই কান্ট্রি। দ্যাট’স ইট। বহুবার বলেছি আপনাকে।”
“তাহলে নিজের জন্য কী করতে চাও?”
বাপের প্রশ্ন শুনে চোখ বুঁজে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত হয়ে নিলো আরবিন। তারপর-ই জবাব দিলো,
“নিজের জন্য কিছু করতে চাই না। প্রয়োজন দেখছি না আপাতত।”
“তোমার আব্বা-আম্মার জন্য কিছু করতে চাও না?”
“আব্বা, এমন দিন কখনোই আসেনি; আপনি আর আম্মা কিছু বলেছেন আমাকে, আর আমি তা করিনি৷ সুতরাং, এধরনের প্রশ্ন করাটা কতটুকু যৌক্তিক বলে আপনি মনে করছেন?”
ইকবাল জম্মাদার এবার কপট হাসলেন। তারপর আরবিনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“এইতো বাজান, লাইনে আসলে। এতগুলো দিন আমি তোমাকে এই কথাটাই বলে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। অথচ, জীবনের অনেকটা সময় আমাদের তোমাকে ছাড়া কাটিয়ে দিতে হয়েছে। এখন আবারও যখন আমাদের ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছো, তাহলে আমাদের একটা সন্তান সমতুল্য কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে যাওয়া তোমার উচিত নয়?”
আরবিন তার আব্বার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মানুষটা যে কি বলতে চাইছেন, তা বুঝতে ওর অসুবিধা হলো না। তবুও না বোঝার ভান করেই বললো,
“আপনি কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না আব্বা।”
“তোমার কিছু বুঝতে হবে না এখন৷ শুধু সমর্থন দাও যে, আমাদের জন্য তুমি কিছু করতে চাও কিনা।”
“জি আব্বা, কিন্তু.. ”
“হ্যাঁ অথবা না?”
আরবিন ঠোঁট চেপে নিজেকে শান্ত করলো। মন অস্থির হয়ে উঠছে বারবার। বুঝলো ফাঁদে পড়েছে। যথেষ্ট শান্ত থেকে ও কাটকাট কন্ঠে জবাব দিলো,
“হ্যাঁ!”
ইকবাল জম্মাদার বললেন,
“ব্যস! এইটুকুতেই চলবে। তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো। তোমার ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না। কোনোদিন দিইওনি। কিন্তু এবার আমাদের একটু কঠোর হতে হবে। নাহলে আগেও যেমন তুমি দেশের জন্য করে এসেছো, বাকিটা জীবনও তাই-ই করবে। নিজের জন্য আর কিছু করবে না। আমার সামনের দিনে করা কাজগুলোকে তুমি সন্তানের প্রতি একজন পিতার দায়বদ্ধতা ধরে নিতে পারো।”
ইকবাল জম্মাদার ঘর থেকে বেরোনোর সময় পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি চিন্তা কোরো না বাজান। তোমার জন্য কারো ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে না। বরং তোমাকে যে পাবে, তার সাত আঙুল কপাল। এটা মনে রেখো, আমি এমন কিছুই করবো না; যাতে কারো ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়। তবে একটা গাঁট বেঁধে দেবো। যেই টানে তোমাকে আমাদের কাছে ফিরে আসতে হবে বারবার।”
আব্বার কথা শুনে যা বোঝার বুঝে নিলো আরবিন। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসলো। চোখ বুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এবার ওর মুখোমুখি হবো কীভাবে আমি! ও ভাববে, আমার মতামতেই এসব হচ্ছে!”
আজ শুক্রবার। অন্যদিন এই সময়ে বাজার-সদাই করতে বের হন সোহরাব হোসেন। কিন্তু আজ তিনি বাসাতেই রয়েছেন এগারোটা পর্যন্তও। রিদি পড়া কমপ্লিট করে নিচে আসতেই ওর আব্বুকে দেখতে পেয়ে অবাক হলো বেশ। এই অসময়ে কখনোই ওর আব্বু বাসায় থাকেন না। ওদিকে তানিয়া বেগমের রান্নাঘরে রান্নার তাড়াও নেই। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই তিনি বাসার মধ্যে ঘোরাফেরা করছেন। হাতে হাতে টুকটাক কাজ করছেন। রিদি এগিয়ে গিয়ে সোফায় ওর আব্বুর পাশে বসলো। সোহরাব হোসেন মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। একমাত্র মেয়ে তার বড্ড সাধনার৷ বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেও যখন তার আর তানিয়া বেগমের কোনো সন্তান হচ্ছিল না, তখন কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখোশধারী বেশকিছু আত্মীয়-স্বজন একেবারে জেঁকে ধরেছিল, আরেকটা বিয়ে করার জন্য। কিন্তু সোহরাব সাহেব আর তানিয়া বেগম ধৈর্য ধরে ছিলেন। রবের ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস এবং ভরসা ছিল তাদের। একারণেই হয়তো আল্লাহতাআ’লা রহমত বর্ষণ করেন তাদের ওপরে। বিয়ের ঠিক ছয় বছরের মাথায় তানিয়া বেগম অন্তঃসত্ত্বা হন। তাদের খুশি দেখে কে তখন! সবসময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন তারা৷ তবুও এরপর যখন রিদির জন্ম হয়, তখনও একদল আত্মীয় অভিনন্দন জানানোর বদলে হায়-হুতাশ শুরু করে এই বলে যে— এতগুলো বছর পরে সন্তান হলো, তা-ও আবার কিনা মেয়ে! এই মেয়ে কী তাদের দেখবে? সারাজীবন থাকবে তাদের পাশে? ছেলে হলে না-হয় কাজ হতো।
কিন্তু সোহরাব সাহেব বরাবরই ভীষণ ধৈর্যশীল আর কঠোর ব্যক্তিত্বের মানুষ। আত্মীয়দের কথায় মোটেও কখনোই প্রভাবিত হননি তিনি। এমনকি পারলে তাদেরকে এড়িয়ে চলেছেন সবসময়। মাঝেমধ্যে মুখের ওপর দু-একটা কথা শুনিয়েও দিয়েছেন কখনো-সখনো।।
তার স্ত্রী তানিয়া বেগম প্রথম প্রথম আত্মীয়দের কথায় একটু ভেঙে পড়লেও তাকে শান্ত করেন সোহরাব হোসেন। দু’হাতে আগলে নেন। আত্মীয়দের মুখের ওপরে তিনি প্রায় চ্যালেঞ্জ করে বসেন, মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন তিনি। ছেলেরা যেমন তার বাবা-মাকে দেখে, তাদের মেয়েও তেমনই তাদের দেখবে। বরং, বেশিই দেখবে। একারণেই মেয়েকে নিয়ে এতো সচেতন সোহরাব হোসেন। এক বিন্দু পরিমাণ আঁচ লাগতে দেন না মেয়ের ওপর। তবে আহ্লাদও দেখান না। যতটুকু দরকার শাসন করেন। বাড়াবাড়ি রকমের নয়।
রিদিকে মাথায় হাত রেখে সোহরাব হোসেন বললেন,
“পড়াশোনা কেমন চলে আম্মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই আব্বু। আমার ইংরেজির বেসিকে একটু সমস্যা ছিল। গত কয়েকদিনে ঠিক হয়ে গেছে। তবে আইসিটিতে একটু ঝামেলা আছে। আজম স্যার ভালোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ওইটাতেও সমস্যা কেটে যাবে ইন শা আল্লাহ। তুমি আজকে বাজারে যাওনি আব্বু?”
“না আম্মা।”
“কেন?”
“আজকে আমাদের বাসায় রান্না হবে না। তোমার ইকবাল আঙ্কেলের বাড়ির ভাড়াটিয়া জুনায়েদ আঙ্কেল আছে না? আমার বন্ধু? ওর আট বছরের ছোট ছেলেটার আজ সুন্নতে খৎনার অনুষ্ঠান। বেশ বড় করেই হচ্ছে। আমাদের দাওয়াত আছে আজ সেখানে। তোমাকে তো রাতেই বলতাম। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখি, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো। শোনো, দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে তৈরি হয়ে থেকো। আমি জুম্মার নামাজ আদায় করে আসার পরে বেরোবো আমরা। আমাদের পৌঁছাতে প্রায় দুইটা বেজে যাবে।”
সোহরাব সাহেব উঠে গেলেন। এখন বাইরে বেরোবেন তিনি। তানিয়া বেগমকে বললেন,
“ও তানি, শোনো।”
“হ্যাঁ বলো।”
তানিয়া বেগম টেবিল গোছাচ্ছিলেন। স্বামীর ডাকে এগিয়ে আসলেন তিনি৷ সোহরাব হোসেন বললেন,
“সেলুনে যাচ্ছি আমি। ফিরতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। তুমি গরম পানি করে ফ্লাক্সে রেখে দিও।”
“আচ্ছা। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরো।”
রিদির আব্বা বেরিয়ে যেতেই রিদি ওর আম্মার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তানিয়া বেগম ধোয়া প্লেট মুছে সাজিয়ে রাখছিলেন। রিদি পেছন থেকে উঁকি দিয়ে বললো,
“আম্মা, সুন্নতে খৎনাতে কী হয়?”
তানি বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকালেন মেয়ের দিকে। রিদি ভড়কে গিয়ে বললো,
“আমি তো কখনো এটার নাম শুনিনি। এভাবে তাকাচ্ছো কেন?”
তানিয়া বেগম বললেন,
“খুব ফাজিল হয়ে গেছো তুমি। যাও, ঘরে গিয়ে বসো। না-হয় টিভি দেখো।”
“আমি কী খারাপ কিছু জিজ্ঞাসা করেছি? বলো না আম্মা, সুন্নতে খৎনা কী?”
তানিয়া বেগম এবার ফিসফিসিয়ে বললেন,
“ছেলে মানুষের লিঙ্গ কা টার অনুষ্ঠান। এটা মুসলমানদের একটা ধর্মীয় প্রক্রিয়া আর গুরুতর সুন্নত হিসেবে বিবেচিত হয়। ছেলেদের জন্মের বারো-তেরো বছর বয়সের মধ্যেই এই কাজটা সম্পূর্ণ করতে হয়।”
রিদি লাফিয়ে উঠলো মায়ের কথা শুনে। যেন নতুন কোনো চমকপ্রদ তথ্য জেনেছে৷ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
“তারমানে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছেলেদের টুনটুনি কা টা হয় আম্মা?”
তানিয়া বেগম মেয়ের লাফালাফি দেখে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩
“হুঁ।”
রিদি বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
“তাহলে তো এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার!”